🔱 রসালিঙ্গ/শিবলিঙ্গ ও রসায়ন।।

 


হেডলাইনের দুইটি শব্দ রসালিঙ্গ রসায়ন খুব তাৎপর্যপূর্ণ একে অপরের পরিপূরক।। 

রসায়ন বলতে আমরা কি বুঝি

যে শাস্ত্রে পদার্থের কিংবা পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয় অর্থাৎ একাধিক পদার্থের ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় নতুন পদার্থের সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা হয় সেটাই রসায়ন।। 

রসায়নের সাথে শিবলিঙ্গের কি সম্পর্ক? রসালিঙ্গ নামকরণের হেতু কি?

জেনে রাখা ভালো রসালিঙ্গের আরেক নাম হচ্ছে পারদ লিঙ্গ। পারদের সাথে রসায়নের সরাসরি সম্পর্ক এটা সকলেই জানি। প্রাচীন ভারতের আলকেমি বা রসায়নে টি ধাতুর কথা বলা হয়েছে যথাঃ / গোল্ড (স্বর্ণ), / সিলভার (রূপা), / মার্কারি (পারদ), / কপার (তামা), / লেড (সীসা), / আইরন (লোহা), / টিন।

অন্যদিকে পশ্চিমা আলকেমিতে পারদকে বাদ দিয়ে অন্য ছয়টিকে ধাতু হিসেবে গণনা করা হতো।

প্রশ্ম আসতে পারে তাহলে এসব ধাতু কিংবা রসায়নের সাথে শিবলিঙ্গের যোগসূত্র কোথায়

উপরেই জেনে এসেছি রসায়ন মানেই হলো একাধিক পদার্থের ক্রিয়া বিক্রিয়া। এই ক্রিয়া বিক্রিয়ায় স্পেসিফিক কোন জিনিসের আদান-প্রদানও হয়। যেমন আধুনিক কালের কবিরা বলেন প্রেমের রসায়ন অর্থাৎ যেখানে নারী পুরুষ সত্ত্বার ভাবের আদান-প্রদান হয়। 

ক্রিয়া বিক্রিয়ায় আদানপ্রদান হয় ইলেক্ট্রনের। আমাদের এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে এটম তথা পরমাণু হতে। পরমাণুর তিনটি অংশের মধ্যে একটি অংশ ইলেকট্রন। আমরা সকলে লবণ খাই যার সংকেত NaCl. সোডিয়াম (ধাতু) ক্লোরিন (অধাতু) একত্রে ইলেক্ট্রন আদান-প্রদান করে সৃষ্টি হয় সোডিয়াম ক্লোরাইড বা খাদ্য লবণ।



আমরা জানি পরম পুরুষ অনাদি এবং তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ পুরুষ প্রকৃতিও অনাদি। পরমাত্মারূপ সদাশিবের অংশই শিব প্রকৃতি/শক্তি। শিবলিঙ্গ সেই পরমাত্মারই প্রতীক যেখানে শিব (পুরুষ শক্তি (প্রকৃতি) মিলেমিশে একাকার।। পুরুষ প্রকৃতি যে অনাদি সেটা বলতে অনেকে উভয়কে স্বতন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু পরমাত্মা অনাদি তাহলে তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ পুরুষ প্রকৃতিও অনাদিই হবে। মানবের চৈতন্য দেহ কিন্তু ভিন্ন হয়েও একে অপরের পরিপূরক। চৈতন্য দেহ স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বহীন বরং উভয়ের মিলনেই ক্রিয়াশীল।। নিচে এই বিষয়টা আরও পরিস্কার করা হবে।।

ভগবতী গীতায় বলে হয়েছে

প্রকৃতি পুরুষের একাত্মভাবের নাম ব্রহ্ম। যথা---

"শিবঃ প্রধানঃ পুরুষঃ শক্তিশ্চ পরমা শিবা।
শিবশত্যাত্মকং ব্রহ্ম যোগিনস্তত্ত্বদৰ্শিনঃ৷৷"

শিবই পরম পুরুষ এবং শক্তিই পরমা প্রকৃতি, তত্ত্বদর্শী যোগিগণ প্রকৃতি পুরুষের একতাকে ব্রহ্ম বলিয়া ভাবেন।

অন্য ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,  

বাহ্য জগতের মর্মে মর্মে যে মহতী শক্তি নিহিত রহিয়াছে, তাহারই নাম প্রকৃতি এবং বাহ্য জগতে যে চৈতন্য-স্ফূর্তি স্বপ্রকাশ রহিয়াছে, তাহারই নাম শিব। এই চৈতন্য এবং মহতী শক্তিকে যখন সমষ্টি করিয়া একাসনে উভয়কে একত্র জড়িত বলিয়া অনুভব হইবে, অর্থাৎ দুইয়ের একটিকে স্বতন্ত্র করিতে গেলে যখন দুইটিই অদৃশ্য হইবে বলিয়া বোধগম্য হইবে, তখনই ব্রহ্মকে চিনিতে পারিবে। এক ব্রহ্মই চণকবৎ দ্বিধা বিভক্ত হইয়া পুরুষ প্রকৃতিরূপে পরিদৃশ্যমান হইতেছেন। যথা

"ত্বমেকো দ্বিত্বমাপন্নঃ শিবশক্তিপ্ৰভেদতঃ"

              --কাশীখন্ড

এই বিষয়টি আরও পরিস্কার বুঝতে হলে শ্রীমদভগবদগীতার নবম পঞ্চদশ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।। পরমাত্মা বলছেন, তিনিই ক্ষেত্র (প্রকৃতি) এবং তিনিই ক্ষেত্রজ্ঞ (পুরুষ) ক্ষেত্র ক্ষেত্রজ্ঞ যৌথক্রিয়ায়ই জগতের সৃজন। 

প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে পুরুষ প্রকৃতিতে আদান-প্রদান হয় কি?

পুরুষ স্থির নিষ্ক্রিয় এবং পুরুষের আছে চৈতন্যশক্তি কিন্তু পুরুষকে বলা হয় খোঁড়া। অন্যদিকে প্রকৃতি ক্রিয়াশীল কিন্তু চৈতন্য ছাড়া প্রকৃতিও অচল তথা অন্ধ। (সাংখ্যকারিকা

উদাহরণ স্বরূপ প্রকৃতি অন্ধ তাই ক্রিয়াশীল হলেও দিকনির্দেশনার (চৈতন্য) অভাবে চলতে পারেনা অর্থাৎ সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন হয় না। অন্ধ বা খোঁড়া স্বতন্ত্রভাবে কখনো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনা। কিন্তু অন্ধ খোঁড়া একত্র হলে ঠিকই পথ সরল হয়ে যায়। অন্ধকে যদি চৈতন্য দান করা যায় তবে অন্ধ চলৎশক্তি প্রাপ্ত হয়। পুরুষ যখন প্রকৃতিতে চৈতন্য দান করে তখনই প্রকৃতিও ক্রিয়াশীল হয়ে উঠে। রসায়নের ইলেকট্রনই ব্রহ্মতত্ত্বের চৈতন্য।।

শ্রীমদভগবদগীতার ১৪/ শ্লোকেও একই কথা বলা হয়েছে।। 

"মম যোনির্মহদ্ব্রহ্ম তস্মিন্ গর্ভং দধাম্যহম্৷
সংভবঃ সর্বভূতানাং ততো ভবতি ভারত৷।"

ব্রহ্ম বা প্রকৃতি থেকে সমস্ত ভূত বা ব্রহ্মাণ্ড উৎপন্ন হয়েছে (সংভবঃ সর্বভূতানাং) 

সেই ব্রহ্মযোনী বা প্রকৃতিকে আমিই গর্ভ দান করি বা ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির শক্তি প্রদান করি (গর্ভং দধামি অহম্)

উপরোক্ত আলোচনায় ইহা স্পষ্ট যে রসায়নের ক্রিয়া-বিক্রিয়া, ভাবের আদান-প্রদান এবং পুরুষ প্রকৃতির মিলনে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিতত্ত্ব একই সূত্রে গাঁথা।

এতকিছু বলার অর্থ হলো রসালিঙ্গের পেছনে যে দর্শন বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে সেটা পরিস্কার করার জন্য। আজকাল আমাদের তথাকথিত আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক তরুণসমাজ আমাদের পূর্ব পুরুষদের নিয়ে, তাঁদের দর্শন নিয়ে তাচ্ছিল্যভরে মন্তব্য করে এবং তাঁদেরকে পশ্চাৎপদ বলে অবজ্ঞা করে। 

প্রাচীন ভারতে আলকেমি তথা রসায়নের যাত্রা শুরু হয় দক্ষিণ ভারতের সিদ্ধা সম্প্রদায়ের হাত ধরে। তাঁরাই প্রথম রসালিঙ্গ তথা পারদ লিঙ্গ বানানো শুরু করেন। তরল পারদকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সলিডিফাই করে শিবলিঙ্গের আকার দেওয়া হতো। তরল পারদকে সলিডিফাই করার প্রক্রিয়া পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা বহু পরে আবিস্কার করেছে অথচ সিদ্ধা সম্প্রদায় বহু আগেই পারদকে সলিডিফাই করে নিখুঁত শিবলিঙ্গের গঠন দিতে পারতেন।। তাঁরা পারদকে পুরুষ হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং গন্ধককে প্রকৃতি তথা ফিমেল পার্টিকেল হিসেবে বিবেচনা করতেন। গন্ধকের সাথে তামার মিশ্রনে তাঁরা তুতে (CuSO4) প্রস্তুত করতেন এবং সেটার সাথে পারদের মিশ্রণকে সলিডিফাই করে এমালগাম (পারদের সলিড গঠন) প্রস্তুত করতেন যা দিয়ে নিখুঁত শিবলিঙ্গের গঠন প্রস্তুত করতেন।। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি তারা প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত উপাদান দিয়েই করতেন যেখানে পারদকে তাঁরা পুরুষ তুতেকে (গন্ধকের আয়ন) বিবেচনা করতেন প্রকৃতি হিসেবে। পুরুষ (শিব) প্রকৃতির (শক্তি) মিলনে তাঁরা প্রস্তুত করতেন রসালিঙ্গ। রসালিঙ্গে যেন পুরুষ প্রকৃতি মিলে একাকার হয়ে যায় এবংশিব শক্তির এক হয়ে যাওয়াকেই নির্দেশ করে।

জয় শিবশক্তি 🙏

©স্টিমন অনিক।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ