মূল যে ৭০০ স্লোকের গীতা সনাতনীরা মেনে আসছেন তা তথাকথিত সমাজ অনুসারীর অনেকেই মানে না। তাদের অনেকের দাবী মূল গীতা ছিলো ৭০ স্লোকের এ দাবীর উৎস হিসেবে তারা জাহির করে ১৯১৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালী দ্বীপ হতে নাকি ভীষ্মপর্বের অংশ হিসেবে ৭০ স্লোকের একখানা গীতা পাওয়া যায়। যা যবদ্বীপ হইতে বাহুরাহু নামক এক ব্রাহ্মণ নাকি বালী দ্বীপে নিয়া আসে। সেই ইন্দোনেশিয়ার বালী দ্বীপে পাওয়া গীতাই নাকি আসল ও প্রচীন, তাদের মতে। আর সনাতনীদের মাঝে প্রচলিত ৭০০ স্লোকের গীতা নাকি প্রক্ষিপ্ত!
এই দাবিটি সম্পূর্ণ অমূলক ও মূর্খামি ৷ যবদ্বীপ —যার বর্তমান নাম জাভাদ্বীপ, এই জাভাদ্বীপবাসীরা প্রথমে হিন্দু ছিল, মধ্যে অনেকে বৌদ্ধ হয়েছিল এবং ১৪৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম আক্রমণের পর বহু সংখ্যক মুসলিম হয়েছিল ৷ প্রাথমিক অবস্থায় তারা যখন হিন্দু ছিল তখন তাদের মহাভারতে সম্পূর্ণ ৭০০ শ্লোকযুক্ত গীতা অবশ্যই ছিল, তারপর তারা যখন মুসলিম হয় তখন গীতা হতে বিভিন্ন অংশ নিষ্কাশিত হয় ৷ মুসলমানদের মতে ঈশ্বরের মূর্ত্তি নাই, কিন্তু ভগবদগীতা বক্তা শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ঈশ্বর, তিনি নিজেই একথা গীতাতে ঘোষণা করেছেন এবং বিশ্বরূপ দেখিয়ে তা প্রমাণিতও করেছেন, আবার পার্থসারথিমূর্ত্তিতে সকলের দৃষ্টিগোচরও হয়েছেন ৷ এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের নিকট গীতার বিভিন্ন অংশ যে বিরক্তির হবে তাতে সন্দেহ কি?
এজন্য তারা গীতার বিভিন্ন অংশ ছেঁটে ফেলতে আরম্ভ করেছিল ৷ তাপর যখন কোন ব্রাহ্মণ ধর্মগ্রন্থাদি নিয়ে জাভাদ্বীপ হতে বালিদ্বীপে পালিয়ে আসে তখন তার নিকটস্থ গীতাতে কেবল ৭০টি শ্লোকমাত্র অবশিষ্ট ছিল ৷ কারণ ১৪৭৮ খ্রিষ্টাব্দের বহু বহু পূর্বেই সনাতনীদের মূল ৭০০ স্লোকের গীতার ভাষ্য আাদি শ্রীশঙ্করাচার্য লিখে গেছেন। আদি শঙ্করাচার্যের জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ৫০৭ খ্রিষ্টাব্দে। অর্থাৎ প্রায় ২৫০০ বছর পূর্বে সেই ৭০০ স্লোকের গীতার ভাষ্য লিখিত হয়।
এখানে উল্লেখ্য সঙ্করাচার্যের জন্ম যে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০৭ এ তার প্রমাণ হিসেবে আদি সঙ্করাচার্যের স্থাপিত চতুর্মঠের পুরীর গোবরধন মঠের সঙ্করাচার্য শ্রী নিশ্চলানন্দ সরস্বতী মহারাজের প্রবচন টা দেখতে পারেন।
লিঙ্কঃ-
শঙ্করাচার্যের পর শ্রীরামানুজাচার্য (১০১৭-১১৩৭ খ্রিঃ), শ্রীমধ্বাচার্য(১২৩৮-১৩১৭ খ্রিঃ) এবং এর পর অনেক আচার্যগণই সেই ৭০০ স্লোকের গীতার ভাষ্যও লিখে গেছেন। তাহলে তারা কি ভুল প্রক্ষিপ্ত গীতা গ্রহন করে আসছেন? আর ইন্দোনেশিয়ায় ১৯১৪ সালে প্রাপ্ত গীতাই আসল হয়ে গেল! ইহা অতি হাস্যকর দাবী ব্যতীত আর কিছুই না। জাভাদ্বীপবাসী হিন্দুদের নিকট মহাভারত অন্তর্গত যে সাতশত শ্লোকযুক্ত গীতা ছিল তা ১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দের পর মুসলমানদের হস্তক্ষেপের ফলে বহু শ্লোক নিষ্কাশিত হয়ে সত্তরটি শ্লোক মাত্র অবশিষ্ট ছিল ৷ কিন্তু তথাকথিত কিছু লোকেরা উল্টো বুঝে পবিত্র শ্রীমদভগবদ্গীতাকে প্রক্ষিপ্ত বলে প্রচার করছে ৷
এবার কিছু কথা বলি বালী দ্বীপের অধিবাসীদের নিয়ে। ইন্দোনেশিয়ার বালী দ্বীপ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। সেখানে এখনো গীতা ফেস্টিভ্যাল পালন করা হয় বেশ ঘটা করে। সেই অনুষ্ঠানে সকলে উপস্থিত হয়ে একত্রে গীতা পাঠ করেন ঐদিন।
নিচে দেওয়া লিঙ্কের ভিডিওতে দেখতে পারবেন তারা যে গীতা পাঠ করছেন তা আমাদের মাঝে প্রচলিত ৭০০ স্লোকের গীতাই। কারণ ভিডিওর ৭ঃ৩১ সময়ে দেখতে পারবেন তারা প্রচলিত ৭০০ স্লোকের গীতার প্রথম স্লোক,
ধৃতরাষ্ট্র উবাচ
ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুত্সবঃ৷
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয়৷৷১/১।।
দিয়েই তাদের গীতা শুরু। তথাকথিত ৭০ স্লোকের গীতার প্রথম স্লোক,
দৃষ্টেবামান্ স্বজনং কৃষ্ণ য়ুয়ুৎসন সমুপস্থিতম্।
ন চ শ্রেয়োহনু পশ্যামি হত্বা স্বজন মাহবে।।
দিয়ে শুরু করে নাই। সুতরাং সেই বালী দ্বীপে এই ৭০ স্লোকের গীতা প্রচলিত নাই। আরো একটা তথ্য বালীদ্বীপের সকল হিন্দু বিগ্রহপূজা, অবতারবাদে বিশ্বাসী। তাদের মধ্যেও পঞ্চদেবের উপাসনা তথা শিব, শক্তি, বিষ্ণু, গণেশ, সূর্য দেবতাদের উপাসনা করতে দেখা যায়। এর উপরও একটা ছোট ডকুমেন্টারির লিঙ্ক দিচ্ছি, নেটে ও ইউটিউবে আরো প্রচুর তথ্য পাবেন তাদের আাচারের উপর।
লিঙ্কঃ
বালী দ্বীপের গীতা ফেস্টিভ্যাল
বালী দ্বীপের ছোট ডকুমেন্টারি
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা হতে এটুকু প্রমাণিত যে প্রচলিত ৭০০ স্লোকের গীতাই মূল আদি আসল ও প্রাচীন গীতা। বরং তথাকথিত ৭০ স্লোকের গীতাই বরং মূল গীতা থেকে স্লোকাদি হারাইয়া ৭০ স্লোকই কেবল ধরে রাখতে পরেছে। আবার এমনও হতে পারে কিছু কুচক্রী মহলের মূল ৭০০ স্লোকের গীতায় এলার্জি থাকার কারণে নতুন করে ৭০ স্লোকের গীতা সঙ্কলিত করেছে।
সুতরাং, আদি আসল প্রাচীন মূল গীতা প্রচলিত ৭০০ স্লোকের গীতাই।
0 মন্তব্যসমূহ