প্রতিমায় পুজা বিরোধী অপযুক্তির ধারাবাহিক প্রত্যুত্তর। [পর্ব-১ (দয়াকান্ড/প্রথম অংশ)]


[দয়াজ্বী'র প্রতিমা পুজা বিরোধী অপ-যুক্তি ও তার প্রত্যুত্তর।।]
খুব সম্প্রতি আমরা দেখেছি ভারতে একজন জোকার নায়েকের আবির্ভাব হয়েছিল যে বেদ মন্ত্রের অপব্যাখ্যা দিয়ে প্রতিমা পুজা বিরোধী ফত**য়া তথা সনাতনের মধ্যেও শিড়কতত্ত্ব প্রচার করেছিলো। তার যুক্তির ধরণ তথা শব্দ বিশ্লেষণ ছিলো অনেকটা এরকম যে আমি কাউকে বললাম তোমার মস্তিষ্ক ধারালো তলোয়ারের মতো তীক্ষ্ণ এবং জোকার সেটার ব্যাখ্যা করলো যে আমি তার মস্তিষ্ককেই ধারালো তলোয়ার বলেছি৷
উপমান ও উপমিত কর্মধারয় সমাসের মধ্যে বেসিক পার্থক্য ধরতে না পারার কারণেই জ্ঞানপাপীদের দ্বারা শব্দ বিশ্লেষণে নানাবিধ অনর্থ হয়। আমরা জানি যার সঙ্গে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে তুলনা করা হয় তাকে উপমান এবং যাকে তুলনা করা হয় তাকে উপমেয় বলে। যে বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্যের জন্য তুলনা করা হয় তাকে সাধারণ ধর্ম বলে।
উপরের যে উদাহরণ দেওয়া হয়েছে সেখানে সাধারণ ধর্ম হচ্ছে 'তীক্ষ্ণতা'।
শব্দ বিশ্লেষণে মূর্খতার পরিচয় হেতু জোকার নায়েক বেদ মন্ত্রের একটা শব্দের অনর্থ করে প্রতিমা পুজা বিরোধী ফত**য়া দিয়েছিলো। সে বলেছিলো,
"ন তস্য প্রতিমা অস্তি" (যজুর্বেদ ৩২/৩)
অর্থাৎ ঈশ্বরের কোন মূর্তি নেই।
সম্পূর্ণ মন্ত্রের বিশ্লেষণ আবশ্যক এখানে।
"ন তস্য প্রতিমা অস্তি যস্য নাম মহদ্ যশঃ।
হিরন্যগর্ভ ইত্যেষ মা মা হিংসীদিত্যেষা যস্মান্ন জাত ইত্যেষঃ।।"
সরলার্থঃ সেই পরমাত্মার মহিমা বর্নিত হিরন্যগর্ভ, যস্মান্ত জাতঃ (যা থেকে ইন্দ্রাদি জাত, অর্থাৎ সমস্ত কিছুর সম্রাট) তথা মা মাহিংসীত (আমাকে হিংসা কর না) আদি মন্ত্রে করা হয়েছে যাহার নাম এবং যশ অত্যন্ত বড় পরন্তু ওনার সমান প্রতিমান/উপমান (ক্ষমতা ও গুণবিশিষ্ট) কেউ নেই।
-যজুর্বেদ (৩২/৩)
অর্থাৎ মন্ত্রের তাৎপর্য হলো যে ঈশ্বরের কোন তুল্য নেই। ঈশ্বরের প্রতিমা গড়া যাবে না এমন কোন নির্দেশনা এই মন্ত্রে নেই।। কেউ আমার একটা চিত্ররূপ দিলে তার অর্থ এই নয় যে সে আমার বিকল্প আমার মতোই আরেকজনকে দাড় করিয়ে দিয়েছে।।
এখানে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখবেন প্রতিমা অর্থ সমতুল্য বোঝানো হচ্ছে। প্রতিমা শব্দের উৎপত্তি প্রতিম্ থেকে যার অর্থ তুল্য। যেমনঃ- মাতৃপ্রতিম - মতৃতুল্য বা মায়ের ন্যায়, ভাতৃপ্রতিম- ভাইয়ের তুল্য বা ভাইয়ের ন্যায়। এখানে প্রতিমা ব্যবহৃত হয়েছে তুল্য বা সমতুল্য অর্থে। তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। এই সুন্দর মন্ত্রের অর্থ বিকৃত করে ঐরূপ, "ঈশ্বরের প্রতিমা নেই" অর্থ করা হয়েছে যা জোকারের অজ্ঞতারই স্বাক্ষ্য দেয়।

জোকার পূর্ববর্তী আর কেউ কি ছিলো প্রতিমা পুজা বিরোধী ফতো**বাজ?

অষ্টাদশ শতকের দিকে একজন গবেষক ও তার্কিকের আবির্ভাব হয়েছিল ভারতের গুজরাটে। বেদের প্রচার, বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারমূলক কাজে তার অবদান অনস্বীকার্য এবং পরবর্তীতে তার কিছু অনুসারী স্বতন্ত্রভাবে সনাতন কল্যাণে ভূমিকাও রেখেছিলেন। কিন্তু বেশিরভাগ অনুসারীই পরবর্তীতে কদাচারের পথ বেছে নিয়েছিলেন এবং সেটা ক্রমবর্ধমান।। সেই বিশিষ্ট তার্কিক ও বিদ্বান ব্যক্তি যেহেতু একজন মানুষ ছিলেন তাই অনেক ভালো ভালো কাজের পাশাপাশি তিনি কিছু স্বাভাবিক ও স্থুল ভুলত্রুটিও করে গেছেন।। তিনি প্রতিমায় বা ভক্তিতে বা ত্যাগে বা শ্রদ্ধায় বা সাধনায় ঈশ্বরলাভে ব্যর্থ হয়ে (প্রচেষ্টা কতদূর ছিলো সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ) কেবল শব্দ ছলে বা শুধুই তর্কে ঈশ্বরকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।। যদিও তার অনুসারীদের প্রচারিত আন-অথেনটিক কিছু ঘটনা ছাড়া বেশিরভাগ তর্কে তার অপ-যুক্তি সাধারণ হিন্দুরা গ্রহণ করেন নি বলে জানা যায় এবং রমাবাঈয়ের মতো একজন মহীয়সী বিদ্বান নারী তার অপ-যুক্তিতে বিরক্ত হয়ে পরবর্তীতে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণের ঘটনাও আছে। পবিত্র কাশির ভুমিতে সেখানকার পন্ডিতদের সামনে এই বিশিষ্ট তার্কিকের প্রতিমা পুজা বিরোধী অপ-যুক্তি ধুপে টিকে নি। উনার অনুসারী হয়েও বিশেষ সমাজের প্রতিমা পুজা বিরোধী বানোয়াট ফ**য়ার কারণে শ্রী রামশর্মার মতো বিদ্বান ব্যক্তিও পরবর্তীতে সনাতন সংস্কৃতির চিরায়ত ধারায় ফিরে আসেন।
তিনি মুলত ব্যক্তিগত মত প্রতিষ্ঠা হেতু-ই (তিনি বিদ্বান ছিলেন নিঃসন্দেহে) প্রতিমা পুজার বিরোধিতা, হাজার বছরের সনাতন সংস্কার ও সংস্কৃতির বিরোধিতা এবং দেবদেবী ও হিন্দুদের তীর্থ স্থানসমুহের অহেতুক নিন্দা করে বেদকে নিজ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে আমৃত্যু একজন তুখোড় তার্কিক হয়েই ছিলেন। প্রতিমা পুজার বিরোধিতা হেতু তার শাস্ত্রীয় ও যুক্তিবাদের সকল অপব্যাখ্যা যখন সনাতনী পন্ডিতদের সামনে এবং বৃহত্তর সনাতন সমাজের কাছে নিঃগৃহিত হলো তখন তিনি তার অর্থ বিনাশ গ্রন্থে প্রতিমা পুজার বিরোধিতা হেতু কিছু নিম্মস্তরের অপযুক্তির আশ্রয় নেন। শচীন টেন্ডুলকার যেমন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার পরও মাঝেমধ্যে ম্যাচের চাপে শূণ্য রানে আউট হোন দয়াজ্বীও প্রতিমা পুজার বিরোধিতায় শাস্ত্র ব্যাখ্যায় ধরাশায়ী হয়ে চমৎকার তার্কিক হওয়া সত্ত্বেও কিছু অপ-যুক্তির আশ্রয় নেন। সেই বিষয়েই পরবর্তী আলোচনা।।

অপ-যুক্তির প্রতিত্তোরঃ

দয়াজ্বীকে সনাতনীর প্রশ্নঃ সাকারে মন স্থির হয় কিন্তু নিরাকারে কঠিন। এইজন্য প্রতিমা পূজা থাকা উচিত।
দয়াজ্বীর উত্তরঃ সাকারে মন কখনও স্থির হইতে পারে না, কারণ মন সাকারকে সহসা গ্রহণ করিয়া, তাহারই এক এক অবয়বের মধ্যে বিচরণ করে এবং অন্য বস্তুর প্রতি ধাবিত হয়। কিন্তু নিরাকার অনন্ত পরমাত্মার গ্রহণে মন যথাশক্তি প্রবল বেগে ধাবিত হইলেও তাহার অন্ত পায় না। নিরবয়ব বলিয়া মনও চঞ্চল থাকে না। কিন্তু তাঁহার গুণ-কর্ম-স্বভাব বিবেচনা করিতে করিতে মন আনন্দে মগ্ন হইয়া স্থির হইয়া যায়। আর যদি সাকারে মন স্থির হইত, তাহা হইলে জগতে সকলেরই মন স্থির হইত। কারণ জগতে মনুষ্য, স্ত্রী, পুত্র, ধন এবং মিত্র প্রভৃতি সাকার পদার্থে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু নিরাকারে যুক্ত না করা পর্য্যন্ত কাহারো মন স্থির হয় না।কেননা মন নিরবয়ব বলিয়া নিরাকারে স্থির হইয়া যায়।
এবার দয়াজ্বীর স্ব-চিন্তিত যুক্তিগুলো বাস্তবিকতার সাথে মেলানোর চেষ্টা করবো।
প্রথম পয়েন্টঃ সাকারে মন স্থির হইতে পারে না কিন্তু অনন্ত নিরাকারের প্রতি মানুষের মন স্থির হয়।
প্রত্যুত্তরঃ অন্ধের হস্তিদর্শন বিষয়টা মনে পড়ে গেলো। যখন আমি স্বচক্ষে কোন বিষয়কে অবলোকন না করতে পারবো তখন তাহা আমার নিকট সদা-ই অসম্পূর্ণ।। আমাকে যদি কেউ প্যারিস নগরের বর্ণনা শোনায় যে কিনা নিজেও কখনও প্যারিস নগরী দেখে নি তবে কেবল বর্ণনা শুনে প্যারিসের প্রকৃত চিত্র আমার মনের চোখ দিয়ে উপলব্ধি করতে গিয়ে মস্তিষ্কে যথাযথ প্রতিবিম্ব (আল্টিমেট ইমেজ) সৃষ্টি হবে না৷ আবার কেউ একজন নিজে দর্শন করে এসেও যদি তার বর্ণনা করেন তবুও তাহা আমাদের মনোপটে প্রকৃত দৃশ্যের অবতারণা করতে ব্যর্থ হবে বরং এতে একেকজন স্ব স্ব মনো পটে একেকভাবে একেক দৃশ্যের (কাল্পনিক) চিত্রাঙ্কন করবে। অপরপক্ষে কেউ যদি সে দৃশ্য এঁকে নিয়ে আসেন অথবা ক্যামেরা ইমেজ নিয়ে আসে তবে তা আমাদের চোখের সামনে এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলবে যা আমাদের চোখ ও মন উভয়কেই প্রশান্তি প্রধান করবে এবং প্যারিসের প্রকৃত স্বরূপই প্রকাশ পাবে। অন্যদিকে কাউকে যদি অন্ধকার কক্ষে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং বলা হয় এই ঘরে টিভি আছে, ফ্রীজ আছে, আলমারি আছে তবে সে অন্ধকারে তাহার কিছুই পরিলক্ষিত করতে না পেরে অস্থির চিত্তে কক্ষের এদিক-সেদিক ধাবমান হবে।
দ্বিতীয় পয়েন্টঃ মনের কোন অবয়ব নেই তাই মন চঞ্চল নয় তাই মন নিরাকার ঈশ্বরের গুণ-কর্ম-স্বভাব ভাবিয়া অনন্দে ডগমগ হয়।
প্রত্যুত্তরঃ মনের কোন অবয়ব নেই সত্য। কিন্তু মনের মধ্যে যদি এমন কোন জিনিসের আরোপ করি যা সম্পর্কে মনের কোন ধারণাই নেই তবে সে মন তখন কতটা অস্থির হয়ে উঠে সেটা নিজের মনকে সত্যের আয়নার সামনে দাড় করালেই পরিস্কার হবে। মন্দিরে যখন বিগ্রহের সামনে বহু মানুষ অবস্থান করে তখন গুটিকয়েক মানুষ গল্পগুজব ও মুবাইলিংয়ে ব্যস্ত থাকে কিন্তু যখনই আরতি শুরু হয় কিংবা প্রার্থনা শুরু হয় তখন ৯০ শতাংশ ভক্তই বিগ্রহের সামনে ঈশ্বর ভাবনায় নিমগ্ন হয় এবং চিত্ত-মন অনন্দে বিহ্বল হয়ে উঠে৷ এইরূপ ঘটনাপ্রবাহ মন্দির প্রাঙ্গণে বাস্তবিকই দৃশ্যমান হয়। আমার সামনে যখন অন্নব্যঞ্জনের থালা রাখা হবে তখনই কেবল আমার মনে অন্নব্যঞ্জনের স্বাদ-গুণ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে এবং তাহা আস্বাদনে আরও স্পষ্ট উপলব্ধির অভিজ্ঞতা অর্জন হবে।
তৃতীয় পয়েন্টঃ তিনি বললেন মন নিরবয়ব বলে মন নিরাকারের স্থির হইয়া যায়। নিরাকারে যুক্ত না করলে মন স্থির হয় না।
প্রত্যুত্তরঃ মন নিরাকারে স্থির হয় এটা তার স্বচিন্তিত মতামত তাই তার ব্যক্তি ভাবনা নিয়ে আমার কোন মতামত নেই। কিন্তু তিনি বললেন যে নিরাকারে যুক্ত না করলে মন স্থির হবে না এতেই আমার আপত্তি কারণ আমার চিন্তার জগৎ তার চিন্তার প্রবাহ দিয়ে বিচার্য নয়। মন অবয়বহীন হলেও প্রকাশিত বস্তুই মন তার নিজ কুঠুরে ধারণ করে নেয় কারণ মন তাহার প্রকাশ অবলোকন করেছে। এতে মনের মধ্যে স্থানসঙ্কুলানে সমস্যা হয় না বরং অপ্রকাশিত বস্তুর স্বরূপ ভাবনায় মন দিকবিদিক ছুটোছুটি করে ক্রমশ চঞ্চল হয়ে উঠার সম্ভাবনা প্রবল যদি সাধনার সর্বোচ্চ স্তরে গিয়ে মন প্রকৃতই স্থির না হয়ে থাকে।।
পরবর্তীতে তার অর্থ বিনাশ গ্রন্থের পরবর্তী যুক্তিগুলোর প্রতিত্তোর দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।।

©স্টিমন অনিক।।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ