✴️ মন ও আত্মার হিসেব নিকেশ

 



মন আত্মা এক জিনিস নয় আবার মনের গভীরেই আত্মা। চিন্তার সমষ্টিই মন, চিন্তা ছাড়া মনের কোনো অস্তিত্ব নেই।

আত্মার স্বরূপ বড়ই জটিল। আত্মা জ্ঞেয় অজ্ঞেয়ও। বলা যায় মন যাহা আশ্রয় করে থাকে তাহাই আত্না।

 

কিছুদিন আগে আত্মার স্বরূপ নিয়ে পড়তে গিয়ে বুঝলাম আত্মাকে জানতে হলে মনকেও বুঝতে হবে। মনের হাত ধরেই পৌছতে হবে আত্মার কাছে।

 

কেনোপনিষদের প্রথম মন্ত্রটা দিয়েই শুরু করা যাক।

 

🔳 কেনোপনিষদ প্রথম খন্ড, মন্ত্র- ০১

 

"মানুষের মন কাহার ইচ্ছাদারা প্রণোদিত হইয়া স্বীয় বিষয়ের প্রতি গমন করে অথবা কাহার দ্বারা প্রেরিত হইয়া মন অভিলষিত বিষয়ের প্রতি গমন করে? সমস্ত ইন্দ্রিয়বৃত্তির প্রথমে উৎপন্ন প্রাণ কাহার দ্বারা নিযুক্ত হইয়া স্বব্যাপারে প্রবৃত্ত হয়? লোকসকল কাহার ইচ্ছায় বাক্য উচ্চারণ করে? কোন দেবতা চক্ষু কর্ণকে স্ব স্ব বিষয়ে নিযুক্ত করেন?"

 

🔸 ব্যাখ্যাঃ

 

এই মন্ত্রে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপনপূর্বক পরে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া হয়েছে। প্রথম প্রশ্ন এই যে কাহার ইচ্ছেদ্বারা প্রেরিত হইয়া মন, প্রাণ ইন্দ্রিয়বর্গ স্ব স্ব কার্য সম্পাদন করে? আমরা সাধারণত মনে করি যে, আমাদের মন স্বাধীন স্বপ্রতিষ্ঠ, উহার কোন পরিচালক বা প্রেরক নাই। ইহা আপনা হইতেই চিন্তা-সংকল্পাদি কার্য করে। মনই আবার অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের পরিচালক; অথবা মন, বুদ্ধি ইন্দ্রিয় সমন্বিত দেহই সমস্ত কিছুর পরিচালক। আমরা আরও মনে করি যে, ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধি দ্বারা আমরা যে জ্ঞান লাভ করি উহারাই সেই জ্ঞানের উৎপাদক।

 

প্রশ্নকর্তা এই সাধারণ বিশ্বাসে সন্দেহ প্রকাশ করিয়া উপরোক্ত প্রশ্ন করিয়াছেন। তিনি মনে করেন যে, মন ইন্দ্রিয়বর্গ স্বাধীনভাবে তাহাদের স্ব স্ব ব্যাপারে প্রবৃত্ত হয় না। ইহারা নিজেদের বোধশক্তির উৎপাদকও নহে৷ ইহাদের প্রেরয়িতা (প্রেরক) এবং বোধয়িতারূপে (বোধ জাগ্রত করে) ইহাদের হইতে স্বতন্ত্র একজন চেতন পুরুষ আছেন। সেই পুরুষ কে তাহাই প্রশ্নকর্তা জানতে চাহিয়াছেন।

 

🔳 পরবর্তী মন্ত্রে বলা হয়েছে,

 

"যাঁহার শক্তিতে কর্ণ শ্রবণ করে, মন মননকার্য করে, বাগিন্দ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে, তাঁহারই শক্তিতে প্রাণ প্রাণনকার্য করে এবং চক্ষু দর্শন করে। ইহা জানিয়া পন্ডিতগণ কর্ণাদি ইন্দ্রিয়, প্রাণ মন হইতে তাঁহাকে পৃথক করিয়া (অর্থাৎ এই সকলে আত্মবুদ্ধি পরিত্যাগপূর্বক এই প্রাকৃত জীবনের উর্ধে উঠিয়া) অমৃতত্ত্ব লাভ করেন।"

 

🔸 ব্যাখ্যাঃ শ্রবণেন্দ্রিয় দ্বারাই আমরা শ্রবণবিষয়ক জ্ঞান লাভ করি, এজন্য শ্রবণেন্দ্রিয়কে শ্রোত্র বলা হয়। কিন্তু শ্রবণেন্দ্রিয় শ্রবণজ্ঞান লাভের একটি উপায় বা যন্ত্র মাত্র। বাহির হইতে স্পন্দন আসিয়া শ্রবণেন্দ্রিয়ে আঘাত করিলেই শ্রবণজ্ঞান জন্মে। কিন্তু শ্রবণেন্দ্রিয় জ্ঞানের কর্তা নহে৷ উহা জড় পদার্থ তাই জ্ঞানপ্রকাশে অসমর্থ। আমাদের অন্তরস্থ আত্ম-জ্যোতিই (আত্মা) শ্রবণজ্ঞানের মূলে অবস্থিত, উহাই শ্রবণেন্দ্রিয়ের বিষয়কে অভিব্যক্ত করিয়া থাকে৷ এজন্য উহাকে শ্রোত্রেরও শ্রোত্র বলা হয়।

 

এই আত্মা যেমন কর্ণেরও কর্ণ তেমনি মনেরও মন। এখানে মন বুদ্ধিকে একত্রেই মন বলা হইল। আত্মা মনেরও মন ইহার অর্থ এই যে, এই আত্মচৈতন্য জ্যোতিতে দীপ্তিমান না হইলে মন স্ববিষয়ক অর্থাৎ সংকল্প বা অধ্যাবসায়দি কার্য করিতে পারে না। অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের ন্যায় মনও জড়, আত্মার চৈতন্যে চৈতন্যসম্পন্ন হইলেই মনের মননশক্তি জন্মিয়া থাকে। এইজন্য আত্নাকে মনেরও মন বলা হয়। আমাদের প্রাণবৃত্তির কার্যও এই আত্মার সাহায্যেই ঘটিয়া থাকে, কারণ আত্মার অধিষ্ঠান বা প্রেরণা ব্যতীত কোনও প্রাণ ব্যাপারই সম্পন্ন হইতে পারে না। এজন্য আত্মাকে প্রাণেরও প্রাণ বলা হয়।



🔹 এই বিষয়ে জালালুদ্দিন রুমি বলেছেন,

 

"তুমি কি তোমার আত্মার খোঁজ করছো? তবে তোমার মনের খাঁচা থেকে অবমুক্ত হও।"

 

আত্মা কি তবে মনকুঠরে আবদ্ধ?

 

🔳 ঈশোপনিষদের নং মন্ত্র যজুর্বেদের ৪০/ মন্ত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

 

আত্মাকে আপাতদৃষ্টিতে নিশ্চল মনে হলেও ইহা মন অপেক্ষাও বেগবান৷ এখন প্রশ্ন হইতে পারে যিনি নিশ্চল তিনি আবার বেগবান হইতে পারে কিভাবে?

 

ইহার উত্তরে শঙ্করাচার্য বলিয়াছেন, ব্রহ্মের দুইটা ভাব আছে৷ একটা ব্রহ্মের নিরুপাধিক ভাব আর একটি সোপাধিক ভাব৷

 

নিরুপাধিক রূপে আত্না সত্য, জ্ঞান আনন্দস্বরূপ। নিরুপাধিক আত্মা স্বয়ংসম্পূর্ণ, ইনি কিছু করেন না, ইহার কোন পরিবর্তন নেই। এই নিরুপাধিক আত্মা নিশ্চল গতিহীন। মনকে আত্মার উপাধি বলা যাইতে পারে। এই মন-সমন্বিত আত্মা সোপাধিক আত্মা। এই সোপাধিক আত্মাকে বলা হয়েছে বেগবান। মন দেহের মধ্যে থাকিলেও ইচ্ছামাত্র মূহুর্তের মধ্যে ব্রহ্মলোকাদি স্থানে চলিয়া যাইতে পারে। কিন্তু মন যেখানেই যায়, গিয়ে দেখে সেখানে আত্মা আগেই উপস্থিত। কারণ কোনকিছুই ব্রহ্ম বা আত্মার অধিষ্ঠান ভিন্ন থাকিতে পারে না এবং মনও আত্মার উপস্থিতি ভিন্ন জড়ের ন্যায়। তাই মন যখন সর্বত্র গিয়া আত্মাকে দেখিতে পায় তখন মনেরও যেন মনে হয় আত্মা তার চেয়ে দ্রুত ছুটিয়া সেখানে পৌছায়ে গিয়াছে। তাই বলা হয়েছে আত্মা মন অপেক্ষাও বেগবান।

 

মন কি মানুষের নিয়ন্ত্রণে?
 

মন চঞ্চল দ্বৈত ভাবসম্পন্ন অন্যদিকে আত্মা অদ্বৈত। মনকে আত্মার সাথে মিলাতে হলে মনকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। মন যখন অদ্বৈত ভাবসম্পন্ন হয় তখন মনই আত্মা হয়ে যায়।

🔸 শ্রীমদভগবদগীতার / শ্লোকে বলা হয়েছে।

"মানুষের কর্তব্য তার মনের দ্বারা নিজেকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করা, মনের দ্বারা আত্মাকে অধোপাতিত করা কখনো উচিত নয়। মন জীবের অবস্থাভেদে বন্ধু শত্রু হয়।"



🔹 পরবর্তী শ্লোকে বলা হয়,

 

"যিনি তার মনকে জয় করেছেন তার মন তার পরম বন্ধু কিন্তু যিনি তা করতে অক্ষম তার মন তার পরম শত্রু।"

 

-শ্রীমদভগবদগীতা (/)

মনের দ্বারা কি আত্মাতে পরমাত্মাকে ধারণ করা যায়?

 

"যুঞ্জানঃ প্রথমং মনস্তত্ত্বায় সবিতা ধিয়ঃ।

অগ্নের্জ্যোতিনর্নিচায্য পৃথিব্যা অধ্যাভরত।।"

 

- যজুর্বেদ (১১/)

 

🔸 ভাবার্থঃ যোগাভ্যাসী মানুষেরা তত্ব অর্থাৎ ব্রহ্মবস্তু বা ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্তির জন্য সর্বাগ্রে মনকে পরমেশ্বর যুক্তি করিয়া থাকেন পরমেশ্বরও এইরূপ যোগীর প্রতি কৃপা করিয়া তাহার বুদ্ধিকে আপনাতে যুক্ত করিয়া নেন তখন সেই যোগী পরমেশ্বরের প্রকাশ নিশ্চয় করিয়া জ্ঞাত হইয়া স্বীয় আত্মাতে পরমেশ্বর কে ধারণ করেন৷

 

🔺 মন্তব্যঃ মন আত্মার হিসেব নিকেশ খুবই জটিল। এই পরমতত্ত্বকে জানার জন্য জ্ঞান উপলব্ধি ভিন্ন পথ নেই। সেই চেষ্টায় থাকলাম।

 

©স্টিমন অনিক।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ