শ্রীরামচন্দ্রের রাজত্বকাল কত বছর? ১১,০০০ বছর নাকি ৩০ বছর?

 


শ্রীরামচন্দ্রের রাজত্বকাল ১১,০০ বছর! অতিরঞ্জিত নাকি সঠিক! মীমাংসা কি?
রামায়ণে আমরা দেখি শ্রীরামচন্দ্রের রাজত্বকাল ১১,০০০ বছর উল্লেখ রয়েছে বাল্মিকী রামায়ণের আদিকাণ্ডের ১ম সর্গের ৯৭নং শ্লোকে।
"দশবর্ষ সহস্রাণি দশবর্ষ শতানি চ।
রামোরাজ্যমুপাসিত্বা ব্রহ্মলোকং প্রযাস্যতি।।"
এখানে সংস্কৃততে আছে দশবর্ষ সহস্রানি, দশবর্ষ শতানি .. অর্থাৎ ১০,০০০ এবং ১,০০০ যোগে ১১,০০০ বছর। খেয়াল করে দেখুন মহাকবি বাল্মিকী সরাসরি একাদশবর্ষ সহস্রনি লিখলেও তো পারতেন কিন্তু তিনি কাব্যের ছন্দ ও রূপক অর্থে ভেঙে লিখেছেন। যাইহোক এই দীর্ঘ সময় শ্রীরামচন্দ্রের রাজত্ব করা কি বাস্তবসম্মত! তাহলে এই ১১,০০০ বছর রাজত্বকালের মীমাংসা কি?
প্রাচীন পুরাণশাস্ত্রসমূহে আমরা বিভিন্ন মুনিঋষি ও অসুরদের হাজার হাজার বছর ধরে তপস্যার উল্লেখ পাই। এই হাজার হাজার বছরের উল্লেখ কি অতিরঞ্জিত নাকি শাস্ত্রেই রয়েছে এর মীমাংসা? মহর্ষি জৈমিনীর পূর্ব মীমাংসায় সবরস্বামীকৃত ভাষ্যে মীমাংসা সূত্র ৬/৩/১৩/৩১-৪০ বিশ্লেষণ করলে সহস্র সংবৎসরের (হাজার বছর) একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায় যা শ্রীরামচন্দ্রের ১১,০০০ বছর রাজত্বকালের সমাধান করতে পারে।

মীমাংসার সন্ধানেঃ
শ্রুতিতে হাজার বছরব্যাপী (বিশ্বসৃজাময়ং সহস্রসম্বৎসরম্....) যজ্ঞের উল্লেখ রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো হাজার বছর ত মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয় তাহলে এর মীমাংসা কি! শ্রুতিবাক্য ত মিথ্যা হতে পারে না। মহর্ষি জৈমিনীর পূর্ব মীমাংসায় মীমাংসা সূত্র ৬/৩/১৩/৩১-৪০ এ এর সমাধান রয়েছে।
মীমাংসা সূত্রে (৬/৩/১৩/৩১) এক পক্ষ বলছে, "সহস্রসম্বৎসরং তদায়ুষামসম্ভবান্মনুষ্যেষু।।" অর্থাৎ সহস্র বছরব্যাপী যজ্ঞ 'তদায়ুষাম্' তথা সহস্র আয়ুযুক্ত ব্যক্তির পক্ষেই বিহিত কিন্তু 'মনুষ্যেষু অসম্ভাৎ' তথা মনুষ্যলোকে তা অসম্ভব। তাহলে এই যজ্ঞ মনুষ্যগণের নয় বরং গন্ধর্বগণের অধিকারে।
তখন আরেকপক্ষ এর প্রতিবাদ করে বলেন এই শাস্ত্রসমূহ মনুষ্যদের জন্য তথা "মনুষ্যধর্মঃ সৎ" তাই "তদধিকারৎ" অর্থাৎ এই যজ্ঞে মনুষ্যেরই অধিকার। হতে পারে রসায়নাদি সেবনে যে দীর্ঘায়ু লাভ করবে সে এই যজ্ঞ করবে।
তখন অন্যপক্ষ তা খণ্ডন করে বলছে "নাসামর্থাৎ" তথা রসায়নের এই সামর্থ্য নেই। রস তথা রসায়ন মনুষ্যের জন্য আরোগ্য বা পুষ্টি আনতে পারে কিন্তু দীর্ঘায়ু প্রদান করতে পারে না।
তখন আরেকপক্ষ বলছে যেহেতু শ্রুতিতে রয়েছে "শতায়ুর্বৈ পুরুষঃ" অর্থাৎ এক ব্যক্তির শতায়ু হতে পারে কিন্তু সহস্র নয় তাই এই যজ্ঞ কুলকল্প তথা আরম্ভকারীর পুত্র-পৌত্রাদি বংশানুক্রমে কৃত্য হবে।
এবার এই মতের খণ্ডন করে আরেকপক্ষ বলছে, যেহেতু যজ্ঞের ফলে এক ব্যক্তিরই ফলপ্রাপ্তি ঘটবে অর্থাৎ যিনি কর্ম আরম্ভ করে তিনিই শেষ করবেন তিনিই ফললাভ করবেন তাই এই যজ্ঞে কুলকল্প হতে পারে না। তাই উক্ত কর্মের অনুষ্ঠান "একস্যৈব স্যাৎ" অর্থাৎ একজনেরই কর্তব্য৷
অতঃপর নানান পক্ষ নানান যুক্তি মীমাংসা উপস্থিত করতে থাকলে এক পক্ষ বলছে "সম্বৎসরো বিচালিত্বাৎ" অর্থাৎ সম্বৎসর শব্দটি গুণী এবং এখানে তা লক্ষণা করতে হবে। "সম্বৎসর" শব্দটি স্বাবয়ভূত দিবসে লাক্ষণিক তাই সহস্রসম্বৎসর অর্থ সহস্র দিন হবে। এটা বলার পেছনে কারণও আছে।

শ্রুতিমধ্যে একদিনের পরিমাপক সূর্যকে একদিনেই ছয় ঋতু অর্থাৎ তদাত্মক সম্বৎসর সম্পাদনকারী বলা হয়েছে। এখন সম্বৎসরেও যেহেতু ছয় ঋতু রয়েছে এবং একদিনেও ছয় ঋতু হচ্ছে তাই লক্ষণার্থে সহস্রসম্বৎসর অর্থ সহস্র দিন হবে। ইহাই পূর্ব মীমাংসা দর্শনে মীমাংসকগণের চুড়ান্ত মীমাংসা।
সহস্রসম্বৎসরের সমাধান ষড় বেদাঙ্গের অন্যতম কাত্যায়ন শ্রৌত সূত্রেও পাওয়া যায়। কাত্যায়ন শ্রৌত সূত্রের ১/১৬/২৬ সুত্রে (শ্রুতিসামর্থ্যাৎ) বলা হয়েছে মানুষের আয়ু সহস্র বছর হতে পারে না তাই সহস্রসম্বৎসর অর্থ সহস্র দিন। শ্রুতি বলছে, "অহর্বৈ সম্বৎসরঃ" অর্থাৎ ১ দিন = ১ বছর।
অর্থাৎ বাল্মিকী রামায়ণেও শ্রীরামচন্দ্রের রাজত্বকাল মূলত ১১,০০০ বছর নয় বরং ১১,০০০ দিবস যা প্রায় ৩০ বছরের সমতুল্য সময়কাল।
শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি যিনি পরস্পর সম্পর্কিত সমস্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন, তিনিই প্রকৃত অর্থে শাস্ত্রবাক্য বুঝতে পারেন। তাই যখনই কোন শাস্ত্র সিদ্ধান্তে সংশয় উৎপন্ন হবে তখনই অন্যান্য শাস্ত্রে তার সমাধান খুঁজতে হবে। এর ইংগিত আমরা পাই শুক্রনীতিতে। শুক্রনীতির ৩য় অধ্যায়ের ১৩৪নং শ্লোকে বলা হচ্ছে, "আমি শাস্ত্রের মর্ম জানি! এই মনে করে অহংকার প্রকাশ করে ধর্মের প্রতি অন্ধ হওয়া উচিত নয় যেহেতু যথার্থ ধর্ম ও কর্ম একটি শাস্ত্রের অধ্যয়নে জানা যায় না।"
পরের শ্লোকেই (১৩৫নং) বলা হচ্ছে,
"নানাপ্রকার শাস্ত্র অধ্যয়ন করলেই সে ব্যক্তি যথার্থ তত্ত্বদর্শী হয় এবং বুদ্ধিমান ব্যাক্তি সর্বদা বহুবিধ শাস্ত্রের (বহুশাস্ত্রাণ্যতন্দ্রিতঃ....) অধ্যয়ন করে সিদ্ধান্তে উপনীত হন।"

এই যে রাজত্বের দীর্ঘ সময়কালের উপস্থাপন তা কি শুধু রামায়ণেই আছে!
না, সুমেরীয় সভ্যতায়ও একজন রাজার নাম পাওয়া যায় যিনি প্রায় ২৮,৮০০ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তিনি ছিলেন মেসোপোটেমিয়ার প্রথম সম্রাট Alulim বা A-lu-lu. তার পরবর্তীতে Alalgar নামক আরেক সম্রাট প্রায় ৩৬,০০০ বছর রাজত্ব করেন। (Ref. kartz 2003, P-118)
ব্রিটিশ ফিলুলজিস্ট ইরভিং ফিংকেলের মতে সে সময়কাল ৩৬,২০০ বছর বা ৬৭,২০০ বছর। (Ref. Finkel 1989, p.71) আরেকজন রাজা ছিলেন ধুমুজিদ, দ্যা শ্যাপার্ড। তিনি রাজত্ব করেছেন প্রায় ৩৬,০০০ বছর। এই সময়কালগুলো আজকের সৌর বছরের মতো নয়। সে সময় তাদেরও একটি বিশেষ একক ছিলো যেমন সার্স/sars মানে হলো units of 3,600 years, নার্স/ners মানে হলো units of 600 years. তাহলে রাজা আলুমিমের রাজত্বকাল হচ্ছে ৮ সার্স/sars, এলাল্গারের রাজত্বকাল হচ্ছে ১০ সার্স/sara। অর্থাৎ তারা সেসময় বছর গণনার ক্ষেত্রে বিশেষ কোন ইউনিট ব্যবহার করতেন যেমন রামায়ণের সময় ব্যবহার করা হতো নক্ষত্রবছর। এক নক্ষত্রবছরে এক সৌরদিন।
তাহলে সকল শাস্ত্র ও তুলনামূলক ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা বলতে পারি ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের রাজত্বকাল ছিলো মূলত ১,০০০ সৌরদিন তথা ৩০ সৌরবছর।

তথ্যসূত্রঃ বাল্মিকী রামায়ণ, মীমাংশা দর্শনম্, কাত্যায়ন শ্রৌত সূত্র, শুক্রনীতি, উইকিপিডিয়া, ফেসবুক।

© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
🖋️ শ্রী অনিক কুমার সাহা


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ