ভাগবত পুরাণে সূর্যের গতি বিজ্ঞান নাকি ভ্রান্তি!!


একদল অনার্য, অনাচারী, সংস্কারহীন, অহিন্দু যেন-তেনভাবে পুরাণাদি শাস্ত্রের অপপ্রচার করতে আদা-জল খেয়ে নেমেছে। এরা হয়তো এদের অজ্ঞতা থেকে নাহলে মনের গভীর বিদ্বেষ থেকে অথবা নিজেদের ভ্রান্ত মত প্রতিষ্ঠা করতে এই কাজগুলো সচেতনভাবে করে যাচ্ছে যা এদের অবান্তর আপত্তিগুলো দেখলে স্পষ্ট হয়৷ 

SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি চেষ্টা করছে সাধারণ হিন্দুদের নিকট শাস্ত্রের আলোকে প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে। তার-ই ধারাবাহিকতায় আজকের পর্বে থাকবে সূর্যের গতি নিয়ে আলোচনা। অন্যান্য পর্বের লিংক লেখার একদম শেষ অংশে দেওয়া হলো। 

একটি অনার্য সংগঠন জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে তাদের অজ্ঞতার ফলশ্রুতিতে ভাবগত পুরাণে কিছু শ্লোক নিয়ে অবান্তর আপত্তি তুলেছে যার মধ্যে কিছু শ্লোকের যথাযথ ব্যাখ্যা আমরা তুলে ধরেছি। এবার তাদের ৫/২১/৩নং শ্লোকের আপত্তি নিরসন করবো।

ভাগবত পুরাণের পঞ্চম স্কন্ধের একুশতম অধ্যায়ের তিন নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে, 

"সেই আকাশের মধ্যস্থলে থাকিয়া চন্দ্র প্রভৃতি গ্রহগণকে তাপ দান করা ঐশ্বর্যশালী অংশুমান স্বীয় তেজ প্রভাবে ও নিজ অঙ্গ কান্তি দ্বারা ত্রিলোককে উদ্দীপ্ত করেন, তার উত্তরায়ণ, দক্ষিণায়ণ, বিষুব এই তিন নাম অনুসারে মন্দ, ক্ষিপ্র, সমান এই তিন গতি আছে। এই তিনগতি অনুসারে তিনি আরোহন, অবরোহণ ও সম স্থানে মকরাদি রাশিতে দিবারাত্রি দীর্ঘ, হ্রস্ব, সমান করিয়া থাকেন।"

এত সুন্দর তথ্য থাকার পরও অনার্যরা এখানে বিস্ময়সূচক চিহ্ন দিয়ে আপত্তি তুলেছে। এখানে দুইটি বিষয় হতে পারে। হয় তারা শ্লোকটি বুঝেই নি অথবা আপত্তি তুলতে হবে তাই অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো করে আপত্তি তুলে দিয়েছে। 

শ্লোকের ব্যাখ্যাঃ পৃথিবী যে পথে সূর্যের চারদিকে ঘোরে তা আসলে উপবৃত্তাকার। এই কারণে পৃথিবীর থেকে সূর্যের দূরত্ব বাড়ে কমে। পৃথিবী যখন সূর্যের কাছাকাছি আসে (যা বর্তমান বিজ্ঞানে "অনুসূর অবস্থান" নামে পরিচিত) তখন তার গতি বেড়ে যায়। আবার যখন সূর্যের থেকে দূরে অবস্থান করে (যা বর্তমান বিজ্ঞানে "অপসূর অবস্থান" নামে পরিচিত) তখন গতিবেগ কমে যায়। আবার পৃথিবী যখন সূর্যের থেকে দূরবর্তী ও নিকটবর্তী এই দুইয়ের মাঝখানে অবস্থান করে তখন তার গতি খুব বেশিও থাকে না, খুব কমও থাকে না অর্থাৎ পৃথিবী তখন বিষুব গতি লাভ করে। 


পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্যের যে আপাত গতি সেটা পুরোপুরি পৃথিবীর পরিক্রমণ গতির ওপর নির্ভরশীল। কারণ পৃথিবীর পরিক্রমণ গতির কারণেই সূর্যের ওপর আপাত বার্ষিক গতি আরোপিত হয়। সেইজন্যই পৃথিবীর গতিবেগ যখন বেশি থাকে তখন পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্যের আপাত গতিও বেশি থাকে। আবার পৃথিবীর গতিবেগ যখন কম থাকে তখন সূর্যও পৃথিবীর সাপেক্ষে হ্রস্ব গতি লাভ করে। আবার পৃথিবীর গতি যখন মাঝামাঝি থাকে তখন সূর্যের আপাত গতি ও মাঝামাঝি বা বিষুব থাকে। 

সূর্যের উত্তরায়ণ কালে আমাদের উত্তর গোলার্ধে যখন গ্রীষ্মকাল বিরাজ করে তখন পৃথিবীর থেকে সূর্যের দূরত্ব বেশি থাকে, এই সময়ই সূর্য হ্রস্ব গতি লাভ করে। এইসময় সূর্য তার যাত্রাপথের রাশিগুলো ধীরে ধীরে অতিক্রম করে, এইজন্যই গ্রীষ্মকালের বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য ইত্যাদি মাসগুলো শীতকালের অগ্রহায়ণ, পৌষ ইত্যাদি মাসগুলোর চেয়ে দীর্ঘতর হয়। আবার শরৎকাল ও বসন্তকালে সূর্যের থেকে পৃথিবীর দূরত্ব মাঝামাঝি অবস্থায় থাকে, তখন পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্য বিষুব গতি লাভ করে। এইসময়ের মাসগুলোর দিনসংখ্যা মাঝামাঝি হয়। আবার দক্ষিণায়ন কালে যখন আমাদের উত্তর গোলার্ধে শীতকাল বিরাজ করে তখন পৃথিবীর থেকে সূর্যের দূরত্ব কম থাকে। এইসময় সূর্য পৃথিবীর সাপেক্ষে দ্রুত গতি লাভ করে ও তার যাত্রাপথের রাশিগুলোকে দ্রুত অতিক্রম করে। এইজন্যই শীতকালের মাসগুলো অপেক্ষাকৃত কম দিনের হয়। 

এখানে অনেকের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে যে আমাদের গ্রীষ্মকালে যদি পৃথিবীর থেকে সূর্যের দূরত্ব বেশি থাকে তাহলে তো গরম কম লাগার কথা আর শীতকালে যদি কম থাকে তাহলে তো গরম বেশি লাগার কথা, কেননা পৃথিবীর আলো ও তাপ উভয়েই সূর্যের থেকে আসে। কিন্তু হয় তো উল্টোটা, কীভাবে? 

আসলে কোন স্থানে গ্রীষ্মকাল হবে নাকি শীতকাল হবে সেটা পৃথিবীর থেকে সূর্যের দূরত্বের উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে সূর্যের রশ্মি কেমন ভাবে ভূপৃষ্ঠে পতিত হচ্ছে। গ্রীষ্মকালে সূর্যের রশ্মি আমাদের দেশে লম্বভাবে পতিত হয়, তাই ভূপৃষ্ঠ অধিক উত্তপ্ত হয়। আর শীতকালে সূর্যের রশ্মি আমাদের দেশে তির্যকভাবে পতিত হয় তাই ভূপৃষ্ঠ অল্প উত্তপ্ত হয়। তবে আমাদের গোলার্ধে যখন গ্রীষ্মকাল তখন দক্ষিণ গোলার্ধে শীতকাল থাকে, আবার আমাদের যখন শীতকাল ওদের তখন গ্রীষ্মকাল থাকে। 

তো আমরা দেখতে পেলাম পৃথিবীর পরিক্রমণ গতি বাড়ে কমে বলে পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্যের আপাত গতিও বাড়ে কমে। এইজন্যই ভাগবতে সূর্যের তিন গতির কথা বলা হয়েছে। 

পৃথিবীর গতি  বাড়ার কমার কারণ সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে চাইলে এই ভিডিওটি দেখুন.... 

এরপর আসি সূর্যের গতি কীভাবে উত্তর দক্ষিণ হয়। পৃথিবী তার কক্ষপথে হেলে থাকার কারণে কখনও উত্তর গোলার্ধ সূর্যের দিকে বেশি ঝুঁকে থাকে, এইসময় সূর্যকে পৃথিবীর আকাশে উত্তর দিকে সরে সরে উদিত ও অস্ত যেতে দেখা যায় যেহেতু উত্তর দিককে পৃথিবীর উপর ধরা হয়েছে তাই এইসময় সূর্যের আরোহণ হয় যা ওই শ্লোকে উল্লেখ আছে। একে সূর্যের উত্তরায়ণ বলা হয়। উত্তরায়ণ কালে উত্তর গোলার্ধে দীর্ঘ দিন ও গ্রীষ্মকাল বিরাজ করে। শরৎকাল আর বসন্তকালে মোটামুটি পূর্ব দিকের মাঝ বরাবর সূর্য উদিত ও অস্ত যায়, কারণ এইসময় দুই গোলার্ধ সূর্যের থেকে সমান দূরত্বে থাকে। এইসময় সূর্যের অবস্থান দুই গোল থেকে সমান হয়, তাই সূর্যের অবস্থান পৃথিবীর সমস্থানে হয়, যা ওই শ্লোকে বলা হয়েছে। আবার যখন দক্ষিণ গোলার্ধ সূর্যের দিকে সূর্যের দিকে বেশি ঝুঁকে যায় তখন সূর্য পৃথিবীর আকাশে দক্ষিণ দিকে সরে সরে উদিত ও অস্তমিত হয়। একে সূর্যের দক্ষিণায়ণ বলা হয়। যেহেতু দক্ষিণ দিককে পৃথিবীর নীচের দিক ধরা হয়েছে, তাই এই সময় সূর্যের অবরোহণ হয়, যা ওই শ্লোকে বলা হয়েছে। দক্ষিণায়ণ কালে দক্ষিণ গোলার্ধে দীর্ঘ দিন ও গ্রীষ্মকাল বিরাজ করে। 

পুরাণে সূর্যের গতি বোঝানোর জন্য একটি সুন্দর উপমা ব্যবহার করা হয়েছে। তা হলো কুলাল চক্র বা কুমোরের চাকা। পৃথিবীর পরিক্রমণ পথ যদি একটি চাকার মতো হয় তবে সেখানে পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্য যদি কেন্দ্রের দিকে সরে অবস্থান করে তাহলে সে অল্প অল্প বিঘূর্ণিত হবে। আবার তার অবস্থান যদি পৃথিবীর সাপেক্ষে পৃথিবীর পরিক্রমণ পথের প্রান্তের দিকে হয় তবে তার দ্রত ঘূর্ণন হবে। কারণ চাকার প্রান্তের দিকের পরিধি বেশি হওয়ায় গতিবেগ বেশি। কারণ কেন্দ্রের দিকে পরিধি কম হওয়ায় গতিবেগ কম হয়। যেহেতু (গতিবেগ = অতিক্রান্ত দূরত্ব ÷ সময়, একই সময়ে ভ্রমণ করার সময় যেখানে দূরত্ব বেশি অতিক্রম করতে হয় সেখানে গতিবেগ বেশি থাকবে) পাঠকগণ কুমোরের চাকার ঘূর্ণন লক্ষ্য করুন নীচের ভিডিওতে.....

চাকা বৃত্তাকার বা উপাবৃত্তাকার যাইহোক না কেন, সবসময় কেন্দ্রের দিকে পরিধি কম হওয়ায় গতিবেগও কম হয়, আর প্রান্তের দিকে পরিধি বেশি হওয়ায় গতিবেগও বেশি থাকে। পৃথিবীর পরিক্রমণ পথে যখন সূর্যের অবস্থান পৃথিবীর সাপেক্ষে কেন্দ্রের দিকে হয় তখন ঘূর্ণন কম হয়, আর যখন সূর্যের অবস্থান পৃথিবীর সাপেক্ষে পৃথিবীর পরিক্রমণ পথের প্রান্তের দিকে হয় তখন গতিবেগ বেশি থাকে। ওটা বোঝাবার জন্য কুমোরের চাকার উদাহরণ টানা হয়েছে।

ধরুন কুমোরের চাকায় দুটো বিন্দু আঁকলেন একটি পরিধির দিকে, আর একটা কেন্দ্রের দিকে, দেখা যাবে পরিধির দিকে যাকে আঁকা হয়েছে সে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করছে, আর যাকে কেন্দ্রের দিকে আঁকা হয়েছে সে কম দূরত্ব অতিক্রম করছে।এই দুটি বিন্দু যদি সূর্যের দুই রকম অবস্থান (কেন্দ্রের দিকে অর্থাৎ অপসূর এবং প্রান্তের দিকে অর্থ্যাৎ অনুসূর অবস্থান) হয় তাহলে অপসূর অবস্থানে সূর্য মন্দ গতি লাভ করবে আর অনুসূর অবস্থানে সূর্য দ্রুত গতি লাভ করবে।

অনুসূর অবস্থানে পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্যকে মনে হয় সে যেন প্রান্তের দিকে সরে এসেছে, আর অপসূর অবস্থানে মনে হয় সে যেন কেন্দ্রের দিকে সরে এসেছে।

এখন যে অনার্যরা তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা হেতু ভাগবত পুরাণের জ্যোতির্বিজ্ঞান বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে না পেরে হাসাহাসি করে তাদের জন্য বিশিষ্ট জ্যোতিষ বিশ্লেষক যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি (অনার্যরাও তাদের ব্লগে এনার জ্যোতিষ ব্যাখ্যা দিয়ে নাক-কান রক্ষা করে) বলেছেন,

"পুরাণের পাঠক ও শ্রোতার মতিগতি ও রুচি অনুসারে উদ্দেশ্য সফল বা বিফল হইতে পারে। আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানদৃষ্ট চিত্তে ঐ উদ্দেশ্য সফল হইবার সম্ভাবনা নাই, কিন্তু সেকালের লোকদিগের নিকট উহার ফল অল্প ছিলো না। 

কিন্তু যে কথা শুনিয়া এখনকার বালকেরা হাস্য করে, সে কথার আলোচনা করিয়া প্রাচীনেরা শিক্ষালাভ করিত। তাহারা কি এতোই বালকোচিত কথা-শুশ্রুষা প্রকাশ করিতেন? তাহারা কি ইদানীস্তনের বালকের তুল্য ছিলেন? কিন্তু দেখা যায়, শ্রুতি স্মৃতি ও পুরাণ পর্যায়ক্রমে প্রমাণ বলিয়া গ্রাহ্য হইয়া থাকে।

এই সকল বিষয় বিবেচনা করিয়া সহজেই বোধ হইবে যে, আমাদের দৃষ্টি প্রাচীনকালের দৃষ্টির অনুরূপ নহে। আমরা যে আখ্যানের কোন তাৎপর্য পাইতেসি না, তাহারা তাহা পাইতেন। বস্তুত প্রাচীনকালের আচার ব্যবহার নিত্য নৈমিত্তিক ক্রিয়ার মূল বা তাৎপর্য অবধারণ আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে। বিদেশী ব্যাক্তি যেমন সংস্কৃত ভাষায় বুৎপন্ন হইলেও আমাদের ধর্ম কর্ম আমাদের মতো বুঝিতে পারেন না, তেমনই সেখালের তুলনায় আমিরা একালে বিদেশি হইয়া পড়িয়াছি।" 

রইলো বাকি স্বঘোষিত বিজ্ঞানী অনার্যদের লম্ফঝম্প। ভাগবতের জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে এই অর্বাচীনদের মন্তব্য বিবেচ্য নয় বরং আমরা একটু দেখি ৩য় বৃহত্তম মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ISRO এর সাবেক প্রধান ড. এ এস কিরন কুমারের বক্তব্য। পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপ্ত ড. কিরন কুমার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তব্য দেন,

“The Vedic and ancient Greek writings constitute the core of ancient wisdom…the Upanishads, the Bhagavad Gita, the Brahman Sutra, the Srimad Bhagavatam and the Mahabharata constitute the primary source of ancient wisdom. We should not disregard our ancient texts which could yield – if verified, studied and researched properly – vital knowledge.”

আগের পর্বের লিংকঃ
১/ https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2022/09/blog-post_26.html
২/ https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2022/10/blog-post_9.html
৩/ https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2022/10/blog-post_15.html

© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি
🖋️ শ্রী গৌতম দন্ডপাট
শ্রী অনিক কুমার সাহা
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ