🔱 নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়- সভ্যতার প্রথম পুর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়।।

 

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, গুপ্ত সাম্রাজ্য তথা ভারতীয় উপমহাদেশের এক সুপ্রাচীন নিদর্শন এবং প্রাচীন বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মহাবিহার তথা পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নালন্দা। বর্তমান ভারতের বিহারের মগধে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় ১৬০০ বছর আগে। কে জানে নালন্দা মহাবিহারের জন্যই "বিহার" নামকরণ হয়েছিল কিনা!

এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয় ৪১৩ খ্রিস্টাব্দে। সেসময় এমন সুসজ্জিত ও পূর্ণাঙ্গ আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব ইতিহাস ঘেটে পাওয়া যায় না। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, সেসময় এ অঞ্চলে গুপ্তদের শাসনামল চলছিল। সে অনুযায়ী, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সম্রাট কুমারগুপ্তকেই ধরে নেয়া হয়। পরবর্তীতে পাল রাজাদের আমলে শিক্ষা-দীক্ষায় বেশ অগ্রগতি লাভ করে নালন্দা। ধর্মপালের সময়ে বিক্রমশীলা, সোমপুর ও ওদন্তপুরী প্রতিষ্ঠিত হলে তা নালন্দা মহাবিহারের জ্ঞানচর্চার গতিকে আরও ত্বরান্বিত করে। পূর্বের সেই সোমপুর বর্তমান বাংলাদেশের পাহাড়পুরে অবস্থিত। অর্থাৎ নালন্দার কল্যাণে সেই সময় থেকেই বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক জ্ঞান চর্চা শুরু হয়। সে বিবেচনায় গবেষক সৈয়দ নিজারের বক্তব্য অনুসারে, সোমপুরকে বঙ্গভূমির প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আখ্যায়িত করলে বোধহয় ভুল হবে না।
নালন্দা সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা দেন চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং। তার বক্তব্য থেকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্থান-পতন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। চতুর্থ শতকের দিকে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম দ্বাদশ শতক কিংবা তার পরবর্তী বেশ কিছু সময় পর্যন্ত চলমান ছিল। হিউয়েন সাংয়ের অবস্থানকালে নালন্দায় প্রায় ছয় হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণের খবর পাওয়া যায়। সপ্তম শতকের দিকে নালন্দা শিক্ষা-দীক্ষায় সবচেয়ে বেশি উৎকর্ষতা লাভ করেছিল বলেও ধারণা করা হয়। প্রায় ১০০ শ্রেণীকক্ষ এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থাসহ সে সময় প্রায় দুই হাজার শিক্ষক এবং ২০ হাজার শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে তৎকালীন পৃথিবীতে জ্ঞানচর্চার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে নালন্দার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা তখন নালন্দায় শিক্ষা গ্রহণ করতে আসতো। কোরিয়া, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, তুরস্ক, তিব্বতসহ আরও বিভিন্ন দেশ থেকে আগত শিক্ষার্থীবৃন্দের আগমনে এক জনবহুল ও মুখরিত ক্যাম্পাস হিসেবে বিরাজমান ছিল নালন্দার ক্যাম্পাস। শিল্পজ্ঞান সমৃদ্ধ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিতর্ক এবং সভা অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য ছিল বিশেষ কক্ষ এবং সে কক্ষগুলো শুধুমাত্র এসব কাজেই ব্যবহার করা হতো।
নালন্দার সমৃদ্ধ ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা মেলে নালন্দার লাইব্রেরী নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণ করার পর। প্রাচীন আমলে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভের জন্য শিক্ষার্থী-গবেষকদের জন্য নালন্দার বিকল্প ছিল না। পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তাদের উদার নৈতিকতার দরুন নালন্দা পেয়েছিল বিশাল এক সমৃদ্ধ সংগ্রহ। নালন্দায় সংরক্ষিত পুস্তকের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, সেখানে প্রায় লক্ষাধিক পুস্তক সংরক্ষিত ছিল। গ্রন্থাগারটি তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ভবনে বিন্যস্ত ছিল। এদের নামকরণ করা হয় রত্নসাগর, রত্নদধি এবং রত্নরঞ্জক নামে। এদের মধ্যে রত্নদধির ছিল প্রায় নয়তলা বিশিষ্ট ভবন। এসব গ্রন্থাগারে শুধুমাত্র ধর্মভিত্তিক পুস্তকের পাশাপাশি ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য, জ্যোতিষবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভেষজবিদ্যা সংবলিত গ্রন্থাবলিও ছিল। আয়ুর্বেদের সবচেয়ে বেশী উৎকর্ষতা সাধিত হয় এই নালন্দার গবেষণাগারেই।

নালন্দা মহাবিহারে প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞানের বিস্তার, প্রসার এবং উদ্ভব (নতুন গবেষণা)। অর্থাৎ এর প্রতিষ্ঠার প্রয়াস এবং উদ্দেশ্যগত দিক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার কোনো পার্থক্য নেই। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই গবেষণার কাজ করতে হবে। আর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মূল কাজই ছিল নতুন জ্ঞানের অন্বেষণ। কেননা নালন্দার শিক্ষার্থী-অধ্যাপকবৃন্দ কোনো জ্ঞানকেই সার্বিক জ্ঞান মনে করতেন না। তারা সকল সত্যকেই আংশিক সত্য মনে করতেন (আপেক্ষিকতা), যাকে সংস্কৃত ভাষায় ‘সংবৃত’ বলা হয়। এবং সকল জ্ঞানকে সংবৃত ধরেই তারা নতুন জ্ঞান আরোহণের পথে অগ্রসর হতেন, যা বর্তমান আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভিত্তি।


তৎকালীন নালন্দায় জ্ঞান অর্জন ছিল সকলের জন্য উন্মুক্ত। কোনো ধরনের শ্রেণী, লিঙ্গ, বর্ণগত বৈষম্যের উপস্থিতি সেখানে ছিল না। হিউয়েন সাংয়ের বক্তব্য অনুসারে জানা যায়, তখন প্রতি ১০ জনের মধ্যে দুজন নালন্দায় শিক্ষার সুযোগ পেত এবং তা ছিল মেধার ভিত্তিতে। প্রাচীন নালন্দার এসব বৈশিষ্ট্য বর্তমানকালের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় পশ্চাৎপদ ছিল না, বরঞ্চ কালের প্রেক্ষাপটে তা ছিল অত্যন্ত আধুনিক এবং উন্নত। সময় বিবেচনায় নালন্দাকে তাই পৃথিবীর প্রাচীনতম ‘আধুনিক’ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আখ্যা দেয়া যায় নিসন্দেহে।
কিন্তু নালন্দার প্রসার বেশীদিন সহ্য হলো না পশ্চাৎপদ কিছু মানবগোষ্ঠীর। নালন্দা বহিশত্রুর আক্রমণে বেশ কয়েকবার ধ্বংসের শিকার হয়েছে। প্রথমবার আক্রমণের শিকার হয় স্কন্দগুপ্তের সময়ে ৪৫৫-৪৫৬ খ্রিস্টাব্দে মিহিরাকুলার নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানদের দ্বারা। আরও বিভিন্ন সময় আক্রমণের শিকার হলেও সবচেয়ে ভয়াবহ ধ্বংসের শিকার হয় ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি শাসক এবং কুখ্যাত লুটেরা বখতিয়ার খলজি দ্বারা। বখতিয়ার খলজি শুধু আক্রমণই করে নি, বিশ্ববিদ্যালয়টি একদম জ্বালিয়ে দেয় এবং পাঠাগারের লক্ষাধিক বই প্রায় তিনমাসব্যপী পুড়েছিল। বহু ছাত্র শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছিল। অথচ তখন প্রচলিত ছিল যে বখতিয়ার খলজি একবার চরম অসুস্থ হলো এবং তার দরবারের হাকিম যখন তার আরোগ্য বিধানে ব্যর্থ হয় তখন নালন্দার এক আয়ুর্বেদ চিকিৎসকের চিকিৎসায় সে সুস্থ হয়।
*https://www.thebetterindia.com/13918/ancient-nalanda-university-reopens-monday-know-lesser-known-facts-great-university/ *https://kreately.in/who-destroyed-nalanda-university-and-why/
কুখ্যাত খলজি কর্তৃক নালন্দা ধ্বংসের বর্ণনা পাওয়া যায় ঐতিহাসিক মিনহাজের "তাব্বিকাত-ই-নাসিরি" বইয়ে। তারপর ধীরে ধীরে ঐতিহাসিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হতে থাকে এবং ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে এসে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। https://www.researchgate.net/publication/315752080_History_of_Bengal_as_reflected_in_the_Tabaqat_-I-Nasiri_of_Minhaj-uddin_Siraj
প্রায় ৮০০ বছর পর নির্ধারিত কিছু বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে শুরু হচ্ছে নালন্দার পুনঃযাত্রা। ভারতের মিসাইলম্যান খ্যাত এপিজে আব্দুল কালামের সদিচ্ছায় ভারত সরকার সুপ্রাচীন এই মহাবিহার তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্জন্ম দেয়। https://www.hindustantimes.com/india/nalanda-university-reopens-after-800-years/story-ysbIgYUq4LXA9U8k0vLSVP.html

প্রাথমিকভাবে ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস, পররাষ্ট্রনীতি, পরিবেশবিদ্যা বিষয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এর শিক্ষাদান পদ্ধতি হবে গবেষণাকেন্দ্রিক। অত:পর দেশ-বিদেশের হাজারো আবেদন থেকে বাছাই করে ১৫ জন শিক্ষার্থী সেখানে পড়াশোনা করার সুযোগ পান। আচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবীদ অর্মত্য সেন। ধীরে ধীরে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান ও শিক্ষাপদ্ধতি উন্নততর হচ্ছে। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আছেন অধ্যাপিকা সুনয়না সিং
পশ্চিমা বিশ্ব যখন পাঠদানকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা থেকে বের হয়ে আধুনিক গবেষণাকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণের দিকে ঝুকছে তখন নালন্দার মতো ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় মহাকালের সাক্ষী হয়ে আছে। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবক হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলোকে কৃতিত্ব দেয়া হলেও এদের হাজারো বছর পূর্বে ভারতবর্ষের মাটিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম এবং বর্তমানকালের প্রাচীনতম ‘আধুনিক’ বিশ্ববিদ্যালয়।
©SPS

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ