★ শ্রীকৃষ্ণ, পরমেশ্বর নাকি যোগেশ্বর?

 ★ শ্রীকৃষ্ণ, পরমেশ্বর নাকি যোগেশ্বর?

🔳 এটা যদিও একটা অযৌক্তিক প্রশ্ন তবুও অনেকে বলতে চায় শ্রীকৃষ্ণ যোগেশ্বর কিন্তু পরমেশ্বর নন। এই বক্তব্যের পেছনে তাদের যুক্তি হচ্ছে তিনি যোগযুক্ত অবস্থায় পরমেশ্বরের বানী প্রচার করেছিলেন মাত্র, নিজের বানী ছিল না। এমনভাবে যোগযুক্ত অবস্থা কি আর কারোও প্রাপ্ত হয় নি? তবে কি তারাও যোগেশ্বর? বৈদিক ঋষিরাও যোগযুক্ত অবস্থায় ঈশ্বর প্রদত্ত বেদবানী প্রাপ্ত হয়েছিলেন তাহলে তারা সকলেই যোগেশ্বর কিংবা তাঁদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ তিনি যোগেশ্বর?
🔳 অবশ্য যোগেশ্বর ও যোগীশ্বরকে তারা একই মনে করে। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণকে সাধারণ মানুষ (কেউ কেউ উত্তম মানবও বলে) প্রমাণ করার জন্য যা কিছু করা সম্ভব সকল প্রয়াসই তারা করছে।
🔳 চলুন কিছু সন্ধি বিচ্ছেদ করি। জগদ্বীশ্বরের সন্ধি বিচ্ছেদ করলে হয় [ জগৎ + ঈশ্বর ]। একইভাবে "যোগেশ্বর"-এর সন্ধি বিচ্ছেদ করলে হয় "যোগ + ঈশ্বর " অন্যদিকে সমাস করলে হয় "যোগের ঈশ্বর" র-এর ষষ্ঠী বিভক্তি লোপ পেয়েছে। সমাসটি হয় সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস। অন্যদিকে গীতা শাস্ত্রি জগদীশ ঘোষ এর গীতাভাষ্যের ১০/১৭ মন্ত্রে "যোগীন্" শব্দটির অর্থ রয়েছে যোগেশ্বর, যা অলৌকিক সৃষ্টি- কৌশল ও ঐশ্বর্যাদি গুনসম্পন্ন। ইহা একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া কারো নেই। যোগের ঈশ্বর হচ্ছে আসলে সকল যোগসমুহের ঈশ্বর, কিন্তু শ্রেষ্ঠ যোগী কোনভাবেই নয়। সংযোগ, সংহনন, উপায়, ধ্যান, সঙ্গতি, সাধনা এগুলো সবই যোগ। এই যোগসমুহের চালিকাশক্তি হচ্ছে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি। পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ গীতায় এই সকল বিষয়গুলোর সমাধান দিয়েছেন বলেই তিনি সকল যোগসমুহের ঈশ্বর তথা "যোগেশ্বর"। 

💠 বিভিন্ন মহান ভাষ্যকার ও আদিগুরু শঙ্করাচার্য "যোগেশ্বর" এর যা যা অর্থ করেছেন,

১.শঙ্করভাষ্যঃ
"যোগেশ্বরঃ সর্ব্বযোগনামীশ্বরস্তৎপ্রভাবত্বাৎ সর্ব্বাযোগীবীজশ্চ কৃষ্ণোযত্র"

অনুবাদঃ যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ সকল যোগের ঈশ্বর এবং তিনি সকল যোগ সমূহের বীজ স্বরূপ।

২.শ্রীধরস্বামী টীকাঃ
"যত্র যেষাং পক্ষে যোগীনামীশ্বরঃ শ্রীকৃষ্ণবর্ত্ততে চ পার্থোগন্ডীবধর্নুদ্ধবস্তত্রৈব শ্রীরাজ্যলক্ষ্মীত্রৈব"

অনুবাদঃ যাহার পক্ষে যোগের ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণ আছেন এবং যেখানে গান্ডীবধারি অর্জুন আছেন রাজ্য জয় সেখানেই।

৩.মধুসূদন সরস্বতী টীকাঃ 
"যোগেশ্বরঃ সর্ব্বযোগসিদ্ধীনামীশ্বরঃ সর্ব্বযোগশক্তির্ভগবান কৃষ্ণো"

অনুবাদঃ যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ সকল যোগ সিদ্ধীর ঈশ্বর এবং সকল যোগশক্তির ভগবান।

৪.আনন্দগিরি টীকাঃ
"সর্ব্বেষাং যোগনামীশ্বরোভগবানিতি"

অনুবাদঃ সকল যোগ সমূহের ঈশ্বর হলেন ভগবান (শ্রীকৃষ্ণ)

৫.রামানুজ ভাষ্যঃ
"সর্ব্বেষাং যোগনামমীশ্বরঃ"

অনুবাদঃ সমস্ত যোগ সমূহের ঈশ্বর (কৃষ্ণ)

🔳 শ্রীকৃষ্ণকে যোগী প্রমাণ করার জন্য যাজ্ঞবল্ক্যের প্রসঙ্গও আনা হয় কারণ যাজ্ঞবল্ক্যকেও যোগীশ্বর বলা হয়। শ্রীকৃষ্ণ যোগেশ্বর এবং যাজ্ঞবল্ক্য যোগীশ্বর তাই তাঁরা দুজনেই ব্রহ্মজ্ঞানী কিন্তু ব্রহ্ম না এই হচ্ছে তাহাদের যুক্তি।

 যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতার প্রথম অধ্যায়ের যাজ্ঞবল্ক্যকে যোগেশ্বর বলা হয়েছে বলে প্রচার করা হয় তাই যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে যাজ্ঞবল্ক্যকের সাথে তুলনা করা চলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিতে যাজ্ঞবল্ক্যকে যোগেশ্বর নয় যোগীশ্বর বলা হয়েছে।

"যোগীশ্বরং যাজ্ঞবল্ক্যং সম্পুজ্জ মুনয়োহধ্রুবন্"

আর গীতায় এবং মহাভারতের কয়েক জায়গায় শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয়েছে যোগেশ্বর। দুটি শব্দের অর্থ কখনই এক না। আর যাজ্ঞবল্ক্য নিজেকে নাকি "আমি ব্রহ্ম" বলেছেন তাই গীতাতে শ্রীকৃষ্ণের "আমি ব্রহ্ম" বলার সাথে তুলনা করে দুটোকে এক করে দেওয়া হয়। কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্য কি সুর্দশন চক্র বা যোগৌশ্বর্য বিশ্বরুপ দেখিয়েছিলেন?

🔸 শ্রীকৃষ্ণ নিজেই যে পরমেশ্বর তিনি শ্রীমদভগবদগীতায়ই স্পষ্ট করেছেন,

"যেহেতু আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর থেকেও উত্তম্ সেহেতু ইহলোকে ও বেদে আমি পুরুষোত্তম নামে বিখ্যাত।"
"হে ভারত, যিনি নিঃসন্দেহে আমাকে পুরুষোত্তম্ বলে জানেন, তিনি সর্বদা এবং তিনিই সর্বতভাবে আমাকে ভজনা করেন।"

- শ্রীমদভগবদগীতা (১৫/১৮-১৯)

🔳 শ্রীমদভগবদগীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের ৭৩-৭৮ নং শ্লোক থেকেও স্পষ্ট হয় যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর। কিন্তু তখনই চলে আসে অন্য প্রসঙ্গ অর্থাৎ অনুগীতার রেফারেন্স দিয়ে বলা হয় শ্রীকৃষ্ণ গীতা বিস্মৃত হয়েছিলেন কারণ তিনি যোগযুক্ত অবস্থায় গীতার বানী দিয়েছিলেন। যোগযুক্ত ও যোগমুক্তের বিষয়টা এই লিখার পরের অংশে বিশ্লেষণ করা হবে। সেক্ষেত্রেও তাদের আরেকটা মিথ্যাচার আছে যে ইন্দোনেশিয়ায় কে বা কাহারা ৭০ শ্লোকের গীতা পেয়েছে তাই সেটাই সত্যিকার গীতা। তাহলে কি আদিগুরু শঙ্করাচার্য নিজে ৭০০ শ্লোকের গীতা বানিয়ে ফেলেছে? অর্থাৎ নিজেদের প্রয়োজনে তারা যতটা বিকৃত করা সম্ভব করতে পারবে কিন্তু অন্যরা যুক্তি ও প্রমাণ দিলেই সেটা প্রক্ষিপ্ত। অর্থাৎ তাদের যুক্তি, প্রমাণ ও ভাষ্যই পরম সত্য।


🔳 এবার তাহলে একটু মহাভারত খুজে দেখা যাক।

 রাজা যুধিষ্ঠির সাম্রাজ্যে অভিষিক্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে সম্বোধন করে বললেন,

"বাসুদেব, আমি কেবল তোমার অনুগ্রহ, নীতি, বল, বুদ্ধি-কৌশল ও বিক্রম প্রভাবেই এই পিতৃ-পিতামহোপভুক্ত রাজ্য পুনরায় প্রাপ্ত হইলাম, অতএব পুনঃপুন নমস্কার করি। তুমি অদ্বিতীয় পুরুষ ও যাদবদিগের একমাত্র অবলম্বন। ব্রাহ্মণগণ তোমার বহুবিধ নাম উল্লেখপূর্বক স্তব করিয়া থাকেন। তুমি বিশ্বকর্মা ও বিশ্বাত্মক, এই জগৎ তোমা হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে। তুমি বিষ্ণু, জিষ্ণু, হবি, কৃষ্ণ, বৈকুন্ঠ ও পুরুষোত্তম। তুমি সপ্ত আদিত্য। তুমি একমাত্র হইয়াও ভিন্ন ভিন্ন বিগ্রহ ধারণ করিয়াছ। তুমি তিন যুগেই বিদ্যমান আছ। তুমি পূর্ণকীর্ত্তি, হৃষীকেশ ও যজ্ঞেশ্বর। তুমি ব্রহ্মারও গুরু, তুমি ত্রিনয়ন শম্ভু।"
মহাভারত, শান্তিপর্ব
(কালীপ্রসন্ন কর্তৃক অনুবাদিত)

 কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যখন রথের চাকা হাতে মহামহিম ভীষ্মকে মারতে উদ্যত হলেন তখন ভীষ্ম বললেন,

"হে ভূতশরণ্য, হে লোকনাথ! আমাকে অবিলম্বে রথ হইতে পতিত করো। হে কৃষ্ণ! তুমি আমাকে সংহার করিলে আমার ইহলোক ও পরলোক উভয় লোকেই শ্রেয়লাভ হবে (শ্রেয় ও প্রিয় - এর ব্যাখ্যা উপনিষদে আছে।) ও ত্রিলোকমধ্যে প্রভাব প্রনিত হইবে।"
মহাভারত, ভীষ্মপর্ব (কালিপ্রসন্ন কর্তৃক অনুবাদিত)

 ভীষ্ম যখন শরশয্যায় তখন পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠির ও তাঁর ভ্রাতাদের নিয়ে কুরুক্ষেত্রে গিয়ে মহামহিম ভীষ্মকে বললেন,

"যুধিষ্ঠির আপনার নিকট ধর্মজিজ্ঞাসা করতে এসেছেন।"

 তখন মহামহিম ভীষ্ম বললেন,
"হে নারায়ণ, তোমার কথা শুনে আমি হর্ষে আপ্লুত হয়েছি। বাক্-পতি তোমার কাছে আমি কি বলিব? সমস্ত বাস্তবতাই তোমার বাক্যে নিহিত আছে৷ দুর্বলতার ফলে আমার বাক্-শক্তি ক্ষীণ হয়েছে, দিক আকাশ ও পৃথিবীর বোধও লুপ পেয়েছে, কেবল তোমার প্রভাবেই জীবিত রয়েছি। কৃষ্ণ, তুমি শ্বাশত জগৎকর্তা, গুরু উপস্থিত থাকতে শিষ্যতুল্য আমি কি ক'রে উপদেশ দিব?
মহাভারত, শান্তিপর্ব, পৃষ্ঠা-৫৫৯ (রাজশেখর বসু অনূদিত)

 পূর্বকালে মহর্ষি ও সুরগণ সমবেত হইয়ে গন্ধমাদনপর্বতে পিতামহ ব্রহ্মার নিকট সমুপস্থিত হলেন৷ প্রজাপতি ব্রহ্মা তাঁদের মধ্যে পরমসুখে উপবেশন করে ত্রিলোকনাথ বিষ্ণুকে বিধানুসারে অর্চনা করে স্তব করলেন,

"হে বসুদেব! তুমি বিশ্ববাসু, বিশ্বশ্বর, বিশ্বমূর্তি ও বিশ্বকেসন, আমি তোমাকে পরম দেবতা বলিয়া স্বীকার করি৷ হে মহাদেব! তুমি বিশ্ব, তুমি লোকের হিতানুষ্ঠানে নিরত, তুমি যোগেশ্বর, তুমি সকলের প্রভু, তুমি যোগাপরায়ণ। হে অনন্ত! হে পদ্মনাভ! হে বিশ্বলোচন! তুমি ঈশ্বরের ঈশ্বর, তুমি ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানের প্রভু। হে প্রিয়দর্শন! তুমি আত্মজের আত্মজ, তুমি অসংখ্য গুণের আধার, তুমি লোকসকলের পরমগতি।"
মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, অধ্যায়-৬৫
(কালিপ্রসন্ন কর্তৃক অনুবাদিত)

 দুর্য্যোধন শরশয্যায় অধীষ্ঠিত মহামহিম ভীষ্মের কাছে কৃষ্ণ মাহাত্ম্য জানতে চাইলে মহামহিম ভীষ্ম বললেন,

"রাজন! বাসুদেব মাহাভূত ও সকল দেবতর দেবতা, তাহা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নিরীক্ষিত হয় না। মহর্ষি মার্কণ্ডেয় তাঁহাকে মহৎ ও অদ্ভুত বলিয়া কীর্ত্তন করিয়া থাকেন; তিনি সমুদয় ভূত, ভূতাত্মা, মহাত্মা ও পুরুষোত্তম। সেই মহাত্মা পুরুষোত্তম পৃথিবী, জল, বায়ু ও তেজ এই সকল পদার্থ সৃষ্টি করিয়া সলিলে শয়ন করিয়াছিলেন। সেই সর্ব্বতেজময় পুরুষ যোগবলে সলিলে শয়ন করিয়া মুখ হইতে অগ্নি, প্রাণ হইতে বায়ু এবং মন হইতে সরস্বতী ও বেদ সমুদয় সৃষ্টি করিয়াছেন।“
মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, অধ্যায়-৬৭
(কালিপ্রসন্ন ভাষ্য)


🔲 যাহারা বলেন পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত অবস্থায় গীতা দান করেছিলেন তাহারা কি শ্রীমদভগবদগীতার বিশ্বরূপদর্শনযোগ অধ্যা পড়েন নি?
১১শ অধ্যায়ের ৩৯-৪৬ শ্লোকসমুহে অর্জুনের বক্তব্য শুনলেই স্পষ্ট হয়ে যায় শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর ছিলেন।।

🔸গীতার ১১/৪১-৪২ শ্লোকদ্বয়ে অর্জুন বলেন,
"পূর্বে আমি তোমার মহিমা না জেনে তোমাকে 'হে কৃষ্ণ', 'হে যাদব', 'হে সখা' বলে সম্বোধন করেছি। প্রমোদবশত এবং প্রণয়বশত যা কিছু করেছি তা তুমি দয়া করে ক্ষমা কর।"
"বিহার, শয়ন, ভোজনের সময়, কখনো একাকী, কখনো অন্যদের সমক্ষে, আমি যে অসম্মান করেছি, সে সমস্ত অপরাধ দয়া করে ক্ষমা কর।"

🔸 পরবর্তী দুই শ্লোকে অর্জুন বলেন,
"হে অমিতপ্রভাব, তুমি এই চরাচর জগতের পিতা, পূজ্যগুরু এবং গুরুর গুরু। অতএব, ত্রিভূবনে তোমার মত আর কেউ নাই। তোমার থেকে শ্রেষ্ঠ অন্য কে হতে পারে?"
"হে পরম পূজ্য ভগবান, তাই আমি তোমাকে প্রণাম করে তোমার কৃপা ভিক্ষা করছি। পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখায়, প্রিয় যেমন প্রিয়ার অপরাধ ক্ষমা করে, তুমিও সেই ভাবে আমার অপরাধ ক্ষমা কর।"
(গীতা- ১১/৪৩-৪৪)

🔸 এরপর ভীতসন্ত্রস্ত অর্জুন পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের সেই সৌম্য চতুর্ভুজ রূপ দেখতে চেয়ে বলেন,

"হে সহস্রবাহো, আমি তোমাকে সেই গদা ও চক্রধারী রুপে দেখতে ইচ্ছা করি। হে বিশ্বমূর্তি, এখন তুমি তোমার সেই চতুর্ভূজ মূর্তি ধারণ কর।" (গীতা- ১১/৪৬)


🔸 এখন কুতার্কিকরা বলবে এহেন বিশ্বরূপ আরও অনেকে দেখিয়েছেন। তাহলে গীতা ১১/৪৭ শ্লোকে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এটা কি বলিলেন?

"তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে আমি তোমাকে জড়জগতের অন্তর্গত আত্মযোগ স্বরুপ শ্রেষ্ঠরুপ দেখালাম। তুমি ছাড়া পূর্বে আর কেউই সেই আদি তেজময় রুপ দেখেনি।"

🔷 অনুগীতার প্রক্ষিপ্ততাঃ

পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে যোগেশ্বর (তাদের ভাষ্যে যোগযুক্ত) প্রমানে তাদের প্রথম যুক্তি মহাভারতের অশ্বমেধিকাপর্বের "অনুগীতা" অংশটি। যদিও অন্য অনেক বিষয়ে তারা মহাভারতকেই প্রক্ষিপ্ত বানিয়ে দেয় কিন্তু নিজেদের অপপ্রচারকে বৈধতা দেওয়ার জন্য অনুগীতাকে প্রক্ষিপ্ত মানবে না। তারা প্রচার করে শ্রীকৃষ্ণ যে গীতাজ্ঞান অর্জুন কে দান করেছিলেন সেটা নাকি শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত হয়ে দিয়েছিলেন। এই অপ্রাসংগিক দাবি তখনই মেনে নেয়া যায় যখন অনুগীতা নিশ্চিত রূপে মহাভারতের অংশ হিসেবে প্রমানিত হয়। কিন্তু অনুগীতা আদৌ মহাভারতের অংশ ছিল না। পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণবিরোধীরা শ্রীকৃষ্ণকে সাধারণ মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য একটা সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র।

 শ্রীরাধিকা চরিত্রকে কাল্পনিক প্রমাণ হেতু তাহারা বঙ্কিমচন্দ্রের "কৃষ্ণচরিত্র" গ্রন্থটি ব্যবহার করেন সেই গ্রন্থ হতেই অনুগীতার প্রক্ষিপ্ততা প্রমাণ করা যায়।
কোন বই কে কৃষ্ণের উক্তি হিসেবে কেউ দাবি করলেই সেটি ত আর কৃষ্ণের উক্তি হয়ে যাবে না, কারণ গীতায় বর্ণিত ধর্মের সাথে অনুগীতায় বর্ণিত ধর্মের কোন মিল নেই, অনুগীতা আর গীতা পরস্পর সাংঘর্ষিক। অনুগীতায় শ্রীকৃষ্ণকে সাধারণ মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন করার প্রয়াস করা হয়েছে। অপরদিকে গীতায় শ্রীকৃষ্ণ কে সর্বভূতের মহেশ্বর রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অনুগীতার সাথে গীতার অনেক তফাৎ, অনুগীতাকে শ্রীকৃষ্ণের উক্তি বা বাণি বলে চালিয়ে দেবার শত প্রয়াস করেও কোন লাভ হয় নি, কারণ জোড়া দাগ খুবই স্পষ্ট।গীতায় বর্ণিত ধর্মের সাথে অনুগীতায় বর্নিত ধর্মের কোন সাদৃশ্য নেই। শ্রী কাশীনাথ "ত্রম্বক উপক্রমণিকা"য় যথেষ্ট যুক্তি ও প্রমানের সাহায্যে দেখিয়েছেন যে, অনুগীতার রচনা হয়েছিল গীতা রচনার কয়েক শতবছর পরে।
পরিশেষে একটা কথাই বলব অনুগীতা যে প্রক্ষিপ্ত বা শ্রীকৃষ্ণবিরোধীদের রচিত তার বড় প্রমান হলো পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে ইহার কিছু মাত্র প্রসংগ নেই।
[রেফারেন্স-কৃষ্ণচরিত্র; ষষ্ঠ খন্ড; দ্বাদশ পরিচ্ছেদ; কৃষ্ণ প্রয়ান (ঋষী বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)]

★প্রক্ষিপ্ত অনুগীতার প্রবেশ ঘটিয়েছিল কারা?

আজকে যারা পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে সাধারণ প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে তারাই।

🔳 এখন যদি যুক্তিতর্কের খাতিরে ধরেও নেই অনুগীতা প্রক্ষিপ্ত নয় তাহলে অনুগীতা হতেই যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করছি যে শ্রীকৃষ্ণ তথাকথিত যোগযুক্ত অবস্থায় ছিলেন না৷

🔹 কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধকালে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের নিকট যে গীতামৃত দান করেছিলেন, সেই পবিত্র গীতাজ্ঞান অর্জুন ভুলে গিয়ে অশ্বমেধপর্বে শ্রীকৃষ্ণের নিকট পুণরায় শুনতে চান।
তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন,

“তুমি নিশ্চয় দুর্ম্মেধা, তাই আমার সেই সকল কথা স্মরণ রাখিতে পার নাই ৷”
তিনি আরও বলিলেন—
"পরম হি ব্রহ্ম কথিতং যোগযুক্তেন তন্ময়া।
ইতিহাসস্তু বক্ষ্যামি তস্মিন্নর্থে পুরাতনম্ ৷৷"

অর্থাৎ, তৎকালে আমি যোগযুক্ত হইয়া পরব্রহ্মের বিষয় বলিয়াছিলাম, এখন সেই বিষয়ে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলিতেছি।
(মহাভারত, আশ্বমেধিকপর্ব্ব, অনুগীতা)

 এখানে লক্ষ্যণীয় যে, যোগ শব্দের নানা প্রকার অর্থ আছে ৷ এখানে কোন অর্থে যোগ-শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা স্পষ্ট লেখা আছে—
"যোগযুক্তেন ঐক্যাগ্রসমন্বিতেন"
(ভারতকৌমুদী টীকা)
অর্থাৎ, এখানে যোগযুক্ত অর্থ 'একাগ্রতার সহিত' ৷

🔹 ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধকালে অর্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করার জন্য সম্পূর্ণ একাগ্রতার সহিত যে সকল বাক্য ব্যয় করেছিলেন, তা আবার এখন পুনঃউক্তি করবেন কিসের নিমিত্তে? তাছাড়া অর্জুন যে গীতা ভুলে গেছেন তার দুর্বল মেধাবশত, তাকে পুনরায় গীতাজ্ঞান বললেও সে যে আবার ভুলে যাবে না তারই বা নিশ্চয়তা কি?

🔸 তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন,
“আমি সেই বিষয়ে তোমাকে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলিতেছি ৷”
অর্থাৎ সেই গীতাজ্ঞানই তিনি প্রকারন্তরে ইতিহাস গল্পের মাধ্যমে বলবেন ৷ কেননা গল্পের মাধ্যমে যদি খুব কঠিন বিষয়ও আলোচনা করা হয়, তবে সেটা খুব সহজেই মনে রাখতে পারা যায়। এই জন্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই উপায়টি অবলম্বন করেন।
পরবর্তীতে গীতাজ্ঞান এইরুপে ভিন্নভাবে কথিত হওয়ায় একে ‘অনুগীতা’ বলা হয় ৷ অনুগীতা প্রদানের পর ভগবান বলিলেন—
"পূর্বমপ্যেতদেবোক্তং যুদ্ধকাল উপস্থিতে।
ময়া তব মহাবাহো তস্মাদত্র মনঃ কুরু।।"

(অশ্বমেধিকপর্ব, ৬৬/৭)

অনুবাদঃ মহাবাহু! পূর্বেই কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের সময় উপস্থিত হইলে, আমি তোমার নিকট ভগবদগীতাস্বরূপ এই বিষয়ই বলিয়াছিলাম, অতএব তুমি এই বিষয়ে মনোনিবেশ কর।
অতএব এইটা সুস্পষ্ট যে ভগবান যদিও সরাসরি ভাবে অর্জুনকে পুনরায় গীতা জ্ঞান প্রদান করতে অসম্মতি জানান তবুও ইতিহাসের মাধ্যমে ভগবান এখানে গীতার বিষয়ই তুলে ধরেছেন, যাতে করে অর্জুন সেই জ্ঞানটা আয়ত্ত করতে পারে।

অর্থাৎ, শ্রীকৃষ্ণ কেবল অর্জুনকে নয় বরং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে নিমিত্ত করে সমগ্র সংসারকে গীতাগ্রন্থ দান করেছিলেন। তাই একই জ্ঞান আলাদা করে অর্জুনকে দ্বিতীয়বার প্রধান করার কোন উপযোগিতা নেই।



🔲 এখন কিছু সাধারণ যুক্তি দিয়ে গীতার কিছু শ্লোক বিশ্লেষণ করি।

🔸 গীতার ৬/৪৭ নং শ্লোকে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

"যিনি শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া মদগতচিত্তে আমার ভজনা
করেন, যোগীদের মধ্যে তিনিই আমার সহিত
যোগে সর্বাপক্ষো অধিক যুক্ত।"

🔸 এরপর গীতার ৭/১ নং শ্লোকে বলেছেন,

"হে অর্জুন, তুমি আমাতে নিবিষ্টচিত্ত ও একমাত্র
আমার শরণাপন্ন হইয়া যোগযুক্ত হইলে
যেভাবে আমার সমগ্র স্বরূপ জানিতে পারিবে,
তাহা বলিতেছি শোনো।"

🔸 এরপর গীতার ৭/২৫ নং শ্লোকে বলেছেন,

"আমি যোগমায়ায় সমাচ্ছন্ন থাকায় সকলের কাছে
প্রকাশিত হই না। তাই মূর্খেরা জন্মমরণরহিত
আমাকে জানতে পারে না।"

একজন সাধারণ যোগীপুরুষ কিভাবে নিজেকে যোগমায়ায় সমাচ্ছন্ন রাখতে পারে!

🔸 শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং গীতার অষ্টম অধ্যায়ে যোগীগণের মুক্তির উপায়ও বলে দিয়েছেন,

"বেদবিদগণ যাঁহাকে অক্ষর বলেন, অনাসক্ত
যোগীগণ যাঁহাতে প্রবেশ করেন, যাঁহাকে
লাভ করিবার জন্য ব্রহ্মচারিগণ ব্রহ্মচর্য অনুষ্ঠান
করেন, আমি তোমাকে সংক্ষেপে সেই পরম
পদ প্রাপ্তির উপায় বলিতেছি।"

(গীতা- ৮/১১)

"হে অর্জুন, যে যোগী অনন্যমনা হইয়া চিরদিন
নিরন্তর আমাকে স্মরণ করেন, সেই সমাহিত
যোগীর পক্ষে আমি সুলভ জানিবে।"

(গীতা- ৮/১৪)

"মাহাত্মারা আমাকে পাইলে পরম সিদ্ধিলাভ করেন,
তাই তাঁহারা আর এই দুঃখময় অনিত্য সংসারে পুনর্জন্ম
প্রাপ্ত হন না।"

(গীতা- ৮/১৫)

"হে অর্জুন, ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সমস্ত লোক
হইতেই জীবসকল ফিরিয়া পুণরায় জন্মগ্রহন
করে, কিন্তু আমাকে পাইলে আমার পুনর্জন্ম
লইতে হয় না।"

(গীতা- ৮/১৬)

★ শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর হয়েও জন্মগ্রহণ করলেন কিভাবে?

যজুর্বেদের ৪০/৮ নং মন্ত্রের স্পষ্ট বলা হয়েছে ঈশ্বর জন্মরহিত এবং শরীররহিত অর্থাৎ ঈশ্বর কখনো জন্মগ্রহন করেন না বা শরীর ধারণ করেন না। তাহলে জন্মগ্রহণ ও দেহধারণ করে শ্রীকৃষ্ণ কিভাবে ঈশ্বর হন?

🔸 এখন দেখা যাক শ্রীকৃষ্ণ গীতায় এ ব্যাপারে কী বলেছেন! গীতার ৪/৬ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

"আমার জন্ম ও মৃত্যু নাই। আমি সকলের ঈশ্বর।
আমি নিজ প্রকৃতিকে আশ্রয় করিয়া নিজ মায়া বলে
আদি চিন্ময়রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।"

তিনি ত এই শ্লোকে যজুর্বেদ ৪০/৮ মন্ত্রেরই অবতারণা করলেন।

সংসারের কল্যাণ ও ধর্ম সংস্থাপন হেতুই তিনি যুগে যুগে অবতীর্ণ হন এবং দিব্য দেহ ধারণ করেন। তিনি আমাদের মত জড় দেহ ধারণ করেন না বরং তাঁর জন্ম, দেহ ও কর্ম সকলই দিব্য। মহাভারতের পাতায় পাতায় তাঁর দিব্য কর্মের উপাখ্যান লিখিত আছে।

🔸 এই বিষয়ে গীতার ৪/৯ নং শ্লোকে স্পষ্টই বলা হয়েছে,

"হে অর্জুন, যিনি আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম
প্রকৃতভাবে জানেন, দেহত্যাগ করিলে তাঁহার আর
জন্ম হয় না, তিনি আমাকেই প্রাপ্ত হন।"



🔳 এত বিচার বিশ্লেষণের পরও যারা সন্দিহান তাদের জন্যও শ্রীমদভগবদগীতায় সমাধান দেওয়া হয়েছে।

🔸 এদের সম্পর্কে পরমেশ্বর শ্রীমদভগবদগীতার নবম অধ্যায়ের ৯/১১-১২ শ্লোকদ্বয়ে বলে দিয়েছেন।

"আমি যখন মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হই, তখন মুর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে। তারা আমার পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয় এবং তারা আমাকে সর্বভূতের মহেশ্বর বলে জানে না।"
"এভাবেই যারা মোহাচ্ছন্ন হয়েছে, তারা রাক্ষসী ও আসুরী ভাবের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেই মোহাচ্ছন্ন অবস্থায় তাদের মুক্তি লাভের আশা, তাদের সকাম কর্ম এবং জ্ঞানের প্রয়াস সমস্তই ব্যর্থ হয়।"

🔸 শ্রীমদভগবদগীতার বিভিন্ন শ্লোক নিয়ে যারা মনগড়া বিভ্রান্তি ছড়ায় তাদের সম্পর্কেও স্পষ্ট শ্রীমদভগবদগীতার ১৮/৬৭ শ্লোকে স্পষ্ট বলা হয়েছে,

"যারা সংযমহীন, ভক্তিহীন, পরিচর্যাহীন এবং আমার প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন তাদের কখনও এই গোপনীয় জ্ঞান প্রদান করবে না।"

🔘 বিঃদ্রঃ তবুও একদল এই বিষয়ে কুতর্ক অব্যাহত রাখবে। যারা তার্কিক তারা সমধান নয় বিতর্কে বিশ্বাসী। নাস্তিকরাও ঈশ্বর নিয়ে, ঈশ্বরের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নিজেদের হতাশা নিবারণ করে তাই বলে কিন্তু ঈশ্বর কাল্পনিক হয়ে যায় না। পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে বহু নামে ডাকা হয় যেমন কেশব, মাধব, গোবিন্দ, বাসুদেব, গোপাল। সেই বহু নামের মধ্যে তিনি যোগেশ্বর হিসেবেও পুজিত।

🔵 জয় শ্রীকৃষ্ণ। 🙏

©স্টিমন অনিক। 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ