বানপ্রস্থ আশ্রমের শাস্ত্রীয় ভিত্তি।।


 “বানপ্রস্থ আশ্রমের শাস্ত্রীয় ভিত্তি”

                                               প্রফেসর ড. রাকেশ দাশ
                                          বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়, বেলুর মঠ

যে কোন সমাজের সর্বাঙ্গীণ উৎকর্ষ সাধনের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিভূমি বর্ণাশ্রম ধর্মের যথাযথ পালন। হিন্দু সমাজ এই সত্য সর্বপ্রথম অনুভব করে এবং ব্যষ্টি ও সমষ্টির সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য চতুরাশ্রমে জীবনকে সুবিন্যস্ত করে। এই চার আশ্রমের তৃতীয় ও চতুর্থ আশ্রম বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। কোন হিন্দুই বানপ্রস্থ বা সন্ন্যাসকে অস্বীকার করতে পারে না।
বানপ্রস্থ বা সন্ন্যাসের যথেষ্ট প্রমাণ শাস্ত্রে রয়েছে। বানপ্রস্থ শব্দের শাব্দিক অর্থ যিনি বনে প্রস্থান করেন। ধর্মশাস্ত্রে বানপ্রস্থ শব্দের তাৎপর্য হল গার্হস্থ্য আশ্রমে নিজ কর্তব্য সমাপ্ত করে বৈরাগ্যের দৃঢ়তা সম্পাদনের উদ্দেশ্যে বনে গমন করেন এবং সেখানে অগ্নিহোত্রাদি নিত্য ক্রিয়া, উপাসনা এবং ভিক্ষান্নে জীবন ধারণ করবেন। চতুরাশ্রম এবং তার বানপ্রস্থ ব্রাহ্মণ, উপনিষদ্, বেদাঙ্গ, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ ইত্যাদি গ্রন্থে স্পষ্ট উল্লিখিত হয়েছে।
আপস্তম্ব ধর্মসূত্রের নবম পটলের প্রথম সূত্র– চত্বার আশ্রমা গার্হস্থ্যম্ আচার্যকুলং মৌনং বানপ্রস্থ্যম্ ইতি। (আশ্রম চারটি– গার্হস্থ্য, আচার্যকুল, মৌন, বানপ্রস্থ।) দ্রষ্টব্য, এখানে সন্ন্যাসের পর্যায় স্বরূপ মৌন শব্দের প্রয়োগ করা হয়েছে। এখানেই বানপ্রস্থীর কর্তব্য অকর্তব্যেরও বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে।
এতদ্ব্যতীত কৃষ্ণযজুর্বেদ সম্বদ্ধ হিরণ্যকেশিশ্রৌতসূত্র, বৈখানসধর্মসূত্র, বৈখানসগৃহ্যসূত্র, বোধায়নধর্মসূত্র এবং ভারদ্বাজশ্রৌতসূত্রেও বানপ্রস্থাশ্রমের বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়।
কূর্মপুরাণে পূর্বভাগে তৃতীয় অধ্যায়ে কূর্ম রূপধারী ভগবান্ নারায়ণ চার আশ্রমের বর্ণনা করেছেন। সেখানে তিনি সাক্ষাৎ বানপ্রস্থ শব্দের প্রয়োগ করেছেন–
ব্রহ্মচারী গৃহস্থস্চ বানপ্রস্থো যতিস্তথা।
ক্রমেণৈবাশ্রমাঃ প্রোক্তাঃ কারুণ্যাদ্ অন্যথা নহি॥
এছাড়াও একই ধরণের বর্ণনা মৎস্যপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ, বামনপুরাণ, বায়ুপুরাণ বা শিবপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, অগ্নিপুরাণ, নারদপুরাণ, পদ্মপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ, স্কন্দপুরাণ প্রভৃতি মহাপুরাণ ও উপপুরাণেও পাওয়া যায়। রামায়ণ ও মহাভারতেও সাক্ষাৎ বানপ্রস্থ শব্দ বহুবার প্রযুক্ত হয়েছে।
মনুস্মৃতিতে ভগবান্ মনু বলেছেন–
ব্রহ্মচারী গৃহস্থশ্চ বানপ্রস্থো যতিস্তথা।
এতে গৃহস্থপ্রভবাশ্চত্বারঃ পৃথগাশ্রমাঃ॥ (৬/৮৭)
বানপ্রস্থ আশ্রমের বর্ণনায় তিনি বলেছেন–
এবং গৃহাশ্রমে স্থিত্বা বিধিবৎ স্নাতকো দ্বিজঃ।
বনে বসেৎ তু নিয়তো যথাবদ্ বিজিতেন্দ্রিয়ঃ॥
গৃহস্থস্তু যদা পশ্যেদ্ বলীপলিতম্ আত্মনঃ।
অপত্যস্যৈব চাপত্যং তদারণ্যং সমাশ্রয়েৎ॥
সন্ত্যজ্য গ্রাম্যম্ আহারং সর্বং চৈব পরিচ্ছদম্।
পুত্রেষু ভার্যাং নিক্ষিপ্য বনং গচ্ছেৎ সহৈব বা॥ (৬/১-৩)
স্নাতক গৃহস্থাশ্রমের পরে জিতেন্দ্রিয় হয়ে বনে বাস করবে। গৃহস্থ যখন নিজের চর্মের শিথিলতা ও কেশের পক্বতা উপলব্ধি করবেন, এবং পৌত্রের মুখদর্শন করবেন তখন অরণ্যে বাস করা শুরু করবেন। গ্রাম্য আহার ও গ্রাম্য বসন পরিত্যাগ করে পুত্রের স্কন্ধে পত্নীর দায়িত্ব অর্পণ করে অথবা পত্নীর ইচ্ছা অনুসারে পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে বনে গমন করবেন।
এর পরে বানপ্রস্থের কর্তব্য অকর্তব্য বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিতে বলা হয়েছে–
সুতবিন্যস্তপত্নীকস্তয়া বানুগতো বনম্।
বানপ্রস্থো ব্রহ্মচারী সাগ্নিঃ সোপাসনো ব্রজেৎ॥
পত্নীর দায়িত্ব পুত্রের উপর অর্পণ করে কিংবা পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে অগ্নি (অগ্নিহোত্রের উপযুক্ত আধেয় অগ্নি) এবং উপাসনা সহিত বানপ্রস্থী (অরণ্যে) গমন করবে। (প্রায়শ্চিত্তাধ্যায় ৩/৪৫)
এখন কথা হল যে, বেদে (মন্ত্র, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, শ্রৌত উপনিষদ্) কোথাওই বানপ্রস্থ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায় না। কোথাও কোথাও অত্যন্ত সূক্ষ্ম সূত্রাকারে কিছু সূচনা পাওয়া গেলেও নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, বানপ্রস্থ নামক তৃতীয় আশ্রমটিকে কোন ভাবেই বেদের মন্ত্র দ্বারা সিদ্ধ করা সম্ভব নয়। তার জন্য আমাদের বেদাঙ্গ সহ নানাবিধ বেদানুকূল শাস্ত্রের শরণাপন্ন হতেই হবে।
বেদ (সংহিতা ব্যতিরিক্ত) সহ সমস্ত শাস্ত্র গ্রন্থের নিন্দায় দিনাতিপাত করা কিছু কিছু অর্বাচীন দাবি করে থাকে যে, বৈদিক সংহিতাতেই বানপ্রস্থ পাওয়া যায়। তারা যে সমস্ত মন্ত্রকে প্রমাণ রূপে উপস্থাপন করে থাকে সেগুলি এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।
মুনয়ো বাতরশনাঃ পিশঙ্গা বসতে মলা।
বাতস্যানু ধ্রাজিং যন্তি যদ্দেবাসো অবিক্ষত॥
                                                         (ঋগ্বেদ ১০ম মণ্ডল, ১৩৬ তম সূক্ত, দ্বিতীয় মন্ত্র)
প্রতিপদার্থ– বাতরশনাঃ (বাতরশন নামক) মুনয়ঃ (মুনিগণ) পিশঙ্গাঃ (কপিলবর্ণ বিশিষ্ট) মলাঃ (মলিন) বসতে (আচ্ছাদিত করেন)। যৎ (যেহেতু) বাতস্য (বায়ুর) ধ্রাজিম্ অনু (গতিকে অনুসরণ করেছিলেন) [সেই হেতু] দেবাসঃ (দেবতা) যন্তি (হয়ে গিয়েছিলেন)
অনুবাদ– বাতরশন নামক ঋষিগণ মুনিগণ কপিলবর্ণের মলিন বসন ধারণ করে তপস্যার মহিমায় দীপ্তিমান হয়ে দেবতার স্বরূপ প্রাপ্ত করেছিলেন। তাঁরা প্রাণের উপাসনার মাধ্যমে প্রাণরূপী বায়ুর গতিকে প্রাপ্ত করেছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা বায়ুদেবতার আরাধনার মাধ্যমে বায়ুদেবতার সাযুজ্য লাভ করেছিলেন।
বিশেষ– বাতরশন শব্দ একটি নির্দিষ্ট ঋষিগোষ্ঠীর বাচক। (দ্র. তৈত্তিরীয় আরণ্যক, প্রথম প্রপাঠক, বিংশ অনুবাকের ভট্টভাস্কর কৃত ভাষ্য, মহামহোপাধ্যায় সায়ণাচার্য কৃত ভাষ্য) জূতি, বাতজূতি, বিপ্রজূতি, বৃষাণক, করিক্রত, এতশ, ঋষ্যশৃঙ্গ– এই ঋষিরা বাতরশন নামে খ্যাত।
ব্রহ্মমুনি পরিব্রাজক কৃত ভাষ্যানুসারে অর্থ– বায়ুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পীতবর্ণ বা সোনালি মননীয় গ্রহপিণ্ড সমূহ বায়ুর বেগকে অনুসরণ করে কৃষ্ণবর্ণ অন্ধকারকে আচ্ছাদন করে। সেই গ্রহসমূহ আকাশমণ্ডলে প্রবেশ করে।
Dr. Tulsi Ram কৃত ইংরেজি অনুবাদ– Self-energised objects of space controlled by cosmic energy wear a dull yellow vestment and they follow the currents of cosmic energy when rays of the sun touch and affect their behaviour. (Sages harmoniously self-controlled in tune with the currents of cosmic energy wear a soothing vestment of yellow hue, and when their senses become totally internalised, they identify their being with the cosmic energy of divinity.)
অন্তরিক্ষেণ পততি বিশ্বা রূপাবচাকশৎ।
মুনির্দেবস্যদেবস্য সৌকৃত্যায় সখা হিতঃ॥
                                              (ঋগ্বেদ ১০ম মণ্ডল, ১৩৬ তম সূক্ত, চতুর্থ মন্ত্র)
প্রতিপদার্থ– মুনি (এই ঋচার দ্রষ্টা ঋষি বৃষাণক) বিশ্বা রূপা (সমস্ত রূপবিশিষ্ট পদার্থসকলকে) অবচাকশৎ (নিজ তেজে প্রকাশিত করে) অন্তরিক্ষেণ (আকাশমার্গে) পততি (গমন করেন)। দেবস্য দেবস্য (সমস্ত দেবতাদের) সখা (বন্ধু হয়ে) সৌকৃত্যায় (যজ্ঞাদি সৎকর্মের সম্যক্ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে) হিতঃ (স্থিত হন)।
অনুবাদ– এই ঋচার দ্রষ্টা বৃষাণক ঋষি সমস্ত রূপবিশিষ্ট পদার্থকে নিজ তেজে প্রকাশিত করে আকাশমার্গে গমন করেন। তিনি সমস্ত দেবতাদের বন্ধু হয়ে যজ্ঞাদি সৎকর্মের সুষ্ঠু অনুষ্ঠানের জন্য অবস্থিত থাকেন। অর্থাৎ যজ্ঞস্থানে উপস্থিত হয়ে হবির্বহনাদির দ্বারা দেবতাদের সাহায্য করেন।
ব্রহ্মমুনি পরিব্রাজক কৃত অর্থ– সূর্যকে আকাশে পাওয়া যায়। সে সমস্ত গ্রহকে প্রকাশিত করে। তাদের গতি প্রদান করে সূর্য তাদের বন্ধু হয়েছে।
Dr. Tulsi Ram কৃত ইংরেজি অনুবাদ– The sun which is an object of meditative realisation flies through space, illuminating and watching the forms of heavenly bodies in the solar system. It itself is placed in orbit by the divine spiritual energy of the cosmos for the sake of harmony among the heavenly objects of the cosmic system.$(So does the soul vibrate in the microcosmic system illuminating, the intelligence and energising the mind and senses and the pranas to achieve the individual’s harmony with himself and the totality of existence.)
বাতস্যাশ্বো বায়োঃ সখাথো দেবেষিতো মুনিঃ।
উভৌ সমুদ্রাবা ক্ষেতি যশ্চ পূর্ব উতাপরঃ॥
                                                  (ঋগ্বেদ ১০ম মণ্ডল, ১৩৬ তম সূক্ত, পঞ্চম মন্ত্র)
প্রতিপদার্থ– বাতস্য (বায়ুর) অশ্বঃ (ব্যাপ্ত/ভোক্তা) বায়োঃ (বায়ুর) সখা (বন্ধু) অথো (এবং) দেবেষিতঃ (দ্যুতিশীল বায়ু বা সূর্য কর্তৃক প্রাপ্ত) মুনিঃ (এই ঋচার দ্রষ্টা করিক্রত) উভৌ সমুদ্রৌ (উভয় সমুদ্রে) আ ক্ষেতি (গমন করেন)। যঃ চ (যে সমুদ্র) পূর্বঃ উত অপরঃ (পূর্ব এবং অপর)।
অনুবাদ– বায়ুর গতির সমান ব্যাপ্ত বা বায়ুমাত্র ভক্ষণকারী করিক্রত মুনি (এই ঋচার দ্রষ্টা) বায়ু বা সূর্য কর্তৃক প্রাপ্ত হয়েছেন। অর্থাৎ বায়ু দেবতা বা সূর্যদেবতা করিক্রত মুনিকে নিজ সান্নিধ্যে স্থান দিয়েছেন। সেই করিক্রত মুনি সূর্য বা বায়ুর সারূপ্য লাভ করে পূর্ব সমুদ্র ও অপর সমুদ্র রূপী উভয় সমুদ্রকেই স্পর্শ করেন।
ব্রহ্মমুনি পরিব্রাজক কৃত অর্থ– সূর্য আকাশে বায়ুর সূত্র দ্বারা গতিশীল থাকে। বিদ্যুতের সমান প্রতাপবিশিষ্ট পরমাত্মা দ্বারা প্রেরিত হয়ে সে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকে বিদ্যমান থাকে।
Dr. Tulsi Ram কৃত ইংরেজি অনুবাদ– The sun moves in orbit by the dynamics of cosmic energy. It is a cooperative friend of cosmic energy, inspired and energised by the supreme Divinity. An object of realisation in meditation, it illuminates both sides of its cosmic movement in space, the former and the latter both in the cosmic orbit.$(The soul in meditation can illuminate both sides of its orbit in time and space, the past and the future both as revealed by the sage Patanjali in accordance with the Veda.)
বাস্তোষ্পতে ধ্রুবা স্থূণাংসত্রং সোম্যানাম্।
দ্রপ্সো ভেত্তা পুরাং শশ্বতীনামিন্দ্রো মুনীনাং সখা॥
                                                (ঋগ্বেদ ৮ম মণ্ডল, ১৭ তম সূক্ত, চতুর্দশ মন্ত্র)
প্রতিপদার্থ– বাস্তোষ্পতে (হে গৃহপতি অগ্নি) স্থূণা (স্থির ভাবে প্রতিষ্ঠিত হও)। সোম্যানাম্ (সোম সম্পাদনকারীদের) অংসত্রম্ (অংস বা স্কন্ধ দ্বারা উপলক্ষিত শরীরকে ত্রাণ অর্থাৎ রক্ষা কর)। দ্রপ্সঃ (সোমবিশিষ্ট) শশ্বতীনাং পুরাং (অনেকানেক অসুরনগরীর) ভেত্তা (নাশকর্তা) ইন্দ্রঃ (ইন্দ্র) মুনীনাং (মুনিগণের) সখা (মিত্র হোন)।
অনুবাদ– হে গৃহপতি অগ্নি, আপনি আমাদের গৃহে স্থির ভাবে প্রতিষ্ঠিত হোন। আপনি সোমসম্পাদনকারী আমাদের শরীরের রক্ষাকর্তা হোন। অনেক অসুরনগরীর নাশক সোমপানকারী ইন্দ্র মুনিদের সখা হোন।
আর্যমুনি অনুসারে অনুবাদ– হে সকলের রক্ষক পরমাত্মা, আপনি আপনার উপাসক আমাদেরকে শারীরিক বল প্রদান করুন যাতে আমরা আত্মিক উন্নতি করে জ্ঞানসম্পন্ন পুরুষদের প্রিয় হই এবং তাঁদের সান্নিধ্যে থেকে জ্ঞান লাভ করে আপনাকে প্রাপ্ত করতে পারি। হে প্রভু, আমাদের গৃহ, পরিবার, গবাদি পশু প্রভৃতি সম্পদের রক্ষা করে এবং শত্রুসমূহ থেকে আমাদের রক্ষা করে আপনি আমাদের যজ্ঞাদি কর্মে প্রবৃত্ত করেন।
Dr. Tulsi Ram কৃত ইংরেজি অনুবাদ– O lord of human habitations, creator of the cosmic home of life, may the centre column of our house be firm. May the lord be the protective armour of the makers of soma. May Indra, lover of soma to the last drop, be destroyer of the strongholds of evil which nevertheless persist through time, and may the lord be friends with the sages.
এই মন্ত্রটি সামবেদেও বর্তমান। সেখানেও একই প্রকার অর্থ দেখা যায়। ব্রহ্মমুনি পরিব্রাজক, রামনাথ বেদালঙ্কার প্রমুখদের ভাষ্যেও এই মন্ত্রে বানপ্রস্থ রূপ অর্থের প্রতিপাদন করা হয়নি। হরিশরণ সিদ্ধান্তালঙ্কার এই মন্ত্রের অর্থ করতে গিয়ে মুনি শব্দের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘মৌনান্মুনিঃ’ যিনি মৌন আচরণ করেন, কম কথা বলেন এবং নিজের কর্তব্য কর্ম অপ্রমত্ত ভাবে করতে থাকেন তিনি মুনি। কোন প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাকারই মুনি শব্দের বানপ্রস্থিপরক কিংবা এই মন্ত্রে বানপ্রস্থ বোঝায় এরকম অর্থ করেননি। বরং যে অর্থ দেখা যাচ্ছে সেই অর্থটি গার্হস্থ্যের সঙ্গেই অধিক সম্পর্কিত বলে মনে হয়। কারণ, বানপ্রস্থী গৃহ পরিবার সম্পদ যাচনা করবেন না। হরিশরণ সিদ্ধান্তালঙ্কার বা রামনাথ বেদালঙ্কারের ভাষ্যেও এই মন্ত্রে এমন কোন শব্দ বা তাৎপর্য দেখানো হয়নি যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে এই মন্ত্রটির সঙ্গে বানপ্রস্থ আশ্রমের কোন সম্বন্ধ রয়েছে।
ন বা অরণ্যানির্হন্ত্যন্যশ্চেন্নাভিগচ্ছতি।
স্বাদোঃ ফলস্য জগ্ধ্বায যথাকামং নি পদ্যতে॥
                                                (ঋগ্বেদ ১০ম মণ্ডল ১৪৬তম সূক্ত ৫ম মন্ত্র)
প্রতিপদার্থ– অরণ্যানিঃ (অরণ্যানী) ন বৈ হন্তি (নিঃসন্দেহে হিংসা করে না)। যদি অন্যঃ (যদি অন্য কোন চৌর, ব্যাঘ্র প্রভৃতি) নাভিগচ্ছতি (না আসে)। স্বাদোঃ (সুস্বাদু) ফলস্য (ফল) জগ্ধ্বায় (ভক্ষণ করে) যথাকামং (নিজ ইচ্ছা অনুসারে) নি পদ্যতে (প্রত্যাবর্তন করে)।
অনুবাদ– অরণ্যানী কাউকে হিংসা করে না। যদি হিংসা করে তবে কোন তস্কর বা বাঘ প্রভৃতি পশু করতে পারে। সেজন্য কেউ স্বেচ্ছানুসারে অরণ্যে সুস্বাদু ফলাদি ভক্ষণ করে প্রত্যাবর্তন করতে পারে।
ব্রহ্মমুনি কৃত অর্থানুসারী অনুবাদ– যদি কেউ জঙ্গলে প্রাপ্ত বন্য ফল ভক্ষণ করে জঙ্গলে বসবাসকারী পশুকে আক্রমণ না করে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করে তবে পশুরা তাকে হত্যা করে না।
Dr. Tulsi Ram কৃত ইংরেজি অনুবাদ– The forest does not hurt anyone. Whoever goes to the forest without the intent to damage eats the delicious fruit and roams around as he wishes at will.
উপর্যুক্ত আলোচনায় সমস্ত মন্ত্রের প্রতিপদার্থ ও ভাবার্থ মহামহোপাধ্যায় সায়ণাচার্যের ভাষ্যানুসারে দেওয়া হয়েছে। উল্লিখিত সমস্ত ভাষ্য ও ব্যাখ্যার মধ্যে কেবলমাত্র মহামহোপাধ্যায় সায়ণাচার্য কৃত ভাষ্যই বেদাঙ্গ সমর্থিত। উল্লিখিত অন্য ভাষ্যগুলি বেদাঙ্গ অসম্মত এবং শব্দার্থের অসঙ্গতি বশতঃ সম্পূর্ণ রূপে উপেক্ষণীয়। তা সত্ত্বেও ‘তুষ্যতু দুর্জন’ ন্যায়ে অনার্য সম্মত ভাষ্য উদ্ধৃত করা হল। ড. তুলসী রাম কৃত ইংরেজি অনুবাদ অনেকাংশেই মহামহোপাধ্যায় সায়ণাচার্যের ভাষ্যকেই অনুসরণ করে।
উপর্যুক্ত সমীক্ষায় দেখা গেল, প্রথম তিনটি মন্ত্র বায়ুদেবতার উপাসনাপরক। কদর্য অর্থ করলেও সূর্যাদি গ্রহ নক্ষত্রের গতি সূচক। চতুর্থ মন্ত্রটি বল, সম্পদ, শত্রু থেকে পরিত্রাণ প্রভৃতি প্রার্থনা সূচক। পঞ্চম মন্ত্রটি অরণ্যের প্রশংসা সূচক। এই পুরো সূক্তটিই অরণ্যের প্রশংসাপরক সূক্ত। এখানে কোন শব্দ অভিধায়, লক্ষণায়, ব্যঞ্জনায় বা তাৎপর্যবশতঃ বানপ্রস্থ রূপ অর্থের প্রতিপাদন করে না। অতএব, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে যে, উক্ত কোন মন্ত্রের কোন ভাষ্যেই বানপ্রস্থের বিন্দুমাত্র প্রতিপাদন দেখা যাচ্ছে না।
খৃষ্টমতানুসারী পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার বশবর্তী হয়ে বেদ-স্মৃতি-পুরাণাদি শাস্ত্রের নিন্দায় প্রবৃত্ত হওয়া আমাদের অনুচিত। বরং, স্মৃতিপুরাণাদি শাস্ত্রকে বেদানুকূল ভাবেই ব্যাখ্যা করে শাস্ত্রের মর্মার্থ অনুধাবনের প্রচেষ্টা করি। এই প্রক্রিয়া সহজ নয়। দুই চার লাইন অনুবাদ পড়ে শাস্ত্র মর্ম অনুধাবন করা অসম্ভব। শাস্ত্র সহজ সরল ভাষায় রচিত নয়। তার ভাষা অর্থবাদে অলঙ্কৃত, ব্যঞ্জনাধর্মী, রূপকের আবরণে সত্যের প্রকাশ। এগুলি বোঝার জন্য কেবল বুদ্ধি নয়, হৃদয়ের নির্মলতা, ইষ্ট-গুরু-শাস্ত্রে শ্রদ্ধা প্রয়োজন। তা নাহলে শাস্ত্রে কেবল অশ্লীলতা এবং পরনিন্দা চোখে পড়ে। সেজন্যই মূর্খরা শাস্ত্রের মধ্যে কেবল অশ্লীলতা খুঁজে পায়। পবিত্র ভাব সমূহ তাদের অপবিত্র হৃদয়কে স্পর্শ করে না। শাস্ত্রকে উপেক্ষা করাই তারা শ্রেয়স্কর মনে করে।
অতঃপর, বেদবিকৃতি সম্পাদনকারী দালাল শ্রেণীর অনার্যগণ যে সমস্ত গ্রন্থকে প্রতিনিয়ত অশ্লীলতা, প্রক্ষিপ্ততা প্রভৃতি নানাবিধ দোষে বিদ্ধ করে থাকে তারাও ঠেকায় পড়ে সেই সমস্ত গ্রন্থ ব্যতিরেকে চতুরাশ্রম ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম নয় বলে সুনিশ্চিত হওয়া গেল। সুতরাং, এই অসভ্য, অনার্য, বেদ মন্ত্রের কদর্থকারীদের থেকে সাবধানতা অবলম্বন করবেন। এই পাপিষ্ঠ, নরাধম, মিথ্যাবাদী, যবনদের দালালদের থেকে শতহস্ত দূরত্ব বজায় রাখবেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ