মহাবলী হনুমান কি “গদা” ব্যাবহার করতেন?

 


রামায়ন নিয়ে সংস্কারহীন, স্বাধ্যায়হীন, আচারহীন অশাস্ত্রীয় অনার্যদের অপপ্রচার যেন থামছেই না। তবে এসপিএস শাস্ত্র গবেষণা কমিটিও সদা তৎপর এসব অপপ্রচারের প্রত্যুত্তর দিতে। এরই ধারাবাহিকতায় আজকে আমাদের বিশেষ পর্ব। 

মহাবলী হনুমান কি “গদা” ব্যাবহার করতেন? 

পূর্বেই আমরা রামায়ণ সম্পর্কিত একটি ব্লগে মহাবলী হনুমানের গদার বিষয়টি সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছিলাম। আজকের এই ব্লগটা সম্পূর্ণ এই বিষয়ের ওপরেই আধারিত, যেখানে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। কিন্তু একবার লেখার পরেও আবার আলাদা করে এই প্রসঙ্গের ওপর ডেডিকেটেড ব্লগ লেখা হচ্ছে কেন?

পূর্বের ব্লগটা প্রকাশের পর কিছু ভ্রান্ত ধারণাধারী ব্যাক্তি পুনরায় হনুমানজীর গদা প্রসঙ্গে নিজের ভ্রান্ত যুক্তি দাঁড় করাতে চায়। আজকের ব্লগটা তারই উত্তর হিসেবে লেখা হল। ব্লগটি লেখার উদ্দেশ্য কাউকে বা কোনও গোষ্ঠী কে আক্রমণ করা নয়, বরং সনাতন ধর্মের গ্রন্থ ও ইতিহাস বিশ্লেষণ-পূর্বক সত্য ঘটনাটা আলোচনা করা। উত্তরের সুবিধার্থে অপপ্রচারের সকল স্ক্রিনশট এই ব্লগে যুক্ত করা হবে। এটকে ব্যাক্তিগত আক্রমণ হিসেবে না দেখে গঠনমূলক সমালোচনা হিসেবে গণ্য করাই কাম্য।

আমাদের পূর্বের ব্লগে গদা প্রসঙ্গে প্রথম পয়েন্ট ছিল, অগ্যস্ত মুনি রচিত “পঞ্চমুখী হনুমান কবচ” এ হনুমানজীর অস্ত্র হিসেবে গদার কথা উল্লেখ করেছেন।

এর বিপরীতে একজন স্বঘোষিত শাস্ত্র গবেষক দাবী তুলেন।

কোনটা প্রামাণিক গ্রন্থ, কোনটা নয়, এই বিচার কি তিনি করবেন? তিনি নিজেই বলে দিলেন এটা প্রামাণিক গ্রন্থ নয়, যেন তিনি কি বিশাল গবেষক! এনার এই বক্তব্যের সাপেক্ষে কোনও প্রমাণ আছে তার কাছে? যদি থাকে তবে তিনি যেন উপস্থাপন করেন। আমরা চ্যালেন্জ জানালাম তাকে। তার সন্দেহ এই গ্রন্থের (“পঞ্চমুখী হনুমান কবচ”) রচনা ১ হাজার বছর হয়েছে কিনা! এই সন্দেহের পিছনে যুক্তি কি? যদি পিডিএফ সাপ্লাইয়ের পাশাপাশি একটু পড়াশোনা করতেন তবে মনে এমন সন্দেহের অবতারণা হত না বরং তথ্যভিত্তিক জবাব দিতেন।  তাছাড়া শুধুমাত্র আপনার সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে কি আমরা মেনে নেবো কোনটা প্রামাণিক, কোনটা নয়? ব্যাপারটা কি এমন হয়ে গেল না যে, আমার ভালো লাগছে না তাই মানব না। আমার স্বীকার করতে কষ্ট হচ্ছে, তাই “প্রামাণিক নয়” বলে দিবো! এরকম সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার কি কি যোগ্যতা আছে, সেই বিষয়ে দয়া করে জানাবেন? 

তবে তার একটি সন্দেহ আমরা দূর করে দিচ্ছি। এই গ্রন্থের মান্যতার পিছে কিছু বিষয় জানাতে চাই। ভারতে যে পঞ্চমুখী হনুমানজীর কত মন্দির আছে, সে কথা কারো অজানা নয়। এমনকি পাকিস্তানের করাচিতেও পঞ্চমুখী হনুমানজীর মন্দির পাওয়া যায়, যা ১৫০০ বছর পুরানো। নিচে তার ছবি ও ডকুমেন্টারি ভিডিও লিংক দেওয়া হল। 


ডকুমেন্টারি ভিডিও লিংকঃ https://www.youtube.com/watch?v=n7OtJpeeKdM

সুতরাং, যেখানে গ্রন্থে বর্ণিত বিবরণ স্বরূপ পঞ্চমুখী হনুমানজীর মন্দিরই প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৫০০ বছর আগে, সেখানে আপনার এই গ্রন্থের রচনা ১০০০ বছর হয়েছে কিনা সন্দেহ! এই মনগড়া বক্তব্যের কোনও ভিত্তি থাকল কিনা  এবং মিথ্যাচারটা কে করল, সেই বিষয়ে একটু ভেবে দেখবেন। আপাতত এই গ্রন্থ ও পঞ্চমুখী হনুমানজীকে অমান্য করার এবং আপনার সন্দেহজনিত সেলফ-মেইড দাবী মেনে নেওয়ার কোনও কারণ দেখছি না।

রামায়ণে মূলত শ্রীরামচন্দ্র ও মাতা সীতার কাহিনীর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে বেশী। তাই হনুমানজীকে নিয়ে বিস্তারিত সেখানে পাওয়া যায়না। হনুমানজীর জীবন কাহিনী বিস্তারে জানা যায় পরাশর সংহিতা গ্রন্থে। (এটি “পরাশর স্মৃতি” নয়। এটি ভিন্ন গ্রন্থ, যেখানে পরাশর মুনি ও তাঁর শিষ্য মৈত্রেয় মুনির কথোপকথনের মাধ্যমে হনুমানজী সম্পর্কে জানা যায়। একে “হনুমানচরিতম”ও বলা হয়। )

এই গ্রন্থেও উল্লেখ পাওয়া যায় পঞ্চমুখী হনুমানজীর কথা। 

শুধু তাই নয়। হনুমানজীর আরো অনেক রূপের কথা বিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে এই গ্রন্থে। যেমন,

বিংশতিভুজা হনুমান ; যেই রুপে উনার  বিশটি হাত আছে, সাথে বিশটি ভিন্ন অস্ত্র। এই রুপে তিনি শ্রী ব্রহ্মা ও সপ্তর্ষিদের সম্মুখে আবির্ভূত হয়েছিলেন। একে হনুমানজীর বিশ্বরূপ ও বলা হয়।

চতুর্ভুজা হনুমান; হনুমানজীর চার হাতধারী রূপ, যিনি এই রুপে উনার ভক্ত বেদ পণ্ডিত কপিলার সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

দ্বিত্রিংশভুজা হনুমান; হনুমানজীর বিভিন্ন অস্ত্র সহ বত্রিশ হাতধারী রূপ, যিনি রাজা সোমদত্ত দ্বারা পূজিত হতেন।

এছাড়া অষ্টাদশভুজা হনুমান, ষণ্মুখা হনুমান, নবখন্ড হনুমান এবং তান্ত্রিক ও শাক্ত মতে আরো অনেক রূপের কথা জানা যায়।

অথর্ব রহস্য গ্রন্থে পাওয়া যায়,

সপ্তমুখী হনুমান; যা হনুমানজীর সাত মুখ ও বিভিন্ন অস্ত্র সহ চৌদ্দ হাতধারী রূপ। এই রুপেও তিনি সপ্তর্ষিদের সামনে এসেছিলেন।

অগ্যস্ত মুনি রচিত “একাদশ্ মুখী হনুমান কবচ”এ হনুমানজীর অস্ত্র ধারী বাইশ হাত সহ একাদশ মুখ ধারী রুপের কথা জানা যায়। এই কবচ অগ্যস্ত মুনি তাঁর স্ত্রী লোপামুদ্রাকে শোনান, যা এর পূর্বে সর্বপ্রথম শ্রী ব্রহ্মা চার কুমারের একজন সনন্দনকে বলেছিলেন।

কয়টা গ্রন্থকে অস্বীকার করবেন আপনি? কিসের ভিত্তিতে করবেন? কোনও গ্রন্থের ব্যাপারে আমরা পরিস্কার ভাবে না জানলে সেটা আমাদের অজ্ঞানতা, তাতে গ্রন্থ কখনো মিথ্যা হয়ে যায়না।

তাও যদি আপনি দাবী করেন, এগুলো সব প্রক্ষিপ্ত, সব মন্দির ভুয়া, কিছুই প্রামাণিক নয়, সব সত্য শুধু আপনিই জানেন, বাকিরা সব ভুল- তাহলে আপনার বক্তব্যের সাপেক্ষে দয়া করে প্রমাণ দেখাবেন, কারণ কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা সেটা আমরাও জানতে চাই। অন্যথায় দয়া করে না জেনে কিছু অপপ্রচার করবেন না। প্রয়োজনে আমাদের সাথে লাইভে যুক্ত হোন, নিজের একনায়কতন্ত্রে পরিচালিত মেসেন্জার গ্রুপে লুকিয়ে লুকিয়ে মিথ্যাচার করবেন না। 

আমাদের পুর্বের ব্লগে সুন্দর কাণ্ড থেকে দুইটা শ্লোক ছিল। 

এর বিপরীতে আপনার দাবী,

৪০ নং শ্লোকে পরিঘ তুল্য লৌহ দণ্ডের কথা থেকে আপনি প্রমাণ করে দিলেন এটা গদা না। কিন্তু সেক্ষেত্রে তো এটাও বলা যায়, ৩৯নং শ্লোকে স্পষ্ট করে বলাই আছে সেটা লৌহ গদা। সেটা না মেনে আপনার দাবী কেন মানবো?

এবার তর্ক ছেড়ে ফ্যাক্ট চেক করা যাক। প্রথমে দেখি আসলে ”পরিঘ” বলতে কি বুঝায়। এক্ষেত্রে আমরা learnsanskrit ওয়েবসাইটের সাহায্য নিচ্ছি। এখানে যেহেতু বেদ সংহিতার অর্থ নির্ণয় করছি না তাই নিরুক্তে যাচ্ছি না। 

এখন বলতে পারেন, iron mace কি জিনিস? 

অর্থাৎ, লৌহ নির্মিত গদাকেই “পরিঘ” বলে। তবে ৪০ নং শ্লোকের জন্য একটা কনফিউশন তৈরি হয় যে, সেটা পরিঘ ছিল, নাকি পরিঘ তুল্য কোনও দন্ড ছিল। সেক্ষেত্রে আমরা ক্রিটিক্যাল এডিশনের সাহায্য নেবো। 

Critical Edition, Chapter- 5 (40)

উল্লেখিত শ্লোকের অনুবাদে আছে, He seized a terrible iron club. এখন iron club কি জিনিস?

মূলত Club এবং Mace উভয়েই গদার ইংরেজি প্রতিশব্দ।

 

সুতরাং, ক্রিটিক্যাল এডিশন অনুসারেও এখানে যে গদার কথাই বলা হচ্ছে, সেই বিষয়ে আর সন্দেহ থাকবে বলে মনে হয় না।

এবার বশিষ্ঠের “ধনুর্বেদ সংহিতা” থেকে দেখা যাক, 

এখানেও বলছে, পরিঘ একপ্রকার গদা (Club) যার সাথে লৌহ Stud বা Nail-head উপস্থিত।

ফাইনালি, Iron Club সহ বিভিন্ন প্রকার Club এর একটা ছবি দিয়ে এই আলোচনা শেষ করছি।  


এবার আপনার পরবর্তী মন্তব্য,

আপনার দাবী, এই দুই শ্লোকের ওপর ভিত্তি করে বলা যায়না যে, হনুমানজীর অস্ত্র গদা ছিল। আমরা এই দুই শ্লোকের ওপর ভিত্তি করে সেটা বলিনি। আমরা পূর্বে বর্ণিত “পঞ্চমুখী হনুমান কবচ” এর ভিত্তিতে বলেছি। আমরা মনে করি যেকোনো বিষয়ে মন্তব্য করার আগে সকলেরই উচিত জিনিসটা ভালো মত পড়া বা জানা।

আমরা ৩৯,৪০ শ্লোক দ্বারা দেখিয়েছি হনুমানজী যে কখনই গদা ব্যবহার করতেন না, তা সঠিক নয়। তিনি সুযোগ বুঝে গদা ব্যবহার করতেন। আর সেটা শুধু এই ২ টা শ্লোকে নয়, আরও অনেকবারই উনার গদা ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। নিচের ছবি গুলো দেখুন। বাল্মীকি রামায়ণের শ্লোক ও তার সাথে সাথে Critical Edition এর অনুবাদ, উভয়ের ছবিই দেখালাম। 







 

সুতরাং, মহাবলী হনুমান যে অনেকবারই গদা ব্যবহার করেছেন, সেটা নিয়ে আর কোনও সন্দেহের অবকাশ আছে বলে মনে করিনা। তবে প্রতিবারই তা শত্রুপক্ষের থেকে কেড়ে নিয়ে, নিজের কৌমুদকী গদা নয়। তবে তখন বানরসেনারা যে গদা ব্যবহার করেতেন তা স্পষ্ট এবং মহাবলী হনুমানের প্রিয় অস্ত্রও গদা। 

আপনার শেষ মন্তব্যে আসি। আপনার প্রশ্ন, রামায়ণে গাছ- পাথরের উল্লেখ থাকলে সেগুলোও কেন হনুমানজীর নির্দিষ্ট অস্ত্র নয়? আপনি আমাদের ব্লগ পুরোটা না পড়ে শুধু তিনটা শ্লোকই পড়লেন কিনা, সেই বিষয়ে আমরা সন্দিহান! কারণ, আমরা তো লিখেই দিয়েছিলাম, রামায়ণ অনুসারে হনুমানজী লঙ্কার যুদ্ধে কোনও নির্দিষ্ট অস্ত্র ব্যবহার করেননি। যখন যা পেতেন, তা দিয়েই যুদ্ধ করতেন। 

তাহলে আবার রামায়ণের মধ্যে উনার নির্দিষ্ট অস্ত্রের কথা কোত্থেকে আনলেন আপেনি?

সবশেষে, আজকের আলোচনা থেকে নিম্নোক্ত পয়েন্ট গুলো আমরা জানতে পারি,

১/ হনুমানজীর গদা ছিলো। (কেউ না মানলে সেটা তার নিজস্ব ভাবনা, তাতে সত্য পরিবর্তন হবেনা)

২/ বাল্মীকি রামায়ণ অনুসারে লঙ্কার যুদ্ধে হনুমানজীকে গদা ব্যবহার করতে দেখা যায়না।

৩/ বাল্মীকি রামায়ণ অনুসারে সুন্দর কাণ্ডে গদা ব্যবহার করতে দেখা যায়, তবে তা উনার নিজস্ব না। (অন্য কারো থেকে প্রয়োজন বুঝে নিয়ে ব্যবহার করতেন।)

৪/ বাল্মীকি রামায়ণ অনুসারে সুন্দর কাণ্ডে শুধু একবার না, কয়েকবার গদা (পরিঘ) ব্যবহার করেছেন। পরিঘ এর অনুবাদ বাংলা গ্রন্থে আছে লৌহগদা এবং সংস্কৃত ডিকশনারি, ধনুর্বেদ ও ক্রিটিক্যাল এডিশনে আছে Iron mace বা, Iron Club।

আর এগুলো আমাদের প্রদত্ত মনগড়া সিদ্ধান্ত না। উপরের সমস্ত প্রমাণ সাপেক্ষে আমরা এই সিদ্ধান্ত গুলোতে উপনীত হয়েছি। তারপরও যারা এই ব্লগ পড়ছেন, উনাদের আমি বলব, আমাদের প্রমাণ গুলো নিজেরা যাচাই করে দেখুন। নিজেরা গ্রন্থ পড়ে এরপর সিদ্ধান্ত নিন। বর্তমানে সোশাল মিডিয়ার দৌলতে অনেক ফেইক, অযোগ্য ব্যাক্তিও পণ্ডিত সেজে ভ্রান্ত ও মনগড়া জ্ঞান বিতরণ করে, নিজেদের স্বার্থ অথবা অজ্ঞানতা দ্বারা পরিচালিত হয়ে এই গ্রন্থ ভুল, ওই গ্রন্থ প্রক্ষিপ্ত, সেই গ্রন্থ প্রামাণিক না বলে বেড়ায়। তাদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে চাইলে নিজেদের শাস্ত্রচর্চা ছাড়া পথ নেই। 

ধন্যবাদ 🙏
© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি

সনাতন শাস্ত্র  দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর।।
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ