💠 গণেশের মস্তক ছেদনের মুল তাৎপর্য্য

গণেশের মস্তক ছেদন এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের সনাতনী ভাইদের মধ্যে কিছু শঙ্কা দেখা দেয় তার নিবারন করার চেষ্টা করছি আজকের এই লিখাতে।।

🔶 আমাদের শঙ্কা গুলো হচ্ছেঃ

প্রথমতঃ
১/ মহাদেব ত্রিশুলের সাহায্যে নিজ পুত্রের মাথা কেটে ফেলেছিলো।
(শিব পুরান : রুদ্র সংহিতা ২, কুমার খন্ড ৪. ১৬/৩৪- ৩৫)

২/ মহাদেব তার গনদের বলেছিলেন উত্তর দিকে গিয়ে যাকে প্রথম দেখতে পাবে তার মাথাটিকে নিয়ে আসতে, সেই মাথাটিই হবে গনেশের জন্য উপযুক্ত।
(শিব পুরান : রুদ্র সংহিতা ২, কুমার খন্ড ৪. ১৪/৪৬- ৫৬)


দ্বিতীয়তঃ
গনেশের মন্তক ছেদন নিয়ে বিভিন্ন পুরানে ভিন্ন ভিন্ন উপাখ্যান রয়েছে। কেন এই ভিন্নতা? এই বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে শিবপুরানে।


🔸 শিব পুরান : ২/৪/১৩/৫-৬ তে আছে

Brama said,


"Due to the difference of kalpa, the story of the birth of Ganesha is told in different ways."
(Tras: J.L.Shastri)

অর্থ্যাৎ ভিন্ন ভিন্ন কল্প অনুযায়ী গনেশের মস্তক ছেদন সংক্রান্ত উপাখ্যানও ভিন্ন হয়। এর কারন কল্প ভিত্তিক সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের দর্শনের দৃষ্টিকোনের পরিবর্তন হয়।।

তাই কোন কল্পে গনেশের মস্তক ছেদন শনির দ্বারা হয়েছিল আবার কোন কল্পে তা মাহাদেবের ত্রিশুলের দ্বারা হয়েছিল। কিন্তু যেই কল্পেই হোক না কেন, তার মধ্যে একটি বিষয় একই যে প্রথমে গনেশের মস্তক ছেদন হয়েছে তারপর সেই ছেদিত মস্তক এর স্থানে অন্য মস্তকের পুনঃস্থাপন।

★কিন্তু গনেশের মস্তক ছেদন হওয়ার কারন কি?

শিব মহাপুরান ২.৪.১৩.১৮-২০ অনুসারে গনেশের জন্ম হয়েছিলো শিবের অনুপস্থিতিতে, দেবী পার্বতীর গাত্রমলিন থেকে এবং গনেশকে সৃষ্টির পিছনে দেবী পার্বতীর উদ্দেশ্য ছিলো যে তার একটি একান্ত অনুগত ভৃত্যের প্রয়োজনে।

শিব মহাপুরান ২.৪.১৩.১৮-২০

18. At the time when the incident occurred, parvati the great Maya, the great goddess, thought as follows.
19. There must be a servant of my own will be expert in his duties.
He must not stray from my behest even a speck.
20. Thinking thus the goddess created a person with all the characteristic, out of the dirt from her body.

(Tras: J.L.Shastri)

শিব এখানে পরমেশ্বরের মঙ্গল স্বরুপ এবং দেবী পার্বতী হল সেই পরমেশ্বরের মায়া স্বরুপ।

অর্থ্যাৎ গনেশের জন্ম উপাদান ছিলো মায়াজাত অজ্ঞতা, যা উপাখ্যানে দেবী পার্বতীর গাত্রমলিন হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। আবার গনেশের জন্ম হয়েছে মঙ্গলের অর্থ্যাৎ শিবের অনুপস্থিতিতে।

🔲 তাই দেবী পার্বতী গনেশকে নিজের অনুগত ও দেবতা হিসেবে সৃষ্টি করলেও তার মস্তকে অমঙ্গল ও অজ্ঞতা মূলক গুনের বিকাশ হয়েছিলো।

🔲 এর প্রমাণ আমরা পাই গনেশের সাথে দেবগন ও রুদ্র গনের যুদ্ধ থেকে। যখন গনেশ মাতৃ আজ্ঞা পালনের প্রতিজ্ঞাতে অন্ধ হয়ে নিজ শক্তি বলের অহংকারে মঙ্গল স্বরূপ শিবকে অপমান করে এবং তাঁর রুদ্রগনের উপর প্রহার করেন আর দেবগনের সাথেও ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু গনেশ যদি চাইতো তাহলে তার মাতাকে সংবাদ দিতে পারতো যে শিব তার সাথে দেখা করতে আগ্রহী, দেবী তাকে ভবনে প্রবেশ করতে দেবে কি না? কিন্তু তিনি সেটা না করে মাতৃ আজ্ঞা পালনের সেই অহংকারের মায়াজালে পতিত হয়ে নিজের শক্তির অহংকারে সকলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। এটাই ছিলো গনেশের মধ্যে বিকশিত অবজ্ঞা ও অমঙ্গল গুনের বহিপ্রকাশ। তার জন্য পরমেশ্বরের মঙ্গলস্বরূপ শিবের দ্বারা গনেশের মস্তক ছিন্ন হয়েছিল। মস্তক হলো ব্যাক্তির সকল গুণের মূল আধার। তাই শিবের দ্বারা গনেশের মস্তক ছিন্ন হওয়ার তাৎপর্য হলো মঙ্গলের দ্বারা গনেশের মধ্যে থাকা অবজ্ঞা ও অমঙ্গলকারী গুনের বিনাশ সাধন।



🔷 কিন্তু গনেশের মস্তক ছেদন হলেও গনেশের জীবিত হওয়া আবশ্যিক ছিলো! কারন গনেশ ছিলো ঈশ্বরের মায়ার একটি অংশ। তাই গনেশের অভাবে সৃষ্টি তত্ত্ব বিকাশ কষ্টসাধ্য হতো। তাছাড়া দেবী পার্বতী গনেশ কে দেবতা হিসেবে সৃষ্টি করেছিলেন, তাই গনেশের অভাবে জগৎ গনেশের দেবত্ব হতে বঞ্চিত হতো।

এজন্য শিবপুরানের ২.৪.১৭.৪২-৪৩ তে দেখা যায় পার্বতী বলছেন গনেশ পুনঃজীবিত না হলে জগতের বিনাশ রদ হবে না এবং গনেশ গনদের অধিপতি না হয় তবে জগতে শান্তি আসবে না।

The goddess said
42-43. "If my son regains life there may not be further annihilation. If you can arranged for him an honourable status and position among you as the chif presiding officer, there may be peace in the would. Otherwise you will never be happy."
(Tras: J.L.Shastri)

তাই গনেশের জীবিত হওয়া যেমন প্রয়োজন ছিল ঠিক তেমনই তার মধ্যে বিকশিত হওয়া অবজ্ঞা ও অমঙ্গল কারক গুনের বিনাশ হওয়ারও প্রয়োজন ছিলো।

🔳 এজন্য শিব তথা পরমেশ্বরের মঙ্গল স্বরূপের মাধ্যমে গনেশের মস্তকের পুঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। এর জন্য শিব তাঁর গনদের আদেশ দিয়েছিলেন উত্তর দিকে যাত্রা করতে এবং যার সাথে তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হবে তার মস্তক নিয়ে আসতে। শিব আগে থেকে জানতেন তার গনেদের প্রথম যার সাথে দেখা হবে সেটি হবে এক-দন্ত বিশিষ্ট গজ।


🔲 উপাখ্যানে গজমুন্ড এইজন্যই উল্লেখ হয়েছে, কারণ গজমুন্ড হল জ্ঞান(Wisdom) এর আধার। তাই অঙ্গল ও অবজ্ঞা রুপি মস্তক ছেদ করে, জ্ঞান কে স্থাপন করাই এই উপাখ্যানের মূল বিষয়। তাই শিব দ্বারা গজমুন্ড বিশিষ্ট গনেশ হলো মঙ্গলের একটি প্রকাশ স্বরুপ। তাই শিবপুরান ২.৪.১৮.১৭ তে শিব এই গজমুন্ড বিষিষ্ট গনেশ কে নিজের পুত্র হিসেবে স্বীকার করেছেন।

"Placing his lotus like hand on his head Shiva told the gods. This is anather son of mine."
(Tras: J.L.Shastri)

 গজমুন্ড বিশিষ্ট গনেশ হল অজ্ঞতা ও অমঙ্গলের বিনাশ এবং জ্ঞান ও মঙ্গলের প্রকাশের একটি স্বরুপ। তাই শিবপুরানে ২.৪.১৮.২৪ তে বলাহয়েছে কোনো আরাধ্যের উপাসনার পূর্বে যদি গনেশের উপাশনা না করা হয়, তবে আরাধ্য উপাসনা লব্ধ ফল নষ্ট হয়।

"If this other deities are worshipped when he is not worshipped, the fruit of that rite will be lost. There is no double in this matter."
(Tras: J.L.Shastri)

গজমুন্ড বিশিষ্ট গনেশ হলো মঙ্গলকারক ও জ্ঞানকারক দেবত্ব-এর অধিকারী। তাই সে মনুষ্য ও দেব সকলের কাছেই পুজ্য কারন কেউ চায় না তার জীবনে মঙ্গল ও জ্ঞান এর অনুপস্থিতি থাকুক।

🔷 কুলকুন্ডলিনী তত্ব অনুসারে এই দৈব গনেশের অবস্থান আমাদের দেহের মূলাধার চক্রে।। চতুস্কোন পৃথীমন্ডল ও শক্তিপীঠ স্বরুপী ত্রিকোণ মন্ডলের নিন্ম মুখের দিকে গনেশের অবস্থান।

★ আরেকটি শঙ্কা মনে জাগে যে গনেশের মাথা অন্য আরেক জীবের মাথা লাগানো কতটা বৈজ্ঞানিক?

🔳 সব কিছু বিজ্ঞান দিয়ে চিন্তা করলে হয় না। মনে রাখতে হবে যে দেবী ময়াবলে এক দেব সৃষ্টি করতে পারে যে শিব হলাহল কন্ঠে ধারন করতে পারে তিনি সবই করতে পারেন। তাছাড়া এই সার্জারির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে।

🔳 মানুষের দেহে হাতির মাথা জোড়া লাগানোর ঘটনাটা সার্জারির একটা প্রতীকী ঘটনা। এখন এক মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অন্য মানুষের দেহে লাগিয়ে তাকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে, এমন কি কোনো কোনো প্রানীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাধ্যমেও মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে, এই বৈজ্ঞানিক সাফল্য হয়তো একদিন এমন স্তরে পৌঁছবে যখন মানুষের কাটা মাথাও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জোড়া লাগিয়ে তাকে বাঁচানো সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে মানুষের কাটা মাথা জোড়া লাগানোর পরিবর্তে উদাহরণ হিসেবে হাতির মাথা কেনো ? হাতির মাথা বলেই উপাখ্যানটা এখনো বেঁচে আছে এবং মানুষ তার চর্চা করে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, না হলে উপাখ্যানটা এতদিনে হারিয়ে যেতো এবং ভবিষ্যতের সার্জারি বিদ্যা যে কোথায় পৌঁছতে পারে, এ ব্যাপারে মানুষ ধারণা হারিয়ে ফেলতো।

©জয়ন্ত সেন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ