সুতরাং, এই বিষয়টি পরিষ্কার করে বলা যায় যে, বানর সেনারা বিক্ষিপ্তভাবে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করেনি বরং এর পূর্বে সার্ভে করে সেতু নির্মাণের জন্য উপযুক্ত সাইট নির্বাচন করেছিল।
Initial Phase:
এই সেক্টরে আমরা দেখব সাইট নির্বাচনের পর কিভাবে বানর সেনা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করছে। প্রথমত, সেতুটি শুধু পাথর নয় বরং পাথর ও বৃক্ষ অর্থাৎ কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল।
তে নগান্ নগসংকাশাঃ শাখামৃগগণর্ষভাঃ।
বভঞ্জুঃ পাদপাংস্তত্র প্রচকর্ষুশ্চ সাগরম্।। ৫৫
তখন পর্বততুল্য বিশালাকায় বানরশ্রেষ্ঠগণ পর্বতশিখরসমূহ এবং বৃক্ষরাজি ভগ্ন করে সমুদ্রতটে টেনে আনতে লাগলেন।
শুধু তাই নয়, কোন কোন বৃক্ষ ব্যবহৃত হয়েছিল সেতু নির্মাণের কাজে তার সুনির্দিষ্ট বর্ণনা রয়েছে পরের কয়েকটি শ্লোকে।
তে সালৈশ্চাশ্বকর্ণৈশ্চ ধবৈর্বংশৈশ্চ বানরাঃ।
কুটজৈরজুনৈস্তালৈস্তিলকৈস্তিনিশৈরপি ॥ ৫৬
বিল্বকৈঃ সপ্তপর্ণৈশ্চ কর্ণিকারৈশ্চ পুষ্পিতৈঃ।
চূতৈশ্চাশোকবৃক্ষৈশ্চ সাগরং সমপূরয়ন্৷৷ ৫৭
সমূলাংশ্চ বিমূলাংশ্চ পাদপান্ হরিসত্তমাঃ।
ইন্দ্রকেতুনিবোদ্যম্য প্রজহ্রুর্বানরাস্তরূন। ৫৮
তালান্ দাড়িমগুল্মাংশ্চ নারিকেলবিভীতকান্।
করীরান্ বকুলান্ নিম্বান্ সমাজহ্রুরিতস্ততঃ৷৷ ৫৯
সেই বানরেরা শাল, অশ্বকর্ণ, ধ্বব, বাঁশ, কুটজ (কুর্চি) অর্জুন, তাল, তিলক, তিনিশ, বেল, ছাতিম, পুষ্পিত কর্ণিকা (কনক চাঁপা), আম এবং অশোক গাছ ও তাদের ডালপালাগুলি সমুদ্রতীরে আনতে লাগল। সেই বানরশ্রেষ্ঠগণ সমূলে এবং বিমূলে (মূল ব্যতীত অর্থাৎ মূলের উপরিভাগ থেকে) ইন্দ্রধ্বজতুল্য বড় বড় বৃক্ষ উৎপাটন করে আনতে লাগল। তাল, ডালিমের ঝাড়, নারকেল, বিভীতক, করীর, বকুল, নিম প্রভৃতি বৃক্ষ নানা দিক থেকে সংগ্রহ করে আনল।
বৃক্ষ ও পাথরগুলোকে বানর সেনা কিভাবে পরিবহন করে আনলো তারও উল্লেখ পাওয়া যায় পরের শ্লোকে। হস্তিমাত্রান্ মহাকায়াঃ পাষাণাংশ্চ মহাবলাঃ ।
বিশালাকার ও মহাবলশালী বানরেরা হস্তীতুল্য বড় বড় প্রস্তর খণ্ড এবং পর্বতসমূহ সমুৎপাটন করে যন্ত্রের সাহায্যে পরিবহন করছিল।
এই শ্লোক থেকে বোঝা যায় বানররা যে শুধু গায়ের জোরেই কাজ করতো তা নয়, বরং কাজের ক্ষেত্রে যান্ত্রিক মাধ্যম অবলম্বন করার চলও তাদের মধ্যে ছিল। অবশ্য ঠিক কোন কোন যন্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল তার বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা যায় প্রাথমিক অবস্থায় ভারী বস্তু পরিবহনের জন্য যেসব যন্ত্র, যেমন: কাঠ নির্মিত লিভার, ক্রেন, কপিকল, পুলি ব্যবহৃত হতো, এখানেও তারই কথা বলা হচ্ছে। বুঝার সুবিধার্থে ভার বহনকারী কিছু প্রাচীন যন্ত্রের ছবি দেওয়া হলো।
সমুদ্রং ক্ষোভয়ামাসুর্নিপতন্তঃ সমন্ততঃ।
অর্থাৎ, সেতু নির্মাণের প্রতিটি ক্ষেত্রে বানরসেনা যে ব্যবহারিক প্রকৌশল বিদ্যারই পরিচয় দিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এভাবেই প্রাথমিক প্রস্তুতি শেষ করে এবার সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
নলশ্চক্রে মহাসেতুং মধ্যে নদনদীপতেঃ।
স তদা ক্রিয়তে সেতুর্বানরৈর্ঘোরকর্মভিঃ৷৷ ৬৩
নদ-নদী সমূহের প্রভু সমুদ্রের মধ্যে নল মহাসেতু নির্মাণ করতে লাগলেন। বানরদের ভয়ানক কর্মের দ্বারা তখন সেতু নির্মাণ কার্য আরম্ভ হল।
Bridge Construction:
দণ্ডানন্যে প্রগৃহ্নন্তি বিচিন্বন্তি তথাপরে।
বানরৈঃ শতশস্তত্র রামস্যাজ্ঞাপুরঃসরৈঃ ৷৷ ৬৪
পরিমাপের জন্য কেউ দণ্ড ধারণ করল, কেউবা সামগ্রী সংগ্রহ করতে লাগল। রামচন্দ্রের আদেশানুসারে শত সহস্র বানর এই কার্যে অগ্রসর হল।
এই শ্লোকে যে বিষয়টা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় তা হল পরিমাপের জন্য বানরদের দন্ডধারণ করা। মূলত অগভীর সমুদ্রতলের কোথায় কতটুকু উঁচু বা নিচু তা পরিমাপের জন্যই এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভাষায় এই পদ্ধতিকে বলা হয় “Levelling” এবং পরিমাপক দন্ডকে বলা হয় “Graduated Staff” ।
মূলত অসমতল কোন সারফেসের এলিভেশন পরিমাপের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে অনেক আধুনিকায়নের সাথে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হলেও বহু প্রাচীন কাল থেকেই এর প্রচলন হয়ে আসছে এবং রামসেতু নির্মাণের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।
মেঘাভৈঃ পর্বতাভৈশ্চ তৃণৈঃ কাষ্ঠৈর্ববন্ধিরে।
পুষ্পিতাগ্রৈশ্চ তরুভিঃ সেতুং বধ্নন্তি বানরাঃ । ৬৫
পর্বততুল্য এবং মেঘতুল্য বানরেরা তৃণ এবং কাষ্ঠ দ্বারা সেতু বন্ধন করছিল। অগ্রভাগে পুষ্পবিশিষ্ট বৃক্ষদ্বারাও বানরেরা সেতু বন্ধন করছিল।
অর্থাৎ এখানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে বানরেরা ঘাস এবং কাঠ দিয়ে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করেছিল। তারা কিন্তু প্রথমেই সেতু নির্মাণের জন্য পাথর ব্যবহার করেনি। এর একটি বিশেষ কারণ আছে। যদি শুরুতেই তারা সরাসরি সী বেডের উপর পাথর স্থাপন করত, তাহলে পাথরের অনিয়মিত আকার, আকৃতি ও ওজনের কারণে সী বেডের উপর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম লোড আসতো। যার কারনে পাথরের নিচের মাটি ভারসাম্যহীন হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল। ফলে মাটি সরে যাওয়া বা পাথর স্থানচ্যুত হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারতো এবং ফলশ্রুতিতে সেতুটি ভেঙে যেতে পারত। এই কারণে সী বেডের উপর প্রথমে কাঠ পেতে একটি বেস তৈরি করে নেওয়া হয়েছে এবং পরবর্তীতে তার ওপর পাথরগুলো রাখা হয়েছে।
পাষাণাংশ্চ গিরিপ্রখ্যান্ গিরীণাং শিখরাণি চ।
দৃশ্যন্তে পরিধাবন্তো গৃহ্য দানবসন্নিভাঃ৷৷ ৬৬
শিলানাং ক্ষিপ্যমাণানাং শৈলানাং তত্র পাত্যতাম্।
বভূব তুমুলঃ শব্দস্তদা তস্মিন্ মহোদধৌ৷ ৬৭
পর্বতসদৃশ বিশালাকার প্রস্তর খণ্ড এবং পর্বত শিখর নিয়ে ধাবমান বানরদের দৈত্যের মতো মনে হচ্ছিল। তখন সেই মহাসমুদ্রে নিক্ষিপ্ত শিলা এবং পর্বতচূড়া সমূহের দ্বারা তুমুল শব্দ সৃষ্টি হল।
অর্থাৎ, কাঠের বেস তৈরি করা সম্পন্ন হলে এরপর বানরসেনারা শিলা এবং পাথরখন্ড এনে তার উপর স্থাপন করা শুরু করে। এভাবেই সুচারু পরিকল্পনা ও ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতার সাথে নির্মিত হয় ঐতিহাসিক রামসেতু।
Dimensions of the Bridge:
দশযোজনবিস্তীর্ণং শতযোজনমায়তম্
দদৃশুদেবগন্ধর্বা নলসেতুং সুদুষ্করম্।। ৭৬
নল কর্তৃক নির্মিত দশযোজন প্রস্থ এবং শতযোজন দীর্ঘ এই সুদুষ্কর সেতু (সেতুটির নির্মাণ কার্য অতি দুরূহ) দেবতা ও গন্ধর্বগণ দর্শন করলেন।
এছাড়াও বানরসেনা কোনদিন সেতুর কতটুকু দূরত্ব নির্মাণ করেছিল তারও উল্লেখ পাওয়া যায় পূর্ববর্তী শ্লোকে। প্রথম দিন ১৪ যোজন, দ্বিতীয় দিন ২০ যোজন, তৃতীয় দিন ২১ যোজন, চতুর্থ দিন ২২ যোজন এবং পঞ্চম দিন ২৩ যোজন সেতু নির্মিত হয়। এভাবে বানর সেনা পাঁচ দিনে সম্পূর্ণ সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করে।
বাল্মিকী রামায়ণ ছাড়াও স্কন্ধ পুরাণ সহ বিভিন্ন গ্রন্থেও উল্লেখ পাওয়া যায় যে, রাম সেতু ১০০ যোজন দীর্ঘ ও ১০ যোজন প্রশস্থ ছিল। তবে এখানে কারো কারো মনে সংশয় কাজ করে কারণ বর্তমান সেতুর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ পরিমাপ করলে একটি ভিন্ন মান পাওয়া যায়।
এর মূল কারণ হলো যোজন এককের পরিবর্তনশীলতা। ১ কিলোমিটার = ১০০০ মিটার যেমন সুনির্ধারিত, সেরকম যোজনের কোনো সুনির্ধারিত মান পাওয়া যায়না। বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন সময়ে যোজনের মানের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। যোজনের যেই মান ধরে বানরসেনা সেতু নির্মাণ করেছিলো বা বাল্মিকী রামায়ণে যোজনের যেই মান ধরা হয়েছে, তার সাথে বর্তমান দিনের যোজনের হিসাবে বিশাল তফাৎ থাকতে পারে ।
এজন্য গবেষকগণ সরাসরি দৈর্ঘ্য প্রস্থের মান হিসেবে চেয়ে এর অনুপাতের দিকে বেশি লক্ষ্য দিয়েছেন। কারণ একক ভেদে দৈর্ঘ্য প্রস্থের মান পরিবর্তিত হলেও সকল এককে এর অনুপাত সবসময় সমান থাকে।
রাম সেতুর দৈর্ঘ্য ছিল ১০০ যোজন এবং প্রস্থ ছিল ১০ যোজন। অর্থাৎ এর দৈর্ঘ্য প্রস্থের অনুপাত ১০:১।
আবার, বর্তমানে রাম সেতুর দৈর্ঘ্য পরিমাপ করা হয়েছে ৩৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ পাওয়া গিয়েছে ৩.৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ, এক্ষেত্রেও দৈর্ঘ্য প্রস্থের অনুপাত ১০:১।
এভাবেই রাম সেতুর পরিমাপ নিয়ে সৃষ্ট সংশয়ের নিরসন করা হয়।
© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
সনাতনী শাস্ত্র ও দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর।।
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)
0 মন্তব্যসমূহ