পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ অনুকরণীয় আদর্শ।

 


আজকের এই দিনে ৫২৪৭ বছর আগে জগতের কল্যাণ হেতু ধর্ম পুনঃস্থাপনের নিমিত্তে লোকশিক্ষা ও লোক কল্যাণের জন্য পরমেশ্বর স্বয়ং মনুষ্যরূপ দিব্য দেহ ধারণ করে ধরাধামে অবতীর্ণ হোন। তাঁর জন্ম দিব্য, তাঁর দেহ দিব্য ও তাঁর লীলাও (লোকশিক্ষায় দিব্য কর্ম) দিব্য। সমগ্র জগতে সেই পরম পুরুষ, পরম সত্ত্বা শ্রীকৃষ্ণ নামে পুজিত হোন।।
তাঁর এই মনুষ্যরূপ দিব্য দেহে অবতীর্ণ হওয়ার স্বাক্ষ্য শ্রীমদভগবদগীতার চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি স্বয়ং দিচ্ছেন,
"যদিও আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই। হে ভারত! যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই।"
উক্ত বক্তব্যের কিছুটা তাৎপর্য প্রতীয়মান হয় গীতার একাদশ অধ্যায়ের দ্বিতীয় শ্লোকে যেখানে অর্জুন বলছেন,
"হে পদ্মপলাশলোচন! সর্বভূতের উৎপত্তি ও প্রলয় তোমার থেকেই হয় এবং তোমার কাছ থেকেই আমি তোমার অব্যয় মাহাত্ম্য অবগত হলাম।"
পরমেশ্বরকে পাওয়ার জন্য, তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য আমরা আমাদের সম্পূর্ণ জীবনে নিরবিচ্ছিন্ন সাধন করে যাই ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সমর্পনে কারণ পরমেশ্বরকে প্রাপ্ত হয়ে মোক্ষলাভই আমাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু তিনি যখন লোকশিক্ষার জন্য মনুষ্যরূপ দিব্য দেহ ধারণ করেছেন তখন তিনি যে শিক্ষা আমাদের দিয়েছেন সেগুলোর আচরণ করাও আমাদের জন্য একপ্রকার সাধনা।। তিনি শ্রীমদভগবদগীতার কর্মযোগের একাধিক শ্লোকে ব্যাখ্যা করেছেন কেন তিনি ধরাধামে অবতীর্ণ হয়ে কর্মের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
বলা যায়,
আপনি আচরি ধর্ম শেখাও অপরে।
প্রচার যা করছো তুমি দেখাও আচারে।।
অর্থাৎ পরমেশ্বর নিজে অবতীর্ণ হয়ে নিজের জীবনাচার দিয়েই ধর্মের প্রকৃত প্রচার করে গেছেন এবং আমাদের জন্য পথের দিশা দেখিয়ে গেছেন।

৫২৪৭ বছর আগে তিনি কেন অবতীর্ণ হলেন?

৫২৪৭ বছর আগে দ্বাপরের শেষ ভাগে সমগ্র জগৎ যখন অধর্মের অতল গহব্বরে তলিয়ে যাচ্ছিল, সাধু-সন্তরা যখন মহাসঙ্কটে, সন্তান যখন তার পিতাকে বন্ধী করছে, ভাই যখন তার ভাইকে রাজ্যচ্যুত করছে, নারীর সম্মান যখন নিলামে উঠছে এবং ধর্ম যেন স্বয়ং এক সংকটে আবদ্ধ হয়ে আছে ঠিক তখনই তিনি অবতীর্ণ হলেন। ভাদ্রপদ মাসের কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী তিথি, রোহিণী নক্ষত্র এবং বৃষ রাশিতে তিনি অবতীর্ণ হলেন। দিনটি ছিল বুধবার এবং সময় ছিল মধ্যরাত্রি। জগতের এক মহা সঙ্কটে তিনি যখন অবতীর্ণ হলেন প্রকৃতি ছিলো ঝড়-ঝঞ্ঝাময়, এ যেন পরম পুরুষকে বরণ করে নিতে প্রকৃতির এক ভিন্ন আয়োজন।
তিনি অবতীর্ণ হলেন এবং নিজেকে টিকিয়ে রাখতে শিশুকাল থেকেই নানারকম প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে উঠলেন। তিনি শেখালেন বন্ধুপ্রতিম আদর্শ, ভাতৃপ্রতিম আদর্শ, তিনি শেখালেন পিতামাতার প্রতি ভালোবাসা, তিনি শেখালেন বৃন্দাবনের প্রেম লীলা। কিন্তু তিনি সবচেয়ে বড় যে শিক্ষাটা দিলেন সেটা হলো কর্তব্য হতে বিচ্যুত না হওয়া তাই তিনি মাত্র এগারো বছর বয়সে গোকুল ও বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় গমন করলেন এবং অত্যাচারী রাজা কংসকে দমন করে মথুরায় ধর্ম রাজ্য স্থাপন করলেন। মহাপরাক্রমশালী অত্যাচারী রাজা জরাসন্ধ যখন একের পর এক মথুরা আক্রমণ করছিলো তখন প্রজাদের অধিক প্রাণহানি নিরসনে যুদ্ধের অসাধারণ কুটনৈতিক বুদ্ধি প্রয়োগ করে নিরাপদ দ্বারকায় তিনি প্রজাদের স্থানান্তর করেন এবং সেখানেও ধর্মরাজ্য স্থাপন করেন। অথচ কিছু কিছু নরাধিমা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে জরাসন্ধের ভয়ে তিনি মথুরা হতে পলায়ন করেছেন।
দেবী রুক্মিনীর এক চিঠিতে তিনি দুরাচারী রাজা শিশুপালের হাত থেকে দেবী রুক্মিনীকে উদ্ধার করে নিজের পত্নীরূপে গ্রহণ করে নারীর সম্মান রক্ষার এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন।
কুরুপাণ্ডবের পারস্পরিক বিভেদের অবসান ঘটাতে তিনি অসংখ্যবার প্রয়াস করছেন এবং পাণ্ডবদের শান্তিদূত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় গিয়ে অসংখ্যবার শান্তি প্রস্তাব দিয়েছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যখন সুনিশ্চিত নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষায় দুর্যোধনকে নিজের নারায়ণি সেনা পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছিলেন এবং অর্জুনের পক্ষেও যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র হাতে নেন নি। তবে সঠিক দিকনির্দেশনা ও স্থির বুদ্ধি দ্বারা কিভাবে এক অসম যুদ্ধ জয় করা যায় তার অনন্য দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে।
শ্রীমদভগবদগীতায় তিনি আমাদের জন্যও এই নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।
"দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে।। গীতা ২/৫৬।।"
সরলার্থঃ যিনি সুখ, দুঃখ, ভয় ক্রোধ কিছুতেই বিচলিত হন না তিনিই স্থিরবুদ্ধি।
তিনি নিজের প্রিয় ভাগনে অভিমন্যুকে নিজ হাতে অস্ত্র শিক্ষা দিয়েছিলেন কিন্তু যুদ্ধনীতির বাইরে গিয়ে প্রিয় ভাগনের জীবন রক্ষায় পক্ষপাতদুষ্ট হোন নি অর্থাৎ প্রতিটি মুহুর্তে তিনি আমাদেরকে ধর্মরক্ষায় অটল থাকার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় ধর্মের জন্য লড়াই করেছেন এবং অসংখ্য যুদ্ধ তিনি করেছেন। তিনি যেমন প্রেমময় বাশি বাজিয়ে ভক্তকূলকে ভক্তির অমৃত স্বাদ দিয়েছেন তেমনি অধার্মিকদের নাশ করতে হাতে সুদর্শন তুলে নিতেও দ্বিধাবোধ করেন নি।
অতঃপর তিনি আমাদের দান করলেন জ্ঞানের অমৃত ভাণ্ডার শ্রীমদভগবদগীতা। শ্রীমদভগবদগীতার ৭০০ শ্লোকে লুকিয়ে আছে জীবনের সকল সমস্যার সমাধান। গীতার শ্লোকগুলো পাঠের পাশাপাশি প্রতিটি শ্লোকের মনন করে নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে হবে। শ্রীকৃষ্ণকে ভালোবেসে তাঁর দেখানো জীবনাচার আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে হবে। যদি আমরা সেটা করতে পারি তবেই নিজের ও জগতের সত্যিকার কল্যাণে ব্রতী হতে পারবো। গীতার শিক্ষাকে কর্মে প্রয়োগ করে, শ্রীকৃষ্ণের জীবনাচার নিজের জীবনে আচরণ করে জগতের কল্যাণ করা-ই হউক আমাদের প্রধান ব্রত।
অতুলনীয় রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী, দূরদর্শী কূটনৈতিক তৎপরতা, ধর্ম পুনঃস্থাপনের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করা , কর্তব্য-কর্ম হতে কদাপি বিচ্যুত না হওয়া পরমেশ্বরের মনুষ্যরূপ দিব্য দেহধারী অবতার পুরুষ বাসুদেবকে আমি প্রণাম করি।
" ওঁ নমঃ ব্রহ্মণ্য দেবায় গো ব্রাহ্মণ হিতায় চ।
জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় বাসুদেবায় নমো নমঃ ।।"
জয় শ্রীকৃষ্ণ 🙏
ঈশ্বর কৃপায় জগতময় শান্তি বিরাজ করুক, জগতের সকল জীবের কল্যাণ হউক এবং এই বিশ্ব করোনামুক্ত হউক।।
©স্টিমন অনিক।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ