সনাতন মাহাত্ম্য ।। তর্পণ ও পিণ্ডদান।।

তর্পণ ও পিণ্ডদানের মাহাত্ম্য হলো সনাতন শাস্ত্রের চিরন্তন সর্বজনীন রূপের প্রতিফলন। সনাতন সংস্কার ও সংস্কৃতির এক অভিনব ও উদার আচার হচ্ছে তর্পণ ও পিণ্ডদান। যদিও আজকাল তথাকথিত পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির আলোকে আলোকিত হয়ে সনাতন সমাজের অনেকেই শ্রাদ্ধ-তর্পণ-পিণ্ডাদি কার্য্যকে কুসংস্কার ভেবে নাসিকা কুঞ্চিত করেন। "মরা গরু কি ঘাস খায়? মৃত পিতৃ-পুরুষদের উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধপিণ্ডাদি শুধু অর্থ ও অন্নের অপচয়!" এই হচ্ছে তাদের মনোভাব। তাহলে ত যজ্ঞাদি ক্রিয়ায় ঈশ্বর আরাধনারও প্রয়োজন নেই, গুহামানব হয়ে কেবল কাঁচা মাংস খেলেও জীবন কেটে যাবে।

এই যে শ্রাদ্ধ-তর্পণ-পিণ্ডদান বিধি, এর মাধ্যমে পিতৃ-মাতৃকুলের পূর্বজগণের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি-কৃতজ্ঞতা নিবেদনপূর্বক ঋণ স্বীকার ও ঋণ পরিশোধের সূত্রে পরম্পরাগত সংস্কৃতিধারা সর্বদা হৃদয়ে জাগ্রত থাকে। ফলে পিতৃ-মাতৃভূমি, পিতৃ-মাতৃভাষা, পিতৃ-মাতৃসংস্কৃতি এই তিনের প্রতি আনুগত্য ও অনুরক্তি সকলের প্রাণে উজ্জ্বল হয়ে জাগ্রত থাকে। এর কারণে বিজাতীয় ভাব ও আদর্শের মোহ আমাদেরকে কদাপি পথভ্রষ্ট করতে পারে না বরং ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতীয়তার প্রতি নিষ্ঠা সুদৃঢ় হয়। 

তাছাড়া তর্পণ ও পিণ্ডদান বিধির মাধ্যমে এটাও প্রতিষ্ঠিত হয় যে সনাতন সংস্কারগুলো সর্বজনীন ও সর্বকল্যাণকামী। মহালয়ায় ও বিভিন্ন তিথিতে যে পিতৃ তর্পণের আয়োজন হয়, অনেকে মনে করেন এই পিতৃ তর্পণ হয়তো কেবল পরলোকগত পিতার উদ্দেশ্যে তর্পণ। কিন্তু তর্পণের যে মন্ত্র তাতে স্পষ্ট হয় যে, সকল পরলোকগত জীবের উদ্দেশ্যেই এই তর্পণ। 

বিষ্ণুপুরাণের (৩.১১.৩৫) একটি শ্লোকে রয়েছে, 

"ওঁ নমঃ যেহবান্ধবা বান্ধবা বা যেহন্যজন্মনি বান্ধবাঃ।
তে তৃপ্তি মখিলাং যাত্ত যে চাম্মৎ তোয়কাক্ষিণঃ।।

অনুবাদঃ যাঁরা বন্ধু নয় বা যাঁরা বন্ধু কিংবা যাঁরা অন্য জন্মে বন্ধু ছিলেন এবং যাঁরা আমাদের জল প্রত্যাশা করেন, তাঁরা সকলেই আমার প্রদত্ত জল দ্বারা সর্বপ্রকার তৃপ্তি লাভ করুন।

এছাড়াও বায়ুপুরানের (১১০/৬৪) একটি শ্লোকে আছে, 

"আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তং যৎকিঞ্চিৎ সচরাচরম্।
ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্তিমায়াশ্চ সর্ব্বশঃ।।"

অনুবাদঃ ব্রহ্মা হতে স্তম্ব পর্যন্ত যা কিছু চরাচর পদার্থ আছে, মৎপ্রদত্ত (আমার দেওয়া) জল দ্বারা তারা পরিতৃপ্ত হোক।

উপরোক্ত তর্পণ মন্ত্রগুলোতে এটা স্পষ্ট হয় যে সনাতন ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতিতে সকল জীব ও সম্প্রদায়ের প্রতি সমদর্শী ভাব প্রকাশ পায় এবং প্রতিষ্ঠিত হয় যে আমাদের ধর্মের সংস্কারগুলো সকল জীবের কল্যাণার্থে। 

আমাদের পিণ্ডদানের বিধিতেও এমন সর্বজনীন ভাবটা ফুটে উঠে। 

বায়ুপুরাণের (১১০/৪৮) একটি শ্লোকে পিণ্ডদানের সাথে সংশ্লিষ্ট একটা শ্লোকে রয়েছে, 

"জাত্যন্তরেসহস্রেষু ভ্রমন্তঃ স্বেন কর্মণা।
মানুষ্যং দুর্লভং যেষাং তেভ্যঃ পিণ্ডং দদাম্যহম্।।"

অর্থাৎ, নিজ নিজ কর্ম দ্বারা যারা অন্য সহস্র জাতিতে ভ্রমণ করিতেছেন এবং মনুষ্যজন্ম যাদের নিকট দুর্লভ, তাদের উদ্দেশ্যে এই পিণ্ডদান করলাম।

এছাড়াও মনুষ্যকুলে যারা জন্ম নিয়েছেন যেমন মাতৃকুলে, অস্মৎকুলে, মাতামহকুলে, বন্ধুবর্গকুলে যারাই মৃত্যবরণ করেছে প্রত্যেকের উদ্দেশ্যেই দেওয়া হয় পিণ্ডদান। এছাড়াও অগ্নিদগ্ধ হয়ে, দাবানলে বা জলে ডুবে নাম-পরিচয়হীন যারা মারা গেছেন প্রত্যেকের উদ্দেশ্যেই দেওয়া হয় পিণ্ডদান। এমনকি পশুপাখি কুলে, কীটপতঙ্গ কুলে জন্ম নেওয়া সকল জীব এবং গৃহপালিত পশুপাখির জন্যও মৃত্যু পরবর্তী পিণ্ডদান বিধেয়। এছাড়াও "যে যে কুলে লুপ্তপিণ্ডাঃ পুত্রদারবিবর্জ্জিতা" তাদের জন্যও পিণ্ডদান করা হয়। অর্থাৎ এই জগৎ ও জগতের বাইরে সকল জীবের জন্যই প্রত্যক্ষভাবে তর্পণ ও পিণ্ডদান দেওয়া হচ্ছে। 

তর্পণ ও পিণ্ডদান নিয়ে অসাধারণ মাহাত্ম্যপূর্ণ কিছু শ্লোক পাওয়া যায় গরুড় পুরাণের উত্তর খণ্ডের ২৬তম অধ্যায় এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৯৬তম অধ্যায়ে এছাড়াও অথর্ববেদ সংহিতার অষ্টাদশ কাণ্ডের ৪র্থ সুক্তের অনেক মন্ত্রে (৭১-৮৮) দেখা যায় পিতা-মাতা, পিতামহ, যম এবং শেষে পিতৃগণের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং খাবার দানের কথা বলছে। পিতৃ বলতে যারা এখন পৃথিবীতে আছেন বা যারা একসময় ছিলেন সবাইকে বুঝিয়েছে। 

তর্পণ ও পিণ্ডদান যে কেবল মৃত জীবের জন্য বা তাদের কাছে সরাসরি জল ও খাদ্য পৌছে দেওয়ার জন্য তা কিন্তু নয়। বায়ুপুরাণের (৮৩/১১৯-১২০) দুইটি শ্লোকে তা স্পষ্ট,

"পিতৃগণ শত শত যোনি প্রাপ্ত হলেও নাম, গোত্র ও মন্ত্রের প্রভাবে তাঁদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত পিণ্ড তৃপ্তির আকারে তাঁদের নিকট গিয়ে উপস্থিত হয়।"

অর্থাৎ আমাদের হাজার হাজার জন্মের পূর্ব পুরুষরা মৃত্যুর পর নিজ নিজ কর্ম অনুসারে যে যে যোনিতে জন্ম নিয়েছেন বা যে ধর্মেরই অনুসারী হয়েছেন আমাদের দেওয়া তর্পণ ও পিণ্ড তাদের জন্য তৃপ্তি হয়ে পৌছে যাচ্ছে যা তাদের সুখের এক অপার্থিব অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। আমরা প্রায়শই কোন কারণ ছাড়াই অদ্ভুৎ ভালো লাগার অনুভূতি প্রাপ্ত করি যা হয়তো আমাদের কুলের কোন না কোন সনাতনীর তর্পণ ও মন্ত্রেরই প্রভাব। এই ধারণা আরও দৃঢ় হয় অথর্ববেদ সংহিতার (১৮/২/৩/১) একটি চমৎকার মন্ত্র থেকে। মন্ত্রে বলা হচ্ছে,

"হে প্রেত পুরুষ! তোমাদের উদ্দেশ্যে বিশেষ ক্রিয়াকর্ম আয়োজনে তোমাদের মনকে আমাদের মনের সাথে যুক্ত করে এই লোকে আহবান করছি, তোমরা প্রীত হয়ে আসো। পিতৃলোকে গমনপথে সুখকর বায়ু দ্বারা তোমাদের পথকে প্রশান্তিময় করুক।"

অনেকে প্রশ্ন করে যারা সনাতন ছাড়া অন্য ধর্মে জন্মগ্রহণ করে তাদের তো তর্পণ, পিণ্ড ও শ্রাদ্ধ ইত্যাদি হয়না। তাহলে তাদের পারলৌকিক শান্তি কীভাবে হয়ে থাকে? আশাকরি উপরের আলোচনায় এই প্রশ্নেরও স্পষ্ট জবাব রয়েছে কারণ আমাদের দেওয়া তর্পণ ও পিণ্ড এই জগতের এমনকি জগতের বাইরেরও সকল জীবের জন্য।

এতো সুন্দর সংস্কার ও সংস্কৃতিকে গর্বের সাথে প্রচার করুন। বরং যারা এগুলোকে কুসংস্কার বলে প্রচার করে তাদের সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন তুলুন এবং তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন, যে সংস্কারে এতো চমৎকার অন্তর্নিহিত ভাবনার প্রকাশ ঘটে, শুভত্বের বার্তা বহন করে সে সংস্কার কিভাবে কুসংস্কার হয়!

© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
সনাতনী শাস্ত্র ও দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর।।
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ