গ্রহণ কি ও কেন হয়? কেন সকল অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় গ্রহণ !


আজ ২৫ অক্টোবর ২০২২, অমাবস্যা তিথি এবং খণ্ড গ্রাস সূর্য গ্রহণ। আজকে গ্রহণ বিষয়ক একটু ভিন্ন আলোচনা করবো আমরা যা সনাতন শাস্ত্রেই বিস্তারিত পাওয়া যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে প্রাচীন কোন শাস্ত্র বা গ্রন্থে যদি পূর্ণাঙ্গ কোন ধারণা পেতে চান তবে পুরাণাদি শাস্ত্রের কোন বিকল্প নেই। যদিও আজকাল কিছু অপরিপক্ক স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞ কিন্তু আদতে অনার্য পুরাণাদি শাস্ত্র হতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অবান্তর ভুল বের করার প্রয়াস করছে সেটা কেবলই বালখিল্যতা কারণ বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই পুরাণের জ্যোতির্বিজ্ঞানকে প্রামাণিক মেনেছে, সেটা নিয়ে আলাদা পর্ব হবে। 

আজকে আমাদের আলোচনা দুইটি পরিপূরক বিষয়ের উপর। 
১/ কেন কেবল অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতেই গ্রহণ লাগে?
২/ কেন সকল অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতেই গ্রহণ লাগে না?

ধারাবাহিক আলোচনা করছি দু'টো পরিপূরক বিষয়ের উপর।

শুধুমাত্র অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতেই গ্রহণ লাগে কারণ গ্রহণের প্রথম শর্ত হলো সূর্য গ্রহণ সংগঠিত করার জন্য পৃথিবীতে আগত সৌরকিরণ আটকে ছায়া সৃষ্টির জন্য চন্দ্রকে সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে যেতে হবে। চাঁদ অমাবস্যা তিথিতে সূর্য আর পৃথিবীর মাঝখানে যায়। অন্যদিকে, চন্দ্র গ্রহণের জন্য চন্দ্রে আগত সৌরকিরণকে পৃথিবীর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ছায়ার সৃষ্টি হতে হবে। তার জন্য পৃথিবীকে সূর্য আর চন্দ্রের মাঝখানে অবস্থিত হওয়া লাগবে। পূর্ণিমার সময় পৃথিবী সূর্য আর চন্দ্রের মাঝখানে অবস্থান করে। 

তাহলে সিদ্ধান্ত হলো, অমবস্যায় সূর্য গ্রহণ এবং পূর্ণিমায় চন্দ্রগ্রহণ।

কিন্তু প্রশ্ন হলো অমাবস্যা মাত্রই যদি চন্দ্র সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে আসে অন্যদিকে পূর্ণিমা মাত্রই যদি পৃথিবী সূর্য ও চন্দ্রের মাঝখানে অবস্থান করে তাহলে সব অমাবস্যা এবং পূর্ণিমায় গ্রহণ হয় না কেন? 

বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে এর উত্তর হয়তো আমরা কমবেশি জানি যে সব অমাবস্যায় পূর্ণিমায় সূর্য চন্দ্র পৃথিবী এক তলে অবস্থান করে না। তাই প্রত্যেক অমাবস্যা পূর্ণিমায় সূর্য চন্দ্র পৃথিবী জ্যোতিশ্চক্রের অনুবর্তী হলেও প্রত্যেক অমাবস্যা পূর্ণিমায় গ্রহণ হয় না। কিন্তু দেখা যাক, আমাদের ঋষিগণ এই ব্যাপারে অবগত ছিলেন কিনা, এর উত্তর আমরা খুঁজে পাবো  লিঙ্গ পুরাণের পূর্বভাগের সপ্তপঞ্চদশ অধ্যায়ে, প্রথমে কিছু চমৎকার তথ্য ওখান থেকে পড়ে নেওয়া যাক-

"চন্দ্র, পর্ব উত্তরায়ণ মার্গস্থিত হলে উচ্চতাবশত শীঘ্র দৃষ্ট হন, তাঁহার গতি মালা অপরিস্ফুট থাকে এবং দক্ষিণায়ণ মার্গস্থিত হলে নীচ পৃথিবীকে আশ্রয় করেন। যেসময় অমাবস্যা পূর্ণিমায় সূর্য ভূমিরেখা আবৃত হয় তখন যথা সময়ে অস্তমিত হয়, এইজন্যই নিশাকর অমাবস্যায় উত্তর মার্গে অবস্থান করেন, দক্ষিণ মার্গে সামান্য রুপে দৃষ্ট হন, বিশেষ রুপে নহে।"

এই শ্লোকগুলিতে চমৎকার বৈজ্ঞানিক তথ্য রয়েছে। আমরা জানি চাঁদ হলো পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ, সে অনবরত পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে, কিন্তু তার প্রদক্ষিণ পথটা কেমন? তার প্রদক্ষিণ পথটি পৃথিবীর আর সূর্যের সংযোগ তল বা পৃথিবীর কক্ষতলের সাথে ৫ ডিগ্রি decline অবস্থায় রয়েছে, এইজন্যই চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার সময় কখনও পৃথিবীর উপরের দিকে উঠে যায় আবার কখনও পৃথিবীর নীচের দিকে নেমে আসে। 

যে পথ চাঁদকে পৃথিবীর উপরের দিকে নিয়ে যায় তাকে পুরাণে চাঁদের উত্তরায়ণ মার্গ আর যে পথ চাঁদকে পৃথিবীর নীচের দিকে নিয়ে যায় তাকে দক্ষিণায়ণ মার্গ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পৃথিবীর কক্ষতলের সাপেক্ষে চাঁদের এই কক্ষপথ প্রায় অমাবস্যা পূর্ণিমায় চাঁদকে সূর্য পৃথিবীর সাথে একতলে অবস্থান করতে দেয় না। দেখা গেল, চাঁদ অমাবস্যার সময় যখন সূর্য পৃথিবীর মাঝখানে অবস্থান করছে তখন সে সূর্য-পৃথিবী রেখা উপরের দিকে অবস্থান করছে। এই অবস্থায় কোন ভাবেই চাঁদের পক্ষে সূর্যকে আড়াল করা সম্ভব হয় না, তাই সব অমাবস্যায় সূর্য গ্রহণ হয় না। আবার পূর্ণিমার সময়ও চাঁদ যখন পৃথিবীকে সূর্যের সামনে রেখে পৃথিবীর বিপরীত দিকে যায় তখনও চাঁদ সূর্য পৃথিবীর সংযোজক রেখা থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে, তাই সব পূর্ণিমায় সে পৃথিবীর ছায়ায় ঢাকা পড়ে না। ফলে সব পূর্ণিমায় চন্দ্র গ্রহণ হয় না। 

এরপর, লিঙ্গ পুরাণের আর একটি শ্লোকে নজর দেওয়া যাক, 

"চন্দ্র সূর্য বিষুবে সমানকালে উদিত ও সমানকালে অস্তমিত হয়।"

অমাবস্যার সময় পৃথিবীর সাপেক্ষে চন্দ্র-সূর্য একই রাশি, একই নক্ষত্রে অবস্থান করে, এটাই হলো চন্দ্র সূর্যের বিষুবকাল। 

এখন কেউ হয়তো ভাববেন, অমাবস্যায়ও চাঁদ ওঠে? হ্যাঁ অমাবস্যায় ও চাঁদ ওঠে, অমাবস্যায় যখনই সূর্য ওঠে তখনই চাঁদও ওঠে, যখনই সূর্য ডোবে তখন চাঁদও ডোবে। তাহলে আমরা অমাবস্যায় চাঁদকে দেখতে পাইনা কেন? 

এর উত্তর হলো, প্রথমত সূর্যের প্রখর আলো দিনের বেলায় অন্যকোন জ্যোতিষ্ককে দেখার উপযুক্ত নয়, দ্বিতীয়ত পৃথিবী থেকে চাঁদের যেই পিঠটা আমরা দেখতে পাই (পৃথিবীর থেকে চাঁদের কেবল একটি পিঠই দেখতে পাওয়া যায়।) সেই পিঠটায় তখন রাত্রি বিরাজ করে, লিঙ্গ পূরাণের কথামতো চাঁদ তখন "তমোরশিতে আবৃত থাকেন" তাই আমরা অম্যাবসার চাঁদকে দেখতে পাই না। 

যাইহোক সব অমাবস্যায় সূর্য-চন্দ্র একই সাথে একই সময়ে পৃথিবীর আকাশে চলাচল করলেও তারা পরস্পর পরস্পরের সাপেক্ষে উত্তর-দক্ষিণে অবস্থান করে বলে সব অমাবস্যায় সূর্য গ্রহণ হয় না। লিঙ্গ পুরাণে তাই বলা হয়েছে, "রশ্মিমান সূর্য দক্ষিণায়ণ মার্গস্থিত হয়ে চলে বলে গ্রহণের অধোদেশ প্রসৃত হয়" পৃথিবীর আকাশে গ্রহণের দুটি তলের মধ্যে একটি চাঁদের সাথে আর একটি সূর্যের সাথে সংযুক্ত। এই দুটি মিলিত না হলে গ্রহণ হয় না। 


তাহলে গ্রহণ কখন হয়? 

পৃথিবী-সূর্যের যে তল রয়েছে যা পৃথিবীর কক্ষতল নামে পরিচিত সেই কক্ষতলের সাথে চাঁদের কক্ষপথ দুটো বিন্দুতে ছেদ করেছে, যা লুনার নোড (পুরাণের ভাষায় যা রাহু, কেতু) নামে পরিচিত। ওই দুটো বিন্দুও চাঁদের সাথে পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে। দেখা যায় ওই দুটো বিন্দু ১৭৩ দিন অন্তর-অন্তর সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে আসে, চাঁদ যদি ওই সময় ওই বিন্দুর মধ্যে কোন একটাতে চলে আসে তখনই সূর্য-পৃথিবী-চাঁদ এর অবস্থান এক তলে এক সরলরেখায় হয়ে যায়, তখনই গ্রহণ লাগে। যা পূরাণে রাহুর গ্রাস নামে পরিচিত। 
আপনরা ছবিটি দেখুন, চাঁদের কক্ষপথের অর্ধেক অংশ পৃথিবীর কক্ষপথের উপরে আর অর্ধেক অংশ পৃথিবীর পরিক্রমণ পথের নীচের দিকে অবস্থিত। চিত্রটিতে বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি চাঁদ তার পরিক্রমণ পথের উপর দিকে অবস্থিত। এরপর সরে সরে নীচের অংশটার দিকে নামবে। যাত্রা পথে সে ১ ও ২ নামক দুটো বিন্দুকে পাবে। ১ ও ২ হলো পৃথিবীর কক্ষতল ও চাঁদের কক্ষপথের ছেদ বিন্দু। এখানে চাঁদ  অবস্থান করলে পৃথিবীর থেকে সূর্য ও চাঁদের তল একই হয়। যদি কোন অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় চাঁদ এই দুটি বিন্দুর কোন একটিতে অবস্থিত হয় তখন গ্রহণ লাগে। যেহেতু পৃথিবী, চাঁদ ঘুরছে সেহেতু ওই বিন্দু দুটোও ওদের সাথে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে ওই দুই বিন্দু, সূর্য-চাঁদ ও পৃথিবী সবাই এক সরলরেখায় যখন আসে তখনই গ্রহণ হয়।

বিঃদ্রঃ রাহু ও কেতু নিয়ে পুরাণের জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে আমরা আলাদা ব্লগ বানাবো। 

উপরের আলোচিত বিষয়টি ভালোভাবে বোঝার জন্য আমরা দুটো ভিডিও দিলাম। 

দেখুন চাঁদ কীভাবে পৃথিবী প্রদক্ষিণের সময় পৃথিবীর উপর নীচ হয়---




দেখুন কেন সব অমাবস্যা পূর্ণিমায় গ্রহণ হয় না----


© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি 
🖋️ শ্রী গৌতম দন্ডপাট
শ্রী অনিক কুমার সাহা 
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ