প্রতিমায় পুজা বিরোধী অপযুক্তির ধারাবাহিক প্রত্যুত্তর।। পর্ব-১ (দয়াকান্ড/তৃতীয় অংশ

 


[দয়াজ্বীর বালখিল্য যুক্তি]
দয়াকান্ড/১ম অংশ- এর লিংকঃ 
https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/...
দয়াকান্ড/দ্বিতীয় অংশ- এর লিংকঃ
https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/...

দয়াজ্বীর বালখিল্য যুক্তির ধারাবাহিক প্রত্যুত্তরঃ

মহান তার্কিক ও গবেষক দয়াজ্বীর সনাতনী শাস্ত্র, সংস্কৃতি ও পরম্পরায় প্রতিমায় ঈশ্বরের আরাধনা করার বিরোধিতা বিষয়ক যুক্তিগুলোর প্রত্যুত্তর দেওয়া হচ্ছে। উপরোক্ত লিংকে প্রথম দুই অংশের প্রত্যুত্তর দেওয়া হলো।
চতুর্থতঃ মূর্তিপূজাকেই ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের সাধন মনে করিয়া লোকেরা পুরুষাকার রহিত হয় এবং বৃথা মনুষ্য জন্ম নষ্ট করে।
প্রত্যুত্তরঃ উনি এই স্থানে নিজস্ব সিদ্ধান্তকেই সকল মানবের উপর সরাসরি আরোপ করেছেন মাত্র যেমন অহিন্দুরাও অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের উপর তাদের নিজস্ব বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত আরোপ করে থাকে।
ধরুন কেউ বললো যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে রেলপথ ব্যবহার করা-ই উত্তম কারণ রাজপথে প্রায়ই বাস-ট্রাক দুর্ঘটনা হয়। উনার পরামর্শ শুনে আপনি রেলপথে গেলেন এবং আপনার রেলগাড়ী লাইনচ্যুত হয়ে আপনি ভয়ানক দুর্ঘটনায় পতিত হলেন। এতে রাস্তার কি দোষ?
আরেকটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায় অনেকেই ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে মৃন্ময়ীতে চিন্ময় সত্ত্বার মূলতত্ত্ব থেকে সড়ে গিয়ে প্রতিমায় ঈশ্বরভাবকে ত্যাগ করে অন্ধকারে পতিত হতে পারে এবং প্রতিমা পুজাকে শুধুমাত্র একটা প্রচলিত আচার হিসেবে গ্রহণ করে আরও অন্ধকারে পতিত হতে পারে কিন্তু এগুলো সর্বজনীন উদাহরণ হতে পারে না। একইভাবে এমন অনেক স্বঘোষিত নিরাকারবাদী আছেন যারা প্রকৃত ঈশরতত্ত্ব উপলব্ধি না করেই নিজেকে নিরাকারবাদী ঘোষণা দিয়ে দম্ভ ও উগ্রতায় আবদ্ধ হয়ে নিজেকে মহান জাহির করতে গিয়ে অহংকারবশত মহা অন্ধকারে পতিত হয়। অর্থাৎ উভয়ক্ষেত্রেই অন্ধকারে পতিত হওয়ার সমান সম্ভাবনা আছে।
অন্যদিকে সনাতনের হাজার বছরের ইতিহাসে সনাতনের ধ্বজাধারী বিভিন্ন মহাপুরুষদের প্রতিমা পুজা করতে দেখা গিয়েছে যেখানে তাঁদের মোক্ষপ্রাপ্তিতে তথা ব্রহ্মজ্ঞানী হওয়ার পথে কোন বাধার সৃষ্টি করে নি। এখন সনাতনী মহাপুরুষদের মোক্ষপ্রাপ্তি নিয়ে দয়ানুসারীরা যদি প্রশ্ন তুলে তবে এটাও প্রমাণিত নয় যে জীবনভর তথাকথিত নিরাকারবাদের বাজনা বাজিয়ে দয়াজ্বীর মোক্ষপ্রাপ্তি হয়েছিল!
প্রতিমা পুজা করলে মনুষ্য জন্ম নষ্ট হবে (মূর্তি পুজা করলে সে কাফে** এবং অভিশপ্ত) এই ধরনের স্ব-চিন্তিত বক্তব্য অহিন্দুদের ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দয়াজ্বি মানলেও হিন্দু সমাজ কোনকালেই গ্রহণ করে নি এবং করবেও না। এমনকি রামায়ণ, মহাভারত ও সপ্ত-সিন্ধু সভ্যতায়ও প্রতিমা পুজার উল্লেখ এবং নিদর্শন পাওয়া যায়। এগুলোকে প্রক্ষিপ্তবাদীরা প্রক্ষিপ্ত বললে সে দায় সনাতন সমাজের নয়।
সমুদ্রে অবলম্বনহীন ভাসমান কোন মানুষ যতক্ষণ না তীরের দেখা পায় ততক্ষণ সে লক্ষ্য স্থির করতে পারবে না।। অর্থাৎ লক্ষ্যবস্তুর প্রকাশ ভিন্ন লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এক্ষেত্রে দুইটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ১/ অবলম্বন ২/ প্রকাশ্যমান লক্ষ্য। দয়াজ্বীর অনুসারীরা যখন ফললাভের আশায় বর্গাকার যজ্ঞবেদিতে (সনাতনীরাও প্রতিমায় ঈশ্বরের আরাধনা করার সময় যজ্ঞবেদি প্রজ্জ্বলিত করেন) অগ্নি প্রজ্জ্বলন করে সেটা কিন্তু যজ্ঞবেদির আরাধনা নয় বরং যজ্ঞবেদিতে পরমেশ্বরেরই আরাধনা করা হয়।
পঞ্চমতঃ বিবিধ প্রকার বিরুদ্ধ স্বরূপ, নাম ও চরিত্র বিশিষ্ট মূর্ত্তিসমূহের কারণে পূজারীদিগের মতের ঐক্য নষ্ট হয়। ফলে তাহারা বিরুদ্ধ মতে চলে এবং পরস্পরের মধ্যে ভেদবৃদ্ধি সৃষ্টি করিয়া দেশের সর্বনাশ করে।
প্রত্যুত্তরঃ এটিও দয়াজ্বীর একটি অত্যন্ত স্ব-চিন্তিত মন্তব্য যা সনাতনী বৈচিত্রতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এই যুক্তিটি তিনি আব্রাহামিক মতাদর্শ হতে গ্রহণ করেছেন যেখানে ঈশ্বরের কোন শরিক নেই। কিন্তু সনাতন শাস্ত্র ও দর্শনে পরমেশ্বরে অনন্ত বিভূতির প্রকাশ রয়েছে। তিনি বিভিন্ন বিভূতিতে প্রকাশিত হয়েও অভিন্ন। শ্রীমদভগবদগীতার ১৩/১৭ শ্লোকে এটা স্পষ্টই বলা হয়েছে।।
ঋগবেদ-১/৬৪/৪৬ মন্ত্রে মহান ঋষিদের উপলব্ধি এই যে, "একং সদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি" অর্থাৎ ব্রহ্ম এক কিন্তু জ্ঞানীগণ তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন বিভূতিতে বর্ণনা করেন। তাঁর থেকেই ব্রহ্মারূপে জগতের সৃষ্টি, তাঁর দ্বারাই বিষ্ণুরূপে জগতের স্থিতি এবং তিনিই রূদ্ররূপে জগতের সংহার করেন। তিনিই স্বয়ং প্রকৃতি তথা শক্তি যাঁকে আমরা মা দুর্গা, মা কালীরূপে পুজা করি। আদিগুরু শঙ্করাচার্য, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁরা ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন বিভূতিতে একেশ্বরেরই বন্দনা করে গেছেন।
সনাতন সমাজে পঞ্চমতের (বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য) কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির মধ্যে বিরোধ থাকলেও অন্তত ৯৫ শতাংশ সনাতনী জন্মাষ্টমীর উপবাস, শিবরাত্রির মহাব্রত, দুর্গা পুজা কোন বিভেদ ছাড়াই হাজার হাজার বছর ধরে করে যাচ্ছে। পূজারীরাও সমান শ্রদ্ধায় সকল বিভূতির পুজোয় পৌরহিত্য করেন এবং এমন হাজার উদাহরণ আছে যেখানে একই মন্দিরের পরমেশ্বরের বিভিন্ন বিভূতির ভিন্ন ভিন্ন রূপের পুজো হয় কোনরূপ বিভেদ ছাড়াই।
কিছুসংখ্যক বিরোধ যদি উদাহরণ হিসেবে দাড় করানো হয় তবে তথাকথিত একক সত্ত্বার অনুসারী মতবাদগুলোর মধ্যেও নানাবিধ বিভেদ স্পষ্টত দৃশ্যমান এবং সেটা রক্তক্ষয়ীও। এমনকি দয়াজ্বী নিজের অনুসারীদের মধ্যেও পারস্পরিক বিভেদের উদাহরণ অসংখ্য দেওয়া যায়, ক্ষোদ বাংলাদেশেই গুটিকয়েক অনুসারীদের মধ্যেই ৫-৬টা বিবাদমান গ্রুপ দেখা যায়। একই গ্রন্থকে তারা ভিন্ন ভিন্ন অর্থ দিয়ে ভাষ্য ও অনুবাদ করতেও তারা অগ্রসরমান।
তাই প্রতিমা পুজার বিরোধিতা হেতু এই বালখিল্য যুক্তি যথাযথ বিশ্লেষণে ধুপে টিকে না।
ষষ্ঠতঃ মূর্ত্তিপূজার ভরসায় শত্রুর পরাজয় এবং নিজের বিজয় মনে করিয়া মূর্ত্তিপূজক নিশ্চেষ্ট থাকে।ফলে নিজের পরাজয় হইলে রাজ্য স্বাতন্ত্র্য ও ঐশ্বর্য্য সুখ-শত্রুর অধীন হয় এবং স্বয়ং পরাধীন হইয়া সবাই রক্ষকের টাট্টু এবং কুম্ভাকারের গর্দভেদ ন্যায় শত্রুর বশীভূত হইয়া বহুবিধ দুঃখ প্রাপ্ত হয়।
প্রত্যুত্তরঃ এই বালখিল্য যুক্তির আসলে কোন প্রতি যুক্তি দেওয়াই সময় নষ্ট।। শিবাজি মহারাজ, মহারানা প্রতাপ থেকে শুরু করে সদাশিব রাও বহু ক্ষত্রিয় যোদ্ধা পুরোদস্তুর প্রতিমা পুজারী ছিলেন। কলকাতা কিলিংয়ে কলকাতার হিন্দুদের জন্য ত্রাণকর্তা হয়ে ঝাপিয়ে পড়া গোপাল পাঠাও ছিলেন মা কালীর পরম ভক্ত এবং প্রতিমা পূজারী। এমন হাজারও সনাতনী যোদ্ধার উদাহরণ দেওয়া যাবে যারা প্রতিমা ও মন্দিরকে রাজ্যের মূল স্তম্ভ মনে করে মন্দির রক্ষায় জীবন বিসর্জনও দিয়েছেন আবার নরাধিমাদের বিনাশও করেছেন।। তাই কেউ ভারতের কোন এক কোণায় বসে কোন কালে কি বলে গেছেন সেটা বৃহত্তর সনাতন সমাজের বিবেচ্য নয়।।
আগামী দুই অংশে সপ্তম হতে ষোড়শতম যুক্তি পর্যন্ত প্রত্যুত্তর দেওয়া হবে।
চলবে.....

©স্টিমন অনিক।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ