মৎস্য অবতারের বৈদিক প্রামাণিকতা।।


 

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রত্যেকটি বিষয়ই বেদ থেকে আগত। বেদ মহাসমুদ্রের মত জ্ঞানরাশি হওয়ায় আমরা হয়তো উৎসগুলো খুঁজে পাই না। একথা অবিসংবাদিত সত্য যে, বৈদিক সুদৃঢ় ভিত্তির উপরেই রামায়ণ, মহাভারত, অষ্টাদশ পুরাণ এবং স্মৃতিশাস্ত্র সকল সকল সনাতন শাস্ত্র স্থাপিত। যদি কোন শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্তে সংশয় দেখা যায় তবে বেদই তখন একমাত্র প্রমাণ বলে বিবেচ্য। যজ্ঞ, তপস্যা, প্রতিমা পূজা, ঈশ্বরের অবতার সহ সহ বর্তমানের ধর্ম বিশ্বাসের সকল বিষয়ই বেদে পাওয়া যায়। কখনো বৃহৎ আকারে আবার কখনো সংক্ষিপ্ত পরিসরে। ঈশ্বরের অবতার প্রসঙ্গে ঋগ্বেদ সংহিতায় বলা হয়েছে যে, সমস্ত দেবগণের প্রতিনিধিভূত ইন্দ্র বিবিধ মূর্তি ধারণ করেন। পরমেশ্বরের দুষ্ট বিনাশকারী রূপের নাম ইন্দ্র। সেই পরমেশ্বর ইন্দ্র জীবের কল্যাণে অনন্ত রূপ পরিগ্রহ করেন। তিনি অনন্ত রূপ ধারণ করে, এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অনন্তভাবে প্রকাশিত হন। সকল কিছুই তিনি করেন মায়াদ্বারা। তাঁর মায়ায় এ জগত বিমোহিত। তাঁর কোন সুনির্দিষ্ট রূপ নেই। তিনি অনন্ত এবং চিন্তার অতীত। তবে রূপ আছে ভক্তের মানসজগতে।ভক্তের বিপদে, ভক্তের ডাকে, ভক্তের কল্যাণে তিনি ভক্তের মনজগতের রূপকে অবলম্বন করে ভক্তকে রক্ষা করেন। অচিন্ত্য পরমেশ্বর দৃশ্যমান ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে ধরা দেন।কারণ অনন্ত তাঁর শক্তি, অনন্ত তাঁর বৈভব।ঈশ্বরের ভাব, অসীমের মধ্যেও সসীম।প্রয়োজনে ঈশ্বর ডাকেন,আসেন,শরীরে থাকেন জীবের মাঝে।


রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব

তদস্য রূপং প্রতিচক্ষণায় ৷

ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরুরূপ ঈয়তে

যুক্তা হ্যস্য হরয়ঃ শতা দশ৷৷

(ঋগ্বেদ সংহিতা: ৬.৪৭.১৮)


"সমস্ত দেবগণের প্রতিনিধিভূত এ ইন্দ্র বিবিধ মূর্তি ধারণ করেন এবং সে রূপ পরিগ্রহ করে তিনি পৃথকভাবে প্রকাশিত হন।তিনি মায়াদ্বারা বিবিধ রূপ ধারণ করে যজমানগণের নিকট উপস্থিত হন। কারণ সহস্র অশ্ব সংযুক্ত (অনন্ত শক্তি) তাঁর রথ।"


জগতকে জল প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা করায় এ বিষয়টি নিয়েই মৎস্য অবতারের কাহিনী। ভগবান এক বৃহৎ মৎস্যরূপ ধারণ করে জগতকে রক্ষা করেছেন। বেদ, মহাভারত সহ বিভিন্ন পুরাণে মৎস্য অবতারের কাহিনী বর্ণিত হয়েছ। এ বিষয়টি নিয়ে 'মৎস্যপুরাণ' নামে একটি স্বতন্ত্র পুরাণই রয়েছে। শুক্ল যজুর্বেদীয় শতপথ ব্রাহ্মণে মনু এবং মৎস্য অবতারের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। এ থেকে থেকে প্রমাণিত যে, মৎস্য অবতারের কাহিনীর উৎস বৈদিক। মৎস্য অবতারের কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে বেদে 'মাৎস্যন্যায়' বিষয়টির অবতারণা করা হয়েছে। যতক্ষণই ছোট মাছগুলো আকৃতিতে ছোট থাকে, ততক্ষণই বহুবিধ বিপদ। কারণ স্বজাতি হলেও বড় মৎস্যই ছোট মৎস্যকে খেয়ে থাকে। তাই ছোট মৎস্যটিকে প্রথমে আলাদাভাবে কলসিতে পালন করে, এরপরে যেখন সেই মৎস্যটি কিছুটা বড় হয়ে কলসিকে ছাড়িয়ে যাবে তখন খাল বা সমুদ্র সহ কোন বড় জলাধারে মৎস্যটিকে ছেড়ে দিতে হবে। বাংলার ইতিহাসেও এ মাৎস্যন্যায়কে পাওয়া যায়।


মনবে হ বৈ প্রাতঃ। অবনেগ্যমুদকমাজহ্রুর্যথেদং  

পাণিভ্যামবনেজনায়াহরন্ত্যেবং তস্যাবনেনিজানস্য  

মৎস্যঃ পাণী ঽআপেদে ॥

(শতপথ ব্রাহ্মণ: ৮.১.১)


পরিচারকগণ প্রাতঃকালে মনুর নিকটে হাত মুখ ধোওয়ার জন্য জল আনয়ন করে। তিনি যখন ধৌত করছিলেন তখন একটি মাছ তাঁর দুই হাতের মধ্যে এল। 


স হাস্মৈ বাচমুবাদ। বিভৃহি মা পারয়িষ্যামি ত্বেতি  

কস্মান্মা পারয়িষ্যসীত্যৌঘ ঽইমাঃ সর্বাঃ প্রজা

 নির্বোঢ়া ততত্ত্বা পারয়িতাস্মীতি কথং তে ভৃতিরিতি ॥

(শতপথ ব্রাহ্মণ: ৮.১.২)


সেই মাছটি মনুকে বললেন— "আমাকে তুমি ভরণপোষণ কর। পরবর্তীতে আমি তোমাকে উদ্ধার করব।" মনু জিজ্ঞেস করলেন, "কোথা থেকে আমাকে উদ্ধার করবে?" উত্তরে মাছটি বললেন, "এক জলপ্রবাহ এই সকল প্রজাকে (সৃষ্ট প্রাণীকে) নিঃশেষে বহন করে নিয়ে যাবে। সেখান থেকে আমি তোমাকে উদ্ধার করব।" মনু পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, "কিভাবে তোমার ভরণপোষণ করতে হবে?"


স হােবাচ। যাবদ্বৈ ক্ষুল্লকা ভবামাে বহ্বী বৈ নস্তাবন্নাষ্ট্রা  

ভবত্যুত মৎস্য এব মৎস্যং গিলতি কুম্ভ্যাং মাগ্রে  

বিভরাসি স যদা তামতিবর্ধা ঽঅথ কর্ষুং খাত্বা তস্যাং  

মাং বিভরাসি স যদা তামতিবর্ধা ঽঅথ মা  

সমুদ্রমভ্যবহরাসি তৰ্হি বা ঽঅতিনাষ্ট্রো ভবিতাস্মীতি৷৷ 

(শতপথ ব্রাহ্মণ: ৮.১.৩)


মৎস্যটি বললেন, "যতক্ষণ আমরা ক্ষুদ্র থাকি ততক্ষণই আমাদের বহুবিধ বিপদ হয়, এমনকি মৎস্যই মৎস্যকে গিলে ফেলে। অতএব আমাকে প্রথমে কলসীতে আলাদাভাবে পালন কর। যখন আমি কিছুটা বড় হয়ে সেই কলসিকে ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠব, তখন একটি খাল খনন করে আমাকে সেখানে পােষণ করবে। এরপরে যখন সেই খালকেও ছাড়িয়ে অনেক বড় হব, তখন আমাকে সমুদ্রে নিয়ে যাবে। তবেই আমি বিপদকে অতিক্রম করে যেতে পারবাে।"


মৎস্যটি বললেন, 'যতক্ষণ আমরা ক্ষুদ্র থাকি ততক্ষণই আমাদের বহুবিধ বিপদ হয়, এমন কি মৎস্যই মৎস্যকে গিলে ফেলে। অতএব আমাকে প্রথমে কুম্ভীতে (কলসীতে) ধারণ কর, যখন আমি তাকে ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠব, তখন একটি খাল খনন করে আমাকে সেখানে পোষণ কর, তারপর যখন তাকেও ছাড়িয়ে বড় হব তখন আমাকে সমুদ্রে নিয়ে যাবে। তাহলেই আমি বিপদকে অতিক্রম করে যেতে পারব' ॥৩॥


শশদ্ধ ঝাষ ঽআস। সহি জ্যেষ্ঠং বর্দ্ধতেঽথেতিথীং সমাং  

তদৌঘ ঽআগন্তা তন্মা নাবমুপকল্প্যোপাসাসৈ স ঽঔঘ 

ঽউত্থিতে নামাপদ্যাসৈ ততত্ত্বা পারয়িতাস্মীতি॥

(শতপথ ব্রাহ্মণ: ৮.১.৪)


শীঘ্রই সেই মৎস্য এক বৃহত্তম মহামৎস্যে পরিণত হল। সে সর্ববৃহৎরূপে বেড়ে উঠল। অনন্তর সেই মৎস্য বললেন, "এইরূপ কোনও বৎসরে এক জলোচ্ছ্বাস আসবে, অতএব তুমি একটি নৌকা নির্মাণ করে আমার জন্য প্রতীক্ষা করবে। জলোচ্ছ্বাস উত্থিত হলে তুমি সেই নৌকাতে আরোহণ করবে। সেখান থেকে আমি তোমাকে উদ্ধার করব"।


 

তমেবং ভৃত্বা সমূদ্রমভ্যবজহার। স যতিথীং তৎসমাং 

পরিদিদেশ ততিথীং সমাং নাবমুপকল্প্যোপাসাঞ্চক্রে স    

ঽঔঘ উত্থিতে নামাপেদে তং স মৎস্য ঽউপন্যাপুপ্লুবে  

তস্য শৃঙ্গে নাবঃ পাশং প্রভিমুমোচ তেনৈতমুত্তরং  

গিরিমতিদুদ্রাব ॥

(শতপথ ব্রাহ্মণ: ৮.১.৫)


তাকে এইভাবে ভরণপোষণ করে, মনু সমুদ্রসকাশে নিয়ে গেলেন। সে (মৎস্য) যে বৎসরটি নির্দেশ করেছিল সেই বৎসরেই নৌকা নির্মাণ করে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন। জলোচ্ছ্বাস গুণিত হলে তিনি নৌকায় আরোহণ করলেন। সেই মৎস্যটি ভাসতে ভাসতে তাঁর নিকটে চলে এল। এবং তার নিজের শৃঙ্গে নৌকার বন্ধনরজ্জুটি বেঁধে নিল। তার দ্বারা সে নৌকাটিকে উত্তরদিকের গিরি অতিক্রম করে নিয়ে চলে গেল ॥৫॥


স হোবাচ। অপীপরং বৈ তা বৃক্ষে নাবং প্রতিবঘ্নীষ্ব 

তং তু ত্বা মা গিরৌ সন্তমুদকমন্তশ্ছৈৎসীদ্যাবদ্যাবদুদকং সমবায়াত্তাবত্তাবদন্ববসর্পাসীতি স হ তাবত্তাবদেবান্ববসসর্প্প তদপ্যেতদুত্তরস্য গিরের্মনোরবসর্প্পণমিত্যৌঘো হ তাঃ সর্ব্বাঃ 

প্রজা নিরুবাহাথেহ মনুরেবৈকঃ পরিশিশিষে ॥

(শতপথ ব্রাহ্মণ: ৮.১.৬)


সেই মহামৎস্য বললেন, "তোমাকে আমি পার করে এনেছি। একটি বৃক্ষে নৌকাটিকে বেঁধে রাখ। গিরিতে অবস্থানকালে উদক যেন ভিতর দিয়ে ছেদন করে তোমাকে নিয়ে যেতে না পারে। যেমন যেমন জল নিচের দিকে নেমে যাবে, সেইরকমভাবে তুমিও পশ্চাৎ পশ্চাৎ নেমে আসবে।" মনু সেই মহামৎস্যের নির্দেশনা অনুসারে সেইভাবেই নিচের দিকে নেমে এলেন। যে পথ দিয়ে মনু নেমে এসেছিলেন উত্তরস্থ গিরির সেই পথ এখনও মনুর অবসর্পণ নামে প্রসিদ্ধ। জলোচ্ছ্বাস এই সকল সৃষ্ট প্রাণিবর্গকে নিঃশেষে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল এবং একমাত্র মনুই একা অবশিষ্ট ছিলেন। 


শতপথ ব্রাহ্মণের এ সংক্ষিপ্ত কাহিনীটিই বৃহত্তর পরিসরে শাস্ত্রের বিবিধ স্থানে পাওয়া যায়। ব্যাসদের রচিত মৎস্যপুরাণে মহারাজ মনু এবং মৎস্য অবতারের কাহিনী পুরাণটির শুরুতেই বর্ণিত হয়েছে। মৎস্যপুরাণের প্রথম এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে মৎস্য অবতারের কাহিনীটি এবং শতপথ ব্রাহ্মণের কাহিনীটি প্রায় একই প্রকারের। মৎস্যপুরাণের কাহিনীটি হল:


পুরাকালে রবিনন্দন রাজা মনু, পুত্রের প্রতি রাজ্যভার সমর্পণ করে মলয়াচলের একটি দেশে গিয়ে বিপুল তপস্যা শুরু করেন। তিনি ছিলেন সুখে দুঃখে সমদর্শী। তিনি সর্ব প্রকারের আত্মগুণে বিভূষিত হয়ে উত্তম যোগ সাধনায় মগ্ন হন। অনন্তর বহু বছরের সাধনার ফলে কমলাসন ব্রহ্মা তাঁর প্রতি প্রীত হয়ে বরদানে উদ্যত হন। ব্রহ্মার বরদান বাক্যে রাজা তাঁকে প্রণাম করে বললেন— "হে পিতামহ ! আমি আপনার নিকট হতে একটা মাত্র পরমোত্তম বর চাই। সে বর হলো, প্রলয়কালে আমি যেন নিখিল ভূতবৃন্দ ও চরাচর সমগ্র জগতের রক্ষা করতে পারি। বিশ্বাত্মা ব্রহ্মা মনুর প্রার্থনায় ‘তথাস্তু’ বলে তৎক্ষণাৎ অন্তর্হিত হলেন। তখন স্বর্গ হতে দেবগণ মনুর উপরে সুমহতী পুষ্প-বৃষ্টি করলেন। অনন্তর একদিন মনু স্বীয় আশ্রমে বসে পিতৃতর্পণ করছেন। সেই সময় একটি শফরী মাছ (পুঁটিমাছ) তাঁর দুই হাতের অঞ্জলির মধ্যে উঠে আসলো। ক্ষুদ্র মাছটিকে দেখে রাজার চিত্ত অত্যন্ত দয়ার্দ্র হল। রাজা তাঁকে যত্নপূর্বক রক্ষা শুরু করলেন। তিনি ক্ষুদ্র মাছটিকে তাঁর কমণ্ডলুর মধ্যে প্রথমে রাখলেন। পরে সেই শফরী এক অহোরাত্র মধ্যেই ষোড়শাঙ্গুল বিস্তৃত হয়ে গেল। সেই শফরী মাছটি রাজাকে বললেন, "রাজন ! আমায় রক্ষা করুন, রক্ষা করুন। "


রাজা মনু তখন সেই মাছটিকে কমণ্ডলু হতে তুলে একটি কলসির মধ্যে রাখলেন। মাছটি সেই কলসির মধ্যে থেকে একরাত্রেই তিনহাত পরিমাণ বড় হয়ে গেলো। কলসির সমপরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে মাছটি পুনরায় আর্ত্তস্বরে রবিনন্দনকে বললো— "রাজন! আমি আপনার শরাণাপন্ন হয়েছি, আমাকে রক্ষা করুন, রক্ষা করুন।" মহীপতি মহারাজ মনু অনন্তর সেই মাছটিকে একটি কূপে নিক্ষেপ করলেন। দেখতে দেখতে সেই কুপেও স্থান সঙ্কুলন হল না রহস্যময় শফরী মাছটির। তখন মহারাজ মনু সেই মাছটিকে একটি সরোবরে নিক্ষেপ করলেন। সরোবরে নিক্ষিপ্ত হয়ে মাছটি সরবরের সমান বিশাল দেহ ধারণ করে ফেলল । মাছটির দেহের পরিমাণ যোজন পরিমাণ হলো। তখন সে সরোবরে থেকে দীনভাবে বললেন,— "হে নৃপোত্তম!আমায় রক্ষা করুন, রক্ষা করুন।" বিস্মিত হয়ে মহারাজ মনু মাছটিকে গঙ্গার জলে নিক্ষেপ করলেন। সেখানেও সে অত্যধিক বৃদ্ধি পেলো। নিরুপায় হয়ে তখন মহীপতি মনু সেই মাছটিকে সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করলেন। সমুদ্রজলে নিক্ষিপ্ত হয়ে, সেই মাছটি তাঁর দেহ দিয়ে সমগ্র সমুদ্র পরিব্যাপ্ত করলেন। এ অভূতপূর্ব ঘটনা দেখে মহারাজ মনু অত্যন্ত ভীত হয়ে গেলেন। তিনি মাছটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,—" হয় তুমি কোন অসুরের অধিপতি হবে, অথবা তুমি সাক্ষাৎ বাসুদেব। এই দুইয়ের মধ্যে একজন তুমি। তুমি তোমার নিজের পরিচয় দাও।এমন বিংশতি-অযুতযোজন বিস্তৃত কলেবর কার হতে পারে? হে কেশব! আমি বুঝতে পেরেছি, তুমিই মৎস্যরূপে অবতীর্ণ হয়েছ। আর আমার ক্লেশ দিও না। হে হৃষীকেশ ! হে জগন্নাথ ! জগদ্ধাম! তোমার নমস্কার।"


মনুর কথা শুনে মৎস্যরূপধারী ভগবান জনাৰ্দ্দন বললেন, –"হে নিষ্পাপ ! সাধু সাধু, তুমি আমায় সম্যকরূপেই চিনতে পেরেছ। হে মেদিনীপতে! এই সশৈল বনকাননা মেদিনী অচিরেই জলমগ্না হবে । হে মহীপতে ! আমি জীব সকলের রক্ষার জন্য নিখিল দেবগণ দ্বারা এক নৌকা নির্মান করেছি। হে সুব্রত ! তুমি সেই নৌকায় যাবতীয় স্বেদজ, উদ্ভিজ্জ ও জরায়ুজ প্রভৃতি অনাথ জীব ও দিগকে স্থাপন করে তাদের জলপ্লাবন হতে রক্ষা করবে। হে নৃপ! এই নৌকা যৎকালে যুগান্ত-বাতে অভিহত হবে। তখন তুমি আমার এই শৃঙ্গে সেই নৌকাকে বেঁধে রাখবে। এরপরে সমস্ত চরাচর জগতের লয় হয়ে গেলে, হে পৃথ্বীপতে! তুমিই সমস্ত জগতের প্রজাপতি হবে। এইভাবে সত্যযুগের প্রারম্ভে তুমিই সৰ্বজ্ঞ ধৃতি সম্পন্ন, মন্বন্তরাধিপতি, নরপতি হয়ে সুর সমাজে সম্মানিত হবে।"


মৎস্যরূপধারী মধুসূদনের বাক্য শুনে মহারাজ মনু জিজ্ঞাসা করলেন,—"ভগবন্! কত বৎসর পরে জগতে প্রলয় সঙ্ঘটিত হবে ? হে নাথ মধুসূদন! জীবগণকে কেমন করে আমি রক্ষা করিব? আপনার সাথে পুনরায় আমার দেখা কেমন করে হবে?" মহারাজ মনুর বাক্য শুনে মৎস্যরূপধারী ভগবান মধুসূদন বললেন,— "আজ হতে মহীমণ্ডলে এক শত বর্ষ পর্যন্ত অনাবৃষ্টি হবে। অনাবৃষ্টির ফলে অচিরেই ঘোর দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে। এতে জগতের বিবিধ অশুভ ঘটনা পর্যায়ক্রমে ঘটবে। সূর্যের সুদারুণ সপ্তরশ্মি প্রতপ্ত অঙ্গাররাশি বর্ষণ করে ক্রমশঃ প্রাণিগণের সংহার সাধন করবে। ভয়ংকর বাড়বানল দেখা দিবে। ভগবান শিবের তৃতীয় নয়নের থেকে অনল-শিখা নির্গত হয়ে ত্রিজগতকে দগ্ধ করবে। হে মহামুনে! এইরূপে সমগ্র মহী দগ্ধ হয়ে যৎকালে ভস্মস্তূপে পরিণত হবে, তখন সেই অনলতাপে রূপধয় আকাশ পর্যন্ত উতপ্ত হয়ে যাবে। এরপরে দেব ও নক্ষত্রমণ্ডল সহ সমস্ত জগৎ সংহারদশায় উপনীত হবে। সম্বৰ্ত্ত, ভীমনাদ, দ্রোণ, চণ্ড, বলাহক, বিদ্যুৎপাত ও কোণ নামক সপ্তসংখ্যক প্রলয়মেঘ প্রাদুর্ভূত হবে । তাঁরা এই অগ্নিদগ্ধ মেদিনীকে অজস্র বারি বর্ষণে প্লাবিত করবে । সমুদ্র সকল ক্ষুব্ধ হয়ে একাকারে অবস্থান করবে। এই জগত্রয়কে একার্ণবে পরিণত করে তুলবে । হে সুব্রত ! ঐ সময় তুমি মৎপ্রদত্ত রজ্জু দ্বারা এই বেদ-নৌকা গ্রহণ করে সর্ব্বপ্রাণীর বীজরাশিকে নৌকায় স্থাপিত করবে। আমার শৃঙ্গে নৌকা বন্ধন করে নিবে। আমার প্রভাবে তুমি সর্বপ্রকার সুরক্ষিত হবে। হে পরন্তপ ! দেব সকল দগ্ধ হয়ে গেলেও একমাত্র তুমিই তথন অবস্থান করবে। যুগান্তে আমি, ব্রহ্মা, সোম, সূর্য লোক চতুষ্টয়, পুণ্য নদী নর্মদা, মহর্ষি মার্কণ্ডেয়, ভগবান্ ভব, বেদগণ, পুরাণগণ এবং বিদ্যাসমূহে পরিবৃত হয়ে এই সমগ্র বিশ্বমণ্ডল তোমার সাথে অবস্থান করবে। চাক্ষুষ মনুর অবসানে এইরূপে জগৎ যখন একার্ণবীকৃত হবে, হে মহীপতে ! সেই সময়ে আমিই আবার বেদসমূহ প্রবর্ত্তিত করব।"


মৎস্যরূপী ভগবান মনুকে এ কথা বলে তৎক্ষণাৎ অন্তর্হিত হলেন। রবিনন্দন মনুও বাসুদেবের প্রসাদে পুনরায় যোগাবলম্বন করলেন। অনন্তর বাসুদেবের বাক্যানুযায়ী প্রলয়কাল উপস্থিত হলে ভগবান শৃঙ্গবান একটি বৃহৎ মৎস্যরূপ ধারণ করে আবির্ভূত হলেন। ভুজঙ্গ রজ্জুরূপ ধরে মনুর কাছে আসলো। ধৰ্ম্মজ্ঞ মহারাজ মনু যোগবলে ভুজঙ্গ-রজ্জু দ্বারা নিখিল ভুতবৃন্দকে আকর্ষণ করে নৌকার মধ্যে স্থাপিত করলেন। এরপরে তিনি সেই নৌকার উপর আরোহণ করে মৎস্যরূপ জনাৰ্দ্দনকে প্রণাম করলেন। ভগবান তখন মনুর নিকটে উৎপত্তি, প্রলয়, বংশ, মন্বন্তর, বংশানুচরিত, ভুবনবিস্তার,দান-ধৰ্ম্মবিধি, নিত্য শ্রাদ্ধকল্প, বর্ণাশ্রম, ইষ্টাপূৰ্ত্ত, দেব-প্রতিষ্ঠাদি, এবং অন্যান্য আরও জাগতিক বিষয় বর্ণনা করলেন। সে সকল তত্ত্বই ‘মৎস্যপুরাণ’ নামে খ্যাত হলো। 


কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ