মৎস্য অবতার ও মনুর মহা-প্লাবনের প্রামাণিকতা।।

সনাতন শাস্ত্রে সর্বাদিক মান্য দশাবতারের মধ্যে প্রথম ও অন্যতম হলো মৎস্য অবতার। বেদাদি শাস্ত্র তথা শতপথ ব্রাহ্মণের ১/৮/১-১০ মন্ত্রসমূহে মৎস্য অবতার নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে।। এই বিষয়ে বেদাদি শাস্ত্রের আলোকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তীর একটি চমৎকার বিশ্লেষণ রয়েছে যেটা তিনি সম্প্রতি তাঁর ভ্যারিফাইড ফেসবুক পেজে পোস্ট করেন।।

[https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2022/01/blog-post_10.html]

ঠিক এরপরই শুরু হয়ে যায় একদল অবৈদিক কদাচারীর নোংরা আস্ফালন।। 

তারা মূলত দুইটা পয়েন্ট সামনে এনে যেন-তেনভাবে তাদের প্রচলিত স্বভাবের আধারে অবৈদিক আস্ফালন দেখিয়েছে। পাশাপাশি আরও কিছু বালখিল্য যুক্তিও প্রদর্শন করেছে তাদের একাধিক লিখায়।

🔸পয়েন্ট-১ঃ কোন শাস্ত্রীয় বা নিজস্ব তাত্ত্বিক প্রত্যুত্তর না দিয়ে যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধির গণিত জ্যোতিষ (Mathematical Astrolgy) এর আলোকে উক্ত বিষয়ের উপর তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্লেষণকে যথারীতি রচনাকারে তুলে ধরে "মনকলা খাওয়া" র মতো তাদের তথাকথিত খণ্ডনকার্য সম্পন্ন করে। 

🔸পয়েন্ট-২ঃ তাদের দ্বিতীয় পয়েন্টটি সবচেয়ে হাস্যকর ছিলো। তাদের যুক্তিমতে (অপ-যুক্তি) এই ঘটনার সাথে যেহেতু অন্যান্য অঞ্চল ও মাজহাবের প্রচলিত ঘটনার মিল পাওয়া যায় তাই শতপথ ব্রাহ্মণে (বেদাদি শাস্ত্র হিসেবে প্রামাণ্য) উল্লেখিত মৎস্য অবতারের ঘটনাটিও কাল্পনিক। 

এখন তাত্ত্বিকভাবেই তাদের দুইটি পয়েন্টের প্রত্যুত্তর দেওয়া হবে ধারাবাহিক আলোচনায়। এছাড়াও তাদের প্রচারিত অন্যান্য কুযুক্তিগুলোরও প্রত্যুত্তর থাকবে এই লিখায়।

আমরা কোনরকম অপ্রাসঙ্গিক রচনা লিখবো না তাই সম্পূর্ণ লিখা পড়া শেষ না করে কোনরকম মন্তব্য বা খণ্ডনের চিন্তা করবেন না। 

🔥 প্রথম পয়েন্টের প্রত্যুত্তরঃ

প্রথম পয়েন্টে দেখা যাচ্ছে তারা তাদের একটি ব্লগ পোস্টে যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধির গণিত জ্যোতিষকে প্রমাণ্য মেনেছে। যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি'র লিখা "পৌরাণিক উপাখ্যান" থেকে মৎস্য অবতার বিষয়ক জ্যোতিষীয় ব্যাখ্যাকে হুবুহু তুলে ধরেছে। আমাদের জানা নেই তারা কি বেদাঙ্গ জ্যোতিষের (দুষ্প্রাপ্য) বাইরে পরম্পরাগত অন্য জ্যোতিষ শাস্ত্রকে মান্য করে কিনা নাকি এরা যথারীতি "যখন যা সুবিধা তা-ই মানবো" রীতিতেই বিশ্বাসী? যদিও এরা যাকে অনুসরণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আস্ফালন চালায় সেই গুজরাটি বিদ্বান তার্কিকও একই কাজ করতেন। সাংখ্যের বেলায় ও মায়াবাদ খণ্ডাতে তিনি যেমন বিজ্ঞান ভিক্ষুকে ধরেছেন একইভাবে শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া খণ্ডাতে তিনি চার্বাকদের যুক্তি গ্রহণ করেছেন। যদিও উনার প্রতিমা পূজা বিরোধী যুক্তিগুলোর প্রত্যুত্তর আমরা ইতোমধ্যে ধারাবাহিকভাবে দিয়ে রেখেছি, উনার অনুসারীদের উদ্দেশ্যে। 

[1/ https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2021/08/blog-post_13.html?m=1

2/ https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2021/08/blog-post_41.html?m=1

3/ https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2021/08/blog-post_15.html?m=1]

এবার মূল পয়েন্টে আসা যাক। অবৈদিকদের ব্যবহার করা যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধির জ্যোতিষ ব্যাখ্যাকে আমরা অস্বীকার করবো না কারণ জ্যোতিষ ষড়বেদাঙ্গের অংশ এবং পরবর্তীতে পরম্পরাগত জ্যোতিষ চর্চাও একটি স্বতন্ত্র ধারা। যেকোনো ঘটনাবলী ও তাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন চরিত্রকে অনেকেই জ্যোতিষের আলোকে ব্যাখ্যা করেন। জ্যোতিষেরও অনেকগুলো ক্ষেত্র বা ধারা প্রচলিত আছে৷ যেমন এস্ট্রোফিজিক্সের মাধ্যমে একটি পৌরাণিক মূর্তি নটরাজ থেকে বিখ্যাত এস্ট্রোফিজিস্ট কার্ল সাগন কসমোলজি ব্যাখ্যা করেছিলেন। একই ব্যাখ্যা CERN এর বিজ্ঞানীরাও করেছেন। 

[https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2020/09/blog-post_90.html?m=1]

এছাড়াও ফেসবুকে শান্তনু দাসগুপ্ত নামে কলকাতার একজন জ্যোতিষ শাস্ত্রবিধ তার ফেসবুক প্রোফাইলে রামায়ণ ও শ্রীরামচন্দ্রকে নিয়ে একটি ধারাবাহিক পোস্ট প্রচার করেন৷ সেখানে তিনি জ্যোতিষের আলোকে শ্রীরামচন্দ্রের চরিত্রটিকে তুলে ধরেন এবং শ্রীরামচন্দ্রকে তারা/নক্ষত্র বানিয়ে দেন।৷ এতে করে কিন্তু রামায়ণের মূল ইতিহাস ও ঐতিহাসিক চরিত্রগুলো কাল্পনিক হয়ে যায় না তবে তার এই জ্যোতিষ বিশ্লেষণে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে চমৎকার কিছু জ্ঞান আহরণ কিন্তু অবশ্যই সম্ভব।।

[https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=168616842074619&id=100067789120097]

এবার ত তাহলে সে অবৈদিকদের সামনে যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি কর্তৃক অন্যান্য বিষয়ের উপর ব্যাখ্যাগুলোও একটু তুলে ধরা প্রয়োজন।। আমরা কিন্তু যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি'র অন্যান্য ব্যাখ্যা গুলোও গ্রহণ করবো কারণ সেগুলোও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক ও শাস্ত্রসম্মত। এরা যেমন আমাদেরকে বলে বেড়ায় পুরাণকে গ্রহণ করলে পুরাণের কতিপয় প্রক্ষিপ্ত (যদিও আমরা সবসময়ই বিশ্বাস করেছি যে মধ্যযুগে পুরাণের বিভিন্ন অংশে কিছু প্রক্ষিপ্ততা ঢুকেছে এবং পরবর্তীতে অনুবাদ বা সংস্করণে কিছু অসংগতি ঢুকেছে) অংশগুলোকেও গ্রহণ করতে হবে এখন তারাও যেন যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি'র মৎস অবতার নিয়ে জ্যোতিষ শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার পাশাপাশি অন্যান্য অংশগুলোও গ্রহণ করে নেয়। 


★ কি সে-সকল ব্যাখ্যা? 

যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি তাঁর "বেদের দেবতা ও কৃষ্টিকাল" নামক গ্রন্থে লিখেছেন, 

"আমাদের সৌভাগ্যক্রমে বেদের মধ্যে কাল সমুদ্রে দিগ্‌দর্শন স্বরূপ দ্বীপ আছে। পঞ্জিকা না থাকিলে হিন্দুর চলে না। কেন চলে না, তাহা হিন্দুমাত্রই জানেন। আমাদের যাবতীয় ধর্মকৃত্যের দিন নির্দিষ্ট আছে। এই লক্ষণ ঋগবেদের যুগেও দেখিতে পাওয়া যায়। আমাদের আর্য পূর্বপুরুষগণ যে সকল যাগযজ্ঞ করিতেন, তাহাদের দিন নির্দিষ্ট থাকিত। সংহিতা এবং ব্রাহ্মণের মধ্যে ঐ সকল দিনের কিছু কিছু উল্লেখ আছে। পঞ্জিকার প্রাচীন নাম কালজ্ঞান। বেদের কালের কালজ্ঞান যতই সংক্ষিপ্ত, অশুদ্ধ বা অপরিণত হউক, ধর্মানুষ্ঠানে তাহা মানিয়া চলিতে হইত।"

প্রশ্ন-১ঃ এখন সে অবৈদিক কদাচারী সমাজ কি মেনে নিবে যে নির্দিষ্ট দিন দেখে ধর্মকৃত্য করা বেদবিরুদ্ধ নয়? নাকি এখন তারা যোগেশচন্দ্রকেও বেদজ্ঞানহীন হিসেবে ফতোয়া দিবেন? এখন যদি যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি বেদজ্ঞানহীন হন তবে তাঁর বই থেকে হুবহু তুলে দিয়ে (যদিও কপি-পেস্ট দেখে মনে হচ্ছে কোন ব্লগ থেকে সরাসরি কপি করেছে) শতপথ ব্রাহ্মণকে খণ্ডন করার চাটুকারিতা কেন দেখানো হলো? 

যোগশচন্দ্র বিদ্যানিধি যে অবান্তর কিছু বলেন নি তার ইংগিত আমরা গোভিল গৃহ্যসূত্রেও পাই। গোভিল গৃহ্যসূত্রে বলা হয়েছে,  "নক্ষত্রে দারাং কুর্বীত" 


এখন কি এটাকেও অস্বীকার করবে? এখন যদি অবৈদিকরা এটার ভিন্ন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে তবে তার প্রত্যুত্তরও আমরা দিয়ে দিবো।

"ঋগ্‌বেদ ইতিহাস নহে, ইহাতে ঘটনা-পরম্পরা লিপিবদ্ধ নাই। স্তোত্রগুলি এক স্থানে বা একই কালে রচিত হয় নাই। ইহাতে সমসাময়িক ঘটনার উল্লেখ আছে, অতীত কাহিনীরও আছে। কতকগুলি স্তোত্র অন্যগুলির বহু পরে রচিত হইয়াছিল।"

প্রশ্ন-২ঃ এই বক্তব্যের ব্যাখ্যায় কদাচারী অবৈদিক সমাজ কি লিখবে? 

আচ্ছা, ব্যাখ্যাটা আমরাই দিয়ে দিচ্ছি। পাঠক শ্রেণী যদি ব্যাখ্যাটা যৌক্তিক মনে করে তবে গ্রহণ করবে এবং অবৈদিক কদাচারীদের চোখেমুখে ছুড়ে মারবে।

বেদ ইতিহাস নয় কারণ এখানে ঘটনা পরম্পরা নেই, তার মানে এই নয় বেদে কোন ঘটনারই উল্লেখ নেই। রামায়ণ ও মহাভারত যে অর্থে ইতিহাস, বেদ ঠিক সে অর্থে ইতিহাস নয়। কিন্তু বেদে কোন ইতিহাসের উপাদানই নেই, এটা বলা বাতুলতা। বেদে দশরাজার যুদ্ধের ঘটনাও উল্লেখ আছে। তারা ত ক্ষেত্রবিশেষে নিজ প্রয়োজনে BORI (Bhandarkar Oriental Research Institute) কে প্রামাণ্য মানে তাহলে BORI এর অফিশিয়াল ইউটিউবেই আমাদের দাবীর সত্যতা দেখে নিবেন। 

[https://youtu.be/gcLzr93ByFE]

এদের দাবিকৃত ৮,৮০০ বা ২৪,০০০ শ্লোকের মহাভারত তত্ত্বও BORI এর ক্রিটিকাল এডিশন দিয়ে খণ্ডন করা হবে SPS এর প্রকাশিতব্য গ্রন্থ "ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বে মহাভারত" এ। শীঘ্রই আসতেছে বইটি যা থেকে আপনারা মহাভারত নিয়ে অবৈদিক ও অহিন্দু সমাজের অনেক অপপ্রচারের প্রত্যুত্তর দিতে পারবেন।। 

"ভারতযুদ্ধের পর শ্রৌত ও গৃহ্যসূত্রে বৈদিক কর্মকাণ্ড এবং উপনিষদে জ্ঞানকাণ্ড সংরক্ষিত হইয়াছিল। পুরাণ, উপাখ্যান আকারে বেদের স্মৃতি জনসাধারণের নিকটে প্রচার করিয়াছেন। পুরাণ বেদবাহ্য নহে। আমাদের বর্তমান ধর্মকৃত্যেও বৈদিক কৃষ্টির বহু আছে।"

প্রশ্ম-৩ঃ এখন বেদের স্বঘোষিত ঠিকাদারী সংস্থা ত দাবী করে যারা পুরাণ মানে তারা বেদ মানে না অর্থাৎ তারা বেদবিরোধী পৌরাণিক। এখন কি তবে তারা যোগেশচন্দ্র বিদ্যিনিধিকেও পৌরাণিক ফতোয়া দিবে নাকি এটার কোন মনগড়া ব্যাখ্যা দাড় করাবে যে এই পুরাণ শব্দ অন্য অর্থে ব্যবহৃত?

"দিব্য-সরস্বতী কেমন করিয়া প্রজ্ঞা উদ্দীপন করেন, কি চিন্তাসূত্রে তিনি সুনৃতা বাগ্‌দেবীতে পরিণত হইয়াছেন, তাহা আমাদের দুর্ত্তেয় হইতে পারে। কিন্তু ধ্যানের অবলম্বন অবশ্য ছিল। দিব্য-সরস্বতীর বাস্তবিক রূপ ছিল, আছে। বৈদিক কৃষ্টির কাল-নির্ণয়ে তাহাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।" 

প্রশ্ন-৪ঃ 'দিব্য-সরস্বতীর বাস্তবিক রূপ ছিল, আছে।' এটা কি মানবে অবৈদিক কদাচারীরা নাকি এখন যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি মহাশয়কে পৌরাণিক, পাখণ্ডি বলে গালাগাল শুরু করে দিবে? 

যাইহোক আমরা ত এটা শতভাগ মানবো কারণ এটাই ধ্রুব সত্য। এখন সরস্বতী'র আগে 'দিব্য' শব্দটা দেখে তথাকথিত আধ্যাত্মিক বা রূপক ব্যাখ্যা (এক কথায় গরু রচনা) দেওয়া শুরু করলে সেটা স্পষ্ট স্ববিরোধীতা হয়ে যাবে কিন্তু।  

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি'র এই বইটি রচনা করা হয়েছে কৃষ্টিকাল নির্ণয়ের উপর তাই তিনি বিভিন্ন তত্ত্ব ও উপাখ্যানকে জ্যোতিষ শাস্ত্রের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন।। দিব্য সরস্বতীকেও তিনি জ্যোতিষ শাস্ত্রের আধারে ব্যাখ্যা করেছেন। 

অবৈদিক কদাচারীদের আজকাল জ্যোতিষ বুঝানোর ইচ্ছে জেগেছে তাই এই লিখার পরবর্তী আলোচনায় এস্ট্রোলজিকাল এনালাইসিসকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।

যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি তাঁর গ্রন্থে ঋগ্বেদ ও পুরাণের উপাখ্যানে উল্লেখিত ইন্দ্র দ্বারা বৃত্র বধকে জ্যোতিষ শাস্ত্রের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন। ইন্দ্র ও বরুণদেবের স্তুতি কেন একত্রে করা হয় সেটার ব্যাখ্যাও তিনি জ্যোতিষ শাস্ত্র থেকে দিয়েছেন। বৃত্রের পুচ্ছ অশ্লেষা নক্ষত্রে, বৃত্রের মস্তিষ্ক হস্তা নক্ষত্রে থেকে বৃত্রকে কিভাবে সর্পের আকার দান করে সেটাও তিনি জ্যোতিষ শাস্ত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। খ্রীস্টপূর্ব ৬৩০০ এর ২৪ শে মার্চ কিভাবে দক্ষিণায়নে বৃত্র দৃশ্যমান হয়েছিলো সেটাও ব্যাখ্যা করা হয়। অতঃপর খ্রীস্টপূর্ব ৬৩০০ এর ৩ রা জুলাই সূর্যদয়ের এক ঘন্টা পূর্বে বৃত্রের পূর্ণ অংশ দৃশ্যমান হয়ে সূর্য কিরণে আবার অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। ইহাই প্রকৃত বৃত্রবধ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো ২৪ শে মার্চ থেকে ৩ রা জুলাই হিসেব করলে হয় ১০০ দিন৷ ইন্দ্র একেকদিন বৃত্রের এক এক পুর ধ্বংস করতো। ইন্দ্র শতদিন বিক্রম দেখিয়ে বৃত্রকে বধ করেছিলেন বলে ইন্দ্রের এক নাম শতক্রতু।  

অন্যদিকে মহর্ষি যাস্ক যেখানে বৃত্রকে মেঘ বলেছেন সেখানে যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি বৃত্রকে সর্পাকৃতির তারার সমষ্টি বলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন বৃত্রের মস্তকে হস্তা নক্ষত্রে কিভাবে পাঁচটি তারার সমাহার হয়। তিনি পূর্ব আকাশ থেকে পশ্চিম আকাশে ১৮০ অংশের মধ্যে ৬০ অংশই বৃত্র বলে চিহ্নিত করেন যা মরুদগনের সহায়তায় ধ্বংস করতে ইন্দ্রের ১০০ দিন লাগে। এমন দীর্ঘ সর্পাকৃতির মেঘগুচ্ছ বাস্তবে দেখা সম্ভব নয় বলেও তিনি দাবী করেন।

যাইহোক যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি জ্যোতিষ শাস্ত্রের আলোকেই বেদ হতে বিতিত পৌরাণিক উপাখ্যানকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। অবৈদিক সমাজ যদি জ্যোতিষকে গ্রহণ করে তাহলে ত দিনান্তে সনাতন পরম্পরায় সকল শাস্ত্রের সমন্বয়ে শাস্ত্রের প্রকৃত পাঠোদ্ধারকে সাদরে গ্রহণ করবে বলে আমরা আশা রাখতে পারি।

তারা শতপথ ব্রাহ্মণের মন্ত্রেও রামকৃষ্ণ মিশনের ব্যাখ্যা তুলে ধরেছে কিন্তু মনগড়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে "দৈব শক্তি" শব্দটা এড়িয়ে গেছে। এই অবৈদিকদের মূল কাজই হলো খণ্ডিতাংশ প্রচার করে নিজ স্বার্থসিদ্ধ করা। 

যাইহোক সম্পূর্ণ লিখা পড়ার পর যদি সবদিকে রাস্তা বন্ধ হয়ে আসে এবং শতপথ ব্রাহ্মণের রেফারেন্স নিয়ে যদি এরা দাবী করে যে ব্রাহ্মণ ত বেদ নয় তাই এই রেফারেন্স অকাট্য ধরা যাবে না তবে সেটার প্রত্যুত্তরও প্রস্তুতই আছে, তাই দিয়ে রাখলাম আগেই।

[https://rakeshdas27.wordpress.com/2021/08/12/brahamna_veda/]

🔥 দ্বিতীয় পয়েন্টের প্রত্যুত্তরঃ

তাদের দ্বিতীয় পয়েন্টটি ভয়ংকর রকম হাস্যকর ছিলো। তাদের যুক্তিমতে (অপ-যুক্তি) এই ঘটনার সাথে যেহেতু অন্যান্য অঞ্চল ও মাজহাবের প্রচলিত ঘটনার মিল পাওয়া যায় তাই শতপথ ব্রাহ্মণ ও পুরাণাদি শাস্ত্রে (বেদাদি শাস্ত্র হিসেবে প্রামাণ্য) উল্লেখিত মনুর মহাপ্লাবন/মৎস অবতারের ঘটনাটিও কাল্পনিক। এগুলো প্রমাণ করার জন্য এরা নাস্তিক (এরা নিজেরাও অবৈদিক ও অর্ধ-নাস্তিক) ও মুক্তমনা বিভিন্ন ব্লগ থেকে তথ্য ও যুক্তি চুরি করে হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করেছে।। 

সমস্যা নেই, জ্যোতিষ শাস্ত্র ও যুক্তির আলোকে পয়েন্ট ধরিয়ে দিয়ে সকল অপ-যুক্তির প্রত্যুত্তর দেওয়া হবে।

বছরখানেক আগে কিছু মুক্তমনা ও অহিন্দু গ্রুপে হঠাৎ করে একদল প্রচার করা শুরু করলো যে মহাভারতের অন্যতম চরিত্র ও সনাতনীদের নিকট পরম পূজ্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রটি কাল্পনিক এবং এই চরিত্রটি নেওয়া হয়েছে গ্রীক উপকথা থেকে। তারা তাদের ধারাবাহিক পোস্টগুলোতে তুলনামূলক আলোচনা ও কিছু ছবির মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করেছিলো যেন মনে হচ্ছিলো সত্যিই শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রটি ও মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনাবলী গ্রীক উপকথা থেকে ধার করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মিথ্যাচার করলেই ত সত্য বদলে দেওয়া যায় না। একটু ঘাটাঘাটি করলেই অর্থাৎ সত্যান্বেষী হলেই সত্যিটা সামনে চলে আসে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের শাসনামলে কিভাবে গ্রীক পর্যটক মেগাস্থেনিসের 'ইন্ডিকা' গ্রন্থের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতির শ্রীকৃষ্ণ গ্রীসে গিয়ে হয়ে গেলেন হেরেকলেস এবং রোমানদের কাছে হয়ে গেলেন হারকিউলিস সেটা যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণসহ তুলে ধরা হলো।।

[https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2020/12/blog-post_70.html?m=1]

অনেক গবেষকদের মতে মিশরীয়/ইজিপশিয়ান নীলাভ গড আমুন-রা'র চরিত্রও শ্রীকৃষ্ণকে অনুসরণ করেই তৈরী করা হয়েছিলো। নিচের লিংকে এই বিষয়ে শক্ত কিছু এভিডেন্স তুলে ধরা হলো।

[https://mallstuffs.com/Blogs/BlogDetails.aspx?BlogId=202&BlogType=Spiritual&Topic=Did%20Egyptians%20worshipped%20lord%20krishna]

মিশরে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবকে তাই প্রাসঙ্গিক মেনে নেওয়া অমূলক নয়। আরেকটি বাস্তবিক উদাহরণ দেওয়া যাক।

মিশরীয়/ ইজিপশিয়ান গড আনুবিসের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন?.. চেনা লাগছে শব্দটা ? আনুবিস ছিলেন মৃত্যু এবং মমির দেবতা, যার শরীরটা মানুষের মতো ও মাথাটা কুকুর বা শেয়ালের মতো। মূলত গ্রিক শব্দ, প্রাচীন মিশরীয় ভাষাতে আনুবিস ‘ইনপু’ নামে পরিচিত। মৃত ব্যক্তিকে মর্ত্যলোক থেকে মৃতদের দেশে নিয়ে যাওয়ার পথে নিরাপত্তা দিতেন আনুবিস। মিশরে বহু ফারাওদের মমির পাশে পাওয়া গেছে আনুবিসের মূর্তি।

এবার একটু মহাভারতের দিকে নজর দেওয়া যাক। মহাভারতে যুধিষ্ঠির স্বর্গে যাওয়ার সময় স্বয়ং যমরাজ কুকুরের বেশে তাঁর সঙ্গ নেন। কি আশ্চর্য মিল না ! যদিও ইজিপশিয়ানরা কুকুরকে শেয়াল ধরে অনুবিসের চরিত্র সাজিয়েছিলেন বলে ধারণা করা যায় কারণ ইজিপ্টে সম্ভবত কুকুরের পরিচিতি ছিলো না।

এবার হুগলি জেলার বর্ধমানের আঁটপুরে চলে আসি। রেসিডেন্সির দেওয়ান আঁটর খাঁয়ের নাম অনুসারে এই জনপদের নাম হয় আঁটপুর। ১৭৮৬-'৮৭ সালে বর্ধমান রাজার দেওয়ান কৃষ্ণরাম মিত্র গঙ্গাজল, গঙ্গামাটি আর পোড়ামাটির ১০০ ফুট উচ্চতার রাধাগোবিন্দ মন্দির নির্মাণ করেন। টেরাকোটার অসাধারণ কাজ সম্বলিত দু'পাশের দেওয়াল জুড়ে অসংখ্য প্যানেলে রয়েছে পৌরাণিক ও সামাজিক চিত্রকথার অপরূপ আখ্যান । আর সেখানেই পাওয়া যায় এক মূর্তি যা দেখতে অবিকল আনুবিসের মতো! 


এমন উদাহরণ আরও অসংখ্য দেওয়া যায়৷ আরেকটি উদাহরণ দিয়ে পরবর্তী অংশে গমন করবো। রামায়ণের শ্রীরামচন্দ্র ও রামায়ণের ঘটনাবলী ভারতের একটি ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র ও রামায়ণকে অবলম্বন করেও বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন উপকথা রচিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো থাইল্যান্ডের ”রামাকেইন”। রামাকেইনের প্রধান চরিত্র ফ্রা রাম (কম্বোডিয়ার খামেরদের কাছে ফ্রে রীম) রামায়ণের শ্রীরামচন্দ্রকে অনুকরণ করে রচিত। রামাকেইন অর্থ হলো "রামের মহিমা"। রামাকেইনের গল্প আহরণ করা হয় দশরথ জটাকা থেকে যা মূলত বৌদ্ধ সাহিত্যে পাওয়া যায়। এই গল্পটি সুখথাইয়ের রাজ্যশাসনে ১৩ শতকে জটাকা উপকথা থেকে থাই জনগণ গ্রহণ করতে শুরু করে। এই উপকথাটির থাই ভার্সন (রামাকেইন) মাত্র ২০০-২৫০ বছর আগে ১৮ শতকে আয়ুথ্যা শাসনামলে লিখা হয়। এর আগে ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়ায়ও রামায়ণের পরিবর্তীত রূপ প্রচলিত হয়। 

এখন রামায়ণের অনুকরণে অন্যান্য স্থানে স্ব স্ব উপকথা প্রচলিত হলে বা কলকাতার সেই শান্তনু দাসগুপ্ত (প্রথম অংশে উল্লেখিত) শ্রীরামচন্দ্রকে এস্ট্রোনোমিকাল এনালাইসিসে তারা/নক্ষত্র হিসেবে দেখাতে চাইলে কি শ্রীরামচন্দ্র ও রামায়ণের ঐতিহাসিকতা অপ্রমাণিত হয়ে যাবে?

🔶 মনুর মহাপ্লাবন বা মৎস্য অবতারের প্রামাণিকতা কি?

একদম লিখার শুরুতে দেওয়া অধ্যাপক কুশল বরণ চক্রবর্তীর লিখাটা পড়লেই বিষয়টি সম্পর্কে প্রামাণিক ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু অবৈদিক কদাচারীদের নানাবিধ অপ-যুক্তির প্রত্যুত্তরে উপরে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবং পরবর্তী অংশে বেদ, পুরাণ, জ্যোতিষ ও যুক্তির আধারে এই ঘটনার প্রামাণিকতা ব্যাখ্যা করা হবে। 

পরবর্তী অংশটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য আপনাদেরকে বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী গিরিন্দ্রশেখর বসু'র "পুরাণ প্রবেশ" গ্রন্থটা পড়ার অনুরোধ করবো। গিরিন্দ্রশেখর বসু হলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সাইকো-এনালিস্ট। সিগমুন্ড ফ্রয়েড হচ্ছেন সাইকো-এনালাইসিসের জনক। গিরিন্দ্রশেখর বসু ফ্রয়েডের কন্সেপ্টের সাথে হিন্দু দর্শনের সমন্বয় করে একটি থিসিস পেপার পাঠান ফ্রয়েডকে যা ব্যাপক চর্চিত হয় এবং পরবর্তীতে ফ্রয়েডের সাথে তাঁর চমৎকার বন্ধুত্ব হয়।।

অবৈদিক কদাচারী সমাজ তাদের বালখিল্য যুক্তিতে দেখানোর চেষ্টা করে যে মনুর মহাপ্লাবন ঘটনাটি ও মৎস অবতারের আবির্ভাব সুমেরীয় সংস্কৃতি, নোয়ার মহাপ্লাবন ইত্যাদি উপকথার মতোই প্রকল্পিত বা সেগুলোর অনুকরণে নির্মিত৷ 

গিরিন্দ্রশেখর বসু তাঁর গ্রন্থে বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এছড়াও বিশিষ্ট সংস্কৃতজ্ঞ ও গবেষক ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ও তার গ্রন্থে মৎস অবতার ও মনুর মহাপ্লাবন নিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের ব্যাখ্যার আলোকে আমি উক্ত উপাখ্যানের ও বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তারের প্রেক্ষাপট তুলে ধরার চেষ্টা করবো। অতঃপর প্রত্নতত্ত্ব ও জ্যোতিষের উপর ভিত্তি করে প্রামাণিক দলিল উপস্থাপন করবো।

এই উপখ্যানটির উল্লেখ পাওয়া যায় মৎস্য পুরাণ, মহাভারতের বনপর্ব (অধ্যায়-১৮৭), ভাগবত পুরাণ এ। তবে এর আদিরূপ পাওয়া যায় শক্ল যজুর্বেদীয় শতপথ ব্রাহ্মণে। শতপথ ব্রাহ্মণের সেই উপাখ্যানটিই পুরাণে এসে পূর্ণরূপে বিতিত (ব্যপ্ত) হয়েছে। বেদ যেহেতু ইতিহাসগ্রন্থ নয় (তবে সমসাময়িক ঘটনাবলীর উল্লেখ থাকে) তাই শতপথ ব্রাহ্মণে মূল উপাখ্যানের ঘটনাবলীর ইংগিত পাওয়া যায় মাত্র, সম্পূর্ণ ইতিহাস নয়। একইভাবে ঋগবেদের সপ্তম মণ্ডলেও দশরাজার যুদ্ধের ঘটনাবলীর ইংগিত পাওয়া যায় কিন্তু সম্পূর্ণ ইতিহাস নয়। এক্ষেত্রে অবৈদিক (অর্ধ-নাস্তিক কদাচারী সমাজ) ও আমাদের (বৈদিক) উভয়ের নিকটই মান্য যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি'র একটি বক্তব্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

"ভারতযুদ্ধের পর শ্রৌত ও গৃহ্যসূত্রে বৈদিক কর্মকাণ্ড এবং উপনিষদে জ্ঞানকাণ্ড সংরক্ষিত হইয়াছিল। পুরাণ, উপাখ্যান আকারে বেদের স্মৃতি জনসাধারণের নিকটে প্রচার করিয়াছেন। পুরাণ বেদবাহ্য নহে। আমাদের বর্তমান ধর্মকৃত্যেও বৈদিক কৃষ্টির বহু আছে।"

আর্থাৎ, পুরাণে এসে বেদে উল্লেখিত ঘটনা বিতিত (পূর্ণরূপে ব্যপ্ত) হতে পারে যেটা মনু ও মৎস অবতারের উপাখ্যানে হয়েছে। বেদ, পুরাণ, জ্যোতিষ ও নানাবিধ সহায়ক শাস্ত্রের সমন্বয়ে কোন ঘটনার পাঠোদ্ধার সম্পর্কে গিরিন্দ্রশেখর বসু তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন। একই পদ্ধতি অবলম্বন করে বেদবীর আর্য বাস্তবে ভারববর্ষের ১৪,৫০০ বছরের কালক্রম নির্ধারণ করেছেন এবং তিনখণ্ডের "দ্যা ক্রনলজি অফ ইন্ডিয়া" গ্রন্থটি রচনা করেছেন যেখানে মনু'র মহাপ্লাবন ঘটনাটিও তিনি সত্য প্রমাণ করেন। 


[বিঃদ্রঃ এখন অবৈদিক কদার্য সমাজ যেন কোনভাবেই বেদবীর আর্যকে নিজেদের একজন দাবী করে বসে না থাকে৷ কারণ প্রকৃত আর্য সকল শাস্ত্র হতেই জ্ঞান আহরণ করে সত্যের সন্ধান করেন যেটা বেদবীর আর্য করেছেন। তিনি তাঁর "দ্যা ক্রনলজি অফ ইন্ডিয়া" গ্রন্থে মনু'র মহাপ্লাবন প্রমাণ করার জন্য বা ভারতবর্ষের কালক্রম নির্ধারণ করার জন্য জ্যোতিষ শাস্ত্রসহ অন্যান্য শাস্ত্রের পাশাপাশি একটি অপ্রচলিত আঞ্চলিক (কাশ্মীর) পুরাণ "নীলমত পুরাণ" থেকেও পাঠোদ্ধার করেছেন। তিনি কোনভাবেই স্বঘোষিত কদার্যদের দলের অন্তর্ভুক্ত নন।]

যাইহোক এই ঘটনাটিই (মনু'র মহাপ্লাবন) পরবর্তীতে ছোটখাটো পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভারত থেকে দক্ষিণ ভারত হয়ে বেবিলনে গিয়ে সুমেরীয়দের এবং ইহুদিদের নোয়ার উপাখ্যান হয়ে যায়। এটা যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সেটা উপরের আলোচনায় (গ্রীক উপকথায় হেরেকলেস, থাইল্যান্ডের সাহিত্যে রামাকেইন) প্রমাণ করেছি।।

ভারতের সাথে বেবিলন/মেসোপোটেমিয়া/সুমেরীয়দের সাংস্কৃতিক সংযোগ নিয়ে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটা গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন আছে সেটা দেখে নিতে পারেন।।

[https://timesofindia.indiatimes.com/blogs/desires-of-a-modern-indian/connections-between-ancient-india-and-ancient-mesopotamia/]

মনু'র মহাপ্লাবনের সত্যতাঃ

মনু'র মহাপ্লাবন যে সত্যই ঘটেছিলো সেটা একাধিক গবেষক প্রমাণ করেছেন। বেদবীর আর্য জ্যোতিষ শাস্ত্র, বিভিন্ন বৈদিক ও পৌরাণিক শাস্ত্রের আধারে মনু'র মহাপ্লাবন ঘটনার পাঠোদ্ধার করেন এবং প্রমাণ করেন ১১,২০০ খ্রীস্টপূর্বে বর্তমান কাশ্মীর অঞ্চলে মহাপ্লাবনের ঘটনাটি সংঘটিত হয় এবং তখন বৈবস্বত মনুর শাসনকাল চলছিলো।

বৈবস্বত মনু হলেন বর্তমান মনু এবং মানুষের পূর্বপুরুষ। তাঁকে শ্রাদ্ধাদেব এবং সত্যব্রতও বলা হয়। তিনি সনাতন সৃষ্টিতত্ত্বের বর্তমান কল্প এর ১৪ জন মনুর সপ্তম। মহাবন্যার মহাপরীক্ষাকালে, বৈবস্বত মনু ও সপ্তঋষিকে মৎস্য অবতার এসে রক্ষা করছেন। 

বেদবীর আর্য দেখান যে ১১,০০০ খ্রীস্টপূর্বে শিশুমার তারামণ্ডলের কাশ্যপ তারা/গামা ড্রেকোনিস উত্তর আকাশে ধ্রুব ছিলো যা ৮,৭০০-৮,৮০০ খ্রীস্টপূর্বেও দেখা যায়। তিনি তামিল সঙ্গম সাহিত্য থেকে দেখান ১১,২৫০ খ্রীস্টপূর্বে অগস্ত্য মুনি প্রথম সঙ্গম (নতুন সৃষ্টির ভিত্তি) আহবান করেন। ১১,০০০ খ্রীস্টপূর্বে কন্যাকুমারীতে থাকা মানুষজন উত্তর আকাশের ধ্রুব তারাকে অগস্ত্য বলতো। সে সময়েই কন্যাকুমারীতে প্রথম মানুষ দেখা যায় যা বৈবস্বত মনন্তরের সময়কালের কাছাকাছি। উল্লেখ্য যে প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ভাষা হলো তামিল ভাষা এবং তামিল ভাষায় প্রথম সাহিত্যকর্ম হলো "সঙ্গম সাহিত্য"৷ এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে এই লিংকে গিয়ে পড়তে পারেন।

[https://www.itihasadda.in/sangam-literature/]

জ্যোতিষ শাস্ত্র ও নীলমত পুরাণের সহায়তায় বেদবীর আর্য আরও দেখান যে কাশ্মীর ঘাটিতে একটি গ্ল্যাসিয়াল ঝিল ছিলো যা ঋক্ বৈদিক যুগে "সতিসার" নামে পরিচিত ছিলো। এই গ্ল্যাসিয়াল ঝিলটি ১২,৭০০-১১,৫০০ খ্রীস্টপূর্বে Meltwater Puls-1 এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিলো। সেখানে বারমুলাধার (যা এখন জম্মু-কাশ্মীরে বারামুলা নামে পরিচিত) এই সতিসরের জল ধরে রেখেছিলো এবং বৈবস্বত মনন্তরে সেখানের আশেপাশে মানুষের আবাসভূমি তৈরী হয়েছিলো।। ১১,২০০ খ্রীস্টপূর্বে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও উল্কাপিণ্ডের আঘাতে বারমুলাধারা খুলে যায় এবং সতিসরের জল নেমে এসে মাদ্র, সিন্ধ ও গুজরাটের সম্পূর্ণ এলাকা ডুবিয়ে দেয়। সে সময়টা ছিলো বৈবস্বত মনুর শাসনকাল। অর্থাৎ মনু'র মহাপ্লাবন একটি সত্য ঘটনা। এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে বেদবীর আর্যের তিনখণ্ডের গ্রন্থ "দ্যা ক্রনলজি অফ ইন্ডিয়া" পড়তে পারেন অথবা নিচের দেওয়া লিংকে গিয়ে ভিডিওটা শুরু থেকে শেষ অব্দি মনযোগ সহকারে অন্তত দশবার দেখতে পারেন।।

[https://youtu.be/yT17Qbs32hQ]

মনুর মহাপ্লাবন যে সত্য ঘটনা সেটা নিয়ে ভারতের বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ASI এর সাবেক ডিরেক্টর জেনারেল বি.বি.লাল একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এই নিউজটি ২০১৭ সালের মার্চ মাসে হিন্দুস্তান টাইমস, টাইমস-অফ-ইন্ডিয়াসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম প্রচারিত হয়।

[https://www.google.com/amp/s/www.hindustantimes.com/india-news/manu-s-flood-that-destroyed-everything-on-earth-was-real-says-archaeologist/story-ChWjyL1JvlblS8n8Ei3peL_amp.html]

বি.বি. লাল যদিও মহাপ্লাবনের সময়কাল আরও অনেক এগিয়ে বলেছেন কিন্তু এক্ষেত্রে বেদবীর আর্যের প্রাপ্ত সময়কালই বেশী গ্রহণযোগ্য কারণ তিনি নানাবিধ শাস্ত্র, এস্ট্রোনোমিকাল এনালাইসিস ও জেনেটিক্যাল প্রোফাইলিং সবকিছুর উপর ভিত্তি করে অনেকগুলো ডাটা পয়েন্টের উপর কাজ করেছেন। 

🔸প্রত্নতাত্ত্বিক ফলাফলের সীমাবদ্ধতাঃ

প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এখানে এক্সকেভেশনে প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষের উপর ভিত্তি করে ধারণা দেওয়া হয় কিন্তু কোন চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। এটা দ্বারকা'র উদাহরণ দিয়ে স্পষ্ট করা যায়। 

দ্বারকা নগরীর সময়কাল নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদ বি.বি. লাল বলেছিলেন সেটা ৩,০০০ বছর আগের প্রাচীন যদিও আরেকজন বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ASI এর সাবেক ডিজি এস.আর.রাও মেরিন এক্সকেভেশনের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসেন দ্বারকার সময়কাল ৩,৫০০ বছরের বেশি। মজার বিষয় হলো সমুদ্রের তলদেশে যেমন ৩,৫০০ বছরের প্রাচীন পটারি ও সীল পাওয়া গাছে তেমন ৯,০০০ বছরের প্রাচীন কাঠের টুকরাও পাওয়া গেছে।।

অন্যদিকে ভারতের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও গবেষকরা জ্যোতিষ শাস্ত্রের আলোকে প্রমাণ করেছেন যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময়কাল ৫,০০০ বছরের প্রাচীন যা হিন্দু ইতিহাসের দাবীকৃত সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। 

জি. সি. আগারওয়াল ও কে এল বর্মা এর "এইজ অফ ভারত ওয়ার" গ্রন্থে ৮১ নং পৃষ্ঠায় লিখা আছে,

'বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় গণিতজ্ঞ আর্যভট্টের হিসেবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের তিথি ১৮ ফেব্রুয়ারী, ৩১০২ খ্রীস্টপূর্ব।'

পি.ভি. হোলে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিবেচনায় হিসেব করে  দেখান যে মহাভারতের যুদ্ধ ১৩ নভেম্বর ৩১৪৩ খ্রীস্টপূর্বে।

ভারতের অধিকাংশ প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গবেষক যেমন বি.এন. আচার, এন.এস. রাজারাম, কে. সদানন্দ প্রমুখরা তাদের গবেষণার মাধ্যমেও দেখান যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময়কাল ৩০০০+ খ্রীস্টপূর্বে।

প্রখ্যাত প্রত্ন-জোতির্বিজ্ঞানী ড. বি. নরহরি আচারের মতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময়কাল ৩০৬৭ খ্রীস্টপূর্ব।

[ড. আচার বিশ্বব্যাপী ক্রোনলজি নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম। তিনি প্রত্ন-জোতির্বিদ্যা নিয়ে এবং প্ল্যানেটারিয়াম সফটওয়্যার (স্টেলারিয়াম, জগন্নাথ হরা) নিয়ে বিস্তর কাজ করেছেন যা আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত ও প্রশংসিত। তিনি আমেরিকার প্যানিসিলভিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন এবং আমেরিকার Argone National Laboratory তে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলেন। তিনি NASA থেকে 'Summer Faculty Fellowship Award' পান।]

আমরা জানি তবুও অবৈদিকদের আস্ফালন থামবে না কারণ তারা এক বিশেষ গোষ্ঠীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে সনাতনী শাস্ত্র যোদ্ধারাও থেমে থাকবে না। তাত্ত্বিক লড়াই চলছে, চলবে।

© শ্রী অনিক কুমার সাহা
সহায়তায়ঃ অনিক সাহা, গৌরব চৌধুরী

প্রচারেঃ SPS  শাস্ত্র গবেষণা কমিটি
সনাতন শাস্ত্র ও দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর।। 





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ