পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ও একমাত্র মৌলিক ভাষা যা এখনও প্রচলিত সেটা হলো সংস্কৃত। সনাতনী সকল শাস্ত্র এই সংস্কৃত ভাষায় রচিত এবং প্রাচীন যুগের শাস্ত্রচর্চাও হতো সংস্কৃততে। শাস্ত্রে বলা হয় দেবতারাও কথা বলে সংস্কৃততে তাই একে দেবভাষাও বলা হয়। ভাষা সাহিত্যে সংস্কৃতকে সকল ভাষার জননী বলা হয়।
প্রশ্ন আসতে পারে, সংস্কৃত ভাষার প্রাচীনত্বের প্রমাণ কি?
প্রাচীনত্বের একটি মাপকাঠি হলো মৌলিকত্ব এবং সংস্কৃত হলো প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে একমাত্র মৌলিক ভাষা। সংস্কৃত ভাষাকে তাই সকল ভাষার জননী বলা হয়। এর মৌলিকত্বের কারণেই NASA-এর একদল গবেষক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মহাজাগতিক যোগাযোগের জন্য সংস্কৃত ভাষাকেই বেছে নিয়েছিলো।
👉 সংস্কৃত ভাষা ও মহাজাগতিক যোগাযোগঃ
নাসার একজন এসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট রিক ব্রিগস ১৯ শতকের শেষ দিকে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছিলেন যেখানে তিনি নিখুঁতভাবে দেখিয়েছেন মহাজাগতিক যোগাযোগের ভাষা হিসেবে কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভাষা হিসেবে "সংস্কৃত" হল একমাত্র উপযোগী ভাষা। এছাড়া "সংস্কৃত" হল একমাত্র ভাষা যেটি মহাজাগতিক যোগাযোগের উদ্দেশ্যে সংকেত সৃষ্টি করতে পারে। এই অনন্য গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেছে “অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা এডভান্সমেন্ট অব আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স” নামক গবেষণা সংস্থা।
(সূত্র: aaai.org, 1985 Spring issue)
[https://docs.google.com/file/d/0B5ph4C2WV1JqNWU3MjVhMmQtMWVjZS00MDgzLTk1M2QtNDgwMmU5ZTRjODVh]
এবার আসি এই গবেষণাপত্রের নেপথ্যের ঘটনায়। বলে রাখা ভালো সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ বেদ রচিত হয় একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ ভাষা "সংস্কৃত" তে। সবচেয়ে প্রাচীন শাস্ত্রের পাণ্ডুলিপি (১৫০০ খ্রীস্টপূর্বে লিখিতভাবে সংকলিত) ঋগবেদের ভাষাও সংস্কৃত।
গবেষণা সংস্থা NASA বহুকাল পূর্ব থেকেই সংস্কৃত ভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিল। তাই তারা তাদের মহাজাগতিক গবেষণায় সহযোগীতা করার জন্য ভারতের সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শি প্রায় এক হাজার জন পণ্ডিতকে অনুরোধ জানিয়েছিলো। কিন্তু তাদের কেউই দেব ভাষা "সংস্কৃত" অন্য কোন ব্যবহারে সম্মত হোন নি।।
ইতোপূর্বে NASA জানিয়েছিল যে, তারা সংস্কৃত ভাষায় মিশন পরিচালনা করবে কেননা "সংস্কৃত" হল কম্পিউটারের বোধগম্য সর্বোৎকৃষ্ট ভাষা এবং এই বিষয়ে 'চৈতন্য সন্দেশে' ইতোপূর্বে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল, রিক ব্রিগসও তার গবেষণাপত্রে একই কথা বলেছিলেন। তারা গত দুই দশক ধরে এই প্রজেক্টে বহু অর্থ ও সময় ব্যয় করছে।
নাসার বিজ্ঞানী রিক ব্রিগস এই ভাষা শেখার জন্য আমেরিকানদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। ২০১২ সালে নাসার এসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট রিক ব্রিগস ঘোষণা দেয়, তারা মহাশূন্য অভিযানের অংশ হিসেবে সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করবে।
এছাড়াও তিনি সর্বাপেক্ষা জটিল কম্পিউটার কোড তৈরিতে সংস্কৃত ভাষার সম্ভাব্যতার কথা ব্যক্ত করেন। অনেকেই ধারণা পোষণ করেন, ইংরেজী হল কম্পিউটার কোডিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য একমাত্র উপযোগী ভাষা। এর কারণ ইংরেজী ভাষা কোন জাতি কিংবা সমাজের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় এবং যে কোন সংস্কৃতিতে ভিন্নভাবে ইংরেজী মানানসই। কিন্তু এই পরিবর্তনশীলতার কারণেই ইংরেজী কিংবা অন্যান্য ভাষাসমূহ আন্ত-মহাজাগতিক যোগাযোগের ভাষা হিসেবে উপযোগী নয়। কম্পিউটারের কোডিং করতে যেমন একটি ইউনিভার্সেল ভাষা প্রয়োজন এবং সেটা না হলে যেকোন ত্রুটিতে কম্পিউটার অ্যাপস ক্রাশ করতে পারে, তেমনি আন্তঃগ্রহ যোগাযোগে কেন একটি আদর্শ ভাষা থাকবে না? যৌক্তিকভাবেই সেটি হতে পারে "সংস্কৃত" ভাষা।
[https://www.aaai.org/ojs/index.php/aimagazine/article/view/466]
[https://bstrategyhub.com/sanskrit-is-the-best-language-for-artificial-intelligence-says-nasa/]
অনেকে বলার চেষ্টা করেন যে, সংস্কৃত ভাষা কিছু ভাষার মিশ্রনে কৃত্রিমভাবে পরবর্তীতে সৃষ্টি হয়েছে।
এটা সত্য যে সংস্কৃত ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা প্রচলিত নেই যেহেতু প্রাচীনকালে এটা ছিলো পরম্পরাগত কথ্য ভাষা। বর্তমানে প্রচলিত সংস্কৃত বর্ণমালাগুলো হলো দেবনগরী বর্ণমালা। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে সংস্কৃত ভাষা বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি হয়েছে।। এই বিষয়ে কয়েকজন বিশিষ্ট ভাষাবিদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।।
ভাষাবিদদের বক্তব্যে সংস্কৃত ভাষাঃ
ভাষা নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা সকলেই এক বাক্যে ব্রিটিশ ভাষাবিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম জুনসকে চিনে থাকবেন। তিনি সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারকও ছিলেন। তিনি প্রায় ২৮ টি ভাষা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তিনিই সম্ভবত প্রথম ১৭৮৬ খ্রীস্টাব্দে সংস্কৃত ভাষার সাথে গ্রীক, ল্যাটিন, গথিক ও সেল্টিক ভাষার গভীর সম্পর্ক আবিস্কার করেন। তিনি বলেন,
"সংস্কৃত প্রাচীন ভাষা হওয়া সত্ত্বেও এর গঠনপ্রণালী অভূতপূর্ব। এটি গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষা হতেও নিখুঁত ও সমৃদ্ধ। যেকোনো ভাষাতাত্ত্বিকের পক্ষেই এর ব্যাখ্যা করা অসম্ভব কারণ এটি এক অবিশ্বাস্য প্রাচীন উৎস থেকে সৃষ্ট।"
ব্রিটিশ অনুবাদক উইলিয়াম ওয়ার্ড ১৮১০ সালে একটি বই লিখেন "A view of the history, literature, mythology of hindoos".
তিনি সেখানে দেখানোর চেষ্টা করেন যে সকল ইউরোপীয় ভাষার উৎসই "সংস্কৃত" ভাষা৷
সংস্কৃত ভাষার ঐতিহাসিক প্রমাণঃ
ঋগবেদের সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি যা প্রায় ১৫০০ খ্রীস্টপূর্বে রচিত হয়েছিল সেটা কিন্তু ভারতে পাওয়া যায় নি, পাওয়া গিয়েছিল বর্তমান সিরিয়াতে যা একসময় মিত্তানি সাম্রাজ্য নামে পরিচিত ছিলো। মিত্তানি সাম্রাজ্যের প্রচলিত ভাষা হারিয়ান হলেও তাদের রাজা ও যোদ্ধাদের সংস্কৃত নামও প্রচলিত ছিলো যেমন মিত্তানি সম্রাট তুশ্রাত্ত-এর সংস্কৃত নাম ছিলো দশরথা। সম্রাট দশরথা খ্রীস্টপূর্ব ১৪ শতকে ফারাও রাজা আমেনহোতেপ-৩ কে একটি চিঠি লিখেছিলেন আক্কাদিয়ান ভাষায় যা এখনও ব্রিটিশ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।। তৎকালীন সময়েও মিত্তানি সাম্রাজ্যে সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার ছিলো। অর্থাৎ সংস্কৃত একটি বিশ্বজনীন ভাষা ছিলো।।
এছাড়াও কথ্য ভাষা হিসেবে পরম্পরাগতভাবে বহু হাজার হাজার বছর ধরেই সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার হয়ে আসছে ভারতে৷ বেদ মন্ত্রের পরম্পরাগত সংকলন UNESCO masterpiece of the oral and intangible heritage এ জায়গা করে নেওয়াও প্রমাণ করে বৈদিক ভাষা সংস্কৃত অত্যন্ত প্রাচীন।।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত অধ্যাপক মাইকেল উইতজেল (আমেরিকান ভাষাবিজ্ঞানী) Harvard University Press এর "Harvard oriental series 92" এ একটি আর্টিকেল লিখেন যেখানে তিনি নেপাল থেকে প্রাপ্ত শুক্ল যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে লিখেন যে এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। সেখানে তিনি এটাও লিখেন যে এই পাণ্ডুলিপি রচনারও হাজার বছর আগে থেকে পরম্পরাগতভাবে বেদমন্ত্রের যে উচ্চারণ ও আবৃত্তি যা এখনও অবিকৃত আছে তা এই পাণ্ডুলিপির উচ্চারণ পদ্ধতির সাথে হুবহু সম্পর্কিত।
[https://www.hup.harvard.edu/catalog.php?isbn=9780674988262]
অর্থাৎ সংস্কৃত প্রকৃত অর্থেই অত্যন্ত প্রাচীন ও মৌলিক ভাষা।।
©স্টিমন অনিক।
প্রচারেঃ
SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।।
সনাতনী শাস্ত্র, দর্শন ও প্রচারে বদ্ধপরিকর।।
0 মন্তব্যসমূহ