
মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র বিশ্বব্যাপী সনাতন বিশ্বাসীদের নিকট হাজার বছর ধরে যেমন ভগবান রূপে পূজিত হয়ে আসছেন তেমন তাঁর কর্ম ও আচার গুণে কোটি সনাতনীর হৃদয়ে একজন আদর্শ ও অনুকরণীয় পুরুষ হিসেবেও অধীষ্ঠিত হয়ে আছেন।


"মৈথিলি আমি তোমাকে ভোগ করতে পারি না, তুমি যেন কুকুরের চাটা ঘি" রামায়ণ (৩/২৭৫/১০-১৩)

এই ধরনের অপপ্রচার দুই শ্রেনীর মানুষ করতে পারে। এক হলো যারা কখনও বাল্মিকী রামায়ণ অধ্যয়ন করেন নি কিন্তু লোকমুখে প্রচলিত মিথ্যাচার শুনে অভ্যস্ত অথবা দুই হলো যারা মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রের চরিত্রহনন করে নিজেদের অশুদ্ধ মনে পৈশাচিক আনন্দ খোঁজার পায়তারা করেন। যাইহোক মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। মিথ্যাচারে বহুল ব্যবহৃত রেফারেন্সটি সম্পূর্ণ ভুল৷ রামায়ণের তৃতীয় কাণ্ড হলো অরণ্য কাণ্ড। তারপর লিখা হয়েছে ২৭৫ং সর্গ অথচ এই কাণ্ডে সর্গই আছে ৭৫ টা। তাহলে বাকী ২০০ সর্গ গেলো কোথায়?
মূল ঘটনাটি ঘটেছিলো রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ডে। যুদ্ধকাণ্ডের ১১৪-১১৮ সর্গ বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য। আমি চেষ্টা করবো পর্যায়ক্রমিক ঘটনাপ্রবাহ ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সম্পূর্ণ বিষয়টি পরিস্কার করতে তাই সবাই একটু ধৈর্য্য সহকারে পড়বেন ও মনন করার চেষ্টা করবেন।

ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বিভীষণকে আদেশ করলেন মাতা সীতাকে স্নান অন্তে দিব্য অঙ্গরাগাদি ও দিব্য ভূষণাদিতে সুসজ্জিত করে সভাকক্ষে নিয়ে আসতে। বিভীষণ যখন দেবী সীতাকে সভাকক্ষে নিয়ে আসছিলেন তখন তিনি সভাকক্ষে উপস্থিত বানরসেনা, রাক্ষসগণকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিলেন যেন তারা দেবী সীতাকে দেখতে না পারেন।
ঠিক সেই মূহুর্তে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বিভীষণকে থামিয়ে দিয়ে এক চমৎকার উক্তি করলেন যা সকল নারী সমাজের মর্যাদাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে যথেষ্ট।
"ন গৃহাণি ন বস্ত্রাণি ন প্রাকারন্তিরস্ক্রিয়া।
নেদৃশা রাজসৎকারা বৃত্তমাবরণং স্ত্রিয়াঃ।।"
অনুবাদঃ গৃহ, বস্ত্র বা গৃহপ্রাচীর প্রভৃতি মহিলাদের পর্দা হতে পারে না। স্বামী থেকে প্রাপ্ত সৎকার এবং পত্নীর সচ্চরিত্র এই দুই-ই হলো স্ত্রীগণের অদৃশ্য আবরণ।
[যুদ্ধকাণ্ড, ১১৪ সর্গ, শ্লোক নং-২৭]
অর্থাৎ শ্রীরামচন্দ্র যখন সীতাকে দিব্যালঙ্কারে সুসজ্জিত করে সভা কক্ষে সর্ব সম্মুখে নিয়ে আসতে আদেশ দিলেন তখনও তিনি নিশ্চিত জানেন যে দেবী সীতা ছিলেন পতিব্রতা ও সতীসাধ্বী।
মাতা সীতা যখন সৌম্যকান্তি মুখ নিয়ে শ্রীরামচন্দ্রের সম্মুখে দাঁড়ালেন তখন উভয়েই ছলছল চোখে ও প্রসন্ন চিত্তে একে অপরকে অবলোকন করলেন।
কিন্তু হঠাৎ করেই যেন শ্রীরামচন্দ্র সম্পূর্ণ বদলে গেলেন এবং মাতা জানকীকে তিনি রূঢ় ভাষায় তিরস্কার করতে লাগলেন এবং সীতার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে তাঁকে ত্যাগ করতে চাইলেন। শ্রীরামচন্দ্রের এমন রূপ দেখে মাতা সীতা যেন বিশ্বাসই করতে পারলেন না তিনিই তাঁর সেই শ্রীরামচন্দ্র! এমতাবস্থায় মাতা সীতা অতিশয় ক্রন্দন করে নিজের পতিব্রতা হওয়ার সাক্ষী দিয়ে যাচ্ছিলেন সর্বসম্মুখে। (যুদ্ধকাণ্ডের ১১৫নং সর্গ দ্রষ্টব্য)
মাতা সীতার প্রতি শ্রীরামচন্দ্রের এহেন আচরণ দেখে উপস্থিত লক্ষ্মণ, হনুমান, সুগ্রীব এবং বিভীষণ কেউ-ই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কারণ তাঁরা সকলেই সীতা উদ্ধারের দীর্ঘ পথ ও সময়ে শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গী হিসেবে ছিলেন তাই তাঁরা জানেন যে শ্রীরামচন্দ্রের হৃদয়ের কতটা জায়গা জুড়ে মাতা সীতার স্থান ছিলো। তবে শ্রীরামচন্দ্রের এই বিরূপ আচরণে কেউ-ই কোন শব্দপ্রয়োগের সাহস পাচ্ছিলেন না। শ্রীরামচন্দ্রের এহেন আচরণে অতিশয় ক্ষুব্ধ মাতা সীতা লক্ষ্মণকে চিতা প্রজ্জ্বলন করতে বললেন এবং নিজে সেই অগ্নিতে নিজেকে বিসর্জন দিতে মনস্থির করলেন। এমতাবস্থায় লক্ষ্মণ নিজ ভ্রাতার দিকে ক্ষুব্ধ নয়নে তাকালেন কিন্তু ভ্রাতার সম্মতিসূচক মনোভাবে বাধ্য হয়ে চিতা প্রজ্জ্বলন করলেন। (যুদ্ধকাণ্ডের ১১৬ নং সর্গ দ্রষ্টব্য)

এর আগে একটা বিষয় একটু জানিয়ে রাখি যখন শ্রীরামচন্দ্রের সামনে মাতা সীতাকে আনা হলো তখন প্রাণপ্রিয় সীতাকে নিজের নিকট দেখেও লোকাপবাদের ভয়ে শ্রীরামচন্দ্রের হৃদয় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাচ্ছিলো। (যুদ্ধকাণ্ডের ১১৫ নং সর্গের ১১ং শ্লোক দ্রষ্টব্য)

মাতা সীতা যখন অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করছিলেন তখন পরমপিতা ব্রহ্মা সহিত সকল দেবতারা সমবেত হয়ে শ্রীরামচন্দ্রকে বোঝাচ্ছিলেন যে তিনি ভগবান বিষ্ণুর অবতার হয়েও কেন একজন সাধারণ পুরুষের ন্যায় আচরণ করছেন। মাতা সীতা যেখানে স্বয়ং লক্ষ্মী স্বরূপা সেখানে তিনি কিভাবে মাতা সীতাকে সন্দেহপূর্বক অগ্নিপরীক্ষার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন! শ্রীরামচন্দ্র এখানে বলছেন যে তিনি এখন কেবলই একজন সাধারণ পুরুষ এবং প্রজাকুলের চিন্তাভাবনার প্রতিফলন তাঁকে প্রভাবিত করছে। পরমপিতা ব্রহ্মার সহিত সমবেত দেবতাদের আপত্তিতেও শ্রীরামচন্দ্র কর্ণপাত করলেন না। মাতা সীতা সকলকে সাক্ষী রেখে সর্বসম্মুখে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করলেন। (যুদ্ধকাণ্ডের ১১৭ং সর্গ দ্রষ্টব্য।)

এখানে লক্ষ্যনীয় যে শ্রীরামচন্দ্র এখানে পরমপিতা ব্রহ্মার কথাও গ্রাহ্য করলেন না এবং মাতা সীতার অগ্নিপ্রবেশে বাধা দিলেন না। কেন তিনি এই রকম আচরণ করলেন? এর উত্তর পাবো আমরা পরের সর্গে।

পরবর্তীতে অগ্নিকুণ্ড হতে অরুণাদিত্যা তুল্য গাত্রবর্ণ, শুদ্ধকাঞ্চণালংকারে বিভূষিতা, রক্তবর্ণে সুসজ্জিতা, কৃষ্ণকুঞ্চিতকুন্তলা অনিন্দ্যসুন্দরী সীতা প্রস্ফুটিত পুষ্পমাল্যগলে অগ্নিদেবের সাথে সর্বসম্মূখে আবির্ভূতা হলেন এবং অগ্নিদেব মাতা সীতাকে শ্রীরামচন্দ্রের হাতে প্রত্যর্পণ করলেন। লোকসাক্ষী অগ্নিদেব সকলের সামনে শ্রীরামচন্দ্রকে এই বলে সাক্ষ্য দিলেন,
"শ্রীরাম! ইনি আপনার ধর্মপত্নী বিদেহরাজকুমারী সীতা। ইনি নিস্পাপ ও কলঙ্কলেশশূণ্য।"
অগ্নিদেবের সাক্ষ্য শেষ হলে শ্রীরামচন্দ্র প্রসন্ন হয়ে অশ্রুসজল নেত্রে জানকীকে সকলের সম্মুখে গ্রহণ করলেন।
(যুদ্ধকাণ্ডের ১১৮ নং সর্গ দ্রষ্টব্য)

এখানে খুব স্পষ্ট যে শ্রীরামচন্দ্রের মাতা সীতাকে জনসম্মুখে নিয়ে আনা, মাতা সীতাকে সকলের সামনে আপন স্বভাব বিরুদ্ধ হয়ে অতিশয় তিরস্কার করা, সকলের এমনকি পরমপিতা ব্রহ্মার আবেদন উপেক্ষা করেও পরোক্ষ ভাবে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার দিকে ঠেলে দেওয়া এবং অগ্নিসাক্ষীর মাধ্যমে সকলের সামনেই মাতা সীতাকে আবার গ্রহণ করার পেছনে রয়েছে কোন বিশেষ তাৎপর্য।

এবার তাহলে শ্রীরামচন্দ্রের মুখেই শুনুন সেই বিশেষ তাৎপর্য কি ছিলো!
অগ্নিদেব যখন মাতা সীতাকে শ্রীরামচন্দ্রের হাতে প্রত্যর্পণ করলেন তখন শ্রীরামচন্দ্র প্রসন্ন চিত্তে অগ্নিদেবকে বললেন,
"হে দেব! মানুষের মনে সীতার পবিত্রতা বিষয়ে বিশ্বাস উৎপাদনার্থে পবিত্রতার এই পরীক্ষা আবশ্যক ছিলো, কেননা সুলক্ষণা সীতা বহুদিন যাবৎ অসহায় অবস্থায় রাবণের অন্তঃপুরে বন্দিনী ছিলেন। আজ সীতার পবিত্রতা পরীক্ষিত না হলে লোকেরা বলত দশরথপুত্র শ্রীরাম অতি মূঢ় ও বাসনাযুক্ত। আমি ভালোভাবেই অবগত আছি যে সীতার হৃদয় সর্বদা আমাতেই নিবদ্ধ। আয়তলোচনা সীতা স্বকীয় তেজোদীপ্তিতে স্বয়ং সুরক্ষিতা। তথাপি কেবলমাত্র সত্যকেই আশ্রয় করে জনগণের মনে বিশ্বাস উৎপাদনার্থে আমি অগ্নিতে প্রবেশে উদ্যতা সীতাকে নিষেধ করি নি। অন্যথায় সূর্যদেব ও তাঁর জ্যোতি যেমন অভিন্ন তেমনই আমি ও সীতা একাত্মা। আপন কীর্তির মতো সীতাকেও আমি পরিত্যাগ করতে সমর্থ নই। আমার কীর্তি যেমন আমাকে যশস্বী করেছে, তেমনি সীতার নিস্কলুষ পবিত্রতা আমাকে মহিমান্বিত করেছে।"
(যুদ্ধকাণ্ডের ১১৮ং সর্গের ১৩-২০ নং শ্লোক দ্রষ্টব্য)

এখানে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র নিজেই সকলের সামনে অগ্নিসাক্ষী রেখে সীতার প্রতি তাঁর বিশ্বাস ও অগ্নিপরীক্ষার কারণ স্পষ্ট করেছেন। শ্রীরামচন্দ্র তাঁর পত্নীকে এতটাই ভালোবাসতেন যে কয়েক হাজার মাইল অজানা ও বিপদসংকুল পথ পায়ে হেটে পারি দিয়ে, সমুদ্রের উপর পাথরের সেতু বানিয়ে তিনি লঙ্কা গিয়েছিলেন কেবল স্ত্রীকে উদ্ধার করতে।
সেই শ্রীরামচন্দ্রকে অনেকে প্রচার করেন তিনি নাকি পত্নীবিদ্বেষী ছিলেন! অথচ মূল বাল্মিকী রামায়ণে মাতা সীতার অগ্নিপরীক্ষা ও পরবর্তীতে পুনরায় বনবাসে পাঠানোর স্পষ্ট ব্যাখ্যা আছে। প্রজাদের ক্রমাগত তিরস্কার থেকে মাতা সীতাকে মুক্ত রাখতে, রাজ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং সর্বোপরি প্রজাসুখকে গুরুত্ব দিয়ে রাজধর্ম পালনের ব্রত রক্ষা করতেই মাতা সীতাকে তিনি ভ্রাতা লক্ষ্মনকে দিয়ে নিরাপদে মহর্ষি বাল্মিকীর আশ্রমে রেখে আসার বন্দোবস্ত করেছিলেন। মাতা সীতাকে বনবাসে রেখে তিনি বিভিন্ন জনের প্রবঞ্চনায় প্রভাবিত না হয়ে পুনরায় বিবাহ না করে একাকী জীবনযাপন করে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। এমনকি অশ্বমেধ যজ্ঞে নিজ পত্নী হিসেবে সীতার স্বর্ণ মূর্তি পাশে বসিয়ে সমস্ত জগতের সামনে এই বার্তা দিয়েছিলেন যে তাঁর স্ত্রী সীতা পতিব্রতা ও সতী।

নিবেদনে,
রাম চরণদাস শ্রী অনিক কুমার সাহা।

Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)
সনাতনী ঐক্য, প্রচার ও কল্যাণে অবিচল।।
0 মন্তব্যসমূহ