"বিদ্যাং দেহী নমস্তুতে"
পরমেশ্বরের জ্ঞানময় নারী মূর্তি হচ্ছে মা সরস্বতী। পৌরাণিক ভাষ্যের স্থুল বিশ্লেষণে কেউ বলে মাতা সরস্বতী পরম পিতা ব্রহ্মার স্ত্রী আবার কেউ বলে কন্যা৷
কিন্তু বেদ, বেদান্ত, পুরাণ শাস্ত্র ও রামায়ণে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাতে স্পষ্ট যে মা সরস্বতী হচ্ছেন পরমেশ্বরের জ্ঞানময় নারী মূর্তি তথা পরমপিতা ব্রহ্মার নারী/স্ত্রী সত্ত্বা। একে একে সম্পূর্ণ বিষয়টি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হবে। একটু ধৈর্য্য সহকারে সম্পূর্ণ লিখাটা পড়ার অনুরোধ রইল।
★ বেদে মাতা সরস্বতীকে কিভাবে বন্দনা করা হয়েছে?
"চোদয়িত্রী সূনৃতানাং চেতন্তী সুমতীনাং।
যজ্ঞং দধে সরস্বতী॥" (ঋগ্বেদ ১/৩/১১)
"মহো অর্নঃ সরস্বতী প্রচেতয়তি কেতুনা।
ধিয়ো বিশ্বা বিরাজতি॥" (ঋগ্বেদ ১/৩/১২)
অনুবাদঃ
সত্য ও প্রিয়বাণীর (মঙ্গলজনক বা মানব হিতকর কথা) প্রেরণাদাত্রী এবং সৎবুদ্ধির চেতনাদাত্রী মাতা সরস্বতী শুভকর্মকে ধারণ করে আছেন। জ্ঞানদাত্রী মাতা সরস্বতী প্রজ্ঞাশক্তি দ্বারা মহান জ্ঞান সমুদ্রকে প্রকাশ করেন এবং ধারণাবতী বুদ্ধি সমূহকে দীপ্তি দান করেন।
অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবানের জ্ঞানমূর্তির নারী সত্তা তথা মাতৃশক্তিই মা সরস্বতী। পরমপিতা ব্রহ্মা ও মা সরস্বতী আলাদা কোন সত্ত্বা নয়৷
সরস্বতীর ত্রি-রূপঃ
সরস্বতী শব্দটি 'সার' এবং 'স্ব’ দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। সেই অনুসারে সরস্বতী শব্দের অর্থ হলো যিনি কারাে মধ্যে সারজ্ঞান প্রকাশ করেন।
আবার সরস্বতী শব্দটি সংস্কৃত 'সুরস বতি' শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে জলের আধার। সরস্বতী সাক্ষাৎ দেবী মূর্তি এবং নদী-দুইরূপেই প্রকটিত।
ঋগ্বেদ- ২/৪১/১৬ মন্ত্রে বলা হয়েছে,
"অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী।
অপ্রশস্তা ইব স্মসি প্রশস্তিমন্ব নস্কৃধি ॥"
অর্থাৎ মাতৃগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, নদীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, দেবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হে সরস্বতী, আমরা অসমৃদ্ধের ন্যায় রয়েছি, আমাদের সমৃৃদ্ধশালী করো।
★সরস্বতী দেবী কীভাবে দেবী, মাতা ও নদীশ্রেষ্ঠ?
বেদে সরস্বতী সম্বন্ধে তিনটি সম্বােধন করা হয়েছে, “দেবীতমে”, “অম্বিতমে” ও “নদীতমে”। দেবীতমার অর্থ দেবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, অম্বিতমার অর্থ সকল মায়েদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং নদীতমার অর্থ সকল নদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
এদিক থেকে তাঁর মহিমা ত্রিবিধ। তিনি দেবী, তিনি মা, তিনি নদীরূপা । সকল দ্যোতনশীল (প্রকাশমান) বস্তুর মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ। তিনি দিব্য ব্রহ্মজ্যোতিঃ স্বরূপিণী, তাই তিনি দেবীতমা, জ্ঞানরূপ আলোরশ্মিতে তিনি আমাদের মতাে অবােধ, অজ্ঞান, অসহায় সন্তানদের জননীর মত নিত্য প্রতিপালন করেন এবং হাত ধরে আলােকদীপ্ত পথে পরিচালিত করেন। তিনি জননীর (মায়ের) ন্যায় আমাদের মূক (বােব) কণ্ঠে ভাষা ফুটিয়ে তােলেন, তাই তিনি অম্বিতমা বা মাতৃশ্রেষ্ঠা। তিনি আবার জলধারার মত রসময় জ্ঞানকে প্রবাহিত করেন মানবের হিতে তাই তিনি নদীশ্রেষ্ঠা।
চতুর্বেদে সরস্বতী মাতাই গায়ত্রী, ত্রিষ্টুপ, অনুষ্টাপাদি, ছন্দোবৈভব। তিনিই ছয় রাগ, ছত্রিশ রাগিণী এবং নিত্য সঙ্গীতময়ী । সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি (ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম,ধৈবত, নিষাদাদি) তিনিই সঙ্গীতের অপূর্বা লহরী বিস্তার করে সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছেন। তিনিই স্বরবর্ণ এবং তিনিই ব্যঞ্জনবর্ণ, বেদে তিনিই মন্ত্রাত্মিকা।
পুরাণদি শাস্ত্র বিশ্লেষণঃ
দেবীভাগবত পুরাণ
দেবী আদ্যাপ্রকৃতির তৃতীয় অংশে সরস্বতীর জন্ম হয়েছিল। তিনি পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের জিহ্বাগ্র থেকে উৎপন্ন হয়েছিলেন। সরস্বতী বাক্য, বুদ্ধি, বিদ্যা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সংশয় মোচনকারিণী ও সর্বসিদ্ধিপ্রদায়িনী দেবী সরস্বতী। ব্রহ্মা প্রথম তাঁকে পুজো করেন। পরে জগতে তাঁর পূজা প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর শ্রীকৃষ্ণ জগতে তাঁর পুজো প্রবর্তন করেন মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমীতিথিতে।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে
মার্কণ্ডেয় পুরাণে শ্রীশ্রীচণ্ডী উত্তরলীলায় শুম্ভ নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবীর যে মূর্তির কল্পনা করা হয়েছিল তা ছিল মহাসরস্বতী। এ মূর্তি অষ্টভূজা। বাণ, কার্মূক, শঙ্খ, চক্র, হল, মুষল, শূল ও ঘণ্টা ছিল তাঁর অস্ত্র। তাঁর এই সংহারলীলাতেও কিন্তু জ্ঞানের ভাবনাটি নষ্ট হয়নি।
স্কন্দ পুরাণ
স্কন্দ পুরাণে প্রভাসখণ্ডে দেবী সরস্বতীর নদীরূপে অবতরণের কাহিনি বর্ণিত আছে।
বায়ু পুরাণ
বায়ু পুরাণ অনুযায়ী পুনর্বার প্রজাসৃষ্টির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজ অন্তর থেকেই দেবী সরস্বতীকে সৃষ্টি করেন।
গরুড় পুরাণ
গরুড় পুরাণে সরস্বতীর শক্তি আট রকমের। তুষ্টি, পুষ্টি, শ্রদ্ধা, ঋদ্ধি, প্রভা, কলা, মেধা ও স্মৃতি। তন্ত্র শাস্ত্রমতে সরস্বতী বাগীশ্বরী।
অর্থাৎ পুরাণ শাস্ত্রের সার্বিক বিশ্লেষণেও মাতা সরস্বতীকে নিয়ে দেবীতমে, অম্বিতমে ও নদীতমের ধারণা স্পষ্ট হয়।
★ তবে এই ধারণা কেন এলো যে ব্রহ্মার কন্যা ও স্ত্রী উভয়ই সরস্বতী?
ব্রহ্মা হলেন জ্ঞানের (wisdom) প্রতীক। সেই ব্রহ্মা যদি জ্ঞান হয় তবে জ্ঞান স্থির। সেই জ্ঞান হতে নদীর মতন বাক্যের মাধ্যমে যে নির্যাস বেরিয়ে আসে তাই হল বিদ্যা (knowledge)। জ্ঞানের প্রকাশ যেমন বিদ্যা আবার বিদ্যার উপলব্ধিই জ্ঞান৷ অর্থাৎ বিদ্যা মানুষকে জ্ঞানের দিকেই ধাবিত করে। তাই জন্যেই সরস্বতী দেবী বিদ্যার দেবী, নদী স্বরূপিনী, বাগদেবী এবং নদী স্বরূপিনী বিদ্যাই আমাদেরকে জ্ঞানের দিকে ধাবিত করে। যেহেতু বিদ্যা জন্ম নিয়েছে জ্ঞানের গর্ভে অর্থাৎ ব্রহ্মা হতে, তাই বলা হয় সরস্বতী দেবী ব্রহ্মাজাত। ইহা জড় জগতের পিতা-কন্যা সম্পর্ক নয়। এই জগতের সবকিছু ব্রহ্মা হতেই সৃষ্ট তাই সবকিছুই ব্রহ্মজাত, একইভাবে বিদ্যা তথা সরস্বতীও ব্রহ্মজাত।
একটু দার্শনিক বিশ্লেষণ করি বিষয়টা।
ধরুন একজন শিল্পী একটা অসাধারণ চিত্রকর্ম প্রস্তুত করলেন এবং চিত্রকর্ম শেষ করে শিল্পী নিজের শিল্পকর্মের সৌন্দর্য্য দেখে এতটাই বিমোহিত হলো যে তিনি তার চোখই সড়াতে পারছেন না। শিল্পীর চর্মচোখ এবং অন্তর্চোখ সেই শিল্পকর্মে এতটাই নিমগ্ন হলেন যে শিল্পকর্মের শিল্পরসে একদম ডুবেই গেলেন। এখন স্বাভাবিক বিবেচনায় এটা ত স্পষ্ট যে প্রতিটি শিল্পকর্ম সেই স্বতন্ত্র শিল্পীর সন্তানতুল্য। সেই শিল্পকর্মের শিল্পরসে শিল্পী যখন ডুবে যায় সেটা কি তবে জাগতিক মৈথুনের সাথে প্রাসঙ্গিক হবে?
সরস্বতী ব্রহ্মা হতে উৎপন্ন জ্ঞানের ধারা এবং এই স্ব উৎপন্ন জ্ঞানের দ্যুতি দেখে ব্রহ্মা এতটাই বিমোহিত হলেন যে তিনি সরস্বতীর জ্ঞানরসে নিমজ্জিত হয়ে গেলেন। স্থুল বিশ্লেষণে হতে পারে সেটা কন্যার প্রতি কামাতুর পিতার অভিলাষ কিন্তু সূক্ষ্মদর্শণে এটার ব্যাখ্যা উপরে উল্লেখিত শিল্পী ও শিল্পকর্মের ব্যাখ্যা হতেই স্পষ্ট হয়।
এবার তবে স্পষ্ট হউক স্ত্রীর ধারণাঃ
আমাদের সমাজে দুইটা ধারণা খুব প্রচলিত সেটা হলো পুং ও স্ত্রী। জড়জাগতিক ব্যাখ্যা যাই হোক এর দার্শনিক ব্যাখ্যা অসাধারণ। পুং তথা শিব হলেন হিমালয়। হিমালয় স্থির ও অবিচল। স্ত্রী তথা পার্বতী হলেন নদীস্বরূপা গঙ্গা। নদী সর্বদা অবিরত বহমান। নদীই হিমালয়ের নির্যাস বয়ে নিয়ে যায় মহাসমুদ্রে।। স্ত্রী ভিন্ন পুং যে নিশ্চল। একই দর্শন ব্রহ্মা ও সরস্বতীর জন্যও। ব্রহ্মা যদি জ্ঞানের গর্ভ হয় তবে সরস্বতী বিদ্যার আধার। সেই নদীস্বরূপা সরস্বতীই বিদ্যাকে জ্ঞানের তথা ব্রহ্মার গর্ভ হতে বয়ে নিয়ে যায় নিরন্তর। আরও স্পষ্ট করে বললে ব্রহ্মা যদি থিওরি হয় সরস্বতী তাঁর অ্যাপ্লিকেশন। নিরন্তর একইসাথে চলমান ব্রহ্মা (জ্ঞান) ও সরস্বতী (বিদ্যা) কে তাই স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যা (বিদ্যার প্রকাশ হয় জিহবায়) ও জ্ঞানের (জ্ঞানের জন্ম হৃদয়ে) এই সম্পর্ক অর্থাৎ ব্রহ্মা ও সরস্বতীকে সুন্দর বর্ণনা করেছেন পরম পিতা ব্রহ্মা নিজে। মহর্ষি বাল্মিকী সেটা লিপিবদ্ধ করেছেন এভাবে,
"ত্রীল্লোকান্ ধারয়ন্ রাম দেবগন্ধর্বদানবান্।
অহং তে হৃদয়ং রাম জিহ্বা দেবী সরস্বতী।।"
(যুদ্ধকান্ড/সর্গ-১১৭/শ্লোক-২৩)
অনুবাদঃ শ্রীরাম! আপনি ত্রিভুবনের দেবতা-দানব-গান্ধর্বদের ধারক বিরাট পুরুষ-নারায়ণ।সকলের হৃদয়স্থিত পরমাত্মা। প্রজাপতি ব্রহ্মা আপনার হৃদয় এবং দেবী সরস্বতী আপনার জিহ্বা।
দেবী সরস্বতীর বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
তন্ত্রানুসারে বর্ণিত ধ্যান মন্ত্রানুসারে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ-
দেবী শুভ্রবর্ণা, চতুর্ভুজা এবং তাঁর হাতে পদ্ম , বীণা, পুস্তক, অক্ষমালা, সুধা কলস ও ব্যাখ্যান মুদ্রা। দেবী ত্রিনয়না, তাঁর ললাটে শশীকলা, তিনি শ্বেত পদ্মাসীনা, তিনি হংসারূঢ়া, তিনি সৌভাগ্য ও সম্পদদাত্রী।
তবে বর্তমানে সরস্বতী প্রায় সর্বত্রই দ্বিভুজা। তাঁর হাতে বীণা অপরিহার্য এবং আচার্য যােগেশচন্দ্র রায়ের মতে, “দ্বিভুজা বীণাপাণি সরস্বতী প্রতিমা গত ১৫০ বছরের মধ্যে কল্পিত হয়েছে”।
উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করেই দেবী সরস্বতীর প্রতিমা কল্পিত হয়।
★সরস্বতীর বাহন কেন শ্বেত হংস?
জলে, স্থলে ও আকশে সর্বত্রই হংসের গতি সমান ও নিয়ন্ত্রিত। চিন্ময়ী বা জ্ঞানময়ী দেবী সরস্বতীর স্থলে, জলে, অনলে, অনিলে চির নভোনীলে সর্বত্রই সমান প্রকাশ। এমনকি মুক্ত আকাশে হংস অত্যন্ত বেগে উড্ডয়নশীল, কিন্তু নিচ হতে তাকালে মনে হয় যেন একই স্থানে স্থির ও নিশ্চল হয়ে আছে। হংসের মিশ্রণ হতে জল ও দুগ্ধকে পৃথক করার ক্ষমতা রয়েছে, অর্থাৎ জল ও দুগ্ধ একত্র মিশ্রিত করে দিলেও হংস শুধু সারভূত দুগ্ধ বা ক্ষীরটুকুই গ্রহণ করে, অন্যদিকে অসার জলভাগ তলানিতে পড়ে থাকে। এমনকি হংসের “পর” ও “পালক” এমন উপাদানে তৈরি এবং বিন্যস্ত যে সদা জলে বিচরণ করা সত্ত্বেও একবিন্দু জলও তার গায়ে লাগে না। তাই এ সমস্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে বিদ্যার দেবীর বাহন শ্বেত হংসই যথোপযুক্ত। কারণ জ্ঞানের গতি সকল পরিস্থিতিতে সম ও বিরামহীন হওয়া উচিত এবং জ্ঞানপিপাসু শাস্ত্র হতে কেবল সারাংশই গ্রহণ করবে, কিন্তু জ্ঞানের অহংকার কদাপি তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
★সরস্বতী দেবী কেন শুভ্রকান্তি বা সর্বশুক্লা?
শ্বেত তথা সাদা বর্ণটি সত্ত্বগুণের প্রকাশক। দেবী সরস্বতীও শুদ্ধ জ্ঞানের প্রকাশ স্বরূপা। তাই মাতা সরস্বতীর গায়ের রঙ শুভ্র। তিনি সাদা বর্ণের পদ্মফুলে আসীন, তাঁর বাহন শুভ্র হংস। তাঁর গতি, প্রকৃতি, রুচি সবই শুভ্র। যিনি যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে চান, তাকে অবশ্যই সত্ত্বগুণের স্তরে উন্নীত হতে হয়। নাহলে তাদের পক্ষে পারমার্থিক উপলব্ধি করা অসম্ভব। তাই মানুষ যদি অপবিদ্যাকে জয় করতে চান তাহলে তাকে অবশ্যই সত্ত্বগুণের স্তরে উন্নীত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
★সরস্বতী দেবী কেন শ্বেত পদ্মাসনা?
শতদল পদ্ম যেমন সর্বদিকে পূর্ণ বিকশিত হয়ে প্রস্ফুটিত হয়, আমাদের জ্ঞানও যেন পূর্ণ বিকশিত হয়। শ্বেত পদ্ম যেন প্রস্ফুটিত শুদ্ধ জ্ঞানকেই প্রকাশ করে।
মাতা সরস্বতীর হন্তে ধারণকৃত বিষয়সমূহের তাৎপর্য কী?
★তিনি বীণা কেন হাতে ধারণ করে আছেন?
বীণা এক বিশেষ সুরযন্ত্র। সঙ্গীত ও নাদের এক অন্যান্য মূর্ছনা সৃষ্টি হয় বীণার ঝংকারে। দেবীর ব্রহ্ম বীণায় সাধা রয়েছে চতুর্বেদ এবং চতুর্বেদ ছন্দোময়ী মূৰ্ছনা।
★তিনি পুস্তক ধারণকারী কেন?
পুস্তক হলো জ্ঞানের আধার। একমাত্র পুস্তকাদিই অজ্ঞানতার অন্ধকার ভেদ করে আলোর দিশা দিতে পারে। মানবের জাগতিক ও পারমার্থিক উভয় মুক্তির সোপান হিসেবে কাজ করে শুদ্ধ জ্ঞান। সরস্বতী পুজার মাধ্যমে আমরা মাতা সরস্বতীর কাছে সেই জ্ঞানের জন্যই প্রার্থনা করি। তিনি প্রসন্ন হউক তাহলে দেবী সরস্বতীর কৃপায় এই জগতের অবিদ্যার অন্ধকারে নিমজ্জিত আমরা যারা হাবুডুবু খাচ্ছি, তারা যেন জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হই।
★মালা ধারণকারী কেন?
মাতা সরস্বতী যে মালা ধারণ করে আছেন সেটা হলো জপমালা ৷ তিনি নিত্য জপ করে চলেছেন সকল সৃষ্টি জগতের মূল পরমাত্মাকে। জাগতিক ও পারমার্থিক মুক্তির জন্য আমাদেরকে যে প্রতি মুহুর্তে পরমাত্মাকে স্মরণ করতে হবে সেই নির্দেশনাই দেওয়া হচ্ছে।
কেউ যদি প্রশ্ন করে, কেনো আমরা দেবীর মৃন্ময়ী অর্থাৎ প্রতিমায় পুজো করি!
তখন স্পষ্ট উত্তর হলো শাস্ত্র অনুযায়ী যেভাবে দেবীর রূপ বর্নীত/ কথিত আছে সেই অনুযায়ী চিন্ময়ী মূর্তি চিন্তা করে মৃন্ময়ী মায়ের রূপ তৈরি করি এবং যথাযথ মন্ত্র উচ্চারণ করে মায়ের চরণে অঞ্জলি নিবেদন করি।
সরস্বতী পুজার পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্রঃ
"ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
নমঃভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ।।
এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।।"
সরস্বতী দেবীর প্রনাম মন্ত্রঃ
"নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।
জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।"
★মা সরস্বতী কি শুধু ভারত কিংবা বাংলাদেশই পূজিত!!
মা সরস্বতী পূজিত হয় বিশ্বময় এবং সেটা হাজার বছর ধরে। পৃথিবীর বহু দেশে মা সরস্বতীর পূজা করা হচ্ছে অনাদিকাল থেকে।
★ কোন কোন দেশে হয় মা সরস্বতীর পুজা?
জাপানঃ
© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
🖋️অনিক কুমার সাহা
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)
জাপানে দেবী সরস্বতীকে দুই রূপে পূজা করা হয়। একটা চতুর্ভূজা (চার হাত) অন্যটি অষ্টভূজা (আট হাত) তবে সর্বাধিক প্রচলিত হচ্ছে চতুর্ভূজা।
জাপানে দেবী সরস্বতীকে বেনজাইতেন বলা হয়। দেবীর হাতে ম্যানডোলিন জাতীয় একটি বাদ্যযন্ত্র দেখা যায়।ঠিক যেমন দেবী সরস্বতীর হাতে দেখা যায় বীণা। দুটি স্ট্রিং ইন্সট্রুমেন্ট দুই ভিন্ন দেশের দেবীর হাতে দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় দেবী সরস্বতীর মতো বেনজাইতেনও জ্ঞানের পাশাপাশি সঙ্গীত ও অন্যান্য ললিত কলার পৃষ্ঠপোষক। সম্ভবত ভারত থেকে চীন হয়ে জাপানে পৌছায় সরস্বতী দেবী। সম্ভবত ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে জাপানে এই দেবীর পূজা শুরু হয়। জাপানের হাসেদারা মন্দিরে আছে বেনজাইতেন গুহা। যেখানে রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য জাপানি সরস্বতীর মূর্তি।
ইন্দোনেশিয়াঃ
ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ। এই দেশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দেবী সরস্বতীকে পূজা করা হয়। আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসির এমব্যাসি রো’তে আছে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস। রঙবেরঙের জাতীয় পতাকা। বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সামনে দেশগুলির প্রাতঃস্মরণীয় মনীষীদের ভাস্কর্য দেখতে পাবেন। ব্রিটিশ দূতাবাসের সামনে দেখবেন উইনস্টন চার্চিলের মূর্তি। ভারতের দূতাবাসের সামনে মহাত্মা গান্ধীর মূর্তি, সাউথ আফ্রিকার দূতাবাসের সামনে নেলসন ম্যান্ডেলার মূর্তি, একটা জায়গায় আপনার চোখ এসে আটকে যাবে । একটা দূতাবাসের সামনে তাঁদের দেশের কোনো প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তির মূর্তি নেই। সেখানে বিরাজ করছেন সোনালী ও দুধসাদা রঙের সনাতনী বিদ্যার দেবী সরস্বতী। এই দূতাবাস হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার।
বিশ্বের প্রথম কোন রাষ্ট্র হিসেবে ইন্দোনেশিয়া সম্ভবত ২০১২ সালে আমেরিকাকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ (১৬ ফুট) সরস্বতী মূর্তি উপহার দেয়। ইন্দোনেশিয়ার সংস্কৃতিতে দেবী সরস্বতীকে সংগীত, কলা ও জ্ঞানের দেবী হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।
কামবোডিয়ার আনকোরভাট মন্দিরের গায়ে বহু হিন্দু দেব দেবীর চিত্র অঙ্কিত আছে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে এখানে হিন্দু রাজবংশ রাজত্ত্ব করেছে। একটি দশম ও একটি একাদশ শতাব্দীর লিপি বলছে আনকোরের হিন্দুরা এখানে জ্ঞানের দেবীর পূজা অর্চনা করতেন। কামবোডিয়ার বিভিন্ন পুঁথি ও লিপি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সপ্তম শতাব্দী থেকে ব্রহ্মা ও দেবী সরস্বতীর পুজো হত এখানে। এই অঞ্চলের খেমার বংশের কবিরা এই দেবীর যথেষ্ট গুণগান করেছেন। কামবোডিয়াতে এই দেবীকে বাগেশ্বরী ও ভারতী বলে ডাকা হয়। বিশেষ করে খেমার সাহিত্যে রাজা যশবর্মণের রাজত্ত্ব কালে এই নাম দুটোরই উল্লেখ আছে।
কম্বোডিয়াঃ
কামবোডিয়ার আনকোরভাট মন্দিরের গায়ে বহু হিন্দু দেব দেবীর চিত্র অঙ্কিত আছে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে এখানে হিন্দু রাজবংশ রাজত্ত্ব করেছে। একটি দশম ও একটি একাদশ শতাব্দীর লিপি বলছে আনকোরের হিন্দুরা এখানে জ্ঞানের দেবীর পূজা অর্চনা করতেন। কামবোডিয়ার বিভিন্ন পুঁথি ও লিপি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সপ্তম শতাব্দী থেকে ব্রহ্মা ও দেবী সরস্বতীর পুজো হত এখানে। এই অঞ্চলের খেমার বংশের কবিরা এই দেবীর যথেষ্ট গুণগান করেছেন। কামবোডিয়াতে এই দেবীকে বাগেশ্বরী ও ভারতী বলে ডাকা হয়। বিশেষ করে খেমার সাহিত্যে রাজা যশবর্মণের রাজত্ত্ব কালে এই নাম দুটোরই উল্লেখ আছে।
থাইল্যান্ডঃ
থাইল্যান্ডে দেবী সরস্বতী হলেন বাগ্মিতা ও শিক্ষার দেবী। অন্যান্য দেশে হাঁসের সঙ্গে দেখা গেলেও এখানে দেবীকে দেখা যায় ময়ূরের সঙ্গে।তিব্বতঃ
টিবেট বা তিব্বতে এই দেবীকে বলা হয় 'ইয়াং চেন মা' বা সঙ্গীতের দেবী। তিব্বতীয় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে দেবীকে এখানে ২১ জন তারার একজন বা দেবী মঞ্জুশ্রীর সঙ্গী হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
পরিশেষ বলব পরমেশ্বর ভগবানের জ্ঞানময় রূপ মা সরস্বতীর কৃপায় সমগ্র বিশ্ব থেকে সকল অজ্ঞানতা দূর হয়ে জ্ঞানের আলোতে উদ্ভাসিত হউক। মানব স্থুল জগত হতে সূক্ষ্ম জগতে প্রবেশ করুক।
© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
🖋️অনিক কুমার সাহা
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)
1 মন্তব্যসমূহ
অসাধারণ তথ্যপূর্ণ আলোচনার জন্যে ধন্যবাদ জানাই লেখক কে...
উত্তরমুছুনজয় মা সরস্বতী 🚩🙏