পুরুষ সুক্ত নিয়ে অপপ্রচারের পুনঃ জবাব



এই লেখা টা পড়ার আগে মূল পোস্টটা পড়ে আসুন,

 পুরুষ সূক্ত নিয়ে অপপ্রচারের জবাব


খন্ডন কি?

 

ধরুন কেউ যখন কোন অভিযোগ করল অথবা মিথ্যাচার করল তবে সেই বিষয়ে তথ্য প্রমাণাদি যুক্তি দিয়ে সেটার জবাব দেওয়াই আপাতদৃষ্টিতে খন্ডন। অনেকসময় ক্ষুরধারা যুক্তি দিয়ে সত্যকে খন্ডন করে মিথ্যাকেও প্রতিষ্ঠা করা যায় আবার মিথ্যার উপর মিথ্যা বসিয়ে মিথ্যাকেও সত্যের রূপ দেওয়া যায়। অর্থাৎ সত্য বলেন আর খন্ডন বলেন এগুলো সবই আপেক্ষিক চলমান প্রক্রিয়া। কেউ কেউ দর্শনও খন্ডন করে দেয় অথচ দর্শন হলো ভিন্ন ভিন্ন মানুষের স্ব-চিন্তত দৃষ্টিভঙ্গী। পরমকে কে দেখেছে! পরমকে কে পেয়েছে? পরমকে কে জেনেছে! এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পূর্ণ হলেই আত্মা পূর্ণ হয়। খন্ডন প্রতি-খন্ডন করলেই কি তাঁকে পাওয়া যাবে! আমরা তাই স্বঘোষিত আত্মজ্ঞানীদের খন্ডন করার মত বাতুলতা দেখাতে চাই না। জাগতিক জীবনযাপনে মত্ত লোকজনের আধ্যাত্মিকতার গল্পকে আদতে আরব্যোপন্যাসই ঠেকে।

 

কোন খন্ডন নয় কেবল কিছু পয়েন্ট তুলে ধরতে চাই। পরম পুরুষকে কোন শর্তে আবদ্ধ করার দৃষ্টতা আমরা দেখাতে চাই না। হাজার বছরের সনাতন পরম্পরায় শাস্ত্রাদিতে যে উপমাসূচক শব্দসকলের মাধ্যমে তাঁর প্রকাশ উপলব্ধ হয় সেটাই আমাদের নিকট মান্য। শব্দসমূহকে তর্কে যেতার অস্ত্র না বানিয়ে তাহার গূঢ়তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারলে বরং পরমকে জানা সহজ হয়।

আমার পূর্ব পোস্টে পুরুষ সুক্ত নিয়ে কিছু শাস্ত্রীয় বিশ্লেষণ করি। ওখানে প্রায় তিনটা পয়েন্ট তুলে ধরে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি মাত্র। সেই পোস্টের আবার খন্ডন প্রচার করে এক বিশেষ সম্প্রদায়। তিনটা পয়েন্টের মূল অংশ এড়িয়ে গিয়ে একটা প্যারাকে ফোকাস করে দাবী করে আমি নাকি উপনিষদের খন্ডন করেছি! (এসব দৃষ্টতা বরং তারা- দেখায়) এরা ভালো করে বাংলা পড়তে পারে কিনা সন্দেহ! তবে ধারাবাহিক একটা আলোচনা থেকে একটা স্পেসিফিক প্যারার ভুল ব্যাখ্যা দাড় করিয়ে কদাচার ঠিকই করতে পারে।

 

যাইহোক বাকি দুইটা পয়েন্ট সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়ে রুপক অলংকার তত্ত্ব দিয়ে একটা খন্ডন নামক কদাচার চালিয়ে দিলেন।

কাব্য কাব্যের অলংকারিক শব্দসমূহের মনগড়া বিশ্লেষণ দিয়ে মোটামুটি একটা বিরোধিতা করার অপপ্রয়াস ভালোই করতে পেরেছিল বলে প্রতিয়মান হয়।

💥কি হয়েছিল আসলে?

 

💥তাদের দাবীঃ

( আমাদের উদ্দেশ্য করে) এখানে আপনারা 'পুরুষ' শব্দটি দেখে খুশিতে ঈশ্বরকে একজন পুরুষ (পুং) হিসেবে দাবী করছেন।

 

💥জবাবঃ

এজন্যই উপরে উল্লেখ করেছিলাম যে এরা বাংলা বুঝে কিনা সন্দেহ! শব্দের বিশ্লেষণ করার আগে এদের এই পোস্টটা ভালো করে পড়া উচিত।

https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/...

আমরা আমাদের কোন পোস্টে কোথায় কখন লিখলাম , যে পুরুষ সুক্তে পুরুষ বলতে পুং বলা হয়েছে??!! এজন্যই উপরে লিখেছিলাম যে মিথ্যার উপর মিথ্যা বসিয়ে মিথ্যাকে সত্য সাজিয়েও খন্ডন করা যায়।

 

 

💥তাদের দাবীঃ

পাণিনির সূত্র অনুযায়ী পুরুষ অর্থ পূর্ণ।

 

💥জবাবঃ

একদম ঠিক। আর আমরা কি কোথাও বলেছি নাকি যে পুরুষ অপূর্ণ ?!

 

💥তাদের দাবীঃ

(তারপর তৈত্তিরীয় আরণ্যক শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ থেকে তারা বললো )

পুরুষ সর্বব্যাপী পরমেশ্বর

 

💥জবাবঃ

হ্যাঁ অবশ্যই পুরুষ সর্বব্যাপী পরমেশ্বর। আমরা এটায় দ্বিমত কোথায় পোষণ করলাম? তবে একটা কথা না বলে পারছি না তাহারা কিন্তু কৃষ্ণ যজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয় সংহিতা মানেন না, তাহলে এখন কেন এই কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্গত তৈত্তিরীয় আরণ্যক শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ থেকে তথ্য নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে ? আসলে এরা সবই পারে, সারাদিন সায়ণাচার্যকে গালাগালি করে বেদে সাকারবাদ খন্ডনের জন্য সায়ণাচার্য থেকেই যুক্তি খুজতে হয়। জাকির নায়েকের কল্কি অবতার খন্ডণের (সাধারণ সনাতনীদের সিম্প্যাথী লাভ) জন্য পুরাণেরও আশ্রয় নিতে হয়। দ্বিচারিতা স্ববিরোধীতা এদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এরা কেবলমাত্র তর্কে জেতার জন্য শাস্ত্রের শব্দসকলকে নিজের সুবিধামতো ব্যাবহার করে যায়। কি আর বলব যখন একজন শিববিরোধী পিঠ বাঁচাতে শিবমন্দিরে গিয়ে আশ্রয় নেয়!

 

💥তাদের দাবীঃ

পুরুষ সূক্তের ঋগ্বেদ ১০/৯০/১১ নং মন্ত্রে 'ব্যকল্পয়ন্' দিয়ে বুঝানো হয়েছে পুরুষের হস্তপদাদি কল্পিত হয়েছে। (সাথে তারা সুন্দর করে সায়ন ভাষ্য টাও তুলে দিয়েছেন। বেশ ভাল কথা।)

 

💥জবাবঃ

সায়ন ভাষ্যে স্পষ্ট করে প্রথম বাক্যেই বলা আছে ,

"প্রশ্নউত্তর রূপে ব্রাহ্মণাদি সৃষ্টি প্রক্রিয়া নিয়ে ব্রহ্মবাদীরা প্রশ্ন করছেন।" অর্থাৎ পুরুষ থেকে ব্রাহ্মণাদি বর্ণাদি যে তৈরি হল তা সম্পর্কিত প্রশ্ন করলেন ব্রহ্মবাদীগণ। সেই কথা প্রসঙ্গে বলা হল যে , তাঁর মুখ হস্ত পদাদি কি রূপে কল্পিত হল?

এর মানে এই না যে, তাঁর হস্ত পদাদি নেই কিন্তু তাহা কিভাবে কল্পিত হল?

এর মানে এই যে , তাঁর যে হস্তপদাদি আছে তা ব্রাহ্মণাদি বর্ণ রূপে কিভাবে কল্পিত হল?

এর উত্তরেই ঋগ্বেদ ১০/৯০/১২ তে বলা হয়েছে ,

তাঁর মুখ ব্রাহ্মণ রূপে, তাঁর বাহু ক্ষত্রিয় রূপে, তাঁর উরু বৈশ্য এবং পা শূদ্র রূপে কল্পিত হল।

যাইহোক এটাকে তারা বলে রূপক তথা আলংকারিক। উপমা, উপমান উপমিত শব্দগুলো নিয়ে তাদের আরেকটু লেখাপড়া করা উচিত।

আমি লিখলাম "পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।"

এখানে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি না হলেও বুঝানো হয়েছে দেখতে অনেকটা ঝলসানো রুটির মত। তাহলে ঝলসানো রুটি কি কল্পনাপ্রসূত কোন অবাস্তব বস্তু? কাব্য বুঝে, রূপক অলংকার বুঝে অথচ এই সহজ বিষয়গুলো বুঝে না!

 

💥তাদের দাবীঃ

পুরুষের হস্ত পদাদি মূলত প্রাণীগণের হস্ত পদাদি। (এর জন্য তারা সায়ন ভাষ্য থেকে উদ্ধৃতি দেয়, শেষে সায়ণেই আশ্রয় খুজে)

💥জবাবঃ

ভাষ্যে বলা আছে, সর্ব প্রাণীগণ পুরুষের অংশ হেতু তাদের হস্তপদাদি মূলত পুরুষের হস্তপদাদি বলা হয়েছে , সর্বপ্রাণী ব্রহ্মান্ড যার শরীর সেই পুরুষ সহস্রশীর্ষ, হস্তপদাদি বিশিষ্ট। এখানে সহস্র বলতে মূলত অনন্ত বোঝানো হয়েছে। থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, প্রাণীগণ পুরুষ হতেই জাত বলে অর্থাৎ পুরুষের অংশ বলে প্রাণীগণের হস্তপদাদি মূলত পুরুষের অংশ।

এখানে মাথায় রাখতে হবে বেদের অর্থ বহুমাত্রিক হয়ে থাকে।

এক দিক থেকে বিবেচনা করলে পুরুষ স্বয়ং অনন্ত শীর, হস্তপদাদি ধারী, যেমন টা বেদের সার গীতায় বলা আছে। যা অর্জুন স্বয়ং প্রত্যক্ষ করেছে। যা গীতার ১১/১৬ তে বলা আছে ( বিস্তারিত উপরের লিঙ্ক ) গীতা সত্য হলে পুরুষের রূপ সত্য।

আবার সায়নাদি ভাষ্য অনুযায়ী প্রাণীগণের হস্ত পদাদি পুরুষের অংশ।

এখন সমস্যা হচ্ছে আপনারা যদি দ্বিতীয় ব্যাখ্যা শৈলী মেনে নেন তাহলে আপনাদের ত্রৈতবাদ টিকে না (যেটা মূলত খ্রিস্টানদের ত্রিনিটি থিওরি থেকে ধার করা) কেননা ত্রৈতবাদ অনুযায়ী জীবাত্মা , জগত, ব্রহ্ম তিন পৃথক কেউ কারো অংশ না। সে হিসেবে প্রাণীগণের হাত পা পুরুষের অংশ না হওয়ায় কখনোই প্রাণী গণের হাত পা কে পুরুষের হাত পা হিসেবে উল্লেখ করা যায় না। এখন যদি আপনারা আপনাদের ত্রৈতবাদ ত্যাগ করতে পারেন তো আপনারা প্রাণীগণের হস্তপদাদি মূলত পুরুষের অংশ বলতে পারেন নাহলে সেটা ভন্ডামি সামিল।

 

আলোচনা আর দীর্ঘ হলো না কারণ তারা বাকী দুইটা পয়েন্ট এড়িয়ে গিয়েছিল।

পরম পুরুষ পরমেশ্বর তাদের কল্যাণ করুক,

তাদেরকে চৈতন্য দান করুক।

 


 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ