"উপবাস" অর্থ কি?

সম্প্রতি সনাতনীদের নিকট সর্বমান্য একাদশী ব্রতকে অশাস্ত্রীয়, অবৈজ্ঞানিক অগ্রহণযোগ্য প্রমাণ করা উদ্দেশ্য "উপবাস" শব্দটি নিয়ে একটা হঠকারিতা শুরু হয়েছে। আমাদের বিশেষ পর্ব "একাদশীর মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব" এ একাদশীর শাস্ত্রীয়, বৈজ্ঞানিক এর সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতে তুলে ধরবো। আজকের পর্বে আমরা কেবল "উপবাস" শব্দটি শাস্ত্রীয় বিচারে বিশ্লেষণ করবো।

উপবাস অর্থ সাধারণত আমরা জানি খাদ্য সংযম, অনশন বা ভোজন ত্যাগ অর্থাৎ কোন বিশেষ তিথি বা ব্র‍ত দিবসে দিনের কিছু প্রহর না খেয়ে থাকা বা খাদ্য সংযম মেনে চলা। 

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে একাদশী ব্রতসহ নানান ব্রত দিবসে খাদ্য সংযমকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য কেউ কেউ প্রচার করছে উপবাস অর্থ কদাপি ভোজন ত্যাগ হতে পারে না। তাদের বক্তব্য হলো উপবাস অর্থ 'ঈশ্বরের সান্নিধ্যে বাস করা'। উপবাস শব্দটি 'উপ' পূর্বক 'বস্' ধাতুর উত্তর ভাবার্থক 'ঘঞ্' প্রত্যয় দ্বারা নিষ্পন্ন হয়। উপ এই নিপাতের অর্থ সামীপ্য। বস্ ধাতুর অর্থ নিবাস। সেজন্য উপবাস শব্দের অর্থ ’সমীপে বাস’। এটা নিয়ে আমাদেরও আপত্তি নেই কারণ  একইভাবে উপ-পূর্বক নি-পূর্বক সদ্‌ ধাতুর উত্তর ক্বিপ্‌ প্রত্যয় যোগ করে উপনিষদ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে যার অর্থ 'সমীপে বসা'। কিন্তু সমীপে বসা দিয়ে উপনিষদের মূল অর্থ প্রকাশ পায় না। এজন্য আদিগুরু আচার্য্যশ্রেষ্ঠ শঙ্করাচার্যের মতে ‘উপ’ উপসর্গের অর্থ – ব্রহ্মবিদ্যা লাভের জন্য উপস্থিত হওয়া, ‘নি’ উপসর্গের অর্থ – নিশ্চয়ের সঙ্গে ব্রহ্মবিদ্যার অনুশীলনে তৎপর হওয়া, ‘সদ্‌’ ধাতুর অর্থ – অনর্থের বিনাশ। সুতরাং তাঁর মতে ব্রহ্মবিদ্যাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্মমৃত্যু – প্রবাহ রূপ যাবতীয় সাংসারিক অনর্থ বিনষ্ট হয় এবং অনর্থের মূল কারণ অবিদ্যার উচ্ছেদ সাধিত হয় বলে ব্রহ্মবিদ্যা বিষয়ক শাস্ত্রকে উপনিষদ বলা হয়।

"উপবাস" শব্দেরও বিকল্প অর্থ হয় এবং সেটার শাস্ত্রীয় মান্যতাও অনস্বীকার্য। 

রামায়ণে শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের পূর্বে মহর্ষি বশিষ্ঠ শ্রীরামচন্দ্রকে বলছেন 

"প্রসন্নস্তে পিতা রাম যত্ত্বং রাজ্যমবাপ্স্যসি।
উপবাসং ভবানদ্য করোতু সহ‍ সীতয়া৷৷ "

[বাল্মীকি রামায়ণ, অযোধ্যাকান্ড, সর্গ ৫, শ্লোক ৯/ ক্রিটিকাল এডিশন ৫/৮]

বঙ্গানুবাদঃ বশিষ্ঠ রামকে বললেন,"রাম ! তোমার পিতা খুব খুশি, কারণ, তুমি রাজ্য লাভ করবে। অতএব, আজ তুমি সীতার সঙ্গে উপবাস ব্রত পালন করো।"

এই শ্লোকে উপবাস ব্রত বলতে কি বোঝানো হয়েছে? এই উপবাস ব্রত যে খাদ্য সংযমই ছিলো তার উত্তর রামায়ণেই আছে। শ্রীরামচন্দ্র বনবাসের শুরুতেই উপবাস ব্রত রেখেছিলেন এবং গঙ্গা তীরে বসে কেবল ফল খেয়ে ব্রত ভেঙেছিলেন। রেফারেন্স রামায়ণ ২.৪৬.৭৯। রামায়ণের উপর সবগুলো প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ টীকাভাষ্যেও এই অংশটি আছে। 

যাইহোক যেহেতু ব্যাকরণের বিষয়টা এনে "সান্নিধ্যে বাস" অর্থ করা হয়েছে তাই আমর ব্যকরণ দিয়েই আগে এর ব্যাখ্যা করব। 

ধাতু অনেকার্থক হয়। একই ধাতুর একাধিক অর্থ ব্যাকরণ শাস্ত্রে প্রসিদ্ধ। ধাতুর এই নানাবিধ অর্থ উপসর্গের সংসর্গে স্পষ্ট প্রতীত হয়। যেমন, সাধারণ ভাবে 'হৃ' ধাতুর অর্থ হরণ করা। কিন্তু উপহার, প্রহার, আহার, বিহার প্রভৃতি শব্দে উপসর্গ যুক্ত 'হৃ' ধাতুর অর্থ বদলে যায়। তেমনই 'বস্' ধাতুর অর্থ নিবাস করা। উপবাস শব্দের অর্থ সমীপে বসতি হতে পারে। কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু পাণিনীয় ব্যাকরণ শাস্ত্রে যার সামান্যতম প্রবেশ রয়েছে সে জানে 'উপ' পূর্বক 'বস্' ধাতুর অনশন বা ভোজন নিবৃত্তি রূপ অর্থ অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। 

অষ্টাধ্যায়ীর প্রথম অধ্যায়ের চতুর্থ পাদের ৪৮ তম সূত্র ‘উপান্বধ্যাঙ্-বসঃ’ অর্থ– উপ, অনু, অধি, আ এই চারটি উপসর্গের সঙ্গে বস্ ধাতুর যোগ হলে বাস ক্রিয়ার আধারের কর্ম সংজ্ঞা হয়। কর্মবাচক শব্দের উত্তর দ্বিতীয়া বিভক্তি হয় এটি মোটামুটি আমাদের সকলেরই জানা। এই সূত্রের উদাহরণ হল গ্রামম্ উপবসতি (গ্রামের নিকটে বাস করে)। গ্রামম্ অনুবসতি/অধিবসতি/আবসতি (গ্রামে বাস করে)।

অষ্টাধ্যায়ীর মহামুনি পতঞ্জলি-কৃত ভাষ্যে এই সূত্রের অর্থ বিবরণে বলেছেন, 

“বসেরশ্যর্থস্য প্রতিষেধঃ॥ (বার্তিক) বসেরশ্যর্থস্য প্রতিষেধো বক্তব্যঃ। গ্রামে উপবসতীতি॥ স তর্হি বক্তব্যঃ ? ন বক্তব্যঃ । নাঽত্রোপপূর্বস্য বসের্গ্রামোঽধিকরণম্ । কস্য তর্হি ? অনুপসর্গস্য । গ্রামেঽসৌ বসংস্ত্রিরাত্রম্ উপবসতীতি॥”

বঙ্গানুবাদঃ অশ্যর্থক বস্ ধাতুর প্রতিষেধ বলতে হবে। গ্রামে উপবসতি। তাহলে সেটি কি বলা প্রয়োজন? না বলার প্রয়োজন নেই। এখানে গ্রাম উপ পূর্বক বস্ ধাতুর অধিকরণ নয়। তাহলে কার অধিকরণ? অনুপসর্গ (বস্ ধাতুর)। গ্রামে বাস করে সে তিন রাত্রি উপবাস করেছে।

অশ্যর্থক = অশি+অর্থক। পাণিনীয় ব্যাকরণে কোন ধাতুর সঙ্গে ‘ই’ বর্ণ যোগ করে সেই ধাতুটিকে নির্দেশ করার পদ্ধতি রয়েছে। (দ্রষ্টব্য ‘ইক্শ্তিপৌ ধাতুনির্দেশে’ ‘রোগাখ্যায়াং ণ্বুল্ বহুলম্’ (৩.৩.১০৮) সূত্রের মহাভাষ্য) অশ্ ধাতুর অর্থ ভোজন। মাধবীয়ধাতুবৃত্তি, ক্ষীরস্বামীর ক্ষীরতরঙ্গিণী এবং মৈত্রেয়রক্ষিতের ধাতুপ্রদীপ – এই তিনটি প্রাচীন ধাতুপাঠেই ‘অশ’ ধাতুর অর্থ দেওয়া হয়েছে ‘ভোজন।’ দয়ানন্দ সরস্বতীর স্বীকৃত ধাতুপাঠেও অশ ধাতুর অর্থ ‘ভোজন’ গ্রহণ করা হয়েছে।

সুতরাং মহাভাষ্যের এই অংশটিতে সহজেই বোঝা যায় যে, বস্ ধাতুর অশন বা ভোজন রূপ অর্থও স্বীকৃত। অন্যথা অশ্যর্থক বস্ ধাতুর কথা মহাভাষ্যকার বলতেন না।

পরের অংশের তাৎপর্য বোঝার জন্য আমরা এর পরে বামন-জয়াদিত্য কৃত কাশিকা ব্যাখ্যার শরণাপন্ন হতে পারি।

কাশিকায় উক্ত সূত্রের অর্থ বিবরণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “বসেরশ্যর্থস্য প্রতিষেধো বক্তব্যঃ। গ্রামে উপবসতি। ভোজননিবৃত্তিং করোতি ইত্যর্থঃ।”

বঙ্গানুবাদঃ অশ্যর্থক বস্ ধাতুর প্রতিষেধ বলতে হবে। গ্রামে উপবসতি। অর্থাৎ ভোজননিবৃত্তি করে।

সুতরাং, কাশিকাকার স্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন শব্দে উপবসতি শব্দের অর্থ বলেছেন ভোজন নিবৃত্তি বা না খাওয়া।

কেউ কেউ "উপবাস" শব্দের একপাক্ষিক অর্থ করার জন্য শতপথ ব্রাহ্মণের প্রথম কাণ্ড, প্রথম প্রপাঠক, প্রথম ব্রাহ্মণের ৭ নাম্বার মন্ত্রেরও উল্লেখ করে।


"সেই দেবগণ ইহার গৃহে (ব্রতদিবসে) আগমন করেন তাঁহারা ইহার গৃহে (আসিয়া) ইহার নিকট বাস করিয়া থাকেন (উ প ব স ন্তি) সেই জন্য  তাহার (ব্রত দিবসে) নাম উপবসথ।" 

যাইহোক এই মন্ত্রে কিন্তু "ব্রতদিবস" এর উল্লেখ আছে অর্থাৎ বিশেষ দিবসের ব্রত যে শাস্ত্রসম্মত সেটাও কিন্তু প্রমাণিত হলো।

তারা মূল মন্ত্র বা অনুবাদ কিছুই না দিয়ে স্বভাবসিদ্ধভাবে কেবল কাটছাঁট করে একটা স্ক্রিনশট প্রচার করেছে কেবল। আমরা সম্পূর্ণ বিষয়টা পরিস্কার করে দিচ্ছি।

"অথাতোঽশনানশনস্যৈব। তদু হাষাঢ়ঃ সাবযসোঽনশনম্ এব ব্রতং মেনে মনো হ বৈ দেবা মনুষ্যস্যাজানন্তি ত এনম্ এতদ্ ব্রতম্ উপযন্তং বিদুঃ প্রাতর্নো যক্ষ্যত ইতি তেঽস্য বিশ্বে দেবা গৃহানাগচ্ছন্তি তেঽস্য গৃহেষূপবসন্তি স উপবসথঃ।"

অনুবাদঃ ব্রতের প্রসঙ্গে এই আলোচনা। ব্রতের পূর্ব দিনে যজমান কি অশন করবে, নাকি অনশন করবে? এই প্রসঙ্গে সাবয়স (সবয়ার পুত্র) আষাঢ় অনশন ব্রতই মনে করেন; কেননা, তিনি বলেন— ‘দেবগণ মনুষ্যের মনকে সমরূপে জানেন; তা এই ব্রতগ্রহগণকারীকে জানেন যে, ‘ইনি প্রাতঃকালে আমাদের যাগ করিবেন’; সেই দেবগণ ইহার গৃহে (ব্রতদিবসে) আগমন করেন, তাঁহারা ইহার পরে (আসিয়া ) ইহার নিকটে বাস করিয়া থাকেন (উপবসন্তি), সেই জন্য তাহার (ব্রত দিবসের) নাম উপবসথ।

এই মন্ত্রের শেষে উপবসথ শব্দের বিচার প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, যেহেতু সেই রাত্রিতে দেবতারা যজমানের নিকটে এসে বাস করেন সেজন্য সেই দিনটিকে উপবসথ বলা হয়। এখানে উপ পূর্বক বস্ ধাতুর সমীপে বাস রূপ অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। এবার আমাদের পরের মন্ত্রটি দেখা উচিত। পরের মন্ত্র 

“তন্ন্বেবানবকৢপ্তম্। যো মনুষ্যেষ্বনশ্নত্সু পূর্বোঽশ্নীয়াদ্ অথ কিমু যো দেবেষ্বনশ্নত্সু পূর্বোঽশ্নীয়াৎ তস্মাদু নৈবাশ্নীয়াৎ।”

অনুবাদঃ যে ব্যক্তি গৃহে সমাগত মনুষ্যের ভোজনের পূর্বে ভোজন করে সেই পাপী। যারা দেবতাদের ভোজনের পূর্বে ভোজন করবে তাদের কথা আর কী বলা? সেজন্য ব্রতী অবশ্যই খাবে না।

অর্থাৎ, শতপথের এই প্রমাণে উপ পূর্বক বস্ ধাতুর সমীপে বাস রূপ অর্থ যদি গৃহীত হয়, তবে ব্রতীর অনশনও প্রমাণিত হয়। প্রসঙ্গতঃ, উপ পূর্বক বস্ ধাতুর অর্থ যে নিকটে বাস তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তার বৈকল্পিক অনশন রূপ অর্থও সম্ভব। এবং অনশন বেদে নিষিদ্ধ নয়। শতপথের এই মন্ত্রের বা বলা ভাল এই সম্পূর্ণ প্রসঙ্গের আলোচনা থেকে আমাদের প্রতিপাদ্য সম্পূর্ণ বিষয়টিই  প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ বেদে ‘উপবাস’ (অনশন) রূপ ব্রত নেই এই কথা যারা বলে তারা ভ্রান্ত এবং বেদনিন্দুক।

আবারও ব্রাহ্মণ থেকেই রেফারেন্স দেওয়া যাক। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৩২/৯ মন্ত্রে দেখা যায় যজমান বিশেষ দিবসে ব্রত হেতু যজ্ঞকুণ্ডে উপবাস থেকে বসতেন। ওখানেও কিন্তু উপবাস অর্থ খাদ্য সংযম বা ভোজন ত্যাগ। 

উপবাসের উভয় অর্থই (সমীপে বাস ও ভোজন ত্যাগ) সঠিক কিন্তু কখন কোন অর্থ হবে তার সমাধানও ব্যাকরণে আছে। কোথায় কোন অর্থ নিতে হবে সেটা ঠিক হবে সপ্তমী ও দ্বিতীয়া বিভক্তির উপস্থিতির উপর। যদি দ্বিতীয়া থাকে তাহলে নিকটে বাস বোঝাবে। যদি সপ্তমী থাকে তবে অনশন বা ভোজন ত্যাগ বোঝাবে।

উপবাস তথা খাদ্য সংযম বা ভোজন ত্যাগ কি বেদবিরুদ্ধ? 

বেদে ভোজন নিবৃত্তি রূপ ধর্মকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যকের (আরণ্যক সন্দেহাতীত ভাবে বেদেরই অংশ) দশম প্রপাঠকে (মহানারায়ণোপনিষদে) ৬২ অনুবাকে মোক্ষসাধক জ্ঞানপ্রাপ্তির উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে অনশন বা ভোজন নিবৃত্তিকে মোক্ষলাভের একটি উৎকৃষ্ট ও কঠিন সাধন রূপে প্রতিপাদন করা হয়েছে। সেই অনুবাকের দ্বিতীয় মন্ত্র–

"তপ ইতি তপো নানশনাৎ পরং যদ্ধি পরং তপস্তদ্ দুর্ধর্ষং তদ্ দুরাধর্ষং তস্মাৎ তপসি রমন্তে॥"

অনুবাদঃ তপস্যাই মোক্ষের পরম সাধন। ভোজনহীনতা অর্থাৎ উপবাস বা একবার ভোজন ইত্যাদি রূপ ভোজনহীনতার থেকে উৎকৃষ্ট তপস্যা নেই। সেই উৎকৃষ্ট তপস্যা অসহনীয়। সেটি সমস্ত প্রাণীদেরই অত্যন্ত কষ্টকর বলে অনেকে উপবাসাদিরূপ তপস্যায় রমণ করেন অর্থাৎ সেই তপস্যা পালন করেন।

এখানে "অনশন" শব্দটি নঞ্-সমাস নিষ্পন্ন। ন অশন অনশন। অশন শব্দটি ভোজনার্থক অশ ধাতুর উত্তর ল্যুট্ প্রত্যয়ে নিষ্পন্ন। অশন শব্দের অর্থ ভোজন বা খাওয়া।

নঞ্ বা ন-এর ছয়টি অর্থে শাস্ত্রে প্রসিদ্ধ– সাদৃশ্য, অভাব, ভেদ, অল্পতা, অপ্রশস্ততা, বিরোধ। সুতরাং, উক্ত মন্ত্রে অনশন শব্দের দ্বারা ভোজনের অল্পতা বা ভোজনের বিরোধ (নিষেধ) বোঝানো হয়েছে। সুতরাং, অনশন মানে ভোজন নিবৃত্তি, কিংবা অল্প ভোজন।

কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতার ১ম কাণ্ডে ষষ্ঠ প্রপাঠকের সপ্তম অনুবাকে রয়েছে,
"... বজ্রো বৈ যজ্ঞঃ ক্ষুৎ খলু বৈ মনুষ্যস্য ভ্রাতৃব্যো যদনশ্বান্ উপবসতি বজ্রেণৈব সাক্ষাৎ ক্ষুধং ভ্রাতৃব্যং হন্তি।"
যজ্ঞ বজ্রের সমান। ক্ষুধা মানুষের শত্রুর সমান। যে ব্যক্তি ভোজন পরিত্যাগ করে উপবাস ব্রত পালন করে সে সাক্ষাৎ যজ্ঞরূপ বজ্রের দ্বারা ক্ষুধারূপ শত্রুকে বধ করে।
এখানে অনশ্বান্ উপবসেৎ কথার দ্বারা ভোজন ত্যাগ পূর্বক উপবাসের কথা বলা হয়েছে।
প্রসঙ্গতঃ আরেকটি আলোচনা সেরে ফেলা দরকার। এখানে উপবাসের দুইটি বিকল্প দেওয়া হয়েছে।
১. গ্রাম্য ভোজন (অর্থাৎ গ্রামে চাষ আবাদ দ্বারা যে শস্যাদি পাওয়া যায় তার দ্বারা নির্মিত ভোজন) পরিত্যাগ পূর্বক আরণ্য ভোজন (জঙ্গলে নিজে থেকে উৎপন্ন ফলাদি ভোজন);

২. সম্পূর্ণ রূপে ভোজন ত্যাগ। যে পূর্ব বিকল্প গ্রহণ করে গ্রাম্য ভোজন ত্যাগের কারণে তার গ্রাম্য পশু (গোরু, ঘোড়া, ছাগল, ভেড়া, গাধা, উট আদি) বৃদ্ধি পায় এবং আরণ্য ভোজন গ্রহণের কারণে হস্তী, পক্ষী প্রভৃতি আরণ্যক পশু বৃদ্ধি পায়। যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ রূপে ভোজন ত্যাগ করে পিতৃদেবতারা তাঁর প্রতি প্রসন্ন হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ প্রদান করেন।

অর্থাৎ, বেদাদি শাস্ত্রে ভোজন ত্যাগ করে উপবাস ব্রত পালন সাধনারই অংশ।

উপবাস ব্রত পালন করলে যদি ভোজন ত্যাগ হয় তাহলে কি জল পান করা যাবে? জল পান না করে ভোজন ত্যাগ ত বিজ্ঞান তথা অটোফ্যাজির সাথে সাংঘর্ষিক।

এই প্রশ্নের উত্তরও রয়েছে কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতার ১ম কাণ্ডে ষষ্ঠ প্রপাঠকের সপ্তম অনুবাকে রয়েছে

"যদি উপবাস রাখা হয় তবে ক্ষুদা বাড়ে, তখন জল পান করবে। জলে ভোজন হয়, আবার হয় না।" 

অর্থাৎ জল পান করলে ভোজন ত্যাগে কোন সমস্যা হয় না তথা উপবাস ভঙ্গ হয় না। প্রশ্ন আসতে পারে জল পানে ভোজন হয় না কেন? 

এর উত্তর আধুনিক বিজ্ঞানেই রয়েছে যা আমাদের ঋষিরাও জানতেন। জলকে কেউ ভোজনের মধ্যে গণ্য করেনা, জল হলো তৃষ্ণার অনুষঙ্গ। আর কেউ তৃষ্ণা মেটাবার জন্য ভোজন করেনা। ভোজনের জন্য প্রয়োজন হয় খাদ্য, জল কিন্তু খাদ্য নয়। 

জৈব রাসায়নিক ব্যাখ্যায়,

জলকে খাদ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। এটি সঠিক শারীরিক ক্রিয়াকলাপের জন্য প্রয়োজনীয়, তবে এটি আমাদেরকে প্রোটিন, চর্বি বা কার্বোহাইড্রেটের মতো অত্যাবশ্যক পুষ্টি দিয়ে পুষ্ট করে না যা আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তির জন্য ক্যালোরি সরবরাহ করে। অতএব, এটি কোন পুষ্টিকর খাদ্য গোষ্ঠীর মধ্যে তালিকাভুক্ত নয়। US-FDA (Food and Drug Administration) এর খাদ্য তালিকায়ও জলকে রাখা হয় নি।

অর্থাৎ জল পান করলে যেহেতু ভোজন হয় না তাই জল পান করলে উপবাসও (ভোজন ত্যাগ) ভঙ্গ হয় না। 

পরবর্তী অংশে আমরা একাদশী ব্রতের শাস্ত্রীয়, আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য ও বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করবো। 

© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি
🖋️ শ্রী অনিক কুমার সাহা
সহযোগিতায়ঃ ড. শ্রী রাকেশ দাশ (উপদেষ্টা, SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি)।
অধ্যাপক, বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়, বেলুর মঠ।
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ