বরাহ অবতার কি, কেন ও কিভাবে? বরাহ অবতারের কেন দরকার হয়েছিল? বরাহ অবতার যেভাবে বিশাল সমুদ্র থেকে পৃথিবীকে উঠিয়েছিলেন তা কতোটা বিজ্ঞানসম্মত? এরকম নানান প্রশ্নের উত্তর শাস্ত্র, যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি। তাই লেখাটি অবশ্যই মনযোগ সহকারে পড়ার চেষ্টা করবেন।
বরাহ অবতার নিয়ে আপাত "অযৌক্তিকতা" ও “অবৈজ্ঞানিকতা”-এর সমাধান পাওয়া যায় পুরাণ শাস্ত্রেই। মূলত শাস্ত্রে শ্রদ্ধাহীনতা, পঠন-পাঠনের অভাব এবং পুরাণ নিয়ে কুচক্রীদের ক্রমাগত অপপ্রচারের ফলে অনেকাংশ ক্ষেত্রেই মূল সত্য আমাদের দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়না। যাইহোক বরাহদেবের সমুদ্রের গভীর থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করার পেছনে যে মূল ঘটনা ও তার ব্যাখ্যা সেটাই আমরা দেওয়ার চেষ্টা করবো বেদ ও পুরাণের বিভিন্ন রেফারেন্স বিশ্লেষণ করে।
বরাহ অবতারের প্রাথমিক উৎস মূলত শ্রুতিশাস্ত্র। কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের প্রথম অষ্টক, প্রথম প্রপাঠক, তৃতীয় অনুবাকে পাওয়া যায়,
"......এই (স্থাবরজঙ্গমাত্মক) সৃষ্টি আগে জলমাত্র ছিল। তখন প্রজাপতি (জগৎসৃষ্টির ইচ্ছায়) (পর্যালোচনারূপ) তপস্যা করলেন। কিরূপে এই (জগৎ) হবে এইরূপ বিচার করে তিনি একটি পদ্মপত্র দেখলেন। তিনি চিন্তা করলেন-যে আধারে এটি আশ্রিত আছে, সেটি নিশ্চয়ই (নীচে) বর্তমান আছে। তিনি বরাহ হয়ে সেই রূপ ধারণ করে (জলমধ্যে) নিমজ্জিত হলেন। তিনি নীচে পৃথিবীকে প্রাপ্ত হলেন। সেই (ভূমির) থেকে (কিছু আর্দ্র মৃত্তিকা নিজ দাঁতের দ্বারা) পৃথক করে (জলের উপর) ভেসে উঠলেন।...."
এছাড়াও, কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় আরণ্যকের (আন্ধ্রপাঠ) মহানারায়ণ উপনিষদে (১/৩০) ভূ-দেবীর স্তুতি করতে গিয়ে ভগবানের বরাহ অবতারকে ভূমির উদ্ধারকর্তা বলা হয়েছে, “উদ্ধৃতাসি বরাহেণ কৃষ্ণেন শতবাহুনা” অর্থাৎ, হে ভূমি! পূর্বে তোমাকে শতবাহুবিশিষ্ট কৃষ্ণবর্ণীয় বরাহদেব উদ্ধার করেছিলেন। এবার বেদ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ও তৈত্তিরীয় আরণ্যক) শাস্ত্রের এই ঘটনার বিস্তৃত বর্ণনা ও ব্যাখ্যা খুঁজে বের করবো আমরা পুরাণাদি শাস্ত্র থেকে এবং সেটা অবশ্যই বিজ্ঞান ও যুক্তির আধারে। কারণ মহাভারতের আদিপর্বের ২২৯নং শ্লোকে বলা আছে, ”ইতিহাসপুরাণাভ্যাং বেদং সমুপবৃংহয়েৎ....” অর্থাৎ, ইতিহাস ও পুরাণ দ্বারা বেদকে বর্ধিত করবে। এছাড়াও ছান্দোগ্য উপনিষদের ৭/১/৪নং মন্ত্রেও ইতিহাস এবং পুরাণাদি শাস্ত্রসমূহকে ”পঞ্চম বেদ” -এর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
বরাহ অবতারের ঘটনাপ্রবাহ:
বায়ু পুরাণের ষষ্ঠ অধ্যায় বিশ্লেষণে, "তিনি সহস্রযুগ তুল্য নৈশ কাল অতিবাহিত করে রাত্রির অন্তে সৃষ্টি করার নিমিত্ত ব্রহ্ম মূর্তি পরিগ্রহ করেন।" অর্থাৎ, এখানে কল্পের শুরুতে সৃষ্টির কথা বর্ণিত হচ্ছে।
"ক্রমে সতত্ত্ব গুণের উদ্রেক বশতঃ সেই ব্রহ্মা প্রবুদ্ধ হয়ে সকল লোক শূন্যকার - সমস্তই জলপূর্ণ দর্শনে বায়ুর আকারে বর্ষাকালীন নিশাভাগে খদ্যোতবৎ বিচরণ করতে থাকেন। ক্রমে বুদ্ধিমান্ ব্রহ্মা অনুমান দ্বারা সিদ্ধান্ত নিলেন সেই জলরাশি মধ্যে পৃথিবী রহিয়াছে; এটি জানতে পেরে ভূমির উদ্ধারার্থ বিবেচনাপূর্ব্বক অন্যান্য কল্পের ন্যায় রূপান্তর পরিগ্রহ করতে অভিলাষ করে ভাবিতে লাগলেন যে, আমি কোন্ মহৎরূপ ধারণ করে এই ধরণীর উদ্ধার করতে পারব? এখানে, ব্রহ্মা বর্ষাকালীন নিশাভাগে জোনাকিপোকার ন্যায় বিচরন করলেন।"
বিশ্লেষণ:
এখানে বর্ষাকালীন বলার কারণ হলো, যখন সৃষ্টির আদিতে পৃথিবী একটি উত্তপ্ত ম্যাগমার সাগর ছিল, তখন উত্তাপের কারণে সকল জলরাশি বাষ্প এবং গ্যাস আকারে বায়ুমণ্ডলে অবস্থান করছিল। পৃথিবীর জলবায়ু যথেষ্ট শীতল হওয়ার পর এই জল বৃষ্টি আকারে নেমে এসেছিল এবং এই বর্ষণ মিলিয়ন বছর ধরে চলেছিল। এই বিষয়ে Medium.com এ, "The First Rain Lasted Millions of Years." নামে একটি প্রবন্ধ রয়েছে। পৃথিবীর এত দীর্ঘ বছরের মেঘাচ্ছাদিত বর্ষণরত অন্ধকার অবস্থাকেই বায়ু পুরাণে “বর্ষাকালীন নিশাভাগ” বলা হয়েছে। তারপর পুরাণে বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মা দেখেন সমস্ত জগতই জলপূর্ণ এবং তিনি অনুমান করলেন জলরাশির মধ্যেই পৃথিবী রয়েছে। Livescience.com এর একটি প্রবন্ধে এই তথ্য স্পষ্ট যে ১.৫ বিলিয়ন বছরের সেই পৃথিবী সম্পূর্ণই জলমগ্ন ছিলো, একটিও মহাদেশ প্রকাশিত ছিলো না।
ন্যাচার জিওসায়েন্সে প্রকাশিত রিসার্চ আর্টিকেল, Astronomy এবং U.S. National Science Foundation এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত আর্টিকেল ও রিসার্চ নিউজ অনুসারে, প্রারম্ভিক অবস্থায় পৃথিবী মহাদেশবিহীন জলমগ্ন এক “জল-জগত” এর ন্যায় ছিলো।
এই বিষয়টিই কোনো রূপক গল্পের আশ্রয় না নিয়ে পুরাণে সরাসরি বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ যা পুরাণে হাজার বছর পূর্বে বর্ণিত ছিলো তা বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে সম্প্রতি বেড়িয়ে এলো। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে আজ যা আমাদের দৃষ্টিতে অবৈজ্ঞানিক, কাল সেটাই বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সাধারণ আবিস্কার হয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
"এই চিন্তান্বিত ব্রহ্মা চতুৰ্দ্দিক্ জলাকীর্ণ দর্শনে জলক্রীড়াকুশল বরাহরূপ স্মরণ করলেন। ঐরূপ বাঙময় ও সর্ব্বভূতের অনভিভাব্য তার-ই নামান্তর ধর্ম।....অতঃপর সেই হরি (বিষ্ণু) বিপুলাকার বরাহ-মূর্তি পরিগ্রহ করে পৃথিবীর উদ্ধারার্থে রসাতলে প্রবেশ করলেন।... সেই বিভু প্রজাপতি এরকম যজ্ঞবরাহ আকার ধারণ করে জলরাশির মধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক অনুসন্ধান করে জলনিমগ্ন পৃথিবীকে প্রাপ্ত হন এবং অনায়াসেই তাকে উদ্বার করেন।"
বিশ্লেষণ:
শুরুতেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে যে, জগতে এত প্রানী থাকতে তিনি বরাহরূপেই কেন অবতার হলেন? কারন হলো এই প্রাণী জলক্রীড়াকুশল। পুরাণেও বরাহ অবতারের প্রাথমিক কারণ জলক্রিড়াকুশল বলা হয়েছে। বরাহ এমন এক স্থলচারী প্রানী যে জলেও স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারে। সেজন্য স্রষ্টা লীলাবশত বরাহরূপই ধারণ করলেন। তাছাড়া বরাহ তার ঘ্রাণশক্তির জন্যও পরিচিত। গন্ধ শুঁকে তারা জল বা কর্দমাক্ত মাটির নিচে থেকে তাদের ঈপ্সিত বস্তুর খোঁজ করতে পারে। এজন্যই ভাগবত পুরাণে (৩/১৩/২৮) দেখা যায়, বরাহদেব এই ঘ্রানশক্তির দ্বারাই মহাসাগরের মাঝে ধরিত্রীকে খুঁজতে খুঁজতে চলেছিলেন। এরপর আমরা দেখতে পাই বরাহদেব জলের নিচে গমন করে পৃথিবীকে উদ্ধার করলেন। বলা বাহুল্য, এখানে পৃথিবী বলতে গোলাকার গ্রহ নয় বরং পৃথিবীর স্থলভাগ বা ভূমিকে বোঝানো হচ্ছে এবং জলের নিচে থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করা বলতে, পৃথিবী জুড়ে অবস্থান করা মহাসাগরের বুকে স্থলভূমি জাগিয়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞানও উক্ত মতকে সমর্থন করে। তবে ঠিক কত আগে সাগরের নিচে থেকে স্থলভূমি জেগে উঠেছিল, তা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে। Times of India, Live Science, Inside Science প্রভৃতি পোর্টালে প্রকাশিত আর্টিকেল অনুসারে, যদিও এতদিন মনে করা হত যে প্রথম স্থলভূমি সাগরের নিচে থেকে ২.৫ বিলিয়ন বছর আগে উত্থিত হয়েছে, কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে এই কালখণ্ড আরও ৭০০+ মিলিয়ন বছর পুরোনো। অর্থাৎ, বর্তমান হিসেবে প্রায় ৩.২-৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে সাগরতল থেকে স্থলভূমি জাগ্রত হয়েছে।
"তৎকালে তিনি সেই জলরাশিকে বিভাগপূর্ব্বক সমুদ্রজল সমুদ্রে আর নদীর জল নদীতে স্থাপন করে অতল জলমগ্না, রসাতলগতা পৃথিবীকে লোকহিত-কামনায় দঃষ্ট্রা (দাঁত) দ্বারা উত্তোলন করলেন। পৃথিবীধর বরাহদেব, সেই পৃথিবীকে উত্তোলনপূর্ব্বক জলরাশির উপরে স্থাপন করলেন। – অর্থাৎ, নব্য গঠিত স্থলভাগের উপরে বরাহদেব জলরাশিকে নদী ও সাগর আকারে বিন্যস্ত করলেন। পৃথিবী সেই জলরাশির উপর মহতী নৌকার ন্যায় ভাসমান রইল।....কিন্তু পৃথিবী বিস্তীর্ণা বলে ডুবে গেলো না! অম্বুজলোচন বরাহদেব, অতঃপর জগদ্বিস্তার বাসনায় পৃথিবীর বিভাগ বিষয়ে মনোযোগ। তিনি পৃথিবীকে সমভূমি করে স্থানে স্থানে পৰ্ব্বতসমূহ বিন্যাস করলেন।"
বিশ্লেষণ:
এখানে পরবর্তীতে স্থলভূমির ওপর সমতল ভূমি, পর্বত প্রভৃতি সৃষ্টির কথা বর্ণিত হয়েছে। পৃথিবীর নৌকার ন্যায় ভেসে থাকা এবং পৃথিবী বিস্তীর্ণা বলে ডুবে গেলো না বলতে আধুনিক বিজ্ঞান অনুসারে ম্যান্টেলের ওপর ভাসমান টেকটনিক প্লেটের কথা বলা হয়েছে। টেকটোনিক প্লেট হল লিথোস্ফিয়ারের অংশ যা ভূত্বক এবং ম্যান্টেলের উপরের অংশ দিয়ে গঠিত। এই টেকটোনিক প্লেটগুলি অপেক্ষাকৃত ঘন ম্যান্টেলের উপর ভাসমান। ম্যান্টেলে পরিচলন স্রোত বিদ্যমান যা পৃথিবীর কেন্দ্রে ম্যাগমা উত্তপ্ত হয়ে এবং লিথোস্ফিয়ারের দিকে অগ্রসর হওয়ার ফলে সৃষ্টি হয়। এই স্রোত অনেকটা সমুদ্র বা নদীর স্রোতের মতো, যা টেকটোনিক প্লেটগুলিকে নদীর উপর একটি নৌকার মতো ধীরে ধীরে চলাচল করতে সাহায্য করে। টেকটোনিক প্লেটের এই চলাচল কারণে সৃষ্টি হয় "কন্টিনেন্টাল ড্রিফট"।
“These currents, much like currents in the ocean or a river, cause the tectonic plates to slowly move like a boat on a river.”
পদ্ম পুরাণ, সৃষ্টি খণ্ড, অধ্যায়-৩, শ্লোক-৪৩ এ আরেকটি আকর্ষণীয় তথ্য পাওয়া যায়। সেখানে বলা হচ্ছে, "বরাহদেবের খুরের আঘাতে বিক্ষত রসাতলে সশব্দে জলরাশি প্রবেশ করতে থাকলো।" রসাতলে সশব্দে জলরাশি প্রবেশ করা থেকে আমরা এটাই বুঝতে পারি যে, পুরাণমতে পৃথিবীর সকল জল যে শুধু এর পৃষ্ঠে অবস্থিত নদী, সাগর বা মহাসাগরে রয়েছে, তা নয়। বরং এরও গভীরে অর্থাৎ, রসাতলেও জলের উপস্থিতি রয়েছে। এই প্রসঙ্গে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানীদের এক গবেষণার কথা উল্লেখ করতে পারি, যেখানে পৃথিবী পৃষ্ঠের ৭০০ কিলোমিটার নিচে ম্যান্টেলে জলের এক বিশাল উৎসের খোঁজ পাওয়া গেছে, যা পৃথিবীপৃষ্ঠের সামগ্রিক জলের পরিমানের তিনগুন! ৭০০ কিলোমিটার গভীরতা উপলব্ধির জন্য বলা যেতে পারে, এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত পৃথিবীর গভীরতম স্থান মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা মাত্র ১০.৬ কিলোমিটার। ম্যান্টেলে আবিষ্কৃত জলাধারের বিষয়ে Northwestern University, Illinois এর গবেষক স্টিভেন জ্যাকবসেন জানান, জলাধারটিকে “রিংউডাইট” নামক নীলাভ পাথর ধারন করে আছে। পাথরটি স্পঞ্জের মতো এবং এই পাথরের জলধারণ করার ক্ষমতা অনেক বেশি। তিনি আরো বলেন, “যদি ম্যান্টেলে এই জলাধার না থাকতো এবং সকল জল উপরে চলে আসতো, তাহলে পৃথিবীপৃষ্ঠে শুধু পর্বত চূড়া গুলোই দৃশ্যমান থাকতো”!
অর্থাৎ এখানে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে বরাহদেবের খুরের আঘাতে পৃষ্ঠের জলরাশি যদি রসাতলে প্রবেশ না করতো তবে ভূভাগকে জাগ্রত করার পরও তার সমতল ভাগ জলমগ্নই থাকতো।
মোটাদাগে এটিই ছিলো বেদ ও পুরাণোক্ত বরাহদেবের পৃথিবী উদ্ধারের কাহিনি, প্রেক্ষাপট ও বিশ্লেষণ। এখানে না আছে অবাস্তব কোন তত্ত্ব, না আছে অযৌক্তিক কোন ঘটনাপ্রবাহ, বরং রয়েছে বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণের সাথে শতভাগ সামঞ্জস্যতা।
একই কাহিনি আমরা ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের ৬ষ্ঠ অধ্যায়, মৎস পুরাণের ১৪৮তম অধ্যায়, কূর্ম পুরাণ-পূর্বভাগের ৬ষ্ঠ অধ্যায়, পদ্ম পুরাণ-সৃষ্টিখণ্ডের ৩য় অধ্যায় এবং বিষ্ণুপুরাণ-১ম অংশের চতুর্থ অধ্যায়ে পাই।
এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্ন সেটা হলো আমরা বিভিন্ন টিভি সিরিয়ালে দেখি যে রাক্ষস হিরন্যাক্ষ পৃথিবীকে একটি সমুদ্রতলে লুকিয়ে রেখেছিলো, তাহলে এই ঘটনার উৎস কোথায়? হিরন্যাক্ষ যে, পৃথিবীকে নিয়ে বলের মত ছুঁড়ে মারছে - এটা সিরিয়াল নির্মাতার কল্পনাপ্রসূত। হয়ত কোনো এক সময় কোনো নির্মাতা উক্ত ঘটনাকে এভাবে কল্পনা করেছিলেন, এরপর থেকে সেভাবেই টিভি সিরিয়াল নির্মিত হয়ে আসছে।
তবে বরাহদেবের সাথে হিরন্যাক্ষের যুদ্ধ কারো কল্পনাপ্রসূত নয়।
ভাগবত পুরাণ, (৩/১৮) এ দেখা যায়, যখন বরাহদেব ভূমিকে জলের ওপরে তুলতে ব্যস্ত ঠিক তখন হঠাৎ হিরন্যাক্ষ সেখানে গিয়ে ভগবানকে বাধা দেয় তথা সৃষ্টিকাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। বরাহদেব প্রথমে ভূমিকে জলের ওপর স্থাপন করেন এবং অত:পর হিরন্যাক্ষকে হত্যা করেন।
নারসিংহ (উপ)পুরাণ, অধ্যায় – ৩৭ এও কিছুটা ভিন্নরূপে উক্ত ঘটনায় হিরন্যাক্ষের ভূমিকা ও শ্রীবরাহদেবের হাতে তার নিধন হওয়ার দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।
তাহলে একেক পুরাণে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার কোনটি সঠিক? উত্তর হলো, সবগুলোই সঠিক। মূলত কল্পভেদের কারণে একেক পুরাণে ঘটনাপ্রবাহের ভিন্নতা দেখা যায়।
বায়ু পুরাণ, অধ্যায়-৬, শ্লোক-৩৫ এ বলা আছে, "বিবিধ প্রজা সৃজনাভিলাষী প্রজাপতি ব্রহ্মা পূর্ব পূর্ব কল্পের ন্যায় সৃষ্টিকাজে প্রবৃত্ত হন।"
বিষ্ণু পুরাণ, ১ম অংশ, অধ্যায়–৪, শ্লোক- ৪৮/৪৯ এ আছে, "সত্যসংকল্প ভগবান তাঁর অমোঘ প্রভাবের সাহায্যে পূর্বকল্পের শেষে দগ্ধ হওয়া সমস্ত পর্বতকে পৃথিবীর তলের ওপর যথাস্থানে রচনা করলেন। তারপর তিনি সপ্তদ্বীপাদি ক্রমে পৃথিবীর যথাযোগ্য বিভাগ করে ভূলোক ইত্যাদি চারলোকের পূর্ববৎ কল্পনা করে দেন।"
অর্থাৎ, প্রতি কল্পেই এই সৃষ্টিকর্ম হয়ে আসছে। এক কল্পের প্রলয়ের পর পরবর্তী কল্পে নতুন করে সবকিছু সৃষ্ট হয়। সেক্ষেত্রে যেহেতু একেক পুরাণ একেক কল্পের কাহিনি বর্ণনা করে, তাই কল্পভেদের কারণে কিছু জায়গায় ব্যতিক্রম দেখা যেতে পারে। এটা স্ববিরোধীতা নয়। কল্পভেদে ঘটনার ভিন্নিতা নিয়ে শিবপুরাণে পরমপিতা ব্রহ্মাও উত্তর দিয়েছেন।
শিব পুরাণে (২/৪/১৩/৫-৬) এ আছে-
Brama said, "Due to the difference of kalpa, the story of the birth of Ganesha is told in different ways." (Tras: J.L.Shastri)
অর্থ্যাৎ ভিন্ন ভিন্ন কল্প অনুযায়ী গণেশের মস্তক ছেদন সংক্রান্ত উপাখ্যানও ভিন্ন হয়। তাই কোন কল্পে গণেশের মস্তক ছেদন শনির দ্বারা হয়েছিল আবার কোন কল্পে তা মহাদেবের ত্রিশুলের দ্বারা হয়েছিল। কিন্তু যেই কল্পেই হোক না কেন, তার মধ্যে একটি বিষয় নির্দিষ্ট যে, প্রথমে গণেশের মস্তক ছেদন হয়েছিলো তারপর সেই ছেদিত মস্তকের স্থানে অন্য মস্তকের পুনঃস্থাপন হয়েছিলো।
পরিশেষে বলবো যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদভগবদগীতায় (৪/৩৯) বলেছেন, "শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানম্" অর্থাৎ শ্রদ্ধাবান ব্যক্তিই জ্ঞান লাভ করে। এই পরমসত্যটি উপলব্ধি করেই কেবল সনাতন শাস্ত্র অধ্যয়ন করা উচিত। তাহলে শাস্ত্রের প্রতিটি সংশয়ের নিরাকরণ শাস্ত্র থেকেই সম্ভব, অনথ্যায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কেবল অপপ্রচারেই লিপ্ত থাকতে হবে।
@ SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
সনাতন শাস্ত্র ও দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর।।
0 মন্তব্যসমূহ