সূর্যমণ্ডল থেকে চন্দ্র কিভাবে উর্ধ্বে দৃষ্ট হয়? (ভাগবতের জ্যোতির্বিজ্ঞান)


ভাগবত পুরাণের অকাট্য ও অভ্রান্ত জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে চলছে মহা-অজ্ঞদের বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার। কিছু অনার্যের দল যেন-তেনভাবেই পুরাণকে অবৈজ্ঞানিক প্রমাণ করার অপচেষ্টায় নেমেছে। এদের ভাবটা এমন যে পুরাণকে যেন-তেনভাবে অবৈজ্ঞানিক প্রমাণ করতে পারলেই যেন তাদের মিশন সাকসেসফুল। 

কিন্তু না! SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি এই মিথ্যার পর্দা সরাবেই, সত্যকে সামনে আনবেই৷ ওরা যে যে শ্লোকে আপত্তি তুলবে আমরা সেখান থেকেই বিজ্ঞানের নির্মোহ বিশ্লেষণ করবো আর সাধারণ সনাতনীদের দেখাবো যে এই অনার্যরা অসত্য প্রচারে কতটা বিরামহীন! এই যে এরা  সবসময় পুরাণের জ্যোতির্বিজ্ঞানের সমালোচনা করে অথচ এরা কি নিজেরা জানে যে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে এদের জ্ঞানের স্তর অতীব দৈন্য! তা না হলে বিজ্ঞানে তথা জ্যোতির্বিজ্ঞানে যে "আপাত গতি" বলে একটা গতি রয়েছে সেটা এরা জানে না বা মানে না বা বোঝে না কেন? 

যাইহোক, আমরা এদের সমস্ত অবৈজ্ঞানিক অপপ্রচারের বৈজ্ঞানিক জবাব দিতে প্রস্তুত। সেই ধারাবাহিকতায় আজকের প্রত্যুত্তর থাকবে "চন্দ্র কীভাবে সূর্যের উর্ধ্বে অবস্থান করে?"

ভাগবতের পঞ্চম স্কন্ধের বাইশতম অধ্যায়ের আট নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে, 

"সূর্যমন্ডলের লক্ষ যোজন উর্ধ্বে চন্দ্র গ্রহ দৃষ্ট হন, চন্দ্র দেব তার উগ্র আচরণশীলত্ব দ্রুতগামী হইয়া দুই পক্ষে সূর্যের সম্বৎর, সওয়া দুই দিবসে সূর্যের একমাস,এক একদিনে সূর্যের এক এক পক্ষ ভোগ করেন।"

অনার্যরা তো সর্বদাই অপপ্রচারের জন্য মুখিয়ে থাকে, এইজন্যই তারা শ্লোকটাতে আসলেই কী বলা হয়েছে তার আধ্যাত্মিক, বৈজ্ঞানিক কোনভাবেই বিচার বিশ্লেষণ না করে পৃথিবীর থেকে সূর্যের দূরত্ব চাঁদ অপেক্ষা বেশি এই তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে এটাকে অবৈজ্ঞানিক ঘোষণা করে বসল। এখন বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা দিয়েই জ্যোতির্বিজ্ঞানে এদের অজ্ঞতা প্রমাণ করা হবে।

এবার বিশ্লেষণে আসা যাক, 

সূর্য ও চন্দ্র একই তলে পৃথিবীর আকাশে ভ্রমণ করছে না এবং চন্দ্র মার্গের উচ্চতা ও বিস্তার রবি মার্গের অপেক্ষা বেশিঃ 

এখানে মূল বিষয় হলো ভূতলের উপরে সূর্যের যাতায়াত পথ তথা রবি মার্গের উচ্চতা অপেক্ষা চন্দ্রের যাতায়াত পথ তথা চন্দ্র মার্গের উচ্চতা অধিক। ব্যাপারটা বৈজ্ঞানিক ভাবে বোঝা যাক। এটা বোঝার জন্য জানতে হবে ভূতলের উপরে সূর্য কোন পথে ভ্রমণ করে? ভূতলের উপরে সূর্য পৃথিবীর কক্ষতল বরাবর ভ্রমণ করেন। 

পৃথিবীর কক্ষতলটা কী? 

পৃথিবী যে পথে সূর্যকে ভ্রমণ করে সেটা হলো পৃথিবীর কক্ষপথ। পৃথিবীর কক্ষপথ যে কাল্পনিক তলে রয়েছে সেটাই হলো পৃথিবীর কক্ষতল। পৃথিবীর কেন্দ্র এবং সূর্যের কেন্দ্র একই তলে রয়েছে।

সূর্যের সামনে পৃথিবী যখন পশ্চিম থেকে পূর্বে  নিজের অক্ষের উপর পাক খায় তখন সূর্যকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে গমন করতে দেখা যায়। সূর্যের এই গমন পথ পৃথিবীর কক্ষতল বরাবর তৈরি হয়। 

চিত্র ১ঃ

পৃথিবী তার কক্ষপথে ৬৬.৫ ডিগ্রি কোণে হেলে রয়েছে। এইজন্যই পৃথিবীর আকাশে বিষুবরেখা থেকে ২৩.৫ ডিগ্রি  উত্তর দক্ষিণে সূর্য আপাত গতিতে ভ্রমণ করে। অর্থ্যাৎ সূর্যের গতিপথ তথা রবি মার্গ ২৩.৫ ডিগ্রি উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত। এদিকে চন্দ্রের কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষতলের সাথে ৫ ডিগ্রি decline অবস্থায় রয়েছে এইজন্যই চন্দ্র বিষুব রেখা থেকে ২৮.৫  ডিগ্রি উত্তর দক্ষিণ পর্যন্ত ভ্রমণ করে। সেইসূত্রে চন্দ্র মার্গের বিস্তার ২৮.৫ ডিগ্রি উত্তর দক্ষিণে। অর্থাৎ পৃথিবীর আকাশে চন্দ্র সূর্যের চেয়ে অধিক উচ্চতা পর্যন্ত ভ্রমণ করে। 

ব্যাপারগুলো চিত্রের সাহায্যে স্পষ্ট করা হলো... 

এই যে ছবিটি দেখছেন, ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখলে বুঝতে পারবেন, সূর্যের গমনপথ তথা রবি মার্গের অবস্থান পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থিত। অন্যদিকে চন্দ্র মার্গের অবস্থান রবি মার্গের চেয়ে অধিক দূরে অবস্থিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পৃথিবী তার কক্ষপথে ৬৬.৫ ডিগ্রি হেলে থাকায় সূর্যের যাত্রাপথও বিষুবরেখা (equator) বরাবর সমতলে তৈরি না হয়ে ২৩.৫ ডিগ্রি উত্তর দক্ষিণে হেলে তৈরি হয়। (চিত্রে দ্রষ্টব্য।) 

চিত্র ২ঃ 


ব্যাপারটা আরও সহজভাবে স্পষ্ট করা যাক।

ধরুন আপনি নিজের চারিদিকে পাক দিচ্ছেন। আপনার থেকে বহু দূরে একটি লোক আপনারই এক সমতলে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে আর একটি লোক আপনার কাছেই কিন্তু মাথার উপর দোতালায় দাঁড়িয়ে আছে। এখন আপনি ঘুরতে থাকলে ওদেরকেও আপাত গতি নিয়ে ঘুরতে দেখবেন। কিন্তু যে লোকটি আপনার এক সমতলে দাঁড়িয়ে আছে তার ঘূর্ণন আপনার সমতলে তৈরি হবে। কিন্তু যে লোকটা আপনার কাছেই কিন্তু আপনার চেয়ে উঁচুতে আছে তার ঘূর্ণন আপনার মাথার উপরই তৈরি হবে। সূর্য চাঁদের ব্যাপারটা তেমনি। সূর্যের কেন্দ্র আর পৃথিবীর কেন্দ্র এক সমতলে থাকে। এইজন্যই সূর্যকে পৃথিবীর কক্ষতল বরাবর ঘুরতে দেখা যায়। (যেমন আপনি আর ঔ বহুদূরের লোকটি এক সমতলে থাকায় তার ঘূর্ণন আপনার গা বরাবর তৈরি হয়েছিল।) অন্যদিকে চন্দ্র পৃথিবীর কক্ষতল থেকে উপরে ও নীচে দৌড়াদৌড়ি করে বলে, তার ভ্রমণ পথ পৃথিবীর কক্ষতল থেকে দূরে তৈরি হয়। 

২ নম্বর চিত্রটিই আবার পর্যবেক্ষণ করুন।

শঙ্কাঃ চাঁদ তো নীচের দিকেও চলে যায়, এর ব্যাখ্যা কিভাবে মিলাবেন?

শঙ্কা নিবারণঃ শ্লোক ভালো করে খেয়াল না করেই শঙ্কার উদ্রেক হলে ত সমস্যা। ওখানে স্পষ্টই বলা হচ্ছে সূর্যমণ্ডলের উপর চন্দ্র দৃষ্ট হোন। অর্থাৎ দৃশ্যমান পরিস্থিতিই বিবেচ্য৷ 

যাইহোক চাঁদ নীচের দিকে চলে যায় বটে (সেটা আমাদের পৃথিবীর দক্ষিণ আকাশে চলে যাওয়া।) কিন্তু তখনও তার মার্গের উচ্চতা সূর্যের চেয়ে বেশিই থাকে। 

চিত্রটি আবার দেখুন। চিত্রের বামদিকে চন্দ্র মার্গের অবস্থান নীচের দিকে মনে হচ্ছে। চাঁদ যখন ওই অবস্থায় এসে পৃথিবীর আকাশে দৃশ্যমান হবে, সূর্যকে তখন ওখানে থাকা চলবে না। কারণ সূর্যের প্রখর তেজে  চাঁদকে দেখাই যাবে না। এই রকম অবস্থান কোন পূর্ণিমার সময় তৈরি হয়। পূর্ণিমার সময় সূর্য আমাদের ভূতলের নীচে গেলে তবেই চাঁদকে দেখা যাবে। অর্থাৎ তখনও চন্দ্র সৌরকিরণের উর্ধ্বে থাকবে। 

অন্যদিকে এটা বিচার করে দেখুন, পৃথিবী যে কাল্পনিক বিষুবরেখা (equator) তে রয়েছে সেখান থেকে কার দূরত্ব বেশি? এখন আমরা যখন পূর্ণিমার চাঁদকে ওখান থেকে দেখবো তখনও বিষুব রেখা তার অবস্থান রবিমার্গের অধিক হবে। 

অন্যদিকে চন্দ্রের ওই রকম অবস্থানের সাথে সূর্যের অবস্থান ও একত্রিত হয় তখন পৃথিবীতে অমাবস্যা বিরাজ করবে। কিন্তু চাঁদ পৃথিবীর কক্ষতলের সাথে ৫ ডিগ্রি ডিক্লাইন থাকায় তখনও চাঁদকে সূর্যের উপরে মনে হবে। 

ছবিটি দেখুন, অমাবস্যার সময় সূর্য চাঁদের অবস্থান-

চিত্র ৩ঃ


চাঁদ কি তাহলে আমাদের দৃষ্টিতে সূর্যের নীচ দিয়ে পৃথিবীর আকাশে আসে না? 

হ্যাঁ, আসে কিন্তু তখনও তার গমন পথের তল সূর্যের গমন পথের তলের দূরে হয় এবং তার ওই অবস্থান পৃথিবীর আমাদের দৃষ্টিতে দৃশ্যমান হতে পারে না। চাঁদ যখন সূর্যের নীচের দিকে ও সূর্যের আগে আগে যায় তখন সে সূর্যের আগেই অস্ত যায় এবং সূর্যোদয়ের পূর্বেই দর্শন দেয়। যেটা কোন কৃষ্ণপক্ষে হতে পারে। অন্যদিকে যখন সূর্যের নীচ দিয়ে ও পিছনে পিছনে যায় তখন সে সূর্যের পর অস্ত যায়। সূর্য দিগন্ত রেখার দিকে নীচে নেমে চাঁদ প্রকাশিত হয়। তখন সে সূর্যের উপরে দর্শন দেয়। যেটা কোন শুক্লপক্ষে হতে পারে। 

চিত্র ৪ঃ ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, চাঁদ সূর্যের নীচ ও আগে আগে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সেই আগে অস্ত যাবে। 

চিত্র ৫ঃ ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, চাঁদ সূর্যের নীচে ও পিছনে পিছনে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সূর্যই আগে দিগন্ত রেখায় অস্ত যাবে আর চাঁদ আকাশে উপরিভাগে থেকে দৃশ্যমান হবে।


সূর্য চাঁদের দৃশ্যমান হওয়ার ব্যাপারটা পরিষ্কার করছি। আমরা কেন কোন কিছুকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে অস্ত যেতে দেখি। এর কারণ পৃথিবীর আবর্তন গতি। পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্বে আবর্তিত হয় বলে আমরা সব জ্যোতিষ্ককে পূর্ব থেকে পশ্চিমে যেতে দেখি। সেই সূত্রে সূর্য পূর্ব দিক থেকে ওঠে পশ্চিমে অস্ত যায়। চাঁদও পূর্ব দিক থেকে উঠে পশ্চিমে অস্ত যায়। কিন্তু চাঁদকে আমরা পূর্ণিমা ব্যতীত অন্যদিনে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত যাওয়াটা আমরা দেখতে পাই না। কারণটা সূর্যালোকের উপস্থিতি। ধরুন শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথি। সূর্য যখন মধ্যগগনে থাকে তখন পূর্ব দিগন্তে চন্দ্রের উদয় হয়। কিন্তু সূর্যের প্রখর তেজে তখন চন্দ্রের উদয় আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয় না। যদি হতো তখন আমরা দেখতে পেতাম সূর্য মাথার উপরে  আর চন্দ্র সূর্যের নীচে দিগন্ত বরাবর অবস্থান করছে। কিন্তু তা তো হয় না। চন্দ্র ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কাছে অপ্রকাশিত থাকেন যতক্ষণ সূর্য আমাদের আকাশের উচ্চ স্থানে অবস্থান করছে। এরপর যত বেলা বাড়বে সূর্য মধ্যগগন থেকে নীচে নামতে থাকবে, আর চাঁদ দিগন্ত থেকে মধ্যগগনে উঠে আসবে। এরপর সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে অস্ত যাবে তখনই চাঁদ প্রকাশিত হবে। অর্থাৎ চাঁদ সূর্যের উপরিভাগে দৃশ্যমান হবে।অর্থাৎ চাঁদ যদি সূর্যের পিছনে নিম্ন আকাশে থাকে তখন অপ্রকাশিত থাকে এবং সূর্যাস্তের পর সৌরকিরণের উর্ধ্বে প্রকাশিত হয়। 

অন্যদিকে কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথির কথা ধরলাম। চাঁদ যখন মধ্যগগনে থাকে তখন সূর্যের উদয় ঘটে। এরপর সূর্যের প্রখর তেজে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। যত বেলা বাড়তে থাকে চাঁদ মধ্যগগন থেকে নীচের দিকে নামতে থাকে। সূর্য উপরে উঠে আসে কিন্তু চাঁদ যে সূর্যের নীচে চলে গেল এটা আমরা দেখতে পাবো না। কারণ সূর্যের প্রখর তেজে তা দেখা যাবে না। এইজন্যই চাঁদ যদি কখনও সূর্যের আগেই নিম্ন আকাশে গমন করে তখন সে সূর্যের আগেই অস্ত যাবে। কিন্তু সূর্যের উপস্থিতিতে তা আমরা দেখতে পাবো না। 

এই যে সূর্যের উপরিভাগে চাঁদের দৃশ্যমান হওয়ার ব্যাপারটা কেবল অষ্টমী তিথি নয়, অন্যান্য তিথিতেও হয়। তবে প্রতিদিন চাঁদের উদয় অস্তের সময় পাল্টে পাল্টে যায়। তাই মধ্যগগনে থাকলেই চাঁদ ওঠে এমন নয়। কিন্তু সূর্য যেখানেই থাকুক তাকে আকাশে চাঁদের নিম্ন স্থানে যেতেই হবে। অন্যথায় চন্দ্র দৃশ্যমান হবে না। কারণ সূর্য নিজ আলোয় আর তেজে দৃশ্যমান হয়, চন্দ্র দৃশ্যমান হওয়ার জন্য সূর্যের আলোর উপর নির্ভরশীল। তাই সূর্যদেব যখন তার উপস্থিতি চাঁদের দৃশ্যমান হওয়ার অনুকূল করেন তখনই চন্দ্র দেব দৃশ্যমান হন। অন্যথায় তিনি আকাশে থাকলেও আমরা তাঁকে দেখতে পাই না। 

এটা আমাদের দৃষ্টিতে আকাশে সূর্য চাঁদের অবস্থান বর্ণনা করা হলো। অর্থাৎ দৃশ্যমান হওয়ার বিচারেও চন্দ্র সর্বদাই সূর্যের উপরে দৃশ্যমান হন।

মাঝেমাঝে আকাশে একইসাথে চাঁদ ও সূর্যকে দেখা যায় এবং তখন চাঁদকেই ‍সূর্যের উপরে দেখা যায়।
Solar and lunar eclipses occur at times of syzygy, as do transits and occultations. The term is often applied when the Sun and Moon are in conjunction (new moon) or opposition (full moon). The word syzygy is often used to describe interesting configurations of astronomical objects in general.


উর্ধ্ব লোক অর্থাৎ স্বর্গলোকে গমনকালে সূর্য চন্দ্রের অবস্থানঃ 

ভাগবত পুরাণ একটি আধ্যাত্মিক শাস্ত্র সেখানে কোনকিছুর বর্ণনাতে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিও থাকবে এটাই স্বাভাবিক। একেবারে জড় বিজ্ঞানের মতো সব কিছুই বর্ণিত হতে হবে এরকম কোন মানে নেই। তবুও সনাতন ধর্মের বেদ, পুরাণে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তা সনাতন ধর্মকে একটি আলদা মহিমাই প্রদান করে। যাইহোক ব্যাখায় আসা যাক। পৃথিবীর উত্তর দিক হলো ওপরের দিক বলে বিবেচিত। মহাশূন্যে তো উপর নীচ বলে কিছু হয় না। তাহলে উপর নীচ ধরা হয়েছে কীসের ভিত্তিতে? ভিত্তিটি হলো শাস্ত্র মতে, পৃথিবীর উত্তর দিকে দেবলোক রয়েছে। সূর্য উত্তর দিকে গমন করলে দেবলোকে দিবাভাগ বিরাজ করে। এর উল্লেখ মহাভারতেও পাওয়া যায়, শরশয্যায় শায়িত মহামহিম ভীষ্ম উত্তরায়ণ কালের জন্য অপেক্ষা করছেন। যাইহোক, সূর্য দেবলোকে অভিমুখে গমন করলে যতটা উচ্চতায় যেতে পারেন, চন্দ্র তাঁর উত্তরায়ণ মার্গে আরও অধিক উচ্চতায় গমন করতে পারেন। এইজন্যই আমাদের পৃথিবীবাসীর সাপেক্ষে সূর্যলোক অপেক্ষা চন্দ্রলোক অধিক উচ্চতায় অবস্থিত। 

চিত্র ৬ঃ



রাশি পরিবর্তনের সময়কালঃ ভাগবতে উচ্চতা বর্ণনার সময় জ্যোতিষ্কগুলোর রাশি পরিবর্তনের সময়কালকেও বিবেচনায় আনা হয়েছে, তাই কে কার উর্ধ্বে অবস্থিত সেটা বলার সময় তাদের রাশি পরিবর্তনের সময়কালকেও উল্লেখ করতে দেখা যায়। পৃথিবীর রাশিচক্র ভ্রমণ করতে যার যত বেশি সময় লাগে তাকে তত উর্ধ্বে বলা হয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে, সূর্য আর চন্দ্রের ক্ষেত্রে। চন্দ্রের রাশি পরিবর্তনের সময়কাল অপেক্ষা সূর্যের রাশি পরিবর্তনের সময়কাল অনেক। তবুও সূর্যকেই চন্দ্রের অপেক্ষা নীচ বলা হচ্ছে এবং এর কারণ স্বরূপ বলা হচ্ছে যে সূর্য চন্দ্রের অপেক্ষা ধীর গতির এবং চন্দ্র সূর্যের চেয়ে অত্যন্ত দ্রুততম। তাই চন্দ্র মার্গের বিস্তার সূর্য মার্গের ওপর এবং বেশি থাকা সত্ত্বেও চন্দ্র সূর্যের চেয়ে অনেক আগেই রাশিচক্র ভ্রমণ করে নেন। 

চন্দ্র কীভাবে সূর্যের চেয়ে অধিক গতিশীল তা পড়ুন আমাদের ব্লগেই-


আধ্যাত্মিক কারণঃ যাইহোক, এতক্ষণ ধরে মহাজাগতিক কারণ ব্যাখ্যা করা হলো। কিন্তু যেহেতু পুরাণ শাস্ত্র আধ্যাত্মিক গ্রন্থ, সেখানে আধ্যাত্মিক কারণও থাকবে। আবার পুরাণ সমুহ হলো বেদের দর্পণ। বেদের সূত্র ধরেই পুরাণে বিষয়বস্তুর প্রবেশ হয়েছে। এই সূর্য, চাঁদের অবস্থানটাও বেদের পাওয়া যায়। 

"এই অগ্নি পৃথিবীর সাপেক্ষে বায়ু ও আকাশের সম্মুখে নিম্ন স্থান প্রাপ্ত হয়, আবার আকাশ মার্গে বায়ু সূর্যের সম্মুখে নত হয়, তেমনি সূর্য ও চন্দ্র এবং নক্ষত্র মণ্ডলীর সম্মুখে নিম্নে অবস্থান করে, চন্দ্রও তারামণ্ডলীর সাপেক্ষে বরুণ (বৃষ্টির দেবতা) এর সম্মুখে নিম্ন স্থান প্রাপ্ত করেন।" 
(কৃষ্ণ যজুর্বেদ, তৈত্তরীয় সংহিতাঃ ৭/৫/২৩)

এখানে বর্ণনা করা হচ্ছে যে, অগ্নি পৃথিবীর ওপর স্থিত হয়, বায়ু অন্তরীক্ষে ভ্রমণ করে, সূর্য অন্তরীক্ষের ওপর ভ্রমণ করে, চন্দ্র নক্ষত্র মণ্ডলের মধ্যে ভ্রমণ করে। 

সুতরাং, সূর্য চন্দ্রের অবস্থান বৈদিক যুগ থেকেই আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতেও নির্ধারিত ছিল। পুরাণে তা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। 

যাইহোক, পৃথিবীর আকাশে ভূতলের উপর সূর্য চন্দ্রের অবস্থান পরিষ্কারভাবে বোঝানোর জন্যে ভিডিওটি দেখুন, সব বুঝতে পারবেন।


সূর্য আর চন্দ্রের গমন পথের ব্যবধান থাকায় প্রতি অমাবস্যায়, পূর্ণিমায় গ্রহণ হয় না। গ্রহণের জন্য সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবীকে এক সরলরেখায় একই তলে আসতে হয়। কিন্তু প্রতি অমাবস্যায়, পূর্ণিমায় সূর্য চন্দ্র পৃথিবী একই তলে একই সরলরেখা বরাবর আসে না কারণ সূর্য পৃথিবীর কক্ষতল বরাবর ভ্রমণ করলেও চন্দ্র পৃথিবীর কক্ষতলের দূর দিয়ে ভ্রমণ করছে। 

বিস্তারিত জানতে প্রতি মাসে গ্রহণ হয় না কেন এ নিয়ে আমাদের ব্লগটি পড়ুন। 


এরপর দূরত্বের পরিমাপের ব্যাপারে আসি। এই ব্যাপারটা একটু দুর্বোধ্য বটে। কোন কোন বিষয় বিবেচনায় এনে এই পরিমাপ করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়, তাই ব্যাপারটা গবেষণা লব্ধ। অনার্যদের মতো হুটহাট করে অবৈজ্ঞানিক আর প্রক্ষিপ্ত ঘোষণা করার বিষয় নয়। 

সবশেষে বলতে চাই, পৃথিবীর থেকে চন্দ্র অপেক্ষা সূর্যের দূরত্বই অধিক। কিন্তু পৃথিবী আর সূর্যের কেন্দ্র এক তলে থাকায় পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্যের অবস্থান নিকটবর্তী তলে তাই সূর্যের যাত্রাপথ পৃথিবীর কক্ষতল বরাবর তৈরি হয়। কিন্তু চন্দ্র পৃথিবীর কক্ষতলের দূরে থাকে তাই তার অবস্থান সূর্যের চেয়েও দূরবর্তী তলে। অন্যদিকে চন্দ্র পৃথিবীর কক্ষতল থেক দূর দিয়ে ভ্রমণ করায় তার ভ্রমণ পথ রবি মার্গের চেয়ে অধিক উচ্চ, অধিক বিস্তৃত হয়। পুরো হিসাবটা Celestial sphere এর সাপেক্ষে করা হয়েছে।Celestial sphere  কী এ নিয়ে পরে বিশদে লেখা আসবে।

বিঃদ্রঃ যারা অজ্ঞতাবশত অবিবেচকের ন্যায় ভাগবত পুরাণের জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে কদাচার করে তারা বাচ্চাদের সামনে এস্ট্রো-অলিম্পিয়াডের গপ্প না করে সরাসরি যেন আমাদের সাথে আলোচনায় আসে। 

© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি 
🖋️ শ্রী গৌতম দন্ডপাট
শ্রী অনিক কুমার সাহা 
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ