অনেকের মনেই একটা ভ্রান্ত ধারণা বিদ্যমান যে, বেদে বিগ্রহ বা প্রতিমা উপাসনার কথা নেই; বিগ্রহ উপাসনার পদ্ধতি তুলনামূলক নব্য পদ্ধতি; বেদে এসবের উল্লেখ নাই।
যারা এরূপ বলে থাকে বেদে মূর্তি (বিগ্রহ) দিয়ে উপাসনা করার পদ্ধতি নেই তাদের উদ্দেশ্যে বলা উচিত, দুই একটা পিডিএফের পাতা পড়ে নিজেকে বেদজ্ঞ ভাবা মূর্খতা ছাড়া কিছুই নয়। এসব মূর্খতাপূর্ণ জ্ঞান নিয়েই কিছু ভুঁইফোড় অনাদিকাল ধরে চলে আসা সনাতন ধর্মের এই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বিগ্রহ উপাসনাকে অস্বীকার করে থাকে। সেসব ভুঁইফোড়গণ বিগ্রহ উপাসনাকে অবৈদিক, সনাতন বিরোধী এসব আখ্যা দিতেও পিছপা হয় না। তারা প্রশ্নই করে বসে, " বেদের কোথায় আছে বিগ্রহ উপাসনার কথা? দেখান দেখি?"
এসব ভুঁইফোড়ের কথায় কিছু সুবোধ সনাতনীদেরও মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায় মাঝে মাঝে; কেও কেও আবার দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যায়, "এতোদিন ধরে তাহলে ভুল করে আসছি? এসব আমাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদে নাই?"
কিন্তু বেদে খুব সুন্দর ভাবে সোনার বিগ্রহ স্থাপন করে তার উদ্দেশ্যে ফুল দিয়ে সামবেদ সংহিতার মন্ত্র উচ্চারণ করে উপাসনার কথা বর্ণনা করা আছে। সেগুলো হয়তো তথাকথিত ভুঁইফোড়দের কখনো দৃষ্টিগোচর হয় নাই, হয়তো কারো কারো হওয়া সত্ত্বেও বিষয়টা অন্যদের থেকে আড়াল করে রেখেছে নিজ ব্যবসা সফলভাবে চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
যাই হোক, ঐ ভুঁইফোড়দের জবাব দিতে ও সুবোধ সনাতনীদের দ্বিধাদ্বন্দ্বের সমাধান দিতেই এই লেখা।
তাহলে শুরু করা যাক...
যজুর্বেদীয় শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৮/১/৭ মন্ত্রের প্রথমেই বলা হয়েছে,
"অথ পুষ্করপর্ণমুপদধাতি।..."
অর্থাৎ, এরপর পদ্মপুষ্পের পাপড়ি স্থাপন করা হলো।
উক্ত মন্ত্রের সায়ণভাষ্যে বলা হয়েছে,
"পুষ্করপর্ণোপধানং বিধায় স্তৌতি -'অথ পুষ্করপর্ণমিতি'। 'অথ' - শব্দঃ সামগানানন্তর্যার্থঃ।"
অর্থাৎ, পদ্মপুষ্পের পাপড়ি স্থাপনার্থে বলা হয়েছে -'অথ পুষ্করপর্ণমিতি'। 'অথ' - শব্দে সামগান (সামবেদ সংহিতার মন্ত্র ছন্দোবদ্ধ ভাবে উচ্চারণ) সমাপ্তির পর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে (শ.প.ব্রা. ৭/৪/১/৩ এ সামগান করার উল্লেখ রয়েছে- "অথ সত্যং সাম গায়তি"। এই সামগান করার পর এই মন্ত্রে পদ্মপুষ্পের পাপড়ি স্থাপন করা হচ্ছে।)
সুতরাং উক্ত মন্ত্রাংশে সামগান করার পর পদ্মপুষ্পের পাপড়ি স্থাপন করা হল এরূপ বিবরণ পাওয়া গেল।
পরবর্তীতে, শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/১/১০ মন্ত্রে বলা হচ্ছে,
"অথ রুক্মমুপদধাতি। অসৌ বাঽআদিত্যঽএষ হীমাঃ সর্ব্বাঃ প্রজাঽঅতিরোচতে রোচো হ বৈ তং রুক্মঽইত্যাচক্ষতে পরোক্ষং পরোক্ষকামা হি দেবোঽঅমুমেবৈতদাদিত্যমুপদধাতি স হিরণ্ময়ো ভবতি পরিমণ্ডলঽএকবিংশতিনির্বাধস্তস্
অনুবাদ-
তারপর তিনি সেখানে একটি সুবর্ণপাত্র (রেকাব) স্থাপন করেন। এই সুবর্ণরেকাবটি ঐ আদিত্য কারণ, আদিত্য পৃথিবীতে সকল প্রাণীর উপর উজ্জ্বলভাবে শোভা পায়। উজ্জ্বল শোভাকেই তারা পরক্ষোভাবে বলেন - রুক্ম (সোনার রেকাব/পাত্র)। কারণ, দেবগণ পরোক্ষপ্রিয়। তিনি এইভাবে ঐ আদিত্যকে (বেদির উপর) স্থাপন করেন। এটি সুবর্ণময় ও গোলাকৃতি এবং এতে একুশটি (বোতামসদৃশ) উঁচু ফলক থাকে- এর তাৎপর্য ব্যাখ্যাত হয়েছে। ফলকগুলিকে নিম্নমুখী করে তিনি এটি স্থাপন করেন। কারণ, ফলকগুলি সূর্যের কিরণ এবং সূর্য নীচের দিকেই কিরণ দেয়।
উক্ত মন্ত্রের সায়ণভাষ্য-
আকাশাত্মনা স্তুতস্য পুষ্করপর্ণস্য মধ্যে সূর্যমন্ডলাত্মনা ধ্যাতব্যস্য রুক্মস্যোপদানং বিধত্তে - 'অথ রুক্মমিতি'। 'অথ'- শব্দঃ পুষ্করপর্ণোপধানানন্তর্যার্থঃ। রুক্মস্যাদিত্যাত্মকত্বমুপপা
সায়ণভাষ্যের বঙ্গানুবাদ-
আকাশাত্মা স্বরূপ পদ্মপুষ্পের পাপড়ির মধ্যে সূর্যমন্ডলস্বরূপ ধ্যান করে সুবর্ণ রেকাবটি বিশেষভাবে স্থাপন করবে অর্থে - 'অথ রুক্মমিতি' ব্যবহৃত হয়েছে। 'অথ' শব্দে পূর্বের পদ্মপুষ্পের পাপড়ি স্থাপনের পর বুঝায়। রেকাবটিকে(সুবর্ণপাত্র) আদিত্য স্বরূপ বুঝাতে - 'এষ হীমা' ব্যবহৃত হয়েছে। 'এষঃ' ইহা পরিদৃশ্যমান সাক্ষাৎ আদিত্য (সূর্য) 'ইমা' 'সর্বাঃ' 'প্রজাঃ' 'অতিরোচতে' সূর্য সকল প্রজাকে উজ্জ্বল প্রভা দান করে; রোচতের ব্যুৎপত্তি রুচ ধাতু হতে। ঠিক ওভাবে পরোক্ষভাবে 'রুক্ম' যে বলা হয়েছে তার অর্থ দেবতারা পরোক্ষ প্রিয় হয়ে থাকে। রেকাবের যে সুবর্ণময় প্রকৃতিদ্রব্যআকৃতিটি দেখা যায় তা বুঝাতে বলা হয়েছে - 'স হিরণ্ময়' ইতি। 'সঃ' সেই সূবর্ণ রেকাব। দাণ্ডিণায়াদি সূত্র অনুসারে (পা.সূ.৬/৪/১৭৪) নিপাতনন্ময়টি, ময়ট থাকলে য- ফলা লোপ হয়ে হিরণ্য শব্দের য-ফলা লোপ। 'পরিমণ্ডলঃ' বর্ত্তুলকৃতি বা গোলাকার আকৃতিবিশিষ্ট 'একবিংশতিনির্বাধঃ' একবিংশটি উঁচু ফলক সমূহ থাকবে ইহা শুভকার্য। 'তস্যোক্ত' এরূপ উক্ত হচ্ছে। 'তস্য' একবিংশ ফলক যুক্ত শতপথ ব্রাহ্মণ- ৬/৭/১/২ ইত্যাদি স্তুতিতে পূর্বান্ময়ে বলা হয়েছে। স্থাপনের সময় ফলকগুলো নিম্নমুখী অবস্থান করা অবশ্য কর্তব্য এরূপার্থে - 'অধস্তান্নিবাধমিতি'। তার কারণ - 'রশ্ময়ো বা এতস্যা' এরূপ। সূর্যমণ্ডল অধোভাগেই 'রশ্ময়ো' রশ্মি প্রদান করে; এজন্য রশ্মিস্বরূপ সেই ফলকগুলো এভাবে অধোমুখী করে রাখাই যুক্তিযুক্ত।
উক্ত মন্ত্রে দেখা যাচ্ছে যে পূর্বে স্থাপন করা সেই পদ্মফুলের পাপড়ির উপরে একটি সোনার গোলাকার পাত্র বা সুবর্ণ রেকাব স্থাপন করা হল। এই রেকাবটিকে আদিত্য বা সূর্যের প্রতিরূপ বলা হচ্ছে। এই সোনার পাত্রটিতে ২১ টি ফলক থাকবে যা সূর্যের রশ্মির প্রতিরূপ। সূর্য যেমন পৃথিবীর দিকে রশ্মি বিকিরণ করে সেরূপ ভাবে ফলগুলো সোনার পাত্রের নিচের দিকে অবস্থান করে, যেন সূর্য তার রশ্মি প্রদান করছে। সূর্যের প্রতিমা বা বিগ্রহটি কেমন হবে তার বর্ণনা করা হচ্ছে এখানে।
এখানে খুবই সুন্দর ও স্পষ্ট ভাবে সামগান করে পদ্মপাপড়ির উপর বিশেষ ফলক বিশিষ্ট সোনার পাত্র রেখে তাকে সূর্য হিসেবে ধ্যান করা হচ্ছে। অর্থৎ এই ২১ ফলক বিশিষ্ট সোনার রেকাবটি যে সূর্য বিগ্রহ /প্রতিমা/মূর্তি তাই বলা হচ্ছে।
এরপর শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/১/১৫ তে বলা হয়েছে,
অথ পুরুষমুপদধাতি। স প্রজাপতিঃ সোঽগ্নিঃ স যজমানঃ স হিরণ্ময়ো ভবতি জ্যোতির্ব্বৈ হিরণ্যং জ্যোতিরগ্নিরমৃতং হিরণ্যমমৃতমগ্নিঃ পুরুষো ভবতি পুরুষো হি প্রজাপতিঃ।।
অনুবাদ-
তারপর তিনি একটি (সুবর্ণ) পুরুষকে (অর্থাৎ সোনার পুরুষ মূর্তি) তার উপর স্থাপন করেন- তিনি প্রজাপতি তিনি অগ্নি, তিনিই যজমান। তিনি হিরণ্ময়, কারণ, হিরণ্য আলোকোজ্জ্বল এবং অগ্নিও আলোকোজ্জ্বল; হিরণ্য অমরণধর্মা, অগ্নিও অমরণ ধর্মবিশিষ্ট। (স্থাপন করা হয়) একটি পুরুষ, কারণ, প্রজাপতি পুরুষ।
উক্ত মন্ত্রের সায়ণভাষ্য-
রুক্মমধ্যে হিরণ্ময়পুরুষস্যোপধানং বিধর্তে- অথ পুরুষমিতি। স প্রজাপতিরিত্যাদি। 'সঃ' উপধেয়ঃ পুরুষঃ 'প্রজাপতিঃ' সথূলপ্রপঞ্চাভিমানী বিরাডাত্মকঃ, 'সঃ' এব 'অগ্নিঃ' সূক্ষ্মপ্রপাঞ্চাভিমানী হিরণ্যগর্ভাত্মকঃ; যজমানস্য তদ্রূপপ্রাসের্যজমানাত্মকোঽপি 'সঃ' ইত্যর্থঃ। তস্য হিরণ্যবিকৃতিত্বং বিধায় স্তৌতি - স হিরন্ময় ইতি। জ্যোতির্বা ইতি। ভাস্বররূপোপেতত্বাচ্চ্যোতিরাত্
সাণভাষ্যের বঙ্গানুবাদ-
(পূর্বোল্লিখত) সুবর্ণ রেকাবের মধ্যে সুবর্ণ পুরুষ মূর্তি স্থাপন করবে এরূপ বুঝাতে - 'অথ পুরুষং' ব্যবহৃত হয়েছে। 'স প্রজাপতি' ইত্যাদি দ্বারা 'সঃ' অর্থাৎ (রেকাবে) স্থাপিত পুরুষই, 'প্রজাপতিঃ' অর্থাৎ স্থূলপ্রপঞ্চ প্রকাশক বিরাটপুরুষাত্মক (বেদের পুরুষ সূক্তে সেই বিরট পুরুষই এই পুরুষ), 'অগ্নিঃ' অর্থাৎ সূক্ষ্মপ্রপঞ্চ প্রকাশক হিরণ্যগর্ভাত্মক (বেদের হিরণ্যগর্ভ সূক্তের সেই হিরণ্যগর্ভই এই পুরুষ বিগ্রহটি), 'যজমানঃ' ইহাদ্বারা (পুরুষই) যজমাত্মক বা যজমানস্বরূপ হন। তাঁকে (এই পুরুষ বিগ্রহকে) হিরণ্ময়স্বরূপ জ্ঞানে স্তুতি করা হয় বুঝাতে - 'হিরণ্ময়' ব্যবহৃত হয়েছে। 'জ্যোতির্বা' দ্বারা আলোকোজ্জ্বল জ্যোতিস্বরূপ এই হিরণ্য(স্বর্ণ) এরূপ বোঝায়। সেরূপ প্রচন্ড অগ্নি সংযোগেও (আলোকোজ্জ্বল হয়); 'অমৃতম্' অর্থাৎ অমারণ স্বভাব বিশিষ্ট বা অমরধর্মা 'হিরণ্যম্' এই স্বর্ণ। 'অগ্নিঃ' অগ্নিও এই উভয়ধর্মাত্মক (অমরণধর্মা ও আলোকোজ্জ্বল) হওয়ায় হিরণ্য বা স্বরর্ণের সাথে যুক্ততার সম্পর্ক বুঝায়। পুরুষরূপ প্রতিপাদনার্থে -'পুরুষো ভবতী' ব্যবহৃত হয়েছে। 'হি' সেই যজ্ঞস্বরূপ 'প্রজাপতিঃ' - প্রজাপতি পুরুষবিধপ্রতিরূপী হিরণ্ময় পুরুষ আকৃতি বিশিষ্ট এরূপ অর্থ প্রকাশ করে।
পুরো লেখার মধ্যে এই অংশটা সবচেয়ে আকর্ষণীয়! কেননা এখানে বলা হচ্ছে যে পূর্বোল্লিখত সেই সূর্য বিগ্রহস্বরূপ সোনার পাত্রের উপর একটি সোনা দ্বারা নির্মিত পুরষাকৃতির মূর্তি বা বিগ্রহ বা প্রতিমা স্থাপন করা হল। এই পুরুষই বেদের পুরুষসূক্তের বিরাটপুরুষ, হিরণ্যগর্ভসূক্তে হিরণ্যগর্ভের ও প্রজাপতি স্বরূপ অর্থৎ এটিই বেদের পরমপুরুষের বিগ্রহ।
এখানে স্পষ্টভাবে হিরণ্যগর্ভ পুরুষের বিগ্রহের কথা বলা হচ্ছে। এই পুরুষই প্রজাপতি, অগ্নি ও যজমান।
পরবর্তী মন্ত্রে আরো কিছু চমক অপেক্ষা করছে!
এরপর শতপথব্রাহ্মহণের ৭/৪/১/১৭ তে বলা হচ্ছে-
"তং রুক্মঽউপদধাতি। অসৌ বাঽআদিত্যঽএষ রুক্মঽথ য ঽএষএতস্মিন্মণ্ডলে পুরুষঃ স ঽএষ তমেবৈতদুপদধাতি।।
অনুবাদ-
তিনি স্বর্ণময় রেকাবে তাকে(সোনার পুরুষ বিগ্রহ) স্থাপন করেন। কারণ, 'সুবর্ণরেকাবই ঐ আদিত্য; ঐ আদিত্যমণ্ডলে যে- পুরুষের অবস্থান তাকেই তিনি এখন (বেদিস্থানে) স্থাপন করেন।
উক্ত মন্ত্রের সায়ণভাষ্য-
তস্য পুরুষোপধানস্যাধারবিশেষং বিধায় স্তৌতি - তং রুক্ম ইতি। যে 'রুক্মঃ' পুষ্করপর্ণে উপহিতস্তস্য মধ্যে 'তম্' হিরণ্ময়ং পুরুষমুপদধ্যাৎ। আদিত্যমণ্ডলাত্মকো হ্যেষ 'রুক্মঃ' আদিত্যমণ্ডলমধ্যে যো হিরণ্ময়ঃ পুরুষ আস্তে। অত এব শ্রূয়তে -' এষোঽন্তরাদিত্যে হিরণ্ময়ঃ পুরুষঃ'- ইতি। "হিরণ্যশ্মশ্রুর্হিরণ্যকেশ আপ্রণখাৎসর্ব এব সুবর্ণঃ" ইতি চ। স এবৈষ উপধীয়মানে হিরণ্ময়ঃ পুরুষো রুক্মরূপ আদিত্য মণ্ডলে তমেব পুরুষমুপহিতবান্ ভবতীত্যর্থঃ।।
সায়ণভাষ্যের অনুবাদ-
সেই পুরুষের (সোনার পুরুষ মূর্তি) স্থাপনের আধার (পাত্র) বুঝাতে উল্লিখিত হয়েছে - 'তং রুক্ম'। সেই 'রুক্ম' অর্থাৎ সুবর্ণপাত্র বা রেকাব যা পদ্মফুলের পাপড়ির উপর স্থাপিত 'তম্' অর্থাৎ তার মধ্যে হিরণ্ময় পুরষটি স্থাপন করা হয়। আদিত্যমণ্ডল স্বরূপ এই 'রূক্মঃ' অর্থাৎ রেকাব যার মধ্যে আদিত্যমন্ডলাত্ম হিরণ্ময় পুরুষ অবস্থান করেন। তাই উল্লেখ করা হয়েছে -'এষোঽন্তরাদিত্যে হিরণ্ময়ঃ'। "হিরণ্যশ্মশ্রুর্হিরণ্যকেশ আপ্রণখাৎসর্ব এব সুবর্ণঃ" (একটি মন্ত্র) - এরূপ। এবং এই স্থাপিত হিরণ্ময় পুরুষই সুবর্ণপাত্ররূপী আদিত্যমণ্ডলের সেই পুরুষ হন এরূপ অর্থ করা হয়েছে।
এখানে সেই সোনার পুরুষ মূর্তি যাকে সূর্যবিগ্রহস্বরূপ ২১ ফলক বিশিষ্ট রেকাবে রাখা হয়েছে তাকে আদিত্যমন্ডলের আত্মাস্বরূপ পুরুষ হিসবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এই স্থাপিত পুরুষ মূর্তিটি সেই বেদের বিরটপুরুষ, প্রজাপতি, হিরণ্যগর্ভ, আদিত্যমন্ডলের আত্মা স্বরূপ এবং তাকে যজ্ঞ বেদীস্থানে স্থাপন করা হচ্ছে।
এরপর শতপথ ব্রহ্মণের ৭/৪/১/২২ এর প্রথমেই বলা হচ্ছে,
অথ সাম গায়তি।..
যার সায়ণভাষ্য,
পুরুষোপধানঙ্গত্বেন সামগানং বিধিতে- 'অথ সাম গায়তীতি'। 'অথ' - শব্দে হিরণ্ময়পুরুষোপধামননন্তর্য়ে।..
অর্থাৎ পুরুষমূর্তি স্থাপনের অঙ্গ হিসেবে সেই পুরুষের উদ্দেশ্যে সামগান (সামবেদ সংহিতার মন্ত্র ছন্দোবদ্ধ ভাবে উচ্চারণ) করবে - ' অথ সাম গায়তি' দ্বারা ইহা বলা হয়েছে। 'অথ'- শব্দ দ্বারা হিরণ্ময় পুরুষের বিগ্রহ স্থাপন করার পর বুঝানো হয়েছে।
এই মন্ত্রে যজ্ঞবেদীতে রাখা পদ্ম পাপড়ির উপর সেই সূর্যরূপী স্বর্ণ রেকাবে রাখা হিরণ্যগর্ভ প্রজাপতি পুরুষের বিগ্রহের উদ্দেশ্যে সামবেদীয় মন্ত্রে স্তুতি করা হচ্ছে।
উক্ত আলোচনা থেকে উঠে আসলো, যজুর্বেদীয় শতপথ ব্রাহ্মণে স্পষ্ট ও সুন্দর ভাবে মূর্তিপূজা বা বিগ্রহ উপাসনা বা প্রতিমা দিয়ে উপাসনা বর্ণিত হয়েছে। যেখানে সূর্যের বিগ্রহ বা প্রতিমা হিসেবে ২১ ফলক যুক্ত সোনার পাত্র ও বেদের বিরাটপুরুষ/ হিরণ্যগর্ভ / প্রজাপতির বিগ্রহ বা প্রতিমা হিসেবে একটি সোনার পুরুষ বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। সূর্য বিগ্রহটি স্থাপন করা হয় পদ্মপুষ্পের পাপড়ির উপর ও পুরুষ বিগ্রহটি স্থাপন করা হয় সূর্য বিগ্রহটির উপর। বিগ্রহ স্থাপনের পূর্বে সামগান গাওয়া হয় এবং বিগ্রহ স্থাপনের পর তার উদ্দেশ্যে সামগান করা হয়। উক্ত মন্ত্রগুলের সায়ণভাষ্য সহ প্রদত্তর রয়েছে।
সুতরাং, প্রতিমাপূজা বা বিগ্রহ উপাসনা ১০০% বেদ স্বীকৃত। যারা যুগ যুগ ধরে চলে আসা সনাতন ধর্মের এই অনুশাসনকে বেদ বিরোধী বলে নিজের ব্যবসার সুবিধার্থে চালায় বা এর বিরোধীতা করে তারা কখনোই সনাতনের অংশ হতে পারে না। তাদের থেকে সকলে দূরত্ব বজায় রাখুন।
--- শ্রী প্রান্ত সাহা
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
- মূর্তিপূজা - অম্বিকা দত্ত ব্যাস
- শ্রী রঘুনাথ দাস শাস্ত্রী
- শ্রী রায়ন চক্রবর্তী
4 মন্তব্যসমূহ
টাইটেলে লিখলেন "বেদে কোথায় আছে বিগ্রহ দিয়ে উপাসনার কথা"। অথচ পুরো আর্টিকেলে আমি কোন বেদমন্ত্রের উল্লেখই পাই নি। সত্যিকার অর্থে আপনারা বেদে বিগ্রহ পূজা দেখাতে অসমর্থ। অবশ্য যেটা নাই সেটা দেখাবেন কীভাবে?
উত্তরমুছুনসবগুল রেফারেন্স ব্রাহ্মন গ্রন্থ থেকে দেওয়া। বেদ বলতে যে সংহিতা, ব্রাহ্মন, আরন্যক, উপনিষদ - এই চার ভাগকেই বুঝায়, সেটা জানা আছে? বেদ নিয়ে মন্তব্য করতে আসছেন, আগে বেদ কি, সেটা ভালভাবে জেনে আসেন, যান।
মুছুনসায়ণ ভাষ্য কখনোই নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স নয়। আর আপনাদের ব্লগে পরচর্চা বেশি থাকে, আসল সত্য তুলে ধরতে না পারলে বেশিদিন আপনাদের এগুলো চলবেনা। এসব অযুক্তি দিয়ে ধর্মের ভাঙন ঠেকাতে পারবেন না।
উত্তরমুছুনআপনাদের লক্ষ্যই দেখছি অপরকে আক্রমণ করা।
সায়ন ভাষ্য নির্ভর যোগ্য নয়, এটা আপনাকে কে বলল? আপনি কি দিয়ে বিচার করলেন যে সায়ন ভাষ্য ভুল? নাকি একদল বেদ ব্যবসায়ী , যারা নিজেদের বেদ বিক্রির জন্য প্রচলিত বেদের সকল ভাষ্যকে ভুল বলে প্রচার করছে, সেই স্রোতে গা ভাসালেন? কখনো নিজে না জেনে বুঝে অপরের বলা বা শোনা কথায় তর্ক করবেন না।
মুছুন