অনুগীতা প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব খর্ব হয় না

 

শ্রীকৃষ্ণ যে পরমেশ্বর তা [এই পোস্টে ]প্রতিপাদন করা আছে, বর্তমান পোস্টে দেখানো হবে অনুগীতা কখনোই শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব খন্ডিত করে না। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর এটা ভিত্তি ধরেই আলোচনা এগোনো হবে।

আশ্বমেধিক পর্বের ১৭ অধ্যায়ে অনুগীতার সূত্রপাত। অনেকে এই অনুগীতার কথা তুলে শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব খন্ডন করতে চায়। কিন্তু অনুগীতায় কখনোই শ্ররকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব খন্ডিত হয় না।

অনুগীতা শুরুর প্রথম দিকে (আশ্বমেধিক পর্ব ১৭/৫) এ অর্জুন শ্রীকৃষ্ণ
কে বলছেন, 

বিদিতং মে মহাবাহো! সংগ্রামে সমুপস্থিততে।

মাহাত্ম্যং দেবকীপুত্র! তচ্চ তে রূপমৈশ্বরম্।। 

>> মহাবাহু দেবকীপুত্র! যুদ্ধ উপস্থিত হইলে আপনার মাহাত্ম্য আমি জানিয়াছি। তদানীন্তন আপনার সেইরূপ- ঈশ্বরেরই রূপ।

এখানে স্পষ্টভাবেই শ্রীকৃষ্ণযে স্বয়ং ঈশ্বর তার সাখ্য অর্জুন দিচ্ছে। সুতরাং এখানে শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব খন্ডিত হলো না। 

তারপর অর্জুন বলছেন (আশ্বমেধিক পর্ব ১৭/৬)

পুরুষশ্রেষ্ঠ কেশব! আপনি সৌহার্দ্দ্যবশতঃ পূর্বে যে সকল কথা বলিয়াছিলেন, আমি যুদ্ধে আসক্তচিত্ত হওয়ায় সে সমস্তই আমার লুপ্ত হইয়াছে। 

অর্থাৎ যুদ্ধাদি বিষয়ে অর্জুন আসক্ত চিত্ত হওয়ায় তিনি সেই গীতার জ্ঞান বিস্মৃত হয়েছেন। 

তারপর ৯-১৩ নং স্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলতে শুরু করলেন,

কৃষ্ণ বলিলেন - ' পৃথানন্দন! আমি তোমাকে গুপ্ত বিষয় শুনাইয়া এবং লক্ষণসংযুক্ত সনাতন ধর্ম ও শাশ্বত সকল লোকের বিষয় জানাইয়াছি।।৯।।

তুমি যে বৈমত্যবশতঃ সেসকল মনে রাখিত পার নাই, তাহা আমার গুরুতর অপ্রিয় হইয়াছে। এখন সেই স্মৃতি পুনরায় আমার পূর্ণভাবে হইবে না।।১০।।

** এখানে সমস্যা হলো, শ্রীকৃষ্ণ ভগবান হলে তার "স্মৃতি পুনরায় পূর্ণভাবে হবে না" এ আবার কেমন কথা?! এই বাক্যে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এতো মহাজ্ঞানগর্ভ ও গোপনীয় বিদ্যা অর্জুন এতো সহজেই ভুলে যাওয়ার ফলে তা শ্রীকৃষ্ণের কাছে খুব অপ্রিয় লাগছে। এজন্য তিনি চাচ্ছেন না আবার পুণরায় তা ঐরূপ ভাবেই বলতে, কারণ তাতে লাভ কি? অর্জুন আবার ভুলে যেতে পারে। তাই শ্রীকৃষ্ণ এরূপ কথা বলেছেন। এখানে তাই তিনি বোঝাচ্ছেন, এখন আর সেই পূর্বের ন্যায় হবহু করা হবে না, ঐরূপ স্মৃতি আর এখন করা হবে না। 

পাণ্ডুনন্দন! নিশ্চয়ই তুমি আমার সেই সকল বাক্যে বিশ্বাস কর নাই, অথবা তুমি নিশ্চই দুর্ম্মেধা। ধনঞ্জয়! তাহা আবার সমস্ত বলা আমার শক্তিসাধ্য নহে।।১১।।

** ভগবানের আবার "শক্তি সাধ্য নহে কেন?" কারণ অর্জুন, তুমি যেহেতু তুচ্ছতাচ্ছিল্য হেতু আমার দেওয়া সেই জ্ঞান ভুলে গেছ সেই হেতু আমি সেই জ্ঞান ঐরূপ শক্তি সাধ্য রূপ দিবো না। আমি যেহেতু আমি পূর্বের ন্যায় ঐরূপে জ্ঞান দিতে ইচ্ছুক নই, (কারণ এবারও ভুলে যেতে পার) সেই অনিচ্ছা হেতু আমি ওসব বলবো না বা  বলতে সামর্থ্য নই। অর্থাৎ আমি পূর্বরূপে বলবো না। 

সেই ধর্মটি পরমাত্মার স্বরূপ জানিবার পক্ষে বিশেষ পর্য্যাপ্ত ছিল। আমি বর্তমান সময়ে সেই সমস্ত পুণরায় বলিতে সমর্থ নহি।।১২।।

** কেন সমর্থ নহি? সেই একই কারণ, তুমি সেই মহাজ্ঞান ভুলে গেছ তাই আমি পুনরায় তোমাকে পূর্বোক্তভাবে তা দেওয়ার ইচ্ছা নেই আমার। ইচ্ছা না থাকা হেতু আমি সমর্থ নই।

**** অর্থাৎ , "স্মৃতি পুণরায় পূর্ণভাবে হবে না, শক্তিসাধ্য নাই ও সমর্থ নহি" এই তিনটা অংশের কারণ হলো যেহেতু তুচ্ছতাচ্ছিল্য হেতু অর্জুন ঐ জ্ঞান ভুলে গেছে তাই আমি (শ্রীকৃষ্ণ) তাকে সে জ্ঞান পূর্বের ন্যায় অনুরূপ ভাবে দিতে ইচ্ছা করি না। যেহেতু ইচ্ছা করছি না সেহেতু পুণরায় সেই স্মৃতি পূর্ণরূপ হচ্ছে না, শক্তিসাধ্য  হচ্ছে না, সামর্থ হচ্ছি না। মূলত ভগবানের ইচ্ছায়ই জগতের সকল কার্য সম্পাদিত হয়, তিনি লীলাপুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ  তাই এই মূহুর্তে তিনি ইচ্ছা করছেন না বলেই এরূপ হচ্ছে। কেন ইচ্ছা করছেন না? কারণ অর্জুন পুণরায় সেই জ্ঞান ভুলেই যেতে পারে। এজন্য তিনি অনুগীতাতে গল্পচ্ছলে ঐ জ্ঞানগুলো পুণরায় দেন। কিন্তু পূর্বের ন্যায় লীলাপুরুষোত্তম হিসেবে দেন না। মানুষকে কোনো শিক্ষা গল্পচ্ছলে দিলে তা মনে রাখা সহজ হয়। 

এবার পরবর্তী ১৩ নং স্লোকে বলা আছে,

তৎকালে আমি যোগযুক্ত হইয়া পরব্রহ্মের বিষয় বলিয়াছিলাম, এখন সেই বিষয়ে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলিতেছি।।১৩।।

** এখানে ভগবান গল্পচ্ছলে সেই পূর্বোক্ত গীতাজ্ঞান গুলো দিবেন বলতেছেন। এখানে প্রশ্ন হলো, "আমি যোগযুক্ত হইয়া" ভগবানের যোগ আবার কি?

হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ তার মহাভারতের ভারতকৌমুদী টীকায় অনুগীতা অধ্যায়ে এই "যোগযুক্ত" কথার ব্যাখ্যা করেছেন, "যোগযুক্তেন ঐক্যাগ্রসমন্বিতেন" অর্থাৎ,  এখানে যোগযুক্ত অর্থ একগ্রতাসহিত। ভগবান একাগ্র হয়ে অর্জুনকে গীতাজ্ঞান দিয়েছিলেন এটা বোঝাতে "যোগযুক্ত" শব্দটি উল্লিখিত হয়েছে। 




 এখানে মূলত ভগবানের যোগশক্তি অর্থাৎ যোগমায়া বোঝানো হয়েছে। যে শক্তির মাধ্যমে ভগবান বিভিন্ন কার্যাদি সম্পন্ন করেন তারই এক রূপ হচ্ছে যোগমায়া। যোগ সম্পর্কে শ্রীধরস্বামী গীতার ১১/৮ স্লোকে ব্যাখ্যায় বলেছেন, 

যোগং যুক্তিমঘটনঘটনসামর্থ্যং - যোগ অর্থাৎ অঘটন - ঘটন- সামর্থ্য। 

অর্থাৎ ভগবান ঘটন অঘটনাদি সামর্থ্য হয় যোগশক্তির দ্বারা, ভগবানের এই শক্তিকেই বলা হয়েছে যোগমায়া। 

শ্রী শ্রী চন্ডির ৫/১৪-১৬ তে পাই,

যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতা।

নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।

>> যে দেবী সকল ভূতে বিষ্ণুমায়া নামে অভিহিত হন, তাহাকে নমস্কার।  তাহাকে নমস্কার। তাহাকে নমস্কার নমস্কার নমস্কার। 

চন্ডীর ১/৮৬-৮৭ তে বলা ব্রহ্মা বিষ্ণুশক্তি যোগমায়াকে বলছেন,

প্রবোধঞ্চ জগৎস্বামী নীয়তামচ্যুতো লঘু।৮৬

বোধশ্চ ক্রিয়তামস্য হন্তুমেতৌ মহাসুরৌ।।৮৭

>> শীঘ্র আপনি জগৎস্বামী বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা হইতে জাগরিত করিয়া এই মহাসুরদ্বয়কে বধ করিবার জন্য তাঁহার প্রবৃত্তি উৎপাদন করুন।

সুতরাং বিষ্ণুর যোগনিদ্রা যাওয়া যোগনিদ্রা থেকে জাগরণ ও কর্মেপ্রবৃত্তি যার কারণে হয় তাই যোগমায়া, তিনি বিষ্ণু হতে ভিন্ন নন, তিনি বিষ্ণুশক্তি বা বিষ্ণুমায়া রূপে পরিচিত। এই যোগমায়া ক্রিয়াই ভগবানের যোগ। ভগবান যে গীতাজ্ঞান দিয়াছিলেন তার প্রবৃত্তিও তাঁর এই যোগ শক্তির প্রভাবে অর্থাৎ যোগমায়ার প্রভাবে। 

সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনা হতে প্রমাণিত হয় যে ,উক্ত অনুগীতার প্রারম্ভের স্লোকগুলি দ্বারা কোনো মতেই শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব খন্ডিত হয় না,  বরং সেখানে শ্রীকৃষ্ণের বা ভগবান বিষ্ণুর শক্তির এক রূপ এবং  এই শক্তির প্রভাবে যে ভাগবানের ইচ্ছা,  একাগ্রতা ইত্যাদি কর্ম সাধিত হয় তাই প্রতিপাদিত হয়, এবং এই শক্তিকেই বলা হচ্ছে ভগবানের যোগশক্তি বা যোগমায়া। 


--------শ্রী প্রান্ত সাহা।  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ