ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ এবং অবৈদিকদের মিথ্যাচার।।


ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ ও মহামতি শুকদেবের ব্রহ্মাণুভূতি নিয়ে অবৈদিকদের মিথ্যাচারের জবাব।

সম্প্রতি যব** সমাজের এজেন্ট যব**বীর নামে ও বেনামে বিভিন্নভাবে সনাতন শাস্ত্র ও দর্শন নিয়ে মিথ্যাচার করে যাচ্ছে নিজেদের অবৈদ শাস্ত্রব্যবসা টিকিয়ে রাখতে। এদেরই একটা তাকিয়া পেজ "দিনে একটি মন্ত্র" নামে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় মন্ত্র (বেদমন্ত্রকে আয়াতের মতো করেও উপস্থাপন করে), দর্শন ও ইতিহাস নিয়ে যথেচ্ছা কৌশলে মিথ্যাচার করছে। অথচ এসব গ্রুপের এডমিনদের শাস্ত্রজ্ঞান বিচার করলে তাদের যুক্তির ধরণ অবশ্যই জাকিরের লেভেল হতেও নিম্মতর হবে। তাদের অপপ্রচারের শিকার হয়েছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সে অনন্য বিশ্বরূপও।। যাইহোক সে অপপ্রচারের খণ্ডন ও এই অবৈদিক অর্বাচীনদের যথোপযুক্ত জায়গা এই লিখার মাধ্যমেই দেখিয়ে দেওয়া হবে।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের ঈশ্বরত্ব প্রমাণ করতে কুরুক্ষেত্রের মহাপ্রান্তরে মহাবীর অর্জুনকে তাঁর ঐশ্বরিক বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন যা নিঃসন্দেহে অনন্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, ইদানিংকালে কদার্যরূপী যবনেরা এই বিশ্বরূপ নিয়েও স্বভাবসুলভ মিথ্যাচারে রত হয়েছে! মহামতি শুকদেবের ব্রহ্মাণুভূতিকে (ব্রহ্মাণুভূতি সম্পর্কেও এই অবৈদিক শাস্ত্রজ্ঞানহীনদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই) বিশ্বরূপ দাবি করে এরা প্রমান করতে চায় যে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ কেবল এক যোগীর অণিমানি অষ্টসিদ্ধি (যদিও এরা মহাবলি মহাযোগী হনুমানের ক্ষেত্রে এই অষ্টসিদ্ধিকেই ভ্রান্ত বলে উপস্থাপন করে) দ্বারা কৃত যোগক্রিয়া মাত্র! 

কতো বড় আহাম্মাক হলে কেউ এহেন যুক্তি দাড় করাতে পারে! আসলে কেউ বড় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করলে যে তার বুদ্ধিশুদ্ধি হাটুর উপরে উঠে যাবে সেটা চিন্তা করে নেওয়াও উচিত হবে না। যাইহোক অবৈদিক ত্রৈতবাদীরা শুকদেবের এই অদ্বৈত উপলব্ধি (ব্রহ্মময় ব্রহ্মাণুভূতি) আর বিশ্বরূপের মাঝে পার্থক্য করতে না পারলে এহেন অপযুক্তির অবতারণাই স্বাভাবিক। এই অর্বাচীনগুলো হয়তো এটাও খেয়াল করে নি যে তারা শুকদেবের ব্রহ্মাণুভূতিকে বিশ্বরূপ দেখাতে গিয়ে পক্ষান্তরে অদ্বৈতকেই মাথা পেতে গ্রহণ করে নিয়েছে। 

এই অবৈদিক মিথ্যাচারীরা শাস্ত্রের আগে ও পরে না পড়ে কেবল মাঝের কিছু শ্লোক বা মন্ত্র তুলে ধরে সাধারণ হিন্দুদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে এবং এদের অন্ধ বা পেইড অনুসারীরা তাদের প্রবন্ধের সঠিক ভুল যাচাই না করেই নির্লজ্জের মতো ঐসব প্রচার করতে থাকে! অবশ্য যাচাই করবেই বা কি করে! এদের অনুসারীরা তো স্বাধ্যায়ের নামে ফটোশেসন, পিডিএফের দু’পাতা পড়া এবং যব*বীরের ভুলে ভরা ব্লগ ছাড়া আর কিছু পড়ে বলে মনে হয়না।

মিথ্যাচার খণ্ডনঃ

তাদের নির্লজ্জ মিথ্যাচারের পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট খণ্ডন এই প্রবন্ধে তুলে ধরা হলো। পাঠকদের প্রতিও অনুরোধ শাস্ত্রের তত্ত্ব ও তথ্য সম্পর্কে গভীর বিশ্লেষণ করতে চাইলে কদার্যদের কাট-পিস (শুরুতে ক'লাইন, শেষে ক'লাইন এবং মাঝখান থেকে অর্ধলাইন) মিথ্যাচার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আমাদের এই প্রবন্ধটি শুরু থেকে শেষ অব্দি মনোযোগ সহকারে পড়ার বিনীত অনুরোধ রইলো। 

প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক যে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ সম্পর্কে মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদভগবদগীতায় যা বলা আছে,,

অর্জুন উবাচঃ

"হে পরমেশ্বর, তুমি আপনার বিষয় যাহা বলিলে তাহা এইরূপই বটে; হে পুরুষোত্তম, আমি তোমার (সেই) ঐশ্বরিক রূপ দেখিতে ইচ্ছা করি। হে প্রভু, যদি তুমি মনে কর যে আমি সেই রূপ দর্শনের যোগ্য, তাহা হইলে হে যোগেশ্বর, আমাকে তোমার সেই অক্ষর আত্মরূপ প্রদর্শন করাও। ” 

ভগবান উবাচঃ

"হে ভারত (অর্জুন), এই আমার দেহে দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয় এবং ঊনপঞ্চাশৎ মরুদ্‌গণ দর্শন কর; পূর্বে যাহা কখনও দেখে নাই, তেমন বহুবিধ আশ্চর্য বস্তু দর্শন করো। হে নিদ্ৰাজয়ী অর্জুন, আমার এই দেহে একত্র অবস্থিত চরাচর সমগ্র জগৎ তুমি দর্শন কর এবং অপর যাহা কিছু তুমি দেখিতে ইচ্ছা কর তাহাও এখন দেখিয়া লও। (হে অর্জুন), তুমি তোমার এই চর্মচক্ষুদ্বারা আমার এই রূপ দর্শনে সমর্থ হইবে না। এজন্য তোমাকে দিব্যচক্ষু দিতেছি, তদ্দ্বারা আমার এই ঐশ্বরিক যোগসামর্থ্য দেখ।  সেই ঐশ্বরিক রূপে অসংখ্য মুখ, অসংখ্য নেত্র, অসংখ্য অদ্ভুত অদ্ভুত দর্শনীয় বস্তু, অসংখ্য দিব্য আভরণ এবং অসংখ্য উদ্যত দিব্যাঙ্গ সকল বিদ্যমান (ছিল)। সেই বিশ্বরূপ দিব্য মাল্য ও বস্ত্রে সুশোভিত, দিব্য গন্ধদ্রব্যে অনুলিপ্ত, সর্বাশ্চর্যময় দ্যুতিমান্, অনন্ত ও সর্বতোমুখ ( সর্বত্র মুখবিশিষ্ট ছিল)। আকাশে যদি যুগপৎ সহস্র সূর্যের প্রভা উত্থিত হয়, তাহা হইলে সেই সহস্র সূর্যের প্রভা মহাত্মা বিশ্বরূপের প্রভার তুল্য হইতে পারে।"

সেই বিশ্বরূপ দর্শন করিয়া ধনঞ্জয় বিস্ময়ে আপ্লুত হইলেন। তাঁহার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। তিনি অবনতমস্তকে সেই দেবদেবকে প্রণাম করিয়া করজোড়ে বলিতে লাগিলেন। 

অর্জুন উবাচঃ

"হে দেব, তোমার দেহে আমি সমস্ত দেবগণ, স্থাবর জঙ্গমাত্মক বিবিধ সৃষ্ট-পদার্থ, সৃষ্টিকর্তা কমলাসনস্থ ব্রহ্মা, নারদ-সনকাদি দিব্য ঋষিগণ এবং অনন্ত-তক্ষকাদি সর্পগণকে দেখিতেছি। অসংখ্য বাহু, উদর, বদন ও নেত্রবিশিষ্ট অনন্তরূপ তোমাকে সকল দিকেই আমি দেখিতেছি। কিন্তু হে বিশ্বেশ্বর, হে বিশ্বরূপ, আমি তোমার আদি, অন্ত, মধ্য কোথাও কিছু দেখিতেছি না। কিরীট, গদা ও চক্রধারী, সর্বত্র দীপ্তিশালী, তেজঃপুঞ্জস্বরূপ, প্রদীপ্ত অগ্নি ও সূর্যের ন্যায় প্রভাসম্পন্ন, দুর্নিরীক্ষ্য, অপরিমেয় তোমার অদ্ভুত মূর্তি সর্বদিকে সর্বস্থানে আমি দেখিতেছি।..... আমি দেখিতেছি, তোমার আদি নাই, মধ্য নাই, অন্ত নাই, তোমার ঐশ্বর্যের অবধি নাই; অসংখ্য তোমার বাহু, চন্দ্র-সূর্য তোমার নেত্রস্বরূপ, তোমার মুখমণ্ডলে প্রদীপ্ত হুতাশন জ্বলিতেছে; তুমি স্বীয় তেজে নিখিল বিশ্বকে সন্তাপিত করিছে। হে মহাত্মন্, একমাত্র তুমিই স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যস্থল এই অন্তরীক্ষ এবং দিক্‌সকলও ব্যাপিয়া রহিয়াছে। তোমার এই অদ্ভুত উগ্রমূর্তি দর্শন করিয়া ত্রিলোক ব্যথিত হইতেছে।..... 

হে মহাবাহো, বহু বহু মুখ, নেত্র, বাহু, ঊরু, পদ ও উদরবিশিষ্ট এবং বহু বৃহদাকার দস্তদ্বারা ভয়ঙ্করদর্শন তোমার এই সুবিশাল মূর্তি দেখিয়া লোকসকল ভীত হইয়াছে এবং আমিও ভীত হইয়াছি। হে দেব, পূর্বে যাহা কখনও দেখি নাই, সেই রূপ দেখিয়া আমার হর্ষ হইয়াছে বটে, কিন্তু ভয়ে মন ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে; অতএব, তোমার সেই ( চিরপরিচিত) পূর্ব রূপটি আমাকে দেখাও ; হে দেবেশ, হে জগন্নিবাস, আমার প্রতি প্রসন্ন হও। কিরীটধারী এবং গদা ও চক্রহস্ত তোমার সেই পূর্বরূপই আমি দেখিতে ইচ্ছা করি। হে সহস্ৰবাহো, হে বিশ্বমূর্তে, তুমি চতুর্ভুজ মূর্তি ধারণ কর।”

সঞ্জয় উবাচঃ

"বাসুদেব অর্জুনকে এই বলিয়া পুনরায় সেই স্বীয় মূর্তি দেখাইলেন মহাত্মা পুনরায় প্রসন্ন মূর্তি ধারণ করিয়া ভীত অর্জুনকে আশ্বস্ত করিলেন। শ্রীভগবান্ বলিলেন- তুমি আমার যে রূপ দেখিলে, উহার দর্শন লাভ একান্ত কঠিন; দেবগণ ও সর্বদা এই রূপের দর্শনাকাঙ্ক্ষী।  আমাকে যে রূপে দেখিলে এই রূপ বেদাধ্যয়ন, উপস্থা, দান, যজ্ঞ, কোন কিছু দ্বারাই দর্শন করা যায় না।"

(রেফারেন্সঃ গীতা - ১১/৩-৫৩,, অনুবাদকঃ জগদীশ ঘোষ)

আশা করি পাঠক বুঝতে পেরেছেন যে বিশ্বরূপধারণ বিষয়টা ঠিক কি। বিশ্বরূপধারণকালে শ্রীকৃষ্ণের দেহে অর্জুন সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং বেদোক্ত ৩৩ কোটি দেবতাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন! এবং অর্জুন সাধারণ চর্মচক্ষু দ্বারা এইরূপ দেখতে পারবে না বিধায় তাঁকে দিব্যচক্ষুও দেওয়া হয়েছিলো! তা সত্ত্বেও অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের ধারণ করা এই অনন্য বিশ্বরূপের আদি-মধ্য-অন্ত কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলেন না! শেষে এইরূপ দর্শনে ভীত হয়ে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে পুনরায় তাঁর চতুর্ভুজরূপ ধারণে অনুরোধ করেন। শ্রীকৃষ্ণও তাঁকে বলেন যে তাঁর পূর্বে এইরূপ আর কেউ দেখেননি এবং বেদ-অধ্যয়ণাদি দ্বারাও কেউ এইরূপ দর্শন করতে সক্ষম নয়! এটাই হচ্ছে বিশ্বরূপ।।

এবার দেখা যাক মহাভারতে শুকদেবের অদ্বৈতউপলদ্ধি (যেটাকে তারা বিশ্বরূপ দাবি করছে) নিয়ে কি বলা হয়েছে।। 

ভীষ্ম বলিলেন—

'ভরতনন্দন। বেদব্যাসের পুত্র শুকদেব, কৈলাসপর্ব্বতের শৃঙ্গে আরোহণ করিয়া, পবিত্র, নির্জ্জন ও সমতলভূমিতে উপবেশন করিলেন।  যমনিয়মাদি যোগাঙ্গসমূহের পৌর্বাপর্য্যাভিজ্ঞ শুকদেব, যোগশাস্ত্রের বিধি অনুসারে ক্রমশ: চরণপ্রভৃতি অঙ্গে মন ধারণ করিলেন। তাহার পর সূর্য গগনমণ্ডলের অনেক অংশে উত্থিত হইলে, জ্ঞানী গুকদেব পূর্বমুখী হইয়া, পদ্মাসনের উপরে হস্তযুগল বিন্যস্ত করিয়া, অধ্যাপকের নিকটে শিষ্যের  ন্যায় উপবেশন করিলেন৷ জ্ঞানী শুকদেব যে স্থানে বসিবার উপক্রম করিলেন; সে স্থানে পক্ষিসমূহ ছিল না, বা কোন শব্দ কিংবা কোন অতিসৌন্দর্য দর্শনও হইতেছিল না। তখন শুকদেব সমস্ত সংসর্গবিবর্জিত পরমাত্মাকে দর্শন করিলেন এবং তিনি সেই পরব্রহ্ম দর্শন করিয়া আনন্দে হাস্য করিলেন। শুকদেব মোক্ষপথ লাভ করিবার জন্য পুনরায় যোগাবলম্বন করিয়া, যৌগিক উপায়ে আকাশগামী হইয়া, আকাশ অতিক্রম করিলেন। তাহার পর দেবর্ষি নারদের আশ্রমে উপস্থিত হইয়া তাহাকে প্রদক্ষিণ করিয়া তাঁহার নিকটে নিজের যোগের বৃত্তান্ত জানাইলেন। 

শুকদেব বলিলেন— 'মহাতেজা তপোধন। আপনার মঙ্গল হউক, আমি মুক্তির পথ দেখিয়াছি এবং যোগাভ্যাসে প্রবৃত্ত হইয়াছি। সুতরাং আপনার অনুগ্রহে আমি অভীষ্ট গতিলাভ করিতে পারিব।' 

ভীষ্ম বলিলেন—'নারদ অনুমতি করিলে দ্বৈপায়নপুত্র শুক, নারদকে অভিবাদন করিয়া পুনরায় যোগাবলম্বনপূর্বক আকাশে উঠিলেন। তখন তিনি কৈলাসপৰ্ব্বতের উপর হইতে লাফ দিয়া আকাশে উঠিলেন এবং মুক্তিবিষয়ে নিশ্চয়কারী ও সুন্দরমূর্তি শুক বায়ুর ন্যায় হইয়া, আকাশে বিচরণ করিতে লাগিলেন। তৎকালে সকলপ্রাণী, গরুড়ের ন্যায় দীপ্তিশালী এবং মন ও বায়ুর ন্যায় বেগবান্ ব্ৰাহ্মণশ্রেষ্ঠ সেই গুকদেবকে উদয়মান অবস্থায় দর্শন করিল॥ তাহার পর অগ্নি ও সূর্য্যের ন্যায় তেজস্বী শুকদেব, যোগাভাব প্রকাশের উদ্যমে সমস্ত ত্রিভুবন বিচরণ করিবার ইচ্ছায় দীর্ঘ আকাশপথ অবলম্বন করিলেন। তিনি পরব্রহ্মে একাগ্রচিত্ত হইয়া, অনাকুলভাবে ও অকুতোভয়ে আকাশমার্গে গমন করিতেছিলেন, সেই অবস্থায় স্থাবর ও জঙ্গম সমস্ত প্রাণী তাহাকে দর্শন করিতে লাগিল। তৎকালে দেবতারা শক্তি অনুসারে যথানিয়মে তাঁহার পূজা করিতে লাগিলেন এবং তাহার উপরে স্বর্গীয় পুষ্পবর্ষণ করিতে থাকিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া সমস্ত গন্ধৰ্ব্ব ও অপ্সরা বিস্মিত হইল এবং সিদ্ধ ঋষিগণও অত্যন্ত বিস্ময়াপন্ন হইলেন। তপঃসিদ্ধ এই কোন্ ব্যক্তি আকাশে গমন করিতেছেন, ইহার দেহের নীচের ভাগ নিম্নদিকে ও মুখমণ্ডল উপরের দিকে রহিয়াছে এবং নয়নের তেজে ইনি রক্তবর্ণ হইয়া গিয়াছেন। তদনন্তর পরমধর্ম্মাত্মা ও ত্রিভুবনবিখ্যাত শুকদেব, পূর্বমুখ ও বাগযত হইয়া সূর্যের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া, গমনের শব্দে সকলদিকের সমস্ত আকাশই যেন পূর্ণ করিতে থাকিয়া, গমন করিতে থাকিলেন। রাজা! তিনি সহসা আসিতেছেন দেখিয়া, সমস্ত অপ্সরাই ব্যস্তচিত্ত ও অতন্ত বিস্মিত হইল। তখন পঞ্চচূড়া প্রভৃতি অপ্সরারা অত্যন্ত উৎফুল্লনয়ন হইয়া, এইরূপ আলোচনা করিতে লাগিল যে, ইনি নিশ্চয়ই কোন দেবতা হইবেন। যেহেতু ইনি উত্তম গতি অবলম্বন করিয়া, মুক্ত পুরুষের ন্যায় নিস্পৃহ হইয়া এইদিকে আসিতেছেন। তাহার পর, উর্বশী ও পূর্ব্বচিত্তি সর্বদা যে পর্বতে অবস্থান করে, শুকদেব সেই মলয়পাতের দিকে গমন করিতে লাগিলেন৷ তৎকালে উর্বশী ও পূর্বচিত্তি সেই শুকদেবের বিষয়ে অত্যন্ত বিস্ময়াপন্ন হইল এবং তাহারা বলিতে লাগিল—'এই বেদাভ্যাসব্যাপৃত ব্রাহ্মণের কি অদ্ভুত বুদ্ধির একাগ্রতা ॥ ইনি অচিরকাল মধ্যেই চন্দ্রের ন্যায় আকাশ অতিক্রম করিবেন; ইনি পিতার পরিচর্যা করায় অত্যুত্তম জ্ঞানলাভ করিয়াছেন। ইনি পিতার ভক্ত, দৃঢ়তপা এবং পিতার অত্যন্ত প্রিয়পুত্র। সুতরাং ইহার প্রতি একাগ্রচিত্ত সেই পিতা, কি করিয়া ইহাকে বিদায় দিলেন। পরমধর্ম্মযজ্ঞ শুকদেব উর্বশীর বাক্য শুনিয়া, সেই বাক্যের দিকে মন অর্পণ করিয়া, সকল দিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন ৷ তখন শুকদেব আকাশ, পর্বত, বন ও উপবনযুক্ত পৃথিবী, জলাশয় ও নদী সকল দর্শন করিলেন ৷ তাহার পর দেবক্তারা সকলে পরমগৌরবনিবন্ধন, কৃতাঞ্জলিপুটে সকল দিক হইতে শুকদেবের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। তখন পরমধর্ম্মজ্ঞ শুকদেব সেই দেবগণকে এই কথা বলিলেন, হে শুক! এই ভাবে আহ্বান করিতে থাকিয়া পিতা যদি আমার অনুসরণ করেন, তাহা হইলে আপনারা সকলে মনযোগের সহিত তাঁহার কথার উত্তর দিবেন। আপনারা আমার প্রতি স্নেহবশতঃ আমার এই বাক্য রক্ষা করিতে পারেন।  শুকের বাক্য শুনিয়া সমস্ত দিক, বন, সমুদ্র, নদী ও পৰ্ব্বত, সকল দিক হইতে তাহার প্রত্যুত্তর করিল। 

ব্রাহ্মণ! আপনি যেমন আদেশ করিতেছেন নিশ্চয়ই সেইরূপ হইবে। বেদব্যাস কোন কথা বলিলে, আমরা তাহার প্রত্যুত্তর দিব। 

অত্যন্ত মহাতপা ব্রহ্মর্ষি শুক, এইরূপ বাক্য বলিয়া অধর্ম, অজ্ঞান, অবৈরাগ্য ও অনৈশ্বর্য্যরূপ চতুৰ্ব্বিধ দোষ পরিত্যাগ করিয়া মুক্তিসিদ্ধির দিকে লক্ষ্য রাখিয়া সেস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। জ্ঞানী শুকদেব অষ্টবিধ তমোগুণ পরিত্যাগ করিয়া, পঞ্চবিধ রজোগুণ পরিত্যাগ করিলেন; তাহার পর আবার সত্ত্বগুণও বিসর্জন করিলেন; তাহা যেন অদ্ভূত হইল।  

তাহার পর শুকদেব, ধূমশূন্য অগ্নির ন্যায় জ্বলিতে থাকিয়া, সেই নিত্য, অনির্বচনীয়, নির্গুণ ও কর্তৃত্বাদিবিবৰ্জ্জিত একমাত্র পরব্রহ্মে অবস্থান করিতে লাগিলেন।। সেই সময়ে যুগপৎ উল্কাপাত, দিগদাহ ও ভূমিকম্প হইতে লাগিল; তাহা যেন অদৃভূত বলিয়া বোধ হইতে থাকিল। বৃক্ষসকল আপন আপন শাখা বিসর্জন করিতে লাগিল, পর্বতসমূহ নিজ নিজ শৃঙ্গ নিক্ষেপ করিতে থাকিল, আর হিমালয় পর্বত যেন নির্ঘাতনব্দে বিদীর্ণ হইয়া পড়িল। তৎকালে সূর্য্য প্রকাশ পাইলেন না, অগ্নি জ্বলিলেন না এবং সমুদ্র, নদী ও হ্রদসকল ক্ষুদ্ধ হইয়া উঠিল। ইন্দ্রপ্রেরিত মেঘসকল সুস্বাদু ও সুগন্ধিজল বর্ষণ করিতে লাগিল এবং বায়ুও অলৌকিক সৌরভবাহী ও পবিত্র হইয়া বহিত হইতে থাকিল। 

ভরতনন্দন! ক্রমে শুকদেব উত্তরদিকে যাইয়া হিমালয় ও সুমেরু পর্বতের অলৌকিক সুন্দর প্রথম দুইটী শৃঙ্গ দেখিতে পাইলেন, সে দুইটী শৃঙ্গই পরস্পর সংযুক্ত এবং পার্শ্বে ও উপরে শতযোজন বিস্তৃত ছিল, আার হিমালয়ের শৃঙ্গ রৌপ্যময় শ্বেতবর্ণ এবং সুমেরুর শৃঙ্গ স্বর্ণময় পীতবর্ণ দেখা যাইতেছিল। ক্রমে শুকদের নিঃশঙ্কচিত্তে পতিত হইতে থাকিলেন; তখন সেই দুইটী পর্বতশৃঙ্গই তৎক্ষণাৎ দ্বিধা বিভক্ত হইয়া গেল। মহারাজা, তৎকালে সেই পর্বতশৃঙ্গদ্বয়ের দ্বিধাকরণ অন্যান্য সকলেরই দৃষ্টিগোচর হইল; তাহা যেন সকলেরই অদ্ভুত বলিয়া বোধ হইলো। তাহার পর শুকদেব তৎক্ষণাৎ পর্বতশৃঙ্গদ্বয়ের মধ্য হইতে নির্গত হইলেন। সেই পর্বতশ্রেষ্ঠ শুকের গতি প্রতিহত করিল না। তাহার পর আকাশে সমস্ত দেবতা, বিশাল হর্ষধ্বনি হইল। 

ভরতনন্দন! পর্বতদ্বয় দ্বিধাকৃত হইয়াছে, শুকও তথা হইতে নির্গত হইয়াছেন দেখিয়া, গন্ধর্বগণ, ঋষিগণ এবং যাহারা সেই পর্বতে বাস করে, তাহাদের সাধু সাধু এইরূপ হর্ষধ্বনি সর্বত্র হইতে লাগিল। তৎকালে দেবগণ, গন্ধর্বগণ, ঋষিগণ, যক্ষগণ, রাক্ষসগণ ও বিদ্যাধরগণ শুকদেবের পূজা করিতে লাগিলেন। 

মহারাজ! সেই শুকের উপস্থিতিকালে, আকাশমণ্ডল সলদিকে স্বর্গীয়পুষ্পে আকীর্ণ হইল। তাহার পর ধর্ম্মাত্মা শুকদেব উপরে যাইতে থাকিয়া মনোজ্ঞা স্বর্গগঙ্গা দর্শন করিলেন; তাহার তীরে বনমধ্যে বহুবিধ বৃক্ষে নানাবিধ ফুল ফুটিয়া রহিয়াছিল।..... শুকদেব আকাশে গমন করিতেছেন দেখিয়া, স্নেহাকুল পিতা বেদব্যাস দ্রুত গতি অবলম্বন করিয়া তাঁহার পশ্চা-পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন।  কিন্তু শুকদেব তখন আকাশে বায়ুর উপরে গতি অবলম্বন করিয়া, আপন যোগের প্রভাব দেখাইয়া, ব্রহ্মের ন্যায় নিরাকার হইয়া গেলেন। তখন মহাতপা বেদব্যাসও মহাযোগবলে তদপ্রকার দ্রুতগতি অবলম্বন করিয়া, আকাশে উঠিয়া, নিমেষমাত্র শুকের গমনস্থানে উপস্থিত হইলেন। ক্রমে বেদব্যাস দেখিলেন- পৰ্ব্বতাগ্র দুইভাগে বিভক্ত করিয়া শুকদেব তাহার ভিতরে গেলেন; তখন পাখিরা সকলে বেদব্যাসের নিকটে তাঁহার পুত্রের সেই কাৰ্য্য বলিলেন। তাহার পর বেদব্যাস্ উচ্চস্বরে ত্রিভুবন অনুনাদিত করিযয়া‘শুক’এইরূপ দীর্ঘ শব্দে শুককে আহ্বান করিলেন। তখন ধর্মাত্মা শুকদেব যোগবলে সর্বব্যাপী, সর্বাত্মা ও সর্বতোমুখ হইয়া, "ভো" শব্দদারা সমস্ত অনুনাদিত করিয়া প্রত্যুত্তর করিলেন। তদন্তর শুকদেব "ভো" ইত্যাকার একাক্ষরশব্দ উচ্চারণ করিয়া, স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমস্ত জগত আকর্ষণ করিলেন। সেই হইতে আজ পর্যন্ত শুকের সেই শব্দ লক্ষ্য করিয়া, পর্ব্বত গুহায় উচ্চারিত পৃথক পৃথক্ ধ্বনির প্রতিধ্বনি হইয়া থাকে ॥ তখন শুকদেব নিজের যোগপ্রভাব দেখাইয়া অন্তর্হিত হইলেন এবং শব্দস্পর্শ প্রভৃতি বিষয় পরিত্যাগ করিয়া, পরমপদ লাভ করিলেন।  এদিকে বেদব্যাস অমিততেজা পুত্রের সেই মহিমা দেখিয়া তাহাকেই চিন্তা করিতে করিতে পৰ্ব্বতের সমতল ভূমিতে উপবেশন করিলেন।..... সেই সময়ে মহর্ষিগণপুঞ্জিত ভগবান্ মহাদেব, দেবগণ ও গন্ধর্বগণে পরিবেষ্টিত হইয়া, পিনাকধনু ধারণ করিয়া, বেদব্যাসের নিকটে আগমন করিলেন। তখন মহাদেব পুত্রশোকে সন্তপ্ত বেদব্যাসকে সান্ত্বনাদানপূর্ব্বক এই কথা বলিলেন। বেদব্যাস, তুমি পূর্ব্বে আমার নিকটে পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশের ন্যায় শক্তিশালী একটি পুত্র প্রার্থনা করিয়াছিলে। তোমার তপস্যার প্রভাবে এবং আমার অনুগ্রহে সেইরূপ লক্ষণসম্পন্নই তোমার এই পুত্র জন্মিয়াছিল এবং সেই পুত্র ক্রমে পবিত্রচিত্ত ও ব্রহ্মতেজোময় হইয়া হিল।  

ব্রহ্মর্ষি! তোমার সেই পুত্র এখন অজিতেন্দ্রিয়গণের দুষ্প্রাপ্য এমন কি দেবগণেরও সুলভ পরমগতি লাভ করিয়াছে। সুতরাং তুমি তাহার জন্য শোক করিতেছ কেন? যতকাল পর্বতসমূহ থাকিবে এবং যাবৎকাল সমুদ্রসমূহ বিদ্যমান রহিবে ; ততকাল সেই পুত্রের সহিত তোমার অক্ষয় কীৰ্ত্তি থাকিবে।  মহর্ষি! আমার অনুগ্রহে এই জগতে সর্ব্বদা সকল দিকে, তুমি নিজের পুত্রের প্রতিবিম্ব দেখিতে পাইবে। 

ভরতনন্দন ! ভগবান্ মহাদেব স্বয়ং এইভাবে বেদব্যাসকে সন্তুষ্ট করিলে, বেদব্যাস শুকের প্রতিবিম্ব দেখিতে থাকিয়া, অতন্ত অনিন্দিত হইতে থাকিলেন। 

মহাভারত (শান্তিপর্ব- ৩১৯/১-৭০)
(অনুবাদকঃ শ্রীহরিদাসসিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য)

এবার পাঠকই বিচার করুন! এখানে কোথাও কি বিশ্বরূপের কিছু পেয়েছেন? আমরা যদি কদার্যদের মতো স্থুলবাক্যে বিশ্লেষণ করি তবে এখানে দেখা যাচ্ছে শুকদেব যোগাবলম্বনে কেবল আকাশপথে ভ্রমণ করেছেন! যেটাকে লঘিমা সিদ্ধি বলা চলে। ঋষি পতঞ্জলি কর্তৃক প্রণীত যোগদর্শনে বলা হয়েছে যোগীর অষ্টবিধ সিদ্ধি লাভ হয়। এই অষ্টবিধসিদ্ধির মধ্যে একটা হলো লঘিমা। এই লঘিমা সিদ্ধির দ্বারা যোগী শূণ্যে ভ্রমণ করতে পারে! এবার আমরা যদি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করি তবে দেখতে পাবো ব্রহ্মজ্ঞানী শুকদেব আপন যোগপ্রভাবে স্থুলদেহ পরিত্যাগ করে সূক্ষ্মদেহকে অবলম্বন করিয়া ত্রিলোক ভ্রমণকরত ত্রিগুণাতিত হইয়া ব্রহ্মণুভূতি লাভ করে অদ্বৈত সত্ত্বায় ব্রহ্মময় হইয়া পরমগতি তথা মোক্ষলাভ করিলেন।। 

কিন্তু এর সাথে অবৈদিক কদার্যরা বিশ্বরূপের কি সম্পর্ক করলো সেটাই বুঝলাম না! বিশ্বরূপ যেখানে দিব্যদৃষ্টি ব্যাতিত দর্শন সম্ভব নয় এবং অর্জুন দিব্যদৃষ্টি লাভ করেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপের আদি-অন্ত-মধ্য কিছুই খুঁজে পেলেন না সেখানে শুকদেবের এই ব্রহ্মোপলব্ধি কিভাবে বিশ্বরূপের সমর্থক হয় সেটা এই অর্বাচীনরা নিজেরাও হয়তো জানে না। তাছাড়া শুকদেবের আকাশপথে ভ্রমণকে দর্শন করতে গিয়ে কাউকেই দিব্যদৃষ্টি অর্জন করতে দেখা যায়না! জগতের সকলেই সাধারণ চর্মচক্ষু দ্বারাই তাঁর সেই আকাশভ্রমণ প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

"তমুদ্যন্তং দ্বিজশ্রেষ্ঠং বৈনতেয়সমদ্যুতিম্দ
দৃশং সর্ব্বভূতানি মনোমারুতরংসহম্।"

অনুবাদঃ তৎকালে সকলপ্রাণী, গরুড়ের ন্যায় দীপ্তিশালী এবং মন ও বায়ুর ন্যায় বেগবান্ ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ সেই শুকদেবকে উদয়মান অবস্থায় দর্শন করিল ॥

(রেফারেন্সঃ মহাভারত-শান্তিপর্ব/৩১৯/১১)
(অনুবাদকঃ ঐ)

অন্যদিকে কেবল মহাতপা বেদব্যাসই মহাযোগবলে শুকদেবের ব্রহ্মময় হয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করলেন৷ পরবর্তীতে মহাদেব স্বয়ং এসে ব্যাসদেবকে পুত্রের মোক্ষলাভ তথা ব্রহ্মলাভ (পরমগতি) সম্পর্কে নিশ্চিত করলেন। এরা ব্রহ্মজ্ঞানী শুকদেবের সর্বতমুখ "ভো" ধ্বনিকেও বিশ্বরূপের সমার্থক দেখাতে চেয়েছে। সমস্যা হলো এরা শুদ্ধ মননে শাস্ত্রচর্চা ত দূর শুদ্ধ চিন্তনও নেই এদের মধ্যে। যদি আমরা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করি তবে পাহাড় মধ্যে শুকদেবের "ভো" ধ্বনি সর্বত প্রতিধ্বনিত হবে এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে যদি আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ করি তবে ব্রহ্মজ্ঞানী শুকদেব যখন অদ্বৈত সত্ত্বায় ব্রহ্মে লীন হয়ে পরমগতি লাভ করলেন তখন শুকদেবের "ভো" ধ্বনি ব্রহ্মনাদ হিসেবেই প্রতিধ্বনিত হয়ে মহাতপা ব্যাসদেবের নিকট উপলব্ধ হয়েছে। 

অবৈদিক অর্বাচীনদের শাস্ত্রজ্ঞান প্রদানঃ

উপরের আলোচনায় স্পষ্ট যে ব্রহ্মজ্ঞানী শুকদেবের আকাশপথে ত্রিলোক ভ্রমণপূর্বক ত্রিগুণাতিত হয়ে পরমপদ লাভ কেবলই তাঁর ব্রহ্মাণুভূতি ছিলো যা তিনি কাউকে দেখিয়ে কারও সংশয় দূর করেন নি বরং নিজেই ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেছিলেন। অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বিশ্বরূপ সম্পর্কে বলেছিলেন,,

"সুদুর্দর্শমিদং রূপং দৃষ্টবানসি যণ্মম্
দেবা অপ্যস্য রূপস্য নিত্যং দর্শন কাঙ্ক্ষিণঃ।"

অনুবাদঃ শ্রীভগবান্ বলিলেন- তুমি আমার যে রূপ দেখিলে, উহার দর্শন লাভ একান্ত কঠিন; দেবগণ ও সর্বদা এই রূপের দর্শনাকাঙ্ক্ষী। 

(রেফারেন্সঃ গীতা - ১১/৫২)
(অনুবাদকঃ জগদীশ ঘোষ)

"নাহং বেদৈন তপসা ন দানেন ন চেজায়া।
শক্য এবংবিধো দ্রষ্টুং দৃষ্টবানসি মাং যথা ॥"

অনুবাদঃ আমাকে যে রূপে দেখিলে এই রূপ বেদাধ্যয়ন, তপস্যা, দান, যজ্ঞ, কোনো কিছু দ্বারাই দর্শন করা যায় না।

(রেফারেন্সঃ গীতা -১১/৫৩)/(অনুবাদকঃ জগদীশ ঘোষ)

"ন বেদযজ্ঞাধ্যয়নৈর্ন দানৈর্ন চ ক্রিয়াভিন তপোভিরুগ্রৈঃ।
এবং রূপঃ শক্য অহং নৃলোকে দ্রষ্টুং তদন্যেন কুরুপ্রবীর ॥ "

অনুবাদঃ হে কুরুপ্রবীর, না বেদাধায়ন দ্বারা, না যজ্ঞবিদ্যার অনুশীলন দ্বারা, না দানাদি ক্রিয়া দ্বারা, না উগ্র তপস্থ্যা দ্বারা মনুষ্যলোকে তুমি ভিন্ন আর কেহ আমার ঈদৃশ রূপ দেখিতে সক্ষম হয়।

(রেফারেন্সঃ গীতা - ১১/৪৮)/(অনুবাদকঃ জগদীশ ঘোষ)

তাহলে তো বলতেই হয় যে বিশ্বরূপ দর্শনকে শ্রীকৃষ্ণ এতো দুর্লভ বলেছেন যা স্বয়ং দেবতারদের জন্যও দুর্লভ এমনকি কঠোর তপস্যা দ্বারাও অর্জুন ভিন্ন অন্য কেউই সেই বিশ্বরূপ দর্শনে সমর্থ নন, সেই বিশ্বরূপকে শুকদেব এতো সহজলভ্য  বানিয়ে দিলেন যে পৃথিবীর সবাই তা দেখতে পাচ্ছে! (তাদের মতানুসারে বললাম)

এমনকি শুকদেবের দেহে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডও পরিলক্ষিত হয়নি, তাঁর দেহে কেউই দেবতাগণের সমাবেশ দেখতে পায়নি! এমনকি তিনি যে রূপে আকাশে ভ্রমণ করছিলেন তা যে বিশ্বরূপ বা দিব্যরূপ সেটাও কোথাও বলা হয় নি। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঐ রূপকে সরাসরি ঐশ্বরিক রূপ বলা হয়েছে মহাভারতে। 

এরপর আসি আচার্যগণের (যদিও এই স্বঘোষিত পণ্ডিতগুলো আদতে অবৈদিক পাখণ্ডিগুলো আচার্যদের পাণ্ডিত্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেই ব্যস্ত থাকে) টীকা প্রসঙ্গে। 

ভগবান কর্তৃক অর্জুনের দিব্যদৃষ্টি প্রাপ্তির প্রসঙ্গে মহামহোপাধ্যায় মহাভারতাচার্য শ্রীহরিদাসসিদ্ধান্তবাগীশ কর্তৃক প্রণীত "ভারতকৌমুদি" টীকায় বলা হয়েছে "এতেন বিশ্বরূপ প্রদর্শনযোগ্যতা সূচিতা" অর্থাৎ (দিব্যদৃষ্টিপ্রাপ্ত দ্বারা) বিশ্বরূপদর্শনের যোগ্যতা সূচিত হলো। 

সমগ্র মহাভারতের সুপ্রাচীন এবং সর্বমান্য টীকাকার আচার্য নীলকন্ঠসুরীজীও তাঁর "ভারতভাবদীপঃ" টীকায় শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ সম্পর্কে লিখেছেন "পরমং দিব্যম্ রূপম্ ঐশ্বরম্" অর্থাৎ পরম ঐশ্বরিক দিব্যরূপ!

এমনকি মহাভারতে সরাসরি লেখা আছে,,

"এবমুক্ত্বা ততো রাজন্ মহাযোগেশ্বরো হবিঃ।
দর্শয়ামাস পার্থায় পরমং রূপমৈশ্বরম্ ॥ "

অনুবাদঃ সঞ্জয় কহিলেন- হে রাজন, মহাযোগেশ্বর হরি এইরূপ বলিয়া তৎপর পার্থকে পরম ঐশ্বরিক রূপ দেখাইলেন। 

(রেফারেন্সঃ গীতা-১১/৯)/(অনুবাদকঃ জগদীশ ঘোষ)

কিন্তু পাঠক! শুকদেব যে রূপ ধারণ করে আকাশ মার্গে গমন করেছেন, ঐরূপকে কোনো আচার্যই তাঁদের টীকায় বিশ্বরূপ হিসেবে দাবি করেননি! এমনকি বিশ্বরূপ তো দূরে থাক, শুকদেব তাঁর স্বাভাবিক রূপ পরিত্যাগ করে অন্যরূপধারণ করে আকাশমার্গে গমন করেছেন এমন কোনো কথাই মহাভারতে পাওয়া যায় নি। মহামতি ভীষ্মও এমন কোন তুলনা উপস্থাপন করেন নি।।

আরেকটি কথা বলে দিতে চাই। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, এই বিশ্বরূপ অর্জুনের পূর্বে আর কেউ দেখেনি,,

"অদৃষ্টপূর্বং হৃষিতোঽস্মি দৃষ্টা ভয়েন চ প্ৰব্যথিতং মনো মে।
তদেব মে দর্শয় দেব রূপং প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস। "

অনুবাদঃ (অর্জুন বলিলেন) হে দেব, পূর্বে যাহা কখনও দেখি নাই, সেই রূপ দেখিয়া আমার হর্ষ হইয়াছে বটে, কিন্তু ভয়ে মন ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে; অতএব, তোমার সেই (চিরপরিচিত) পূর্ব রূপটি আমাকে দেখাও; হে দেবেশ, হে জগন্নিবাস, আমার প্রতি প্রসন্ন হও। 

(রেফারেন্সঃ গীতা- ১১/৪৫)/(অনুবাদকঃ জগদীশ ঘোষ)

তাদের বক্তব্য অনুসারে শুকদেবে সেই আকাশমার্গে ভ্রমণ করে ব্রহ্মাণুভব করাকে যদি বিশ্বরূপ ধরতে হয় তবে শ্রীকৃষ্ণের কথা মিথ্যা হয়ে যায়। 

এবার আসি শুকদেবের ঐ ঘটনা কোন প্রসঙ্গকে ইঙ্গিত করে। শুকদেবের জন্মের পূর্বে দেবাদিদেব মহাদেব ঋষি বেদব্যাসকে বলেছিলেন,,

"তদ্ভাবভাবী তদ্বুদ্ধিস্তদাত্মা তদপাশ্রয়ঃ
তেজসাবৃত্য লোকং স্ত্রীন্ যশঃ প্রাপ্স্যতি তে সুতঃ"।।

অনুবাদঃ তোমার সেই পুত্র পরমাত্মার ধ্যান করিবে; পরমাত্মাতে বুদ্ধি রাখিবে পরমাত্মাতে জীবাত্মা মিশাইবে এবং পরমাত্মাকেই আশ্রয় করিয়া রহিবে; আর তোমার সেই পুত্র আপন তেজে ত্রিভুবন আবৃত করিয়া যশ লাভ করিবে। 

(রেফারেন্সঃ মহাভারত- শান্তিপর্ব/৩১৪/২৯,, অনুবাদকঃ ঐ)

অর্থাৎ মহাদেবের ভবিষ্যৎবাণী হলো শুকদেব মহাযোগী হবেন। নিজের আত্মাকে পরমাত্মায় লয় করে জীবন্মুক্ত হবেন। বেদান্তের  মহাবাক্য অহম্ ব্রহ্মাস্মি (বৃহদারণ্যক উপনিষদ- ১/৪/১০) অর্থাৎ "আমিই সেই ব্রহ্ম" এই বাক্যকে উপলদ্ধি করবেন। এবং নিজের জীবত্বকে ব্রহ্মে লয় করে ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত করবেন।

বেদান্তে বলা হয়েছে,, 

"ব্রহ্ম বেদ ব্রহ্মেব ভবতি" (মুণ্ডক উপনিষদঃ ৩/২/৯ ) 

অর্থাৎ যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি ব্রহ্মই হোন।

মহাদেবের ভবিষ্যতবাণী অনুসারে শুকদেব ব্রহ্মকে জেনে ব্রহ্মই হবেন এবং এই ভবিষ্যৎ বাণীর প্রতিফলনই দেখা যায় শুকদেবের সেই ঘটনায়। শান্তিপর্বের যে অধ্যায়কে ঐ কদার্যগণ শুকদেবের বিশ্বরূপ দর্শনের ঘটনা বলে উল্লেখ করে, সেই অধ্যায়েই বলা হয়েছে,, 

"স দদর্শ তদাত্মানং সর্ব্বসঙ্গ বিনিঃসৃতম্

প্রজহাস ততো হাসং শুকঃ সংপ্রেক্ষ্য তৎপরম্ ॥ "

অনুবাদঃ তখন শুকদেব সমস্ত সংসর্গবিবর্জিত পরমাত্মাকে দর্শন করিলেন এবং তিনি সেই পরব্রহ্ম দর্শন করিয়া আনন্দে হাস্য করিলেন। 

(রেফারেন্সঃ মহাভারত- শান্তিপর্ব/৩১৯/৫)/( অনুবাদকঃ ঐ)

এখানে ত স্পষ্টই বলা হচ্ছে তিনিই পরব্রহ্মকে দর্শন করতেছেন। 

"তমেকমনসং যান্তমব্যগ্রমকুতোভয়ম্।"

অনুবাদঃ তিনি পরব্রহ্মে একাগ্রচিত্ত হইয়া অনাকূলভাবে ও অকুতোভয়ে আকাশমার্গে গমন করিতেছিলেন।

(রেফারেন্সঃ মহাভারত- শান্তিপর্ব/৩১৯/১৩)/(অনুবাদকঃ ঐ)

"শুকন্তু মারুতাদূদ্ধং গতিং কৃত্বান্তরীক্ষগাম্ ।
দর্শয়িত্বা প্রভাবং স্বঃ ব্রহ্মভূতোহভবত্তদা।।”

অনুবাদঃ কিন্তু শুকদেব তখন আকাশে বায়ুর উপরে গতি অবলম্বন করিয়া, আপন যোগের প্রভাব দেখাইয়া, ব্ৰহ্মের ন্যায় নিরাকার হইয়া গেলেন।।

(রেফারেন্সঃ মহাভারত-শান্তিপর্ব/৩১৯/৪৯)

আর এহেন আশ্চর্য কর্ম যে শুকদেব যোগ অবলম্বনে করেছেন, এটা তো সরাসরি মহাভারতেই বলা হয়েছে,, 

"স পুনর্যোগমাস্থায় মোক্ষমাগোপলব্ধয়ে।
মহাযোগেশ্বর ভূত্বা সোহত্যক্ৰামদ্বিহায়সম্ ॥"

অনুবাদঃ শুকদেব মোক্ষপথ লাভ করিবার জন্য পুনরায় যোগাবলম্বন করিয়া, যৌগিক উপায়ে আকাশগামী হইয়া, আকাশ অতিক্রম করিলেন ॥

(রেফারেন্সঃ মহাভারত- শান্তিপর্ব/৩১৯/৬)/(অনুবাদকঃ ঐ)

ঐ অবস্থায় শুকদেব সর্বতোমুখ হয়েছিলেন,, 

"শুকঃ সৰ্ব্বগতো ভূত্বা সৰ্ব্বাত্মা সৰ্ব্বতোমুখঃ।
প্রত্যভাষত ধৰ্ম্মাত্মা ভোঃ শব্দেনানুনাদয়ন্॥ "

অনুবাদকঃ তখন ধৰ্ম্মাত্মা গুকদেব যোগবলে সর্বব্যাপী, সর্বাত্মা ও সর্বতোমুখ হইয়া, "ভো" শব্দধারা সমস্ত অনুনাদিত করিয়া প্রত্যুত্তর করিলেন। 

(রেফারেন্সঃ মহাভারত- শান্তিপর্ব - ৩১৯/৫৩)/(অনুবাদকঃ ঐ)

যেহেতু বিশ্বরূপদর্শনকালে শ্রীকৃষ্ণও সর্বতোমুখ হয়েছিলেন সেহেতু অর্বাচীনগণ এই ঘটনাকে বিশ্বরূপ বলে আখ্যায়িত করেছে! আসলে টীকা টীপ্পনী না পড়ে কেবল পিডিএফ হতে এক লাইনের শ্লোক দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া ব্যক্তিদের এহেন চিন্তাভাবনা অস্বাভাবিক নয়। 

মহাভারতাচার্য হরিদাসসিদ্ধান্তবাগীশকৃত "ভারতকৌমুদি" টীকায় এই শ্লোকের ব্যাখায় বলা হয়েছে,,  

"শুরু ইতি। সৰ্ব্বগতঃ সর্বব্যাপী, ভৃত্বা যোগবলেন"

অর্থাৎ শুকদেবের এই কার্য যোগক্রিয়া মাত্র।

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে কি বিশ্বরূপধারণ করতে যোগশাস্ত্রের অণিমাদি অষ্টসিদ্ধির দরকার হয়েছিলো? কোথাও কি লেখা আছে যে শ্রীকৃষ্ণে যোগবলে বিশ্বরূপ ধারণ করেছিলেন?

অবশ্য ঐ অর্বাচীনগণ এখন এক নতুন মিথ্যাচার সামনে আনবে। তারা এখন দাবি করে বসবে যে মহাভারতে বর্ণিত আছে শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত হয়ে গীতাজ্ঞান দান করেন যথা-

"পরম হি ব্রহ্ম কথিতং যোগযুক্তেন তন্ময়া।
ইতিহাসস্তু বক্ষ্যামি তস্মিন্নর্থে পুরাতনম্।"

অর্থাৎ— ‘তৎকালে আমি যোগযুক্ত হইয়া পরব্রহ্মের বিষয় বলিয়াছিলাম, এখন সেই বিষয়ে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলিতেছি ৷’

(মহাভারত, আশ্বমেধিকপর্ব্ব, অনুগীতা - ১৩)/(অনুবাদক: ঐ)

তাদের বলে রাখি,, গীতাজ্ঞান দান আর বিশ্বরূপ দেখানো এক বিষয় নয়। দ্বিতীয়ত এখানে যোগযুক্ত বলতে অণিমাদি অষ্টসিদ্ধিকে বোঝায়নি। কারন আচার্য মহামহোপাধ্যায় শ্রীনীলকন্ঠসুরীপ্রণীত "ভারতকৌমুদি" টীকায় "যোগযুক্ত" শব্দের অর্থ করা হয়েছে,,

"যোগযুক্তেন ঐক্যাগ্রসমন্বিতেন"

অর্থাৎ এখানে যোগযুক্ত অর্থ একাগ্রতার সহিত ৷ 

অতএব, এইকথা প্রমাণিত যে শুকদেব যোগমার্গ অবলম্বণ করে আকাশে ভ্রমণ করেছিলেন এবং সর্বতোমুখ, সর্বাত্মা হয়ে ব্রহ্মদর্শন করেছিলেন (যেটাকে অর্বাচীনগণ বিশ্বরূপ বলে চালিয়ে দিয়েছে) কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ মোটেই যোগাবলম্বনে কৃতকর্ম নয় এবং সেই রূপ ব্রহ্মজ্ঞানী শুকদেবের ব্রহ্মাণুভূতির সম্পূর্ণ ভিন্ন।।

অনুগীতা ও যোগেশ্বরতত্ত্ব নিয়ে অবৈদিক কদাচারীদের ভ্রান্তি নিরসনে SPS এর জবাব: 

[1/ https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2020/09/blog-post_26.html?m=1

2/ https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2020/12/blog-post_4.html?m=1]

যে মহামতি ভীষ্মের শরশয্যার বক্তব্য নিয়ে এই অকালকুষ্মাণ্ডগুলো লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়েছে তারা কি মহামতি ভীষ্মের অন্য কথাগুলো পড়ে নি! না পড়ারই কথা কারণ এদের মূলত গ্রন্থ পড়ার অভ্যাসই নাই একমাত্র কাট-পিস ছাড়া। 

★ মহামতি ভীষ্ম শরশয্যায় কি বলেছিলেন? 

মহামহিম ভীষ্ম যখন শরশয্যায় তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠির ও তাঁর ভ্রাতাদের নিয়ে কুরুক্ষেত্রে গিয়ে ভীষ্মকে বললেন,

"যুধিষ্ঠির আপনার নিকট ধর্মজিজ্ঞাসা করতে এসেছেন।"

 তখন মহামহিম ভীষ্ম বললেন,

"হে নারায়ণ, তোমার কথা শুনে আমি হর্ষে আপ্লুত হয়েছি। বাক্-পতি তোমার কাছে আমি কি বলিব? সমস্ত বাস্তবতাই তোমার বাক্যে নিহিত আছে৷ দুর্বলতার ফলে আমার বাক্-শক্তি ক্ষীণ হয়েছে, দিক আকাশ ও পৃথিবীর বোধও লুপ পেয়েছে, কেবল তোমার প্রভাবেই জীবিত রয়েছি। কৃষ্ণ, তুমি শ্বাশত জগৎকর্তা, গুরু উপস্থিত থাকতে শিষ্যতুল্য আমি কি ক'রে উপদেশ দিব?

[মহাভারত, শান্তিপর্ব, পৃষ্ঠা-৫৫৯ (রাজশেখর কর্তৃক অনুবাদিত)]

দুর্য্যোধন শরশয্যায় অধীষ্ঠিত মহামহিম ভীষ্মের কাছে কৃষ্ণ মাহাত্ম্য জানতে চাইলে মহামহিম ভীষ্ম বললেন,

”রাজন! বাসুদেব মাহাভূত ও সকল দেবতর দেবতা, তাহা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নিরীক্ষিত হয় না। মহর্ষি মার্কণ্ডেয় তাঁহাকে মহৎ ও অদ্ভুত বলিয়া কীর্ত্তন করিয়া থাকেন; তিনি সমুদয় ভূত, ভূতাত্মা, মহাত্মা ও পুরুষোত্তম। সেই মহাত্মা পুরুষোত্তম পৃথিবী, জল, বায়ু ও তেজ এই সকল পদার্থ সৃষ্টি করিয়া সলিলে শয়ন করিয়াছিলেন। সেই সর্ব্বতেজময় পুরুষ যোগবলে সলিলে শয়ন করিয়া মুখ হইতে অগ্নি, প্রাণ হইতে বায়ু এবং মন হইতে সরস্বতী ও বেদ সমুদয় সৃষ্টি করিয়াছেন।”

[মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, অধ্যায়-৬৭ (কালিপ্রসন্ন কর্তৃক অনুবাদিত)]

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন রথের চাকা হাতে মহামহিম ভীষ্মকে মারতে উদ্যত হলেন তখন ভীষ্ম বললেন,

"হে ভূতশরণ্য, হে লোকনাথ! আমাকে অবিলম্বে রথ হইতে পতিত করো। হে কৃষ্ণ! তুমি আমাকে সংহার করিলে আমার ইহলোক ও পরলোক উভয় লোকেই শ্রেয়লাভ হবে (শ্রেয় ও প্রিয় - এর ব্যাখ্যা উপনিষদে আছে।) ও ত্রিলোকমধ্যে প্রভাব প্রনিত হইবে।"

[মহাভারত, ভীষ্মপর্ব (কালিপ্রসন্ন কর্তৃক অনুবাদিত)]

এখন কদার্য যব**গুলো মহামহিম ভীষ্মের এই কথাগুলোও বসে বসে মনন করুক তবে যদি এদের শুভবুদ্ধি হয়।।

এবার এই অর্বাচীনদের মূলে আঘাত করা হবে।।

শ্রীমদভগবদগীতার একাদশ অধ্যায়ের ৩৯-৪৬ শ্লোকসমুহ শুদ্ধ চিত্তে পঠন, চিন্তন ও মনন করলেই স্পষ্ট হয়ে যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন সেটি অনন্য। 

🔸গীতার ১১/৪১-৪২ শ্লোকদ্বয়ে অর্জুন বলেন,

"পূর্বে আমি তোমার মহিমা না জেনে তোমাকে 'হে কৃষ্ণ', 'হে যাদব', 'হে সখা' বলে সম্বোধন করেছি। প্রমোদবশত এবং প্রণয়বশত যা কিছু করেছি তা তুমি দয়া করে ক্ষমা কর।"

"বিহার, শয়ন, ভোজনের সময়, কখনো একাকী, কখনো অন্যদের সমক্ষে, আমি যে অসম্মান করেছি, সে সমস্ত অপরাধ দয়া করে ক্ষমা কর।"

🔸 পরবর্তী দুই শ্লোকে অর্জুন বলেন,

"হে অমিতপ্রভাব, তুমি এই চরাচর জগতের পিতা, পূজ্যগুরু এবং গুরুর গুরু। অতএব, ত্রিভূবনে তোমার মত আর কেউ নাই। তোমার থেকে শ্রেষ্ঠ অন্য কে হতে পারে?"

"হে পরম পূজ্য ভগবান, তাই আমি তোমাকে প্রণাম করে তোমার কৃপা ভিক্ষা করছি। পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখায়, প্রিয় যেমন প্রিয়ার অপরাধ ক্ষমা করে, তুমিও সেই ভাবে আমার অপরাধ ক্ষমা কর।" 

(গীতা- ১১/৪৩-৪৪)

🔸 এরপর ভীতসন্ত্রস্ত অর্জুন পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের সেই সৌম্য চতুর্ভুজ রূপ দেখতে চেয়ে বলেন,

"হে সহস্রবাহো, আমি তোমাকে সেই গদা ও চক্রধারী রুপে দেখতে ইচ্ছা করি। হে বিশ্বমূর্তি, এখন তুমি তোমার সেই চতুর্ভূজ মূর্তি ধারণ কর।" (গীতা- ১১/৪৬)

অর্বাচীনগুলো মহাদেবের বিশ্বরূপকে সামনে এনেছে। এতে সমস্যা কি? মহাভারতেই যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে আত্মস্বরূপ শিবের উপাসনা করেন তখনই ত স্পষ্ট হয়ে যায় যে মহাদেব ও শ্রীকৃষ্ণ আলাদা কেউ নন। 

তারপরও যারা এই অবৈদিক স্বার্থান্বেষী যব**দের বিভ্রান্ত হবেন তারা কস্মিনকালেও মুক্তির সন্ধান পাবে বলে মনে হয় না বরং কূপ সদৃশ অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জীবনভর ঘুরপাক খেতে থাকবে যেমনটা অবৈদিক কদাচারীরা খাচ্ছে। 

© নিলয় চৌধুরী (অগ্নিপুত্র)

প্রচারেঃ
SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
সনাতনী শাস্ত্র ও দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ