বেদের ব্রাহ্মণে বিগ্রহ উপাসনা নিয়ে অবৈদিকদের আস্ফালন নিরসন

 




ভূমিকাংশঃ
শুরু করছি পরমেশ্বরের শ্রীচরণে এই প্রার্থনা জানিয়ে যেন অবৈদিক ও অপ-সংস্কারচ্ছন্ন সমাজের কতিপয় কদাচারীদের হৃদয়ে শুদ্ধ সংস্কার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শাস্ত্রোক্ত অমৃত বানীগুলো তাদের জীবনাচরণে প্রয়োগ হয়।
সম্প্রতি সনাতন সমাজের তরুণ-তরুণীদের বিভ্রান্ত করার জন্য ব্যবহৃত সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার হলো "সনাতন শাস্ত্রে প্রতিমা পূজা নিষিদ্ধ"। এই বিষয়টি নিয়ে শাস্ত্রের খণ্ডিতাংশ তুলে ধরে সবচেয়ে বেশি মিথ্যাচার করে জাকির গং ও তাদের অনুগামী অবৈদিক সমাজের কতিপয় কদাচারীগণ। অথচ সনাতন শাস্ত্র, দর্শন ও পরম্পরায় প্রতিমা পূজা সিদ্ধ যা আমরা শাস্ত্র, যুক্তি ও দর্শনের আলোকে তুলে ধরেছি।
অতঃপর তারা প্রচার করতে শুরু করে যে বেদে প্রতিমা পূজার কোন বিধান নেই তাই প্রতিমায় ঈশ্বর উপাসনা সম্পূর্ণ অবৈদিক। অর্থাৎ সূক্ষ্মভাবে সুকৌশলে তারা সনাতন সংস্কৃতিতে আব্রাহামিক ভাবাদর্শ প্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখে।
সনাতন শাস্ত্র ও দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর 'SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি'র মাধ্যমে তাদের এই অপপ্রচারের প্রত্যুত্তরও তুলে ধরা হয় এবং বেদাদি শাস্ত্র হতেই প্রমাণ দেওয়া হয় প্রতিমা পূজা শাস্ত্রসিদ্ধ এবং কোন অবৈদিক কার্য নয়।
উক্ত লিখায় শতপথ ব্রাহ্মণোক্ত বিগ্রহ উপাসনা নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয়৷ সেটা দেখে কতিপয় অপ-সংস্কারী ও অবৈদিকদের প্রতিক্রিয়া অনেকটা এমন ছিলো যেন কেউ তাদের মূলে আঘাত করে তাদের সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক ভিত্তি নড়িয়ে দিয়েছে। তারা আমাদের লিখার প্রত্যুত্তরে শাস্ত্রোক্ত শব্দের চেয়ে বেশী প্রয়োগ করেছে অশাস্ত্রীয় অপ-শব্দ যা স্পষ্টত অবৈধ ক্ষোভের প্রতিফলন।।
কতটা অপসংস্কারী (নিশ্চয়ই যবন মানসিকতার) হলে তারা একটি শাস্ত্রীয় প্রত্যুত্তরে একাধিকবার "অবৈধ পিতা" ও নানাবিধ অপ-শব্দের ব্যবহার করতে পারে!! কিন্তু আমরা তাদের জন্মপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাদের মাতৃদেবীকে অপমান করার দৃষ্টতা দেখাবো না কারণ এটা আমাদের সনাতন সংস্কৃতির পরিপন্থী এবং আমাদের সংস্কার কোন যবন আদর্শে হয় নি।
যাইহোক তারা তাদের তথাকথিত খণ্ডনে কিছু সাত পাঁচ লিখে আকাশকে পাতাল বানিয়ে একটি আজগুবি লিখা দেয় তাদের ব্লগে এবং তাদের অপ-দাবীর স্বপক্ষে ৮৩ খানা (!) রেফারেন্স দিয়ে বিশাল রাজ্য জয়ের মিথ্যা আস্ফালন চালায় ফেসবুকে। এই তথাকথিত ৮৩ খানা রেফারেন্স যদি এরা নিজেরাও ঠাণ্ডা মাথায় যাচাই করে তবে রেফারেন্সগুলোর বেশিরভাগের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সন্ধিহান হবে নিশ্চিত। অবশ্য তাদের দ্বারা ব্রেইনওয়াশড তরুণ অনুগামীদের বিভ্রান্ত করতে "৮৩ খানা" শব্দটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
মূল প্রসঙ্গে চলে আসা যাক এবং কোনরূপ রচনা না লিখে আমাদের মতের পক্ষে প্রাসঙ্গিক প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হবে। আশাকরি এই লিখাটা পড়ার পর এদের অনুগামী অনেকেই মন্দিরে ছুটবে প্রতিমার সামনে মাথা ঠেকাতে কিন্তু যাদের মাথা ইতোমধ্যে অবৈদিক সংস্কারে ঠেকে আছে তাদের ব্যাপারে আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।
পূর্বে আমাদের ব্লগে দেওয়া বেদের "কোথায় আছে প্রতিমা/ বিগ্রহ দিয়ে উপাসনা করার কথা?" পোস্টে শতপথ ব্রাহ্মণোক্ত বিগ্রহ উপাসনা নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয়, তা দেখে কিছু অবৈদিক অসংস্কারীর (সনাতনী রূপধারী কিন্তু সনাতনীদের শত্রুর) ভয়াবহ জ্বলন হয়।
যারা আমাদের পূর্বের লিখাটি পড়েন নি তারা এই লিখা পড়ার আগে অবশ্যই পূর্বের লিখাটি পড়ে নিন।

বেদের কোথায় আছে প্রতিমা/ বিগ্রহ দিয়ে উপাসনা করার কথা?

মূল আলোচনাঃ
স্বপক্ষঃ
শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/১/১০ মন্ত্রে বলা হচ্ছে,
"অথ রুক্মমুপদধাতি।
অসৌ বাঽআদিত্যঽএষ হীমাঃ সর্ব্বাঃ প্রজাঽঅতিরোচতে রোচো হ বৈ তং রুক্মঽইত্যাচক্ষতে পরোক্ষং পরোক্ষকামা হি দেবোঽঅমুমেবৈতদাদিত্যমুপদধাতি স হিরণ্ময়ো ভবতি পরিমণ্ডলঽএকবিংশতিনির্বাধস্তস্যোক্তো বন্ধুরধস্তান্নির্বাধমুপদধাতি রশ্ময়ো বাঽএতস্য নির্বাধা অবস্তদুন বাঽএতস্য রশ্ময়ঃ।।"
(শ.প.ব্রা.৭/৪/১/১০)
অনুবাদ:
তারপর তিনি সেখানে একটি সুবর্ণপাত্র (রেকাব) স্থাপন করেন। এই সুবর্ণরেকাবটি ঐ আদিত্য কারণ, আদিত্য পৃথিবীতে সকল প্রাণীর উপর উজ্জ্বলভাবে শোভা পায়। উজ্জ্বল শোভাকেই তারা পরক্ষোভাবে বলেন - রুক্ম (সোনার রেকাব/পাত্র)। কারণ, দেবগণ পরোক্ষপ্রিয়। তিনি এইভাবে ঐ আদিত্যকে (বেদির উপর) স্থাপন করেন। এটি সুবর্ণময় ও গোলাকৃতি এবং এতে একুশটি (বোতামসদৃশ) উঁচু ফলক থাকে- এর তাৎপর্য ব্যাখ্যাত হয়েছে। ফলকগুলিকে নিম্নমুখী করে তিনি এটি স্থাপন করেন। কারণ, ফলকগুলি সূর্যের কিরণ এবং সূর্য নীচের দিকেই কিরণ দেয়।
প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক রুক্ম অর্থ কি!
ঋগ্বেদ সংহিতা ৫/৬১/১২ অনুসারে রুক্ম অর্থ, দীপ্তি পাওয়া বা বিশেষভাবে শোভা পাওয়া


শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/১/১০"অথ রুক্মমুপদধাতি" দিয়ে বলা হচ্ছে উজ্জ্বল দীপ্তিমান কিছু একটা স্থাপন করা হলো। এবার এই উজ্জ্বল বস্তু টি কি তা সম্পর্কে বলা হচ্ছে "স হিরণ্ময়ো ভবতি" অর্থাৎ এটি স্বর্ণময় অর্থাৎ, উজ্জ্বল বস্তুটি স্বর্ণ নির্মিত। এখানে হিরণ্য অর্থ যে স্বর্ণ তা অনেক অসংস্কারী অর্বাচীন মানতে নারাজ।

নিরুক্তের ২/১/১০ হিরণ্যের ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে বলা হচ্ছে,
অলঙ্কার নির্মাণ শিল্পীগণ টেনে সোনার আয়তন বড় করে এজন্য হিরণ্য শব্দের ব্যুৎপত্তি, যখন আয়ত করা হয় তখন আকৃষ্ট হয়।
আবার হিরণ্য এক স্থানে স্থির থাকে না কেননা ইহার আর্থিক ব্যবহার সিদ্ধির জন্য একজনের থেকে আরেক জনের কাছে গমন করে এজন্য হিরণ্যের ব্যুৎপত্তি, এক ব্যক্তির নিকট হতে অন্য ব্যক্তির নিকট নীত হয়।
আবার হিরণ্য দুর্ভিক্ষাদিতে হিতকারী ও ইহা সর্বদা সকলের আনন্দদায়ক বলে হিরণ্যের ব্যুৎপত্তি, হিতকর ও আনন্দদায়ক।
হিরণ্য সকলের হৃদয়ে আনন্দ দান করে বলে এর ব্যুৎপত্তি, হৃদয়ের আনন্দদায়ক।


তারপর নিরুক্তের ১/১৬/১৩-১৫ তে বিদ্যুতাগ্নির বর্ণকে বলা হচ্ছে হিরণ্যের ন্যায় বর্ণ বিশিষ্ট।


সুতরাং নিরুক্ত অনুসারে উক্ত মন্ত্রে যে হিরণ্য বলতে ধাতব স্বর্ণের কথাই বলা হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এতটুকু পরিস্কার হলো যে, উক্ত মন্ত্রে রুক্ম মূলত সোনার তৈরি একটি বস্তু।
এই রুক্মের আকার ঠিক কেমন হবে সে বিষয়ে বলা হচ্ছে, "পরিমণ্ডলঽএকবিংশতিনির্বাধস্তস্যোক্তো" অর্থাৎ পরিমণ্ডলঃ বা বর্তুলাকৃতি এবং একবিংশতিনির্বাধঃ বা একুশটি নির্বাধ বা ফলক বা ঘাট যুক্ত, তস্য উক্ত অর্থাৎ এরূপ উক্ত হয়।
শব্দকল্পদ্রুমে পরিমণ্ডল শব্দের অর্থ বর্তুলাকারই করা হয়েছে এবং সায়ণ ভাষ্যেও এই অর্থই গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ রুক্ম বস্তুটি বর্তুলাকৃতি এবং ২১ টি নির্বাধ বা ফলক যুক্ত।


এখন এই রুক্মটি মূলত কি প্রকাশ করে?
সে সম্পর্কে বলা হচ্ছে, "অসৌ বাঽআদিত্যঃ" অর্থাৎ এই রুক্মটি আদিত্যস্বরূপ বা সূর্য স্বরূপ।

অবৈদিকদের দাবীঃ- এখানে আদিত্য বলতে সূর্যকে বুঝানো হয় নি। এখানে আমরা আমাদের স্বভাবসুলভ "সাত-পাঁচ ভুজুম ভাজুম" দিয়ে প্রমাণ করবো যে আদিত্য বলতে প্রজা সমগ্র বুঝানো হচ্ছে! কারণ আমাদের মূল কাজই হলো এসব ভুজুম ভাজুম করে লোক ঠকিয়ে নিজেদের ব্যবসা সফল করা।
প্রত্যুত্তরঃ তাহলে এবার নির্ণয় করা যাক এখানে আদিত্য বলতে ঠিক কি বুঝানো হয়েছে, সূর্য নাকি অন্যকিছু?
নিরুক্তের ২/১/১৩/২ এ আদিত্য শব্দের ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে বলা হচ্ছে,
যা রস গ্রহণ করেন, যা জ্যোতিষ্ক সমূহের আলো আবৃত করে বা অদিতির পুত্র।
পরবর্তীতে ২/১/১৩/৩ এ বলা হচ্ছে, ঋগ্বেদ সংহিতা ১০/৮৮/১১ তে বলা হচ্ছে "সূর্য্যম্‌ আদিতেয়ম্‌" অর্থাৎ সূর্য অদিতির পুত্র, এজন্য সূর্যের নাম আদিত্য। এখানে মূলত আদিতেয়ম্‌ সূর্যের বিশেষণ রূপে ব্যবহৃত হয়েছে।




আবার নিরুক্তের ১/১৬/৬ এ বলা হচ্ছে,
জার শব্দ জৃ ধাতু থেকে উৎপন্ন; জার শব্দের অর্থ এখানে আদিত্য (সূর্য)। সূর্য রাত্রিকে জীর্ণ করেন অর্থাৎ সূর্যোদয়ে রাত্রির লয় হয়; সূর্যই দীপ্তি সমূহের জীর্ণতা সম্পাদক- সূর্যোদয়ে নক্ষত্রগণের দীপ্তি বিলীন হয়।

শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/১/১০ মন্ত্রেই বলা হচ্ছে,
"অসৌ বাঽআদিত্যঽএষ হীমাঃ সর্ব্বাঃ প্রজাঽঅতিরোচতে" অর্থাৎ আদিত্য পৃথিবীতে সকল প্রাণীর উপর উজ্জ্বলভাবে শোভা পায়।
এখানে রোচতে দিয়ে ঊজ্জ্বলভাবে শোভা পাওয়া বুঝায়।
নিরুক্ত ২/১/২০/২ ও ৫/৫/৫ মতেও রোচতে দিয়ে ঊজ্জ্বল্ভাবে শোভা বা দীপ্তি পাওয়া বুঝায়।






পৃথিবীর সকল প্রাণীর উপর ঊজ্জ্বলভাবে সূর্যই শোভা পায়।
আবার শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/১/১০ মন্ত্রে বলা হচ্ছে,
"বন্ধুরধস্তান্নির্বাধমুপদধাতি রশ্ময়ো বাঽএতস্য নির্বাধা অবস্তদুন বাঽএতস্য রশ্ময়ঃ" অর্থাৎ, (রুক্মের) নির্বাধ বা ফলকগুলিকে নিম্নমুখী করে তিনি এটি স্থাপন করেন। কারণ, ফলকগুলি সূর্যের কিরণ এবং সূর্য নীচের দিকেই (ভূপৃষ্ঠমুখী) কিরণ দেয়।
এ থেকেও বুঝা যায় যে রুক্মটি সূর্যের প্রতীক এবং রুক্মের নির্বাধ গুলো সূর্যরশ্মির প্রতীক।
এখানে রশ্মি শব্দ দিয়ে মূলত সূর্যের রশ্মিকেই বুঝানো হচ্ছে,
নিরুক্তের ২/১/১৫/১-২ এ বলা হচ্ছে,
নিঘন্টু ১/৫ তে রশ্মির নাম সমূহের প্রথম ৫ টি নাম দিয়ে অশ্বরশ্মি বুঝায়।




নিরুক্ত ৪/১৩/৯ মতে অশ্ব সূর্যেরই একটি নাম।

নিরুক্ত ১/২/৩/২৩ এ বলা হচ্ছে আদিত্য রশ্মিসমূহকে প্রেরণ করেন।


শুক্লযজুর্বেদ সংহিতা ১৮/৪০ এ বলা হচ্ছে, "সুষুম্ণঃ‌ সূর্যরশ্মিশ্চন্দ্রমা গন্ধর্বঃ" অর্থাৎ সূর্যের সুষুম্‌ণা রশ্মি চন্দ্রে গমন করে চন্দ্রকে আলোকিত করে।
নিরুক্ত ২/১/৬/১০ এ এই রশ্মিকে 'গো' বলা হয়েছে।



সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা হতে প্রমাণিত হয় যে, আদিত্য বলতে এখানে সূর্য এবং রশ্মি বলতে সূর্যরশ্মিই বুঝানো হচ্ছে। রুক্মটিকে আদিত্য বা সূর্যের প্রতিরূপ বলা হচ্ছে এবং রুক্মের ফলকগুলোকে সূর্যশ্মির সাথে তুলনা কর হচ্ছে। অর্থাৎ রুক্মটি হচ্ছে সূর্যের বিগ্রহ বা প্রতিমূর্তি তথা প্রতীকী উপস্থাপন যা প্রতিকোপসনার মাধ্যম।
বরাবরই অবৈদিকদের যুক্তিসমূহ শিশুসুলভ ও হাস্যকর! আচার্য সায়ণ যে কিনা কৃষ্ণযজুর্বেদীয় তৈত্তরীয় শাখার সংস্কারী ব্রাহ্মণ ছিলেন। যিনি সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক সহ সর্বমোট ১৮ টি বৈদিক গ্রন্থের ভাষ্য করেছেন। যার ভাষ্য পরম্পরা যুক্ত আচার্যগণও প্রামাণিক মানেন। সেই সায়ণ আচার্য নাকি জানেন না রুক্ম কি জিনিস! অথচ ১৫০ বছর আগে হঠাৎ করে আবির্ভূত হওয়া তথাকথিত কিছু অবৈদিক সংগঠন বা দুইবছর পিডিএফ পড়া কিছু অসংস্কারী যুবা (এরা মূলত পরম্পরাহীন কারণ ব্যাখ্যা পছন্দ না হলে এরা নিজেদের মান্য আচার্যদের ভাষ্যও পরিমার্জন করে ফেলে) কিনা বেদের অর্থ সায়ণাচার্যের চেয়ে ভালো ভাবে বুঝে ফেলেছে! আবার নিজেদের অসংস্কারী কল্পনার মত চারকোণা এক আজব বস্তু বানিয়ে নাম দিয়ে দিয়েছে তার রুক্ম!
বাহ্‌ বাহ্‌! বলিহারি! লা জবাব!
অত্যন্ত হাস্যকর দাবী! এই চারকোণা গর্তযুক্ত বস্তুখানা কি তাদেরর কাঙ্গালী গুরুকূল থেকে আবিষ্কৃত কোন প্রজেক্ট মডেল কিনা তা খতিয়ে দেখা আবশ্যক!

অবৈদিকদের প্রশ্নঃ- কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্রের ১৬/৫/১ এ আবার শতপথ ব্রাহ্মণের ৬/৭/১/১ এ বলা হচ্ছে রুক্ম নিয়ে, সে বিষয়ে কি বলবেন?
প্রত্যুত্তরঃ ওরে বাবা! আপনারা শ্রৌতশাস্ত্র মানা শুরু করলেন আবার কবে থেকে!? যতদূর জানি অবৈদিকরা সাধারণত কল্পসূত্রাদি মানে না। যদিও নিজেদের ব্যবসার সুবিধার জন্য এরা ঠিকই এসব কল্প সূত্রাদি থেকে বিভিন্ন খণ্ডিতাংশ নিজেদের মতো করে প্রচার করতে দেখা যায়। এদের আসলে মান্যতারও কোন ভিত্তি নেই৷ এরা "যখন যা অনুকূল সে হিসেবে বাজবে ঢোল" নীতিতে চলে।
শুক্লযজুর্বেদের অন্তর্গত একটি শ্রৌতসূত্র হল কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র। আর শতপথ ব্রাহ্মণ হচ্ছে শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতার অন্তর্গত ব্রাহ্মণ। কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্রের ১৬/৫/১ এ মূলত শতপথ ব্রাহ্মণের ঐ ৬/৭/১/১ মন্ত্রকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে। আর উক্ত সূত্রে রুক্মটিকে গলায় ঝুলানোর কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত পাওয়া যাবে শতপথ ব্রাহ্মণের ৬/৭/১ এ। সেখানে বিস্তারিত বলা আছে এই রুক্মের আকার কিরূপ, রুক্মটি দিয়ে কি বুঝাচ্ছে বা রুক্মটি কিসের প্রকাশক, সেটা কেন গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে!

এখন দেখি সেই শতপথ ব্রাহ্মণের ৬/৭/১ এ কি বলা আছে?
”রুক্মং প্রতিমুচ্য বিভর্তি।
সত্যং হৈতদ্যদ্রুক্মঃ সত্যং বা ঽএতং যন্তুমর্হতি সত্যেনৈতং দেবাঽ অবিভরুঃ সত্যেনৈবৈনমেতদ্বিভর্ত্তি।।” (৬/৭/১/১)
অনুবাদঃ- তিনি (গ্রীবাকে বেষ্টন করে ) একটি স্বর্ণ-পট্র (রুক্ম) ঝোলান এবং একে ধারণ করেন; কারণ, ঐ স্বর্ণ-পট্রটি হচ্ছে সত্য এবং সত্যই ঐ (অগ্নিকে) ধারণ করতে সক্ষম; সত্যের মাধ্যমে দেবতারা একে সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং সত্যের মাধ্যমে বর্তমানে তিনি (একে) বহন করেন।
এর ঠিক পরবর্তী মন্ত্রেই বলা হচ্ছে এই রুক্মের আকার ও রুক্মটি কিসের প্রকাশক সে বিষয়ে,
”তদ্যত্তৎসত্যম্‌।
আসৌ সঽ আদিত্যঃ স হিরণ্ময়ো ভবতি জ্যোতির্বৈ হিরণ্যং জ্যোতিরেষো ঽমৃতং হিরণ্যমমৃতমেষ পরিমণ্ডলো ভবতি পরিমণ্ডলো হ্যেষঽ একবিংশতিনির্বাধ একবিংশ হ্যেষ বহিষ্ঠন্নির্বাধং বিভর্ত্তি রশ্ময়ো বাঽএতস্য নির্বাধা বাহ্যতঽ উ বাঽএতস্য রশ্ময়ঃ।।” (৬/৭/১/২)
অনুবাদঃ- এখন ঐ সত্যই ঐ দূরবর্তী সূর্যের অনুরূপ। এটি একটি স্বর্ণ-পট্র (রুক্ম); যেহেতু স্বর্ণ হচ্ছে আলোকচ্ছটা এবং তিনি (সূর্য) হচ্ছেন আলোক; স্বর্ণ হচ্ছে অমরত্ব এবং তিনিও অমরত্ব। ঐ পট্রটি গোলাকার, যেহেতু তিনিও (সূর্য) গোলাকার। ঐটির (রুক্মটির) একুশটি শক্ত ঘাট রয়েছে, কারণ, তিনি হচ্ছেন একবিংশতিসংখ্যক। তিনি একে (রুক্মটিকে) ধারণ করেন বহিঃপার্শ্বের শক্ত ঘাট সহ, কেননা, শক্ত ঘাটগুলো হচ্ছে তাঁর (সূর্যের) রশ্মি সমূহ এবং তাঁর রশ্মিগুলো বহির্মুখী।
এখানেও স্পষ্টভাবেই আমাদের সেই পূর্বোল্লিখিত ২১ ফলক বা ঘাট যুক্ত গোলাকার সূর্যের প্রতিরূপ সেই স্বর্ণের রুক্মের উল্লেখই পাই। যার ফলক গুলো সূর্যের রশ্মিকে প্রকাশ করে।
এরপর বলা হচ্ছে,
”যদ্বেব রুক্মং প্রতিমুচ্য বিভর্তি।
অসৌ বাঽআদিত্য ঽএষ রুক্মো নো হৈতমগ্নিং মনুষ্যো মনুষ্যরূপেণ যন্তুমর্হত্যেতেনৈব রূপণৈতদ্রূপং বভর্তি।।” (৬/৭/১/৩)
অনুবাদঃ- (প্রশ্ন আসে) কেন তিনি গ্রহণ করেন এবং ধারণ করেন রুক্মটি? (উত্তরে বলা হচ্ছে) রুক্মটি হচ্ছে দূরবর্তী সূর্য এবং মনুষ্য তার মনুষ্য-আকৃতিতে ঐ অগ্নিকে ধারণ করার বিষয়ে অক্ষম। এটা একমাত্র সম্ভব এই (সৌর অথবা দিব্য) আকৃতিতে , যা (দিব্য আকৃতি) তিনি ধারণ করেছেন।
এখানেও স্পষ্ট করা হচ্ছে যে, যেহেতু দূর্বর্তী সেই সূর্যকে ধারণ করার সামর্থ্য মানুষের নাই তাই এই সূর্য স্বরূপ রুক্মকে ধারণ করা হচ্ছে।
সুতরাং আপনাদের দেওয়া কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্রের ১৬/৫/১ এবং শতপথ ব্রাহ্মণের ৬/৭/১/১ তে রুক্ম বলতে গোলাকার ২১ ঘাট যুক্ত স্বর্ণের সূর্যবিগ্রহকেই (সূর্য প্রতীক) বুঝানো হয়েছে।
আপনারা স্বভাবসুলভ কপিপেস্ট (হিন্দি পাতলা বইয়ের বাংলা কাট-পিস) করে অর্ধ মন্ত্রের বিকৃত অর্থ দেখিয়ে লোক ঠকিয়ে নিজেদের ব্যবসার প্রসার করে আর কতদিন চলবেন? আপনাদের মুখে ঝামা ঘষে দিতে SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি সত্যের ধ্বজা হাতে প্রস্তুত।

স্বপক্ষঃ
শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/১/১৫ তে বলা হয়েছে,
”অথ পুরুষমুপদধাতি।
স প্রজাপতিঃ সোঽগ্নিঃ স যজমানঃ স হিরণ্ময়ো ভবতি জ্যোতির্ব্বৈ হিরণ্যং জ্যোতিরগ্নিরমৃতং হিরণ্যমমৃতমগ্নিঃ পুরুষো ভবতি পুরুষো হি প্রজাপতিঃ।।”
অনুবাদ-
তারপর তিনি একটি (সুবর্ণ) পুরুষকে (অর্থাৎ সোনার পুরুষ মূর্তি) তার উপর স্থাপন করেন- তিনি প্রজাপতি তিনি অগ্নি, তিনিই যজমান। তিনি হিরণ্ময়, কারণ, হিরণ্য আলোকোজ্জ্বল এবং অগ্নিও আলোকোজ্জ্বল; হিরণ্য অমরণধর্মা, অগ্নিও অমরণ ধর্মবিশিষ্ট। (স্থাপন করা হয়) একটি পুরুষ, কারণ, প্রজাপতি পুরুষ।
উক্ত অংশে রুক্মের উপর হিরণ্য মূর্তি বা স্বর্ণের পুরুষ মূর্তি স্থাপন করতে বলা হয়েছে।

অবৈদিকদের দাবীঃ- না না, আমরা এসব মানবো না। এখানে স্বর্ণ মূর্তি নয় পুরুষ শব্দে রাজার কথা বলা হচ্ছে। আর আমাদের মত স্বঘোষিত বেদজ্ঞদের (মূলত অবৈদিক) মতে এখানে রাজসূয় যজ্ঞের কথা বলা হচ্ছে।

প্রত্যুত্তরঃ

শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থটি আদৌ হাতে নিয়ে পড়েছেন ত নাকি আপনাদের দৌড় হিন্দি পাতলা বইয়ের কপি-পেস্ট বা পিডিএফ থেকে টুকে মেরে দেওয়া অব্দি?
মধ্যান্দিন শতপথ ব্রাহ্মণের ৭ম কাণ্ড অগ্নি চয়ন নিয়ে। এখানে গার্হপত্য়াদি যজ্ঞবেদি নির্মাণ বিধি এবং যজ্ঞের ও যজ্ঞবেদীর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা রয়েছে।
মন্ত্র প্রকরণ আদৌ বুঝেন নাকি নিজেরা যেখানে আটকে যান সেখানেই কেবল অদৃশ্য মন্ত্র প্রকরণ খুঁজে পান?
সপ্তম কাণ্ডের শুরুতেই ৭/১/১ এ বলা হচ্ছে গার্হপত্য যজ্ঞবেদি নির্মাণ বিষয়ে। ৭/৪/১ এ আহবানীয় যজ্ঞ বেদি নির্মাণের বিষয়ে বলা হয়েছে। যেহেতু গ্রন্থ পড়ার অভ্যাস আপনাদের নেই (স্বাধ্যায়ের নামে ফটোশেসন অবশ্য চলে) তাই আপনাদের উদ্দেশ্যে জানিয়ে রাখি, রাজসূয় যজ্ঞ প্রকরণ হচ্ছে মধ্যান্দিন শতপথ ব্রাহ্মণের ৫ম কাণ্ডে।
ওহে অবৈদিক! আপনারা তাহলে এই মন্ত্রে রাজা ও রাজসূয় পাইলেন কোথা হইতে?


৭ম কান্ডের শুরুতেই বলা হয়েছে,

”গার্হ্যপত্যং চেষান্‌পলাশশাখয়া ব্যুদূহতি।
অবসাতি হৈতদ্যদ্গার্হপত্যং চিনেতি যঽউ বৈ কে চাগ্নিচিতোঽস্যামেব তেঽবসিতান্তদ্যংদ্‌ব্যূদূহত্যবসিতানেব তদ্‌ ব্যুদূহতি নেদবদিতানধ্যবস্যানীতি।।”
(৭/১/১/১)

অনুবাদঃ- গার্হপত্য অগ্নির বেদিস্থান নির্মাণ করার জন্য তিনি (অধ্বর্যু) পলাশ শাখার দ্বারা (স্থানটি)  সম্মার্জন করেন। কারণ, যখন তিনি গার্হপত্য অগ্নির স্থান নির্মাণ করেন, তিনি সেইস্থানে অধিষ্ঠিত হন। এবং অগ্নিবেদি যাঁরা নির্মাণ করেন তাঁরা প্রকৃতই এই পৃথিবীতে সেই স্থানে অধিষ্ঠিত থাকেন। সেজন্য তিনি যখন (বেদি) স্থানটি সম্মার্জনা করেন তখন তিনি পূর্ব থেকেই যারা অধিষ্ঠিত তাদের অপসারিত  করেন এই ভেবে যে, ' পাছে আমি পূর্বাধিষ্ঠদের উপরেই অধিষ্ঠান করি'।

সুতরাং এইখানে পুরুষ শব্দে রাজা বুঝানোর কোনো অবকাশই নেই।  

নিরুক্ত ২/১/৩/৩ এ পুরুষের অর্থ পরমাত্মা বা ব্রহ্ম করা হয়েছে।
তৈত্তরীয় আরণ্যক ১০/১০/৩, মহানারায়ণ উপনিষদ৩/৯, শ্বে০উ০৩/৯  এ পুরুষ বলতে সর্বব্যাপ্ত পরমেশ্বরকেই বোঝানো হয়েছে। (নিচের স্ক্রিনশটে বিস্তারিত)







বেদের পুরুষ সূক্তে পুরুষ বলতে পরমেশ্বরকেই বুঝানো হয়েছে। পুরুষ সূক্তের দ্বিতীয় মন্ত্রেও বলা হয়েছে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতে যা কিছু ছিল আছে থাকবে তা সবই যাঁর থেকে জাত তিনিই পুরুষ। 

"পুরুষ এবেদং সর্বং যদ্‌ভূতং যচ্চ ভব্যং ।

    উতামৃতত্বস্যেশানো যদন্নেনাতিরোহতি ।।"

(ঋগ্বেদ সংহিতা- ১০/৯০/২)

অনুবাদঃ- অতীতে যা ছিল , বর্তমানে যা আছে , ভবিষ্যতে যা থাকবে তা সকলই সেই পুরুষের

প্রকাশ তিনি অমৃতত্বের অর্থাৎ মোক্ষের অধীশ্বর এবং অন্ন অর্থাৎ খাদ্যের উপর নির্ভরশীল

জীবেরও অধীশ্বর


হিরণ্য শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ পূর্বেই করা হয়েছে। সুতরাং এখানে হিরণ্য পুরুষ মূর্তিটি মূলত পরমেশ্বরেরই স্বর্ণমূর্তি এটাই প্রমাণিত।

শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/১/১৫ তে পুরুষ মূর্তিটিকে প্রজাপতি বলা হচ্ছে।
ঋগ্বেদ সংহিতা ১০/১২১/১ এ সমগ্র জগতের অধীশ্বরকে হিরণ্যগর্ভ বলা হচ্ছে। পরমেশ্বরই একমাত্র সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর এবং এই হিরণ্যগর্ভকেই প্রজাপতি বলা হচ্ছে উক্তসূক্তের ১০ নং মন্ত্রে, যার দ্বারা সকল বস্তু আয়ত্তকৃত অর্থাৎ যিনি সর্বব্যাপী। পরমেশ্বরই একমাত্র সর্বব্যাপী।



উক্ত হিরণ্যগর্ভ সূক্তের মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে পুরুষমূর্তিটি বেদিস্থানে স্থাপন করা হয়। শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/১/১৯ মন্ত্রে উক্ত পুরুষ মূর্তিটিকে হিরণ্যগর্ভ এবং প্রজাপতি হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। আর এখানে প্রজাপতি ও হিরণ্যগর্ভ শব্দ দিয়ে পরমেশ্বরকেই বুঝানো হচ্ছে,
”হিরণ্যগর্ভঃ সমবর্ত্তাগ্রহইতি।
হিরণ্যগর্ভো হ্যেষ সমবর্ততাগ্রে ভূতস্য জাতঃ পতিরেকহ আসীদিত্যেষ হ্যস্য সর্বস্য ভূতস্য জাতঃ পতিরেক হাসেৎসদাঢার পৃথিবীং দ্যামুতেমামিতোষ বৈ দিব্যং চ পৃথিবীং চ দাধার কস্মৈ দেবায় হবিষা ব্বিধেমেতি প্রজা পতির্ব্বৈ কন্তস্মৈ হবিষা ব্বিধেমেত্যেতৎ।।”
(শতপথ ব্রাহ্মণ ৭/৪/১/১৯)।।
অনুবাদঃ- (তিনি এই মন্ত্রে বাজ০সং০-১৩/৪/১ স্থাপন করেন) - 'হিরণ্যগর্ভ সর্বাগ্রে অবস্থান করেছিলেন।' হিরণ্যগর্ভই তিনি যিনি সকল প্রাণিগণের উৎপত্তির পূর্বে নিজেই শরীর ধারণ করেন; 'তিনি জাতমাত্র সকল প্রাণীর অধীশ্বর ছিলেন, তিনি সকল জগতের ঈশ্বরহয়েই জাত হয়েছিলেন; 'তিনি এই পৃথিবী এবং দ্যুলোককে ধারণ করেছেন' কারণ, তিনিই (আদিত্যই) দ্যুলোক এবং পৃথিবীলোক উভয়কে ধারণ করে থাকেন; 'ক-শব্দবাচ্য সেই দেবের (প্রজাপতির) উদ্দেশ্যে আমরা হবি প্রদান করছি' প্রজাপতিই ক-শব্দবাচ্য, এর দ্বারা তাঁরই উদ্দেশ্যে আমরা হবি প্রদান করি।
সুতরাং উক্ত শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/১/১৫ মন্ত্রে প্রজাপতি শব্দে পরমেশ্বরকেই বুঝানো হচ্ছে, যা উক্ত মন্ত্রের পরবর্তী মন্ত্রেই বলা হচ্ছে।
বেদের সংহিতাভাগে অগ্নিকেও সর্বব্যাপী বলা হয়েছে,
ঋগ্বেদ সংহিতা (১/৯৭/৬)- এ,
বিশ্বব্যাপী তাঁর (অগ্নি) মুখ, তিনিই বিশ্বব্যাপ্ত করে বিরাজমান।
শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা (১৭/৯৯)-এ,
হে অগ্নি! সমগ্র বিশ্বভুবন ব্যাপ্ত করে তোমার অবস্থান।
ঋগ্বেদ সংহিতা (২/১/৩-৭)-এ,
হে অগ্নি! তুমি সাধুদের অভিষ্টবর্ষী, অতএব তুমি বিষ্ণু।
উল্লেখিত মন্ত্রগুলোতে অগ্নি বলতে মূলত সর্বব্যাপী পরমেশ্বরকেই বুঝানো হচ্ছে। পূর্বে দেখানো হয়েছে সর্বব্যাপী পরমেশ্বরকে প্রাজাপতি বলা হয়েছে। তাই এখানে পুরুষকে প্রজাপতি ও অগ্নি বলা হয়েছে।

অবৈদিকদের প্রশ্নঃ- তাহলে এখানে পুরুষকে যজমান বলা হচ্ছে কেন?
প্রত্যুত্তরঃ আচ্ছা! এখানে সমস্যা? শাস্ত্র যদি সংস্কার ভিন্ন অধ্যয়ন করেন তাহলে কোন মন্ত্রেরই যথার্থ করা আপনাদের পক্ষে সম্ভব হবে না৷ অবশ্য দুই বছরে বেদাদি শাস্ত্র শেষ করে ফেললে আপনাদের দ্বারা বেদমন্ত্রের অনর্থই সম্ভব।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ১/৫/২ এ বলা হচ্ছে, "যজমান বৈ যজ্ঞঃ", অর্থাৎ যজমানই যজ্ঞ। আবার শতপথ ব্রাহ্মণ ১/৭/১/১২ এ বলা হচ্ছে, "যজ্ঞ বৈ বিষ্ণু", অর্থাৎ বিষ্ণুই যজ্ঞ।
সুতরাং এখানে যজমান শব্দে সেই সর্বব্যাপী ঈশ্বরকেই বুঝানো হচ্ছে।
অর্থাৎ শতপথ ব্রাহ্মণ ৭/৪/১/১৫ -এ পুরুষ, প্রজাপতি, অগ্নি, যজমান শব্দে সেই সর্বব্যাপী পরমেশ্বরকেই বুঝানো হচ্ছে এবং হিরণ্য পুরুষ থাকায় পরমেশ্বরের স্বর্ণমূর্তি বুঝানো হচ্ছে।
এরপর শতপথ ব্রাহ্মণ ৭/৪/১/১৭ এ বলা হচ্ছে,
"তং রুক্মঽউপদধাতি।
অসৌ বাঽআদিত্যঽএষ রুক্মঽথ য ঽএষএতস্মিন্মণ্ডলে পুরুষঃ স ঽএষ তমেবৈতদুপদধাতি।।"
অনুবাদ:-
তিনি স্বর্ণময় রেকাবে তাকে (সোনার পুরুষ বিগ্রহ) স্থাপন করেন। কারণ, 'সুবর্ণরেকাবই ঐ আদিত্য ; ঐ আদিত্যমণ্ডলে যে- পুরুষের অবস্থান তাকেই তিনি এখন (বেদিস্থানে) স্থাপন করেন।
এখানে রুক্মের উপর রাখা মূর্তিটি যজ্ঞবেদীতে রাখার কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ রুক্মটিকে আদিত্য বলা হচ্ছে এবং পুরুষ মূর্তিটিকে আদিত্যমণ্ডলস্থ পুরুষ বলা হচ্ছে। পূর্বে আদিত্য বলতে যে সূর্যই বুঝানো হচ্ছে তা দেখানো হয়েছে। আর পুরুষ মূর্তিটি যেহেতু আদিত্য মণ্ডলস্থ পুরুষ সেহেতু পুরুষ লৌকিক রাজা হতে পারেন না।
কারণ,
প্রথমত এখানে রাজসূয় যজ্ঞের কথা বলাই হয় নি বরং এখানে আহবানীয় যজ্ঞ বেদি নির্মাণের বিষয়ে বলা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত সূর্যের অভ্যন্তরস্থ পুরুষ কখনোই ভূপৃষ্ঠের জীব হতে পারেন না, কেননা সূর্যের প্রচণ্ড তাপের ফলে সেখানে পৃথিবীর জীবের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
ছান্দোগ্য (১/৬/৬)-এ "যঃ এষঃ অন্তরাদিত্যে" অর্থাৎ "আর সূর্যমণ্ডলের অভ্যন্তরবর্তী এই যে হিরণ্ময় পুরুষ"।
ব্রহ্মসূত্র (রমানুজ ভাষ্য ১/১/২১ , শঙ্কর ভাষ্য ১/১/২০) এ বলা হচ্ছে,
(সূর্য ও চক্ষুর) অভ্যন্তরস্থ ( যে পুরুষ তিনি ব্রহ্ম), যেহেতু তাহার (পরমাত্মার) এইরূপ ধর্মের উপদেশ আছে।
এখানে সূর্যের অভ্যন্তরস্থ পুরুষ বলতে স্পষ্টভাবেই সর্বব্যাপী পরমব্রহ্মকেই বুঝানো হচ্ছে।
সুতরাং এখানে রাজার কথা নয় বরং পুরুষ মূর্তির কথাই বলা হচ্ছে।

শতপথ ব্রহ্মণের ৭/৪/১/১৯ এ উক্ত পুরুষ মূর্তিটিকে হিরণ্যগর্ভ বা প্রজাপতি হিসেবে হিরণ্যগর্ভ সূক্তের প্রথম মন্ত্র পাঠ করে স্থাপন করেন,
হিরণ্যগর্ভঃ সমবর্ত্তাগ্রহইতি।
হিরণ্যগর্ভো হ্যেষ সমবর্ততাগ্রে ভূতস্য জাতঃ পতিরেকহ আসীদিত্যেষ হ্যস্য সর্বস্য ভূতস্য জাতঃ পতিরেক হাসেৎসদাঢার পৃথিবীং দ্যামুতেমামিতোষ বৈ দিব্যং চ পৃথিবীং চ দাধার কস্মৈ দেবায় হবিষা ব্বিধেমেতি প্রজা পতির্ব্বৈ কন্তস্মৈ হবিষা ব্বিধেমেত্যেতৎ।।
অনুবাদঃ- (তিনি এই মন্ত্রে বাজ০সং০-১৩/৪/১ স্থাপন করেন) - 'হিরণ্যগর্ভ সর্বাগ্রে অবস্থান করেছিলেন।' হিরণ্যগর্ভই তিনি যিনি সকল প্রাণিগণের উৎপত্তির পূর্বে নিজেই শরীর ধারণ করেন; 'তিনি জাতমাত্র সকল প্রাণীর অধীশ্বর ছিলেন, তিনি সকল জগতের ঈশ্বর হয়েই জাত হয়েছিলেন; 'তিনি এই পৃথিবী এবং দ্যুলোককে ধারণ করেছেন' কারণ, তিনিই (আদিত্যই) দ্যুলোক এবং পৃথিবীলোক উভয়কে ধারণ করে থাকেন; 'ক-শব্দবাচ্য সেই দেবের (প্রজাপতির) উদ্দেশ্যে আমরা হবি প্রদান করছি' প্রজাপতিই ক-শব্দবাচ্য, এর দ্বারা তাঁরই উদ্দেশ্যে আমরা হবি প্রদান করি।
এরপর শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/২/১ মন্ত্রে সেই স্বর্ণের পুরুষ বিগ্রহটির উপরই যজ্ঞ বেদি তৈরির প্রথম স্বমাতৃণ্ণা (ছিদ্রযুক্ত) ইট রাখা হচ্ছে। এরপর আরো বেশ কয়েকটি ইট স্থাপন করে সেই সোনার পুরুষ মূর্তিটির উপর যজ্ঞ বেদি নির্মাণ করা হচ্ছে।
স্বয়মাতৃণ্ণামুপদধাতি।
ইয়ং বৈ স্বয়মাতৃণ্ণেমামেবৈতদুপদধাতি ও তামনন্তৰ্হিতাং পুরুষাদুপদধাত্যন্নং বৈ স্বয়মাতৃণ্ণেয়ং বৈ স্বয়মাতৃণ্ণেয়মু বাহঅ্যামস্যাং হি সর্ব্বময়, পঢ়াতেহনস্তুহিতমেব্যস্মাদেতদাং দধ্যত্যুত্তরামুত্তরমেধাম্মাদেতদন্নং দধাতি ॥১॥
অনুবাদ: তিনি (সুবর্ণপুরুষটির) উপর একটি স্বয়মাতৃণ্ণা (স্বাভাবিক গর্তযুক্ত) ইষ্টক স্থাপন করেন এই (স্বাভাবিক গর্তযুক্ত) স্বয়মাতৃণ্ণা এই পৃথিবীস্বরূপ, তিনি এর দ্বারা পৃথিবীকেই সেখানে স্থাপন করেন। তিনি পুরুষটির থেকে অবিযুক্তভাবে তাকে স্থাপন করেন; কারণ, স্বয়মাতৃণ্ণা অন্নই এবং স্বয়মাতৃণ্ণা এই পৃথিবী—এই পৃথিবী অন্নসম, কারণ, পৃথিবী বা ভূমিতেই সকল অন্ন পর হয়। তিনি এইভাবে অন্নকে পুরুষটির (অগ্নির) নিকটে স্থাপন করেন (পুরুষটির) উপর তিনি (অন্নরূপ) স্বয়মাতৃণ্ণাকে স্থাপন করেন; এইভাবে তিনি পুরুষের উপর অন্নকে স্থাপন করেন ॥১॥
এরপরও অবৈদিক যুবারা যদি পুরুষ অর্থ এখানে সোনার পুরুষ মূর্তি না করে রাজা করেন তাহলে আপনাদের রাজাকে মাটির নিচে ইট দিয়ে চাপা দিতে হচ্ছে বলা যায়! কি দারুণ বিষয় হবে না!

অবৈদিকদের প্রশ্নঃ- তাহলে শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/১/২১ এ 'দ্বিপাদ্যযজমানো' এটি দিয়ে কি বুঝানো হল?
প্রত্যুত্তরঃ
খণ্ডিতাংশ নয় বরং আগে মূল মন্ত্রটা দেখে নেওয়া যাক,
"দ্বাভ্যামুপদধাতি।
দ্বিপাদ্যজমানো যজমানোহগ্নির্য্যবতস্য মাত্রা তাবতৈবৈনমেতদুপদধাতি ত্রিষ্টুদ্ভ্যাং ত্রৈষ্টুভো হ্যেষ সাদ্যিত্বা সূদদোহসাহধিবদতি তস্যোক্তো বন্ধু।।"
শতপথ ব্রাহ্মণ (৭/৪/১/২১)
অনুবাদঃ- দুটি মন্ত্রের দ্বারা তিনি তাঁকে শায়িত করেন - যজমান দ্বিপদবিশিষ্ট এবং যজমানই অগ্নি (স্বরূপ); অগ্নি যেমন বিরাট তাঁর পরিমাণ (মাত্রা) ততটার দ্বারাই তিনি তাঁকে স্থাপিত করেন - দুটি ত্রিষ্টুপ ছন্দোযুক্ত মন্ত্রের দ্বারা কারণ, ত্রিষ্টুপ আদিত্যসম্বন্ধী। তাঁকে স্থাপন করে তিনি তাঁর উদ্দেশ্যে সূদদোহস্‌মন্ত্র উচ্চারণ করন এর তাৎপর্য পূর্বকথিত।
এখানে সেই পুরুষ মূর্তিটি রুক্মের উপর রাখা হয় শায়িত করে। এবং তাঁর উদ্দেশ্যে দুটি ত্রিষ্টুপ মন্ত্র ছন্দোবদ্ধভাবে উচ্চারণ করা হয়। সেই যজমান স্বরূপ পুরুষ মূর্তিটির দুই পা সেটাই এখানে বলা হচ্ছে।
অবৈদিকদের প্রশ্নঃ- তাহলে শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/১/২২ এর ব্যাখ্যা কি? সেখানে পুরুষকে শুষ্ক কাঠের ফলক ও হীনবীর্য বলা হল কেন?
প্রত্যুত্তরঃ
এই মন্ত্রের কোথাও পুরুষকে হীনবীর্য বলা হয় নাই। মন্ত্রার্থ সহ মন্ত্রটি নিম্নরূপ,
"অথ সাম গায়তি।
এতদ্বৈ দেবাহএতং পুরুষ্মুপধায় তমেতাদৃশমেবাপশ্যন্যথৈতচ্ছুষ্কং ফলকম্‌।।"
শতপথ ব্রাহ্মণের (৭/৪/১/২২)
অনুবাদঃ- অনন্তর তিনি একটি সামমন্ত্র গান করেন। কারণ, দেবগণ এই পুরুষকে অবস্থাপিত করবার পর তাঁকে এইরূপ একটি শুষ্ক কাষ্ঠফলকের মতো দেখাচ্ছিলেন।
এর তাৎপর্য হচ্ছে, দেবতাগণ যজ্ঞ করার সময় যখন এভাবে পুরুষ মূর্তিটিকে শায়িত করেন তখন সেটি দেখতে কাষ্ঠ ফলকের মত চ্যাপ্টা দেখাচ্ছিল।
হয়তো প্রশ্ন আসতে পারে দেবতারা আবার যজ্ঞ করেন নাকি?

হ্যাঁ ।
শুধু মরণশীল জীবই নহে, দেবতারাও স্বর্গীয় মর্যাদা ও মহিমা লাভ করিয়াছেন যজ্ঞের মাধ্যমে।
(শতপথ ১/৫/১/৬)
ঋগ্বেদ সংহিতার পুরুষসূক্তের ১০/৯০/১৬ মন্ত্রেও বলা হচ্ছে,
"যজ্ঞেন যজ্ঞময়জংত দেবাস্তানি ধর্মাণই প্রথমান্যাসান্‌।
তে হ নাকং মহিমানঃ সচংত যত্র পূর্বে সাধ্যাঃসংতি দেবাঃ।।"
অনুবাদঃ- দেবতারা যজ্ঞ পুরুষের দ্বারা যজ্ঞ সম্পাদন করলেন, সেটিই সর্বপ্রথম ধর্মানুষ্ঠান। যে স্বর্গলোকে প্রধান দেবতা ও সাধ্যগণ আছেন, এক্ষণে যারা বিরাটের উপাসনা করেন তাহারাও সেই স্বর্গলোক প্রাপ্ত হয়েন।
পরবর্তী ২৩ ও ২৪ নং মন্ত্রে বলার হচ্ছে, দেবতাগণের কাছে পুরুষ মূর্তিটি এরূপ পাতলা ফলকের ন্যায় মনে হওয়ায় তারা তাঁকে সামগান রূপী বীর্য প্রদান করলেন। যার ফলে তাদের কাছে পুরুষ মূর্তিটিকে আর ফলকের মত লাগল না।
এখানে তাৎপর্য এই যে, ধাতব পুরুষ মূর্তিটা যেরূপ পরমেশ্বরের প্রকাশক বেদ মন্ত্রও সেরূপ পরমেশ্বরের বীর্যেরই (তেজ) প্রকাশক।

অবৈদিকদের প্রশ্নঃ- শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/১/৩৬, ৪০, ৪৩ এ পুরুষের দুই বাহু বলা হল কেন?
প্রত্যুত্তরঃ
উক্ত মন্ত্রগুলোয় সেই পুরুষ মূর্তির দুই বাহু এটাই বলা হচ্ছে। এই মন্ত্র গুলো থেকে আরো পরিষ্কার বর্ণনা পাওয়া যায় পুরুষ মূর্তিটির গঠনের ব্যাপারে।

অথ স্রূচাঽউপদধাতি। বাহূ বৈ স্রূচৌ বাহূঽএবাস্মিন্নেতৎপ্রতিদধাতি তে যৎস্রূচৌ ভবতঃ স্রূচৌ হি বাহূঽইদমে কপুচ্ছলময়ং দণ্ডো দ্বে ভবতো দ্বৌ হীমৌ বাহূ পার্শ্বতঽউপদধাতি পার্শ্বতো হীমৌ বাহূ।।
(শত. ব্রা. ৭/৪/১/৩৬)
অনুবাদঃ- তিনি তারপর দুটি স্রুকপাত্র স্থাপন করেন। স্রুকদ্বয় দুই বাহুতুল্য; তিনি এইভাবে তাঁকে(অগ্নিকে) বাহুদ্বয় প্রদান করেন। এবং যে কারণে স্রুকদ্বয় স্থাপিত হয় তার কারণ স্রুকদ্বয় দুটি বাহু- পাত্র এবং হাতল, এরা (সংখ্যায়) দুই, আর এই বাহুও দুটি। তিনি তাদের পার্শ্বভাগে (বামদিকে ও দক্ষিণদিকে) রাখেন। কারণ (আমাদের) বাহুও (শরীরের) দুই পাশে থাকে।

(স্রুক্ - কাষ্ঠ নির্মিত বিভিন্ন আকৃতির হাতা বিশেষ যাতে আহুতি প্রদানের জন্য আজ্য গৃহীত হয়।)
তাবব্রবীৎ উপ মেতং প্রতি মঽএতদ্ধত্তং যেন মে যুবমুদক্রমিষ্টমিতি তাভ্যাং বৈ নৌ সর্ব্বমন্নং প্রযচ্ছেতি তৌ বৈ মা বাহূ ভূত্বা প্রপদ্যেথামিতি তথেতি তাভ্যাং বৈ সর্ব্বমন্নং প্রাযচ্ছত্তাবেনং বাহূ ভূত্বা প্রাপদ্যেতাং তস্মাদ্বাহুভ্যামেবান্নং ক্রিয়তে বাহুভ্যামদ্যতে বাহুদ্যাং হি স সর্ব্বমন্নং প্রাযচ্ছৎ।।
(শত. ব্রা. ৭/৪/১/৪০)

অনুবাদঃ- প্রজাপতি তাদের দুজনের প্রতি বলেছিলেন, তোমরা আমার নিকটে এসো এবং আমার নিকট থেকে যা তোমরা নিয়ে গিয়েছ তা আমার মধ্যে প্রতিস্থাপন কর। তাঁরা দুজন বলেছিলেন- বেশ, সেক্ষেত্রে আপনি আমাদের জন্য সকল অন্ন প্রদান করুন। (প্রজাপতি বলেছিলেন)- বেশ, আমার হস্ত হয়ে তোমরা দুজন আমার সঙ্গে মিলিত হও। (তাঁরা বলেছিলেন) - তাই হোক। তিনি তাদের সকল প্রকার অন্ন প্রদান করলেন এবং তাঁরা দুজন সেই দুটি হস্ত গয়ে তাঁর সঙ্গে মিলিত হলেন। এইজন্য হস্ত দ্বারা সকল অন্ন প্রস্তুত হয়ে থাকে, হস্ত দ্বারাই অন্ন ভক্ষিত হয়, কারণ প্রজাপতি দুটি হাতেই সকল অন্ন প্রদান করেন।
অবস্যৈতাবিন্দ্রাগ্নীঽএব বাহূ। তাবেনাং চ ব্বীর্যেণ চ সহ প্রপদ্যেতে স সম্প্রত্যুরঃ পুরুষমাকাশ্য যত্রাভ্যাপ্নোতি তদালিখ্যৈনেঽউপদধাত্যেষ হৈতয়োর্লোকঃ।।
(শত. ব্রা. ৭/৪/১/৪৩)
অনুবাদঃ- ইন্দ্র এবং অগ্নি প্রকৃতই তাঁর (প্রজাপতির) সেই দুই বাহু, তাঁরা (ইন্দ্র ও অগ্নি) তাঁকে (প্রজাপতিকে) তীক্ষ্ণ তেজ ও বলের সঙ্গে যুক্ত করেন। যজমান যখন একান্ত নিকটে বক্ষঃসংলগ্ন সুবর্ণ পুরুষটিকে রিরীক্ষণ করতে করতে হাত দুটি ভূমি স্পর্শ করেন, অধ্বর্যু তখন সেখানে চিহ্নিত করেন এবং সেখানেই স্রুক্-দুটি স্থাপন করেন, কারণ সেটাই বাহুদ্বয়ের স্থান।




অবৈদিকদের প্রশ্নঃ- শতপথ ব্রাহ্মণের ৬/১/১/৪-৬ এ প্রজাপতি ও পুরুষ শব্দে যে জীব বুঝানো হচ্ছে, সেটার মীমাংসা কি হবে?
প্রত্যুত্তরঃ
উক্ত মন্ত্রগুলো কি মনযোগ সহকারে আদৌ কোনোদিন পড়ে দেখেছিলেন? অথবা এর আগের ও পরের মন্ত্র গুলো দেখেছিলেন কোনোদিন? হিন্দি পাতলা বই ও হিন্দি ব্লগ থেকে রেফারেন্স টুকাটুকি বাদ দিয়ে এবার অন্তত একটু শুদ্ধ সংস্কারে স্বাধ্যায় (ফটোসেশান একপাশে রেখে) শুরু করেন।।
উল্লেখিত মন্ত্রগুলোতে প্রজাপতি ও পুরুষ শব্দে পরমেশ্বরকেই বুঝানো হচ্ছে।

শতপথ ব্রাহ্মণের ৬/১/১/১-১০ মন্ত্র গুলো ধারাবাহিকভাবে পঠন, চিন্তন ও মনন করলেই পরিস্কার হয়ে যায় যে, এখানে পুরুষ ও প্রজাপতি শব্দে পরমেশ্বরকেই বুঝানো হয়েছে। কোনদিনও যেহেতু এগুলো খুঁজে বের করে পড়বেন না তাই আমরাই তুলে দিলাম এখানে।
"অসহাঽইদমগ্রঽআসীৎ।
তদাহুঃ কিং তদসদাসীদিত্যৃষয়ো বাব তেঽগ্রেঽসদাসীত্তদাহুঃ কে তঽ ঋষয়ঽ ইতি প্রাণা বাঽঋষয়ন্তে যৎপুরাহস্মাৎ সৰ্ব্বস্মাদিদমিচ্ছস্তঃ শ্রমেশ তপসাঽঽরিষংস্তস্মাদূষয়ঃতপসাঽঽরিষংস্তস্মাদূষয়ঃ।।১।।"
অনুবাদঃ- নিশ্চিতরূপে জগতের সৃষ্টির পূর্বে অসৎই ছিলছিল। এবিষয়ে বলা হয়, 'সেই অসৎটা কী ছিল?' এটা নিশ্চিত যে, ঋষিরাই ছিলেন অসৎ। এপ্রসঙ্গে বলা হয়, এই ঋষিগণ কারা ছিলেন? নিঃসন্দেহে বলা চলে, এই ঋষিবৃন্দ ছিলেন প্রাণবায়ু। বিশ্বশ্রপঞ্চের সৃষ্টির পূর্বে, এটির কামনায় তাঁরা শ্রম ও তপস্যার দ্বারা নিজেদের আচ্ছাদন করেছিলেন। এজন্য তাঁদের বলা হয় 'ঋষি'॥১॥


উক্ত প্রথম মন্ত্রে সৃষ্টির পূর্বের কথা বলা হচ্ছে। তখন কেবল প্রাণ বায়ু রূপী ঋষিগণই অবস্থান করছিলেন। (অসৎ - শব্দটি শ্রুতিতে নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে অসৎ বলতে প্রাণবায়ু - সদৃশ ঋষিদের বুঝানো হয়েছে।)
"স যোঽয়ং মধ্যে প্রাণঃ।
এস ঽএবেন্দ্রস্তানেয় প্রাণান্মধ্যত
ঽইন্দ্রিয়েণৈ যদৈন্দ্ধ তন্মাদিগ্ধ ঽইন্ধো হ বৈ তমিন্দ্রঽইত্যাচক্ষতে পরোঽক্ষং পরোঽক্ষকামা হি দেবান্ত ঽইদ্ধাঃ সপ্ত নানা পুরুষানসৃজন্ত ৷৷২ ৷৷"
অনুবাদঃ- এই মধ্যবর্তী যে প্রাণবায়ু নিঃসন্দেহে তিনিই ইন্দ্র। তিনি তাঁর শক্তি বা ইন্দ্রিয় দ্বারা মধ্যস্থান থেকে অন্যান্য প্রাণবায়ুগুলোকে উদ্দীপ্ত করেন। যেহেতু তিনি উদ্দীপ্ত করেন, সেজন্য তিনি অবশ্যই উদ্দীপ্তকারী (ইন্ধ)। এরূপ ইন্ধন - সম্বন্ধের জন্য তিনি পরোক্ষভাবে ইন্দ্র নামে অভিহিত। কেননা, দেবগণ পরোক্ষপ্রিয়। উদ্দীপ্ত প্রাণবায়ুসমূহ সপ্তবিধ অর্থাৎ নানা প্রকারের পুরুষ শরীর সৃজন করলো॥২॥
"তেহবন্ ৷
ন বা ঽইত্থং সন্তঃ শক্ষ্যাম প্রজনয়িতুপ্রজনয়িতুমিমানৎ্সপ্ত পুরুষানেকং পুরুষং করবামেতি তঽ এতানৎসপ্ত পুরুষানেকং পুরুষমকুর্বন্যাদৃধ্বং নাভেস্তেী দ্বৌ সমৌবজন্যদবাঙনাভেস্তৌ দ্বৌ পক্ষঃ পুরুষঃ পক্ষঃ পুরুষঃ প্রতিষ্ঠৈকঽ আসীৎ ৷৷৩ ৷৷"
অনুবাদঃ- এই ইন্দ্রিয়গণ ( অধিগণ ) নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেন- সপ্তশরীরের দ্বারা আমরা। প্রজননে সমর্থ হবো না। অতএব এই সাতটি পুরুষকে একটি পুরুষে পরিণত করবো। তাঁরা দুটো শরীরকে চাপ দিয়ে নাভির উপরের অংশে পরিণত করলো, অপর দুটো শরীরকে চাপ দিয়ে নাভির নিম্নভাগে পরিণত করলো। অন্য একটি পুরুষ -শরীরে চাপ দিয়ে একটি পার্শ্ব এবং অপর একটি পুরুষকে আরেকটি পার্শ্বে পরিণত করলো। অবশিষ্ট পুরুষ - শরীরকে প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ পদযুগলরূপে পরিণত করলো ॥৩ ॥


ঐ সপ্তপুরুষের মধ্যে যে শ্রী (ঐশ্বর্য), যে রস (সার) নিহিত ছিল তা ঊর্ধ্বে অভিনিবিষ্ট হয়ে (নবোৎপন্ন) পুরুষের মস্তকে পরিণত হলো। যেহেতু 'শ্রী'তে অভিনিবেশের ফলে মস্তকের উদ্ভব হয়েছিল এজন্য মস্তককে বলা হয় 'শিরঃ' । যেহেতু মস্তকভাগে শ্বাস-প্রশ্বাসের আশ্রয়স্থল (শ্রী) এজন্যও মস্তককে ‘শির' বলা হয়। যেহেতু শ্বাস - প্রশ্বাসের ইন্দ্রিয়দ্বয় মস্তকে অবস্থান করে চমৎকার ক্রিয়া সম্পাদন করে সেজন্যও মস্তককে শ্রী (শির) বলা হয়ে থাকে। আবার শ্রীরূপা প্রাণবায়ু সমস্ত দেহে পরিব্যাপ্ত এজন্য একে শরীর বলা হয়।।৬/১/১/৪।।
(সপ্ত পুরুষ থেকে রূপান্তরিত) এই এক পুরুষই হলেন প্রজাপতি এবং সেই যে পুরুষ প্রজাপতি হয়েছিলেন তিনিই হবেন এই চীয়মান অগ্নি।।৬/১/১/৫।।
এই পুরুষ (প্রজাপতি) সপ্ত পুরুষেরই সমন্বিতরূপ। চীয়মান অগ্নিও সপ্তপুরুষাত্মক হন, অবগত থাকার জন্য বলা যায়, চারজনের দ্বারা শরীর এবং তিনজনের দ্বারা পক্ষ ও পুচ্ছ; ঐ প্রথম পুরুষের (চীয়মান অগ্নির) শরীর সংগঠিত হয়েছে চার আত্মার পরিণামেপরিণামে, পক্ষ ও পুচ্ছ সংগঠিত হয়েছে তিন আত্মার পরিনামে। বিবেচনা অনুসারে বলা যায়, সেই পুরুষ (অগ্নি) তার অবয়বকে অধিকতর বৃদ্ধি করার প্রবেগে স্বীয় আত্মশক্তিতে পক্ষ ও পুচ্ছকে তুলে ধরেন॥৬/১/১/৬॥


চীয়মান অগ্নি (ইষ্টকনির্মিত) বেদিতে সংস্থাপিত হন। সপ্তপুরুষের যা কিছু ঐশ্বর্য (শ্রী) এবং যা কিছু সার বস্তু (রস) তা ঊর্ধ্বে অভিনিবিষ্ট হওয়ার পরিণামে চীয়মান অগ্নির মস্তক স্বরূপ হলো। ঐ একই মস্তকে অন্যান্য দেবতাগণও আশ্রিত হলেন। কেননা, ওখানেই সকল দেবতাদের উদ্দেশে আহতি প্রদান করা হয়, এজন্যই ঐ মস্তক 'শিরঃ' (অর্থাৎ সর্বোচ্চ)॥৬/১/১/৭॥

৬/১/১/২ থেকে ৬/১/১/৭ এ দেখা যাচ্ছে সৃষ্টির পূর্বে পাঁচটি পুরুষ শরীর তৈরী হল। সেই পাঁচটি পুরুষ শরীর মিলিত হয়ে একটি শরীর উৎপন্ন হল, যাঁকে প্রাজাপতি বলা হচ্ছে। এখানেও সেই পুরুষকে অগ্নি বলা হচ্ছে। এখানে সৃষ্টির পূর্বের অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে তাই এখানে পুরুষ ও প্রজাপতি শব্দে কোনো জীব বা মানুষ হওয়া সম্ভব নয়। পরবর্তী মন্ত্র গুলো দেখলে আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, এই প্রজাপতি মূলত পরমেশ্বরই।

এখানে একটি লক্ষণীয় বিষয়, সেই পুরুষের স্বরূপের প্রতীকী ভাবে যজ্ঞ বেদি সহ যজ্ঞাগ্নির বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং যজ্ঞ বেদিতে যজ্ঞ করা মূলত বিগ্রহ উপাসনার মতই প্রতীক উপাসনা। বিগ্রহ পূজার ক্ষেত্রে মূর্তি হচ্ছে পরমেশ্বরের প্রতীক এবং যজ্ঞের ক্ষেত্রে যজ্ঞবেদি ও অগ্নি হচ্ছে পরমেশ্বরের প্রতীক।

"এই প্রজাপতি - পুরুষ ইচ্ছা করলেন— 'আমি বহু হব, আমি পুনরায় উৎপন্ন হব, তিনি শ্রম করলেন, তপস্যাপরায়ণ হলেন। শ্রম ও তপস্যায় ভ্রান্ত হয়ে তিনি প্রথমেই সৃষ্টি করলেন ব্রহ্মকে এবং ত্রয়ী বিদ্যাকে। এটি তাঁর কাছে হলো প্রতিষ্ঠাস্বরূপ; সুতরাং তাঁরা (ঋষিগণ) বলেন— 'ব্রহ্মই (বেদ) হচ্ছে এখানে (বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে) সবকিছুর প্রতিষ্ঠা।' অতএব বেদ অধ্যয়ন করে যে - কেউ দণ্ডায়মান হতে পারে প্রতিষ্ঠায়; এজন্য বলতে গেলে বলতে হয়, এরূপ লোকের ক্ষেত্রে বেদ-ই হচ্ছে প্রতিষ্ঠা। এরূপ প্রতিষ্ঠায় স্থিত হয়ে তিনি পুনরায় তপস্যায় রত হন॥৬/১/১/৮॥"
(মন্ত্রে 'ব্রহ্ম' শব্দের অর্থ বেদ। 'ত্রয়ী' অর্থাৎ ঋক্, যজুঃ এবং সাম বেদ)


এই মন্ত্রে বলা হচ্ছে সেই প্রজাপতি এক হতে বহু হবেন ইচ্ছা করলেন, তারপর প্রজাপতি থেকে ত্রয়ী বিদ্যা তথা বেদ উৎপন্ন হল। এখানে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে এই প্রজাপতি কে। আমরা জানি পরমেশ্বর হতেই বেদের উৎপত্তি। এখন কি অবৈদিক যুবারা এখানে প্রজাপতিকে মানুষ দাবী করবে? তাহলে কি তারা বলতে চাইছে যে বেদ মানুষের সৃষ্ট গ্রন্থ?
আসলে আগে ও পরের মন্ত্র বিশ্লেষণ না করে হিন্দি পাতলা বই থেকে মন্ত্রের কেবল খণ্ডিতাংশ টুকে নিলে মন্ত্রের মূল অর্থের ধারেকাছেও যাওয়া সম্ভব নয়।।
পরের মন্ত্রে বলা হচ্ছে,
"তিনি (প্রজাপতি) বাক্ (শব্দ) থেকে লোক (পৃথিবী) থেকে সৃষ্টি করলেন জলরাশিকে। বাক্ তাঁর (প্রজাপতির) মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত ছিল; এটিকে উৎপন্ন করলেন অর্থাৎ বিমুক্ত করলেন। এটি এখানে (সৃষ্টি মধ্যে) সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত হলো সেজন্য একে বলা হয় 'আপঃ' (আপ) এবং যেহেতু এটি আবৃত (বর্) করে এজন্যও একে বলা হয় জল (বারি)॥৬/১/১/৯॥"
তিনি ইচ্ছা করলেন– “আমি পুনরায় উৎপন্ন হবো জলরাশি থেকে। তিনি জলে প্রবেশ করলেন সেই বিদ্যাত্রয়ের সাথে। সেখান থেকে উত্থিত হলো একটি ডিম্ব। তিনি এটিকে স্পর্শ করলেন। তিনি এরূপ বললেন— 'এটি বিদ্যামান হোক, এটি অবস্থিত হোক, এর সংখ্যা বৃদ্ধি হোক।' এটি (ডিম্বটি) থেকে প্রথমে সৃষ্টি হলো ব্রহ্মশ্রয়ী বিদ্যার। এজন্যে তাঁরা (ঋষিগণ বলেন সবার পূর্বে ব্রহ্মের উৎপত্তি। এমনকি সেই পুরুষের (প্রজাপতির) ও পূর্বে ব্রহ্মের সৃষ্টি। এর সৃষ্টি হয়েছিল তার মুখের মতো। সুতরাং তাঁরা (ঋষিগণ) বলেন, তার সম্বন্ধে যে যিনি বেদ অধ্যয়ন করেছেন, যে তিনি অগ্নির মতো; যেহেতু ব্রহ্ম (বেদ) হচ্ছেন অগ্নির মুখ।। ৬/১/১/১০।।


উল্লেখিত দু'টি মন্ত্রে (৬/১/১/৯-১০) বলা হচ্ছে সেই প্রজাপতি থকে জল ও পৃথিবী উৎপন্ন হল। পরমেশ্বর থেকেই সৃষ্টির শুরুতে সব উৎপন্ন হয়েছে। তাই এখানে প্রজাপতি ও পুরুষ শব্দে পরমেশ্বরকেই বুঝানো হচ্ছে, মানুষকে নয়।
মজার বিষয় হল এখানে পরমেশ্বরের সাকার রূপ গ্রহনের বিষয়টা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ এখান থেকে এটাও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে প্রজাপতি তথা পরমেশ্বর সৃষ্টির পূর্বে সাকার রূপ ধারণ করেন। অবৈদিকদের মূল সমস্যা আসলে ঈশ্বরের সাকার রূপ প্রমাণিত হওয়ায় যেহেতু তারা অসত্য প্রকাশ্যে আপোষহীন হয়ে ঈশ্বরের সাকার রূপকে মেনে নিতে পারেন না।

অবৈদিকদের প্রশ্নঃ- তাহলে পুরুষটি যদি পরমেশ্বরই হবে তাহলে শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/২/১ এ সেই মূর্তিটিকে মাটি চাপা দেওয়া হল কেন ? আবার ৭/৪/২/৯ এ কেন বলা হচ্ছে পুরুষ অন্ন ও প্রাণের দ্বারা বাধাগ্রস্থ হয় না? তার উপর ৭/৪/২/১০ এ পশু রূপী ইট রাখা হচ্ছে কেন?
প্রত্যুত্তরঃ
আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি বরাবরই নিচু মানের। আপনাদের না আছে শুদ্ধ সংস্কারে পঠনের অভ্যাস, না আছে চিন্তনের অভ্যাস এবং না আছে মননের অভ্যাস তাই আপনাদের স্থুল মস্তিষ্কে এখানে শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/২/১ মন্ত্রে আপনাদের নিকট মাটির নিচে চাপা দেওয়া মনে হচ্ছে।

অথচ এখানে শতপথ ব্রাহ্মণে স্পষ্ট করেই বলা হচ্ছে স্বয়মাতৃণ্ণা ইষ্টক হচ্ছে পৃথিবী ও প্রাণ স্বরূপ। সুতরাং স্বয়মাতৃণ্ণা ইষ্টক টি পুরুষের উপরে রাখা হচ্ছে বলতে বুঝানো হচ্ছে এই ভূমণ্ডলকে প্রজাপতি ধারণ করে আছেন।
এই ইষ্টক স্থাপন মূলত যজ্ঞ বেদি নির্মাণের জন্য। পুরুষ মূর্তির উপর যজ্ঞ বেদি তৈরি করার তাৎপর্য এই যে, পুরুষ যেভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধারণ করে থাকেন(বেদের পুরুষ সূক্তে ও হিরণ্যগর্ভ সূক্তে) , সেরূপ ভাবে এই স্বর্ণের পুরুষ যজ্ঞ বেদিকে ধারণ করে আছেন।

"স্বয়মাতৃণ্ণামুপদধাতি।
ইয়ং বৈ স্বয়মাতৃণ্ণেমামেবৈতদুপদধাতি ও তামনন্তৰ্হিতাং পুরুষাদুপদধাত্যন্নং বৈ স্বয়মাতৃণ্ণেয়ং বৈ স্বয়মাতৃণ্ণেয়মু বাহঅ্যামস্যাং হি সর্ব্বময়, পঢ়াতেহনস্তুহিতমেব্যস্মাদেতদাং দধ্যত্যুত্তরামুত্তরমেধাম্মাদেতদন্নং দধাতি ॥"
শ০প০ ৭/৪/২/১॥

অনুবাদ: তিনি (সুবর্ণপুরুষটির) উপর একটি স্বয়মাতৃণ্ণা (স্বাভাবিক গর্তযুক্ত) ইষ্টক স্থাপন করেন এই (স্বাভাবিক গর্তযুক্ত) স্বয়মাতৃণ্ণা এই পৃথিবীস্বরূপ, তিনি এর দ্বারা পৃথিবীকেই সেখানে স্থাপন করেন। তিনি পুরুষটির থেকে অবিযুক্তভাবে তাকে স্থাপন করেন; কারণ, স্বয়মাতৃণ্ণা অন্নই এবং স্বয়মাতৃণ্ণা এই পৃথিবী—এই পৃথিবী অন্নসম, কারণ, পৃথিবী বা ভূমিতেই সকল অন্ন পর হয়। তিনি এইভাবে অন্নকে পুরুষটির (অগ্নির) নিকটে স্থাপন করেন (পুরুষটির) উপর তিনি (অন্নরূপ) স্বয়মাতৃণ্ণাকে স্থাপন করেন; এইভাবে তিনি পুরুষের উপর অন্নকে স্থাপন করেন ॥শ০প০ ৭/৪/২/১॥

"তাং বৈ প্রজাপতিনোপদধাতি প্রজাপতির্হ্যেতৈৎস্বয়ত্মানঃ প্রত্যধত্ত ধ্রুবাহসীতি স্থিরাঽসীতোতদথো প্রতিষ্ঠিতাহসীতি ধরুণেতি প্রতিষ্ঠা বৈ ধরুণমাস্তৃতা বিশ্বকর্মপেতি প্রজাপতির্বৈ বিশ্বকর্মা তেনাস্তৃতাসীতোতন্মা ত্বা সমুদ্র হউদ্বধীষ্মা সুপর্ণ হইতি রুক্মো বৈ সমুদ্র পুরুষঃ সুপর্ণস্তৌ ত্বা মোদ্বধিষ্টামিতোতদব্যথমানা পৃথিবীং দংহেতি যথৈব যজুস্তথা বন্ধুঃ ||" শ০প০ ৭/৪/২/৫||

অনুবাদ: তিনি প্রজাপতির দ্বারা তাকে স্থাপিত করেন, কারণ, প্রজাপতি সেভাবে (সেই সময়) তাঁর দেহের ভিত্তিভূমি (প্রতিষ্ঠা)কে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন (এই মন্ত্র দ্বারা) – (হে পাষাণময়ী ইষ্টকা) ‘তুমি স্থির' অর্থাৎ তুমি দৃঢ় বা ভূমি প্রতিষ্ঠিত। তুমি ধাবক কারণ, যা ধারণ করে তা-ই প্রতিষ্ঠা। 'বিশ্বকর্মার দ্বারা তুমি স্থাপিত' বিশ্বকর্মন প্রজাপতিই, অতএব প্রজাপতির দ্বারাই তুমি প্রতিষ্ঠিত। সমুদ্র ও পক্ষী তোমার যেন বিনাশ না করে সমুদ্র অবশ্যই সুবর্ণ মণ্ডল বা বেকান, এবং পক্ষী (বা সুপর্ণ) হলো মনুষ্য, অতএব এই দুই যেন তোমায় বিনাশ না করে। “তুমি নিশ্চল থেকে পৃথিবীকে দৃঢ় কর''---যেমন মূল অংশ তেমনি তার বাখ্যান।

প্রজাপতিষ্ট্বা সাদয়স্থিতি। প্রজাপতির্হ্যেতাং প্রথমাঃ চিত্তিমপশ্যদপাং পৃষ্ঠে সমুদ্রস্যেমন্নিত্যপাং হীয়ং পৃষ্ট; সমুদ্রস্য হীয়নেনা ব্ব্যচস্বতীং প্রথস্বতীমিতি ব্বাচস্বতী চ হীয়ং;প্রথমতী চ প্রথস্ব পৃথিব্যসীতি প্রথস্ব পৃথিবী চাসীত্যেতৎ ॥
শ০প০ ৭/৪/২/৬

অনুবাদ: (অপর মন্ত্র)— 'প্রজাপতি তোমাকে স্থাপন করুন। কারণ, প্রজাপতি এই প্রথম চিতি (প্রথম স্তব) দর্শন করেছিলেন "জলের উপর, সমুদ্রের অবস্থানে জলের উপর বলতে এই পৃথিবী এবং সমুদ্রের অবস্থানে এই পৃথিবী। "বিস্তৃতিযুক্তা ও বিশালাকৃতি তোমাকে। কারণ, এই পৃথিবী একইসঙ্গে বিস্তৃতিযুক্তা ও বিশালাকৃতি, 'তুমি বিস্তৃতিযুক্তা হও, তুমি বিস্তাবিতা পৃথ্বী ॥শ০প০ ৭/৪/২/৬

এরপর শ০প০ ৭/৪/২/১০ এ বলা হচ্ছে,

"অথ দূৰ্ব্বেষ্টকামুপদধাতি৷ পশবো বৈ দূৰ্ব্বেষ্টকা পশুনেবৈতদুপদধাতি তদ্যৈরদো হগ্নিরনন্তর্হিতৈঃ পশুভিরপৈত্তহএতে তানেবৈতদুপদধাতি তামনস্তৰ্হিতাং স্বয়মাতৃণ্ণায়া হউপদধাতীয়ং বৈ স্বয়মাতৃণ্ণাহনন্তৰ্হিতাংস্তদস্যৈ পশুন্দধাত্যুত্তরামুক্তরাংস্তদস্যৈ পশূন্দপাতি ৷৷১০৷৷"
অনুবাদ: অনন্তব তিনি দুর্বা নামক ইষ্টককে উপস্থাপিত করেন। দুর্বেষ্টিক পশুই; পশুর সঙ্গেই তিনি তাকে উপহিত করেন। এই পশুগুলি সেই মানের সঙ্গে অগ্নি পূর্বে সেই সময় আগমন করেছিলেন, সেই তাদেরই তিনি এখন সেখানে স্থাপন করেন। তিনি তাদের স্বয়মাতৃণ্ণা উপরেই অবিযুক্তভাবে স্থাপন করেন,স্বীয়মাতৃণ্ণা (ইষ্টক) এই পৃথিবীরূপাই, অতএব তিনি পশুগণকে পৃথিবীর উপরেই অবিযুক্তভাবে স্থাপন করেন। (স্বীয়মাতৃণ্ণা) উপরেই তিনি স্থাপন করেন। এইভাবেই তিনি এই পৃথিবীর উপরে পশুগণকে স্থাপন করেন ।১০।

এখানে স্পষ্ট ভাবেই বলা হচ্ছে দূর্বা ইষ্টক হচ্ছে পশু, সকল পশু পৃথিবী পৃষ্ঠে থাকে অর্থাৎ পৃথিবীর উপর অবস্থান করে তাই পশু সদৃশ দূর্বা ইষ্টক টি পৃথিবী স্বরূপ স্বয়মাতৃণ্ণা ইষ্টকের উপর রাখা হয়।
শ০প০ ৭/৪/২/৯ এ বলা হচ্ছে,

"তদাহুঃ।
কথমেষ পুরুষঃ স্বয়মাতৃণ্ণাহনভিনিহিতো ভবতীত্যন্নং বৈ স্বয়মাতৃণ্ণা প্রাণঃ স্বল্পমাতৃষ্ণাঽনভিনিহিতো বৈ পুরুষোহন্নেন চ প্রাণেন চ ৷৷"
অনুবাদ: সে বিষয়ে তাঁরা বলেন, কীভাবে সেই হিরণ্মষ পুরুষ স্বয়মাতৃণ্ণা (ইষ্টকের) দ্বারা বিঘ্নগ্রস্ত হয় না?' (সে বিষয়ে উত্তর –) স্বয়মাতৃণ্ণা (ইষ্টক) প্রকৃতপক্ষে অন্ন ও প্রাণ; এবং মানুষ কখনো অন্ন বা প্রাণের দ্বারা বিঘ্নগ্রস্ত হয় না ।।

এখানে পুরুষঃ সেই পুরুষের অর্থাৎ ঈশ্বরের বিগ্রহের কথা এবং পুরুষোহন্নেন এর পুরুষ শব্দে যজ্ঞকারী মানুষের কথা বলা হচ্ছে।(মানব যজমান ও আদি যজমান পরমেশ্বর সম্পর্কে বিস্তারিত পরের পয়েন্টে)

এর তাৎপর্য এই যে, যজ্ঞকারী সেই পুরুষ বিগ্রহকে ইষ্টকের নিচে রাখায় কি তার কোন অপরাধ হচ্ছে কিনা, যেহেতু পুরুষ মূর্তিটি পরমেশ্বরের মূর্তি এবং তাঁকে যজ্ঞবেদির নিচে রাখা হচ্ছে। যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে মুক্তিআদিতে বিঘ্ন ঘটে কিনা?
তার উত্তরে বলা হচ্ছে, না এখানে পুরুষকে স্বয়মাতৃণ্ণা রূপী অন্ন ও প্রাণ নিবেদ করা হচ্ছে পুরুষের উদ্দেশ্যে। এখানে কোন অপরাধ ঘটে না। অন্ন ও প্রাণ পরমেশ্বেরকে নিবেদন করলে সেই অন্ন ও প্রাণ কখনোই নিবেদনকারী ব্যক্তির মুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।

অবৈদিকদের প্রশ্নঃ শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/২/১৬ মন্ত্রে যে হিরণ্য পুরুষটিকে যজমানের দৈবরূপ বলা হচ্ছে তার ব্যাখ্যা কি?
প্রত্যুত্তরঃ
উত্তর দেওয়ার পূর্বে জানিয়ে নেই উক্ত বক্তব্যটি শ০প০ ৭/৪/২/১৬ তে নয়, শ০প০৭/৪/২/১৭ তে করা হয়েছে। আপনাদের যে আসলেই শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা নেই বরং হিন্দি পাতলা বই টুকে নয়-ছয় খণ্ডন বানান সেটা বারবার প্রমাণিত হয়। আপনাদের কাছে বিনীত অনুরোধ যে ফটোসেশানের বাইরে এসে একটু যথাযথ স্বাধ্যায় করবেন অন্যথায় আপনাদের যেকোন দাবীর প্রত্যুত্তর দেওয়াও আমাদের জন্য বিব্রতকর (যেমন সুভাষবাহিনীর সাথে আমরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হই না) হবে।

শতপথ ব্রাহ্মণের ৭/৪/২/১৬ মন্ত্রে বলা হচ্ছে,
"অথ দ্বিযজুষমুপদধাতি।
ইন্দ্ৰাগ্নিহঅকাময়েতাং স্বর্গং লোকমিয়াবেতি তাবেতামিষ্টকামপশ্যতাং দ্বিযজুষমিমামেব তামুপাদধাতাং তামুপধারাস্যৈ প্রতিষ্ঠায়ৈ স্বর্গং লোকমৈতাং তথৈবৈতদ্যজমানো যদ্বিযজুষমুপদধাতি যেন রূপেণ যৎকর্ম কৃত্বেন্দ্রাগ্নী স্বর্গং লোকমৈতাং তেন রূপেণ তৎকর্ম কৃত্বা স্বর্গং লোকময়ানীতি সা যদ্ দ্বিযজুর্নাম দ্বে হ্যেতাং দেবতে হঅপশ্যতাং যদ্বেব দ্বিযজুষমুপদধাতি যজমানো বৈ দ্বিযজুঃ।।"

অনুবাদ: তারপর তিনি একটি দ্বিযজুস্-ইষ্টক স্থাপন করেন। ইন্দ্র এবং অগ্নি কামনা করেছিলেন, 'আমরা স্বর্গলোকে গমন করব। তারা সেই দ্বিযজুস্(ইষ্টক) দেখেছিলেন যা এই পৃথিবীর সমতুল, তাঁরা তাকে স্থাপন করেছিলেন, তাকে স্থাপন করে তাঁরা সেই প্রতিষ্ঠা থেকে স্বর্গলোকে গমন করেছিলেন। সেইভাবেই এই যজমান যখন দ্বিযজুস্-ইষ্টক স্থাপন করেন তিনি এইরূপ মনে করেন, “আমি সেইভাবেই, সেই কর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা স্বৰ্গলোকে যেতে চাই, যে কর্ম দ্বারা ইন্দ্র ও অগ্নি স্বর্গলোকে গমন করেছিলেন। একে দ্বিযজুস্ বলা হয় কারণ, দুই দেবতা এটিকে দেখেছিলেন। আর তিনি যে একটি দ্বিযজুস্(ইষ্টক) স্থাপন করেন তার কারণ, দ্বিযজুস্ অবশ্যই যজমানস্বরূপ ॥১৬।।
তারপর শ০প০৭/৪/২/১৭,
"তদাহুঃ।
যদসাবেব যজমানো যোহসৌ হিরণ্ময়ঃ পুরুষোহথ কতমদস্যেদং রূপমিতি দৈবো বাহাসা বাহঅস্য মনুষোহয়ং তদ্যৎস হিরণ্ময়ো ভবত্যমৃতং বাহঅস্য তদ্রূপং দেবরূপমমৃতং হিরণ্যমথ যদিয়ং মৃদঃ কৃতা ভবতি মানুষং হাস্যেদং রূপম্ ৷৷"
অনুবাদ: এবিষয়ে তাঁরা (যাজ্ঞিকগণ) বলেন, 'যদি এই দ্বিযজুস্ই যজমান তাহলে যিনি সেই হিরণ্ময় পুরুষ তিনি কে, কোন্‌টি তাঁর (যজমানের) আসল রূপ?' সেই হিরন্ময় পুরুষ তাঁর দৈব রূপ এবং এই (ইষ্টক) তাঁর মনুষ্যরূপ; সেই যে হিরণ্ময় পুরুষ সেই তাঁর অমৃত রূপ, তাঁর দৈবমূর্তি, কারণ হিরণ্য অমৃতস্বরূপ। আর এই যে ইষ্টক-টি, এটি মৃত্তিকানির্মিত, একারণে এটি তাঁর মানবীয় রূপ।
যজ্ঞের উৎপত্তি পরমেশ্বর থেকেই এবং তিনি নিজে যজমানও। শতপথ ব্রাহ্মণ ১/৭/১/১২ তে বলা হচ্ছে, "যজ্ঞ বৈ বিষ্ণু" , অর্থাৎ বিষ্ণুই যজ্ঞ। আবার ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ১/৫/২ এ বলা হচ্ছে, "যজমান বৈ যজ্ঞঃ", অর্থাৎ যজমানই যজ্ঞ। এক্ষেত্রে এখানে যজমান ব্রহ্ম। এখানে যজমানের দৈবরূপ বলতে সেই পরমব্রহ্ম পরমেশ্বরকেই বুঝানো হচ্ছে।
আবার যজমানের মানুষী রূপ দিয়ে এখানে যে ব্যক্তি এখন যজ্ঞ করছে তাকে বুঝানো হচ্ছে। তিনি যজ্ঞ করছেন বলে তিনিও যজমান। "যদ্‌ যজতে তদ্‌ যজমান" শ০প০-৩/২/১/১৭ অর্থাৎ, যে যজ্ঞ করে সেই যজমান।
যজ্ঞের আদি যজমান পরমব্রহ্মই। আর এই জড়জগতে কেও যখন সেই পরমেশ্বর থেকে জাত যজ্ঞ কার্য সম্পাদন করেন তখন তিনিও যজমান হন। শ্রীমদভগবদগীতায়ও বলা হয়েছে পরমেশ্বর যজ্ঞসহ প্রজা সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ তিনিই যজমান।
জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ।

গীতা ১৫/৭ এ বলা হচ্ছে,
"মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ৷
মনঃষষ্ঠানীন্দ্রিয়াণি প্রকৃতিস্থানি কর্ষতি৷৷"
অর্থ: এই জড় জগতে বদ্ধ জীবসমূহ আমার সনাতন বিভিন্ন অংশ। জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলে তারা মন সহ ছয়টি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রকৃতির রুপ ক্ষেত্রে কঠোর সংগ্রাম করছে।
আবার পরমাত্মা যেহেতু জীবাত্মারও আত্মা, জীবাত্মা যেহেতু পরামত্মার অংশ। এখানে সেই অংশ অংশীর সম্পর্কের ন্যায় সম্পর্ক বুঝিয়ে দুই যজমানের একত্ত্বতা এবং ভিন্নতা দুইই ইঙ্গিত করছে। পঠনের পর একাগ্রচিত্তে চিন্তন ও মনন করলেই বিষয়টা পরিস্কার হয়। কিন্তু স্বাধ্যায়হীন অবৈদিকদের পক্ষে এগুলো উপলব্ধি করা প্রায় অসম্ভব।
এই পুরুষ বিগ্রহ মূলত পরমাত্মার প্রতীক তিনি আদি যজমান। আর দ্বিযজুস্-ইষ্টক মানুষ যজমান যিনি যজ্ঞবেদি নির্মাণ করে যজ্ঞ করছেন।
তারপর শ০প০৭/৪/২/১৮,
স যদমূমেবোপদধ্যাং।
নেমামপশিংষ্যাৎক্ষিপ্রে হাস্মাল্লোকাদ্যজমানঃ প্রেয়াদথ যদিমামপশিনষ্টি যদেবাস্যেদং মানুষং রূপং তদস্যৈতদপশিনষ্টি তথো তথো হানেনাত্মনা সৰ্ব্বমায়ুরেতি ৷৷
অনুবাদ: এখন তিনি যদি কেবলমাত্র সেই হিরন্ময় পুরুষকে স্থাপন করেন এবং এই দ্বিযজুস্ (ইষ্টক) না রাখেন তাহলে যজমান অবশ্যই ইহলোক থেকে শীঘ্র বিদায় নেবেন; কিন্তু তিনি যখন এই ইষ্টকটি সেখানে রাখেন, তিনি তার দ্বারা তাঁর মানবীয় রূপটি সেখানে রেখে দেন এবং সেই কারণে তিনি তাঁর পার্থিব শরীরে পূর্ণ আয়ুষ্কাল লাভ করেন ৷৷১৮৷৷
এখানে তাৎপর্য এই যে, যেহেতু দ্বিযজুস্-ইষ্টক হচ্ছেন বেদিনির্মাণকারী যজ্ঞকারী যজমানের (মানুষ) প্রতীক সেহেতু এই ইষ্টক টি না রাখলে যজমান আর সেখানে থাকবেন না। অর্থাৎ দেহ ত্যাগ করবেন।
তারপর শ০প০৭/৪/২/১৮,
"স যন্নানুপদধ্যাৎ।
ন হৈত দৈবমাত্মানমনুপ্রজানীয়াদথ যদনূপদধাতি তথো হৈতং দৈবমাত্মানমনুপ্রজানাতি তামনন্তৰ্হিতাং দূৰ্ব্বেষ্টকায়া হউপদধাতি পাবো বৈ দূৰ্ব্বেষ্টকা যজমানং তৎপশুষু প্ৰতিষ্ঠাপয়তি।।"
অনুবাদ:আর যদি তিনি (হিরন্ময় পুরুষকে স্থাপনের) পশ্চাৎ এই দ্বিযজুস্-ইষ্টক স্থাপিত না করেন তাহলে তিনি অবশ্যই পরবর্তী সময়ে সেই দৈব রূপের সন্ধান পাবেন না। কিন্তু এখন যখন তিনি তারপর দ্বিযজুস্-ইষ্টকটি স্থাপন করেন তখন তিনি পরবর্তী সময়ে সেই দৈব আকৃতিকে অবশ্যই খুঁজে পান। তিনি দূর্বা-ইষ্টকের নিকটেই তাকে স্থাপন করেন; দূর্বা-ইষ্টক পশুস্বরূপ হওয়ায় তিনি এইভাবে যজমানকে পশুদের মধ্যে স্থাপন করেন।
এখানে তাৎপর্য এই যে, যেহেতু হিরণ্য পুরুষ পরমব্রহ্ম ও দৈব যজমান, সেহেতু যজ্ঞকারী যদি হিরণ্য পুরুষ মূর্তিটি না শুধু দ্বিযজুস্-ইষ্টক রাখেন তাহলে তিনি আর দৈব রূপের সন্ধান পাবেন না অর্থাৎ তার ব্রহ্মপ্রাপ্তি ঘটবে না।

উপসংহারঃ
শাস্ত্রে বলা আছে,
"আচার্যবান পুরুষো বেদ" (ছা০ উ০ ৬/১৪/২) অর্থাৎ , পরম্পরাজ্ঞ কর্তৃক উপদিষ্ট পুরুষ আত্মাকে জানতে পারেন।
"আচার্যাদ্ধৈব বিদ্যা বিদিতা সধিষ্টং প্রাপৎ" (ছা০ উ০ ৪/৯/৩) অর্থাৎ, পরম্পরাজ্ঞের নিকট হইতে বিজ্ঞাত বিদ্যাই কল্যাণতম হইয়া থাকে।
শ্রীমদভগবদগীতায়ও বলা হয়েছে,
"তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া৷
উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ৷৷৪/৩৪।।
অর্থ: সদগুরু শরণাগত হয়ে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার চেষ্টা কর। বিনম্র চিত্তে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কর এবং অকৃত্রিম সেবার দ্বারা তাকে সন্তুষ্ট কর তা হলে সেই তত্ত্বদ্রষ্টা পুরুষ তোমাকে জ্ঞান উপদেশ দান করবে।
"নিজশক্তিব্যুৎপত্তা ব্যবচ্ছিদ্যতে।"
- সাংখ্যপ্রবচণসূত্র - (৫/৪৩)
অনুবাদঃ বেদ অপৌরুষেয় হইলেও তাহাতে (বেদে) যে স্বতঃসিদ্ধা শক্তি বিদ্যমান, সেই শক্তি গুরু-শিষ্য পরম্পরায় ও উপদেশ দানগ্রহণনিয়ম অবলম্বনে ব্যুৎপাদিত হয় ও তাহাতেই ইতর অর্থের ব্যবচ্ছেদ হয়। তদর্থাতিরিক্ত অর্থের বোধ হয় না। মৰ্ম্মার্থ এই যে, অনাদি উপদেশ-পরম্পরায় বেদশব্দের শক্তিগ্রহ হয়।
"ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তবিচচক্ষিরে৷৷" ঈশোপনিষদ-১০।।
অনুবাদঃ এরূপ আমরা সেই ধীর তত্ত্বজ্ঞানী মহাপুরুষগণের নিকট হতে শুনেছি। তাঁরা এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করে আমাদের পৃথক পৃথকরূপে ভালোভাবে বুঝিয়েছেন।৷
সহজেই বোঝা যায় যে এই মন্ত্রে পরম্পরাগত পুরুষের নিকট হতে ব্রহ্মজ্ঞান নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।।
আচার্য শঙ্করও তাঁর এই মন্ত্রের ভাষ্যে লিখেছেন,,
"যে আচাৰ্যা নোঽস্মভ্যং তৎ কর্ম চ জ্ঞানং চ বিচচক্ষিরে ব্যাখ্যাতবস্তুঃ তেষাময়মাগমঃ পারম্পর্যাগত ইত্যর্থঃ"
অর্থাৎ সকল আচার্যগণ আমাদিগকে সেই কর্ম ও জ্ঞান ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন তাঁহাদের এই উপদেশ পরম্পরাক্রমে আগত, ইহাই তাৎপর্য।। একই কথা ঈশোপনিষদের ত্রয়োদশ মন্ত্রেও বলা হয়েছে।।
তাই বৈদিক শাস্ত্রের মত অনুসারে পরম তত্ত্ব জানতে হলে অবশ্যই শুদ্ধ পরম্পরা অনুসারী সৎ গুরুর শরণাগত হয়ে তাঁর কাছ থেকে জানতে হবে। সংস্কারহীন, স্বাধ্যায়হীন, পরম্পরাহীন, পিডিএফবাদী সমাজ তাদের ২০০ বছর আগের এক ব্যক্তিকে উপজীব্য করে (কখনও কখনও ব্যাখ্যা পছন্দ না হলে এরা নিজেদের আচার্যদের ও গুরুর ব্যাখ্যাকেও বিশুদ্ধ করে ফেলে) বেদাদি শাস্ত্রের অসত্য প্রচার করলেই সেগুলো আর ধুপে টিকবে না কারণ SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি এখন থেকে এদের দাঁতভাঙা জবাব দিবে। আমরা হিন্দি পাতলা বই টুকে বা ব্লগ কপি করে খণ্ডনের নামে গরুরচনা করি না তাই প্রত্যুত্তর দিতে স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি সময় নেই৷ তাহাদের তথাকথিত ৮৩ খানা (৯০% অপ্রাসঙ্গিক) রেফারেন্সকে আমরা ৭৫ খানা রেফারেন্স (প্রাসঙ্গিক) দিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলাম। এবার তারা যদি এর প্রত্যুত্তর করতে আসে তবে অবশ্যই যেন যথাযথ স্বাধ্যায় করে সঠিক যুক্তিতর্কে শাস্ত্রের আলোকে রেফারেন্স দেয় নাহলে এদেরকেও সুভাষবাহিনীর মতো ব্রাত্য ধরা হবে।


©শ্রী প্রান্ত সাহা
@SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি

সহযোগিতায়ঃ
  • স্টিমন অনিক 
  • অনিক কুমার সাহা
  • গৌরব চৌধুরি
  • নিলয় সরকার
  • অর্জুন সখা দাস
  • অমিত বর্মন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ