ইদানীং কিছু নব্য পণ্ডিতের আবির্ভাব হয়েছে যারা গীতার ১৮/৬১ ও ১৮/৬২ শ্লোক দিয়ে প্রমাণ করতে চায় শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নন। এসব পন্ডিতদের কথা শুনে না হেসে পারা যায় না।
প্রথমেই মূল শ্লোক গুলো দেখে নেয়া যাক,
ঈশ্বরঃ সরবভূতানাং হৃদ্দেশে অর্জুন তিষ্ঠতি।
ভ্রাময়্যন্ সর্বভূতানি যন্ত্ররূঢ়ানি মায়য়া।। (১৮/৬১)
সরলার্থ ---> হে অর্জুন ! ঈশ্বর সমস্ত প্রাণীর হৃদয়ে অধিষ্ঠিত থাকেন এবং নিজ মায়ার দ্বারা শরীররূপী যন্ত্রে আরূঢ় হয়ে থাকা সমস্ত প্রাণীকে ( তাদের স্বভাব অনুসারে ) চালিত করতে থাকেন।
তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত৷ তত্প্রসাদাত্পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্৷৷(১৮/৬২) সরলার্থ ---> হে ভারত, সর্বত ভাবে তার শরণাগত হও। তার কৃপায় তুমি পরাশক্তি লাভ করবে এবং তার নিত্যধাম প্রাপ্ত হবে।
সেই তথাকথিত নব্য পন্ডিতগণ এই দুই শ্লোক দেখিয়ে বলে থাকে,
" এই যে দেখ, শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নন। তিনি যোগস্থ ছিলেন। এখানে এসে তিনি সেই ঈশ্বরের কথা ও সেই ঈশ্বরের শরণাগত হতে বলছেন, যিনি সকলের হৃদয়ে অবস্থিত।"
আসলেই অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী। গীতার দু একটা শ্লোক পড়েই গলাবাজী করতে আসলে যা হয় আরকি।
আরো পড়ুন, শ্রীমদভগবদগীতা কি ভীষ্মপর্বে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে?
মূর্খ গুলো জানেই না গীতার এই হৃদয়ে অবস্থিত ঈশ্বর কে! শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং গীতার ১৫/১৫ শ্লোকে তা বিবৃত করছেন,
সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টো মত্তঃ স্মৃতির্জ্ঞানমপোহনং চ৷ বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যো বেদান্তকৃদ্বেদবিদেব চাহম্৷৷(১৫/১৫) অর্থ: আমি সকলের হৃদয়ে অবস্থিত আছি এবং আমার থেকেই জীবের স্মৃতি এবং জ্ঞান উৎপন্ন ও বিলোপ হয়। আমি সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য, সমস্ত বেদান্ত কর্তা এবং বেদবেত্তা।
এখানে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বলছেন তিনিই সেই জীব হৃদয়ে অবস্থিত ঈশ্বর। উক্ত শ্লোকগুলোর ভাব এমন যে, (কৃষ্ণ বলছেন) অর্জুন আমিই হচ্ছি সকল জীবের হৃদয়ে অবস্থিত ঈশ্বর। তুমি সেই হৃদয়স্থিত ঈশ্বরের (আমার) শরণাগত হও।
আরো পড়ুন,অনুগীতা প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব খর্ব হয় না
আবার ১৮ অধ্যায়ের ৬৪-৬৬ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ কি বলছেন দেখুন,
হ্যতমং ভূয়ঃ শৃণু মে পরমং বচঃ৷
ইষ্টোসি মে দৃঢ়মিতি ততো বক্ষ্যামি তে হিতম্৷৷৬৪ অর্থ: তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয় তাই তোমার হিতের জন্য আমি সবচেয়ে গোপনীয় জ্ঞান উপদেশ করছি তুমি তা শ্রবণ কর।
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু৷ মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োসি মে৷৷৬৫ অর্থ: তুমি আমাতে চিত্ত স্থির কর এবং আমার ভক্ত হও। আমার পূজা কর এবং আমাকে নমস্কার কর। তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়। এই জন্য আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে এই ভাবে তুমি আমাকে প্রাপ্ত হবে।
সর্বধর্মান্পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ৷
অহং ত্বা সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ৷৷৬৬ অর্থ: সমস্ত ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শ্বরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। সে বিষয়ে তুমি কোন দুশ্চিন্তা করো না।
এখানে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে গীতার সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বগুহ্য উপদেশটিই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়া। আবার কিছু পণ্ডিত এখানে অযৌক্তিক যুক্তি দেখাতে আসে যে,
"উক্ত ১৫/১৫ ও ১৮/৬৪-৬৬ তে আমি বা আমার বলতে কৃষ্ণকে বোঝানো হয় নি। শ্রী কৃষ্ণ এখানে যোগস্থ ছিলেন। ঈশ্বর তাকে দিয়ে ঐ কথা গুলো বলাচ্ছেন, ওগুলো তার কথা নয়। কৃষ্ণ ঈশ্বর নন, যোগী।"
এই পণ্ডিতদের বলি, এ কেমন যোগ? শ্রীকৃষ্ণ গীতায় কয়বার যোগস্থ হয়েছিলেন? ১৫ অধ্যায়ে একবার যোগস্থ হলেন আবার সেই ভেঙ্গে গেল ১৮/৬১ তে এসে আবার যোগ এসে ভর করলো ১৮/৬৪-৬৬ তে! দারুণ তো! না জানি আপনাদের মতে কয়বার যোগের আপডাউন হয়েছে! যে যোগে ক্ষণিকেই যোগরূঢ় হয়ে যান ঈশ্বর ও নিজের মাঝে ভেদ দেখেন না আবার ক্ষণিকেই ভেদ দৃষ্ট হয়! এ কেমন যোগ? নাম কি এ যোগের?
আরো পড়ুন, ★ শ্রীকৃষ্ণ, পরমেশ্বর নাকি যোগেশ্বর?
ত্যানা একটু কমিয়ে প্যাঁচাবেন। দুই একটা শ্লোক নিয়ে না লাফিয়ে পুরো গীতা পড়ুন, সঠিক পরম্পরাগত ভাষ্য পড়ুন, বুঝুন ,তারপর না হয় লাফালাফি করবেন। এভাবে দু এক শ্লোক নিয়ে লাফালাফি করলে তো হাত পা ভেঙ্গে নিচে পড়ে থাকবেন।
আরো পড়ুন, তথাকথিত প্রাচীন গীতার সমীক্ষা
আপনাদের মত তথাকথিত পণ্ডিত পূর্বেও ছিলো আর এখন তো আপনারাই আছেন। আপনাদের উদ্দেশ্যে গীতার একটি শ্লোক উল্লেখ করে শেষ করছি,
ন মাং দুষ্কৃতিনো মূঢ়াঃ প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ। মায়য়াপহৃতজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ।।১৫।। অনুবাদঃ মূঢ়, নরাধম, মায়ার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে এবং যারা আসুরিক ভাবসম্পন্ন, সেই সমস্ত দুস্কৃতকারীরা কখনও আমার শরণাগত হয় না।
------------ শ্রী প্রান্ত সাহা
0 মন্তব্যসমূহ