কৈলাশ মন্দির- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও আশ্চর্যজনক মনোলিথিক স্ট্রাকচার ও স্থাপত্য



★মনোলিথিক স্ট্রাকচার কি?
#যে স্ট্রাকচার কেবল একটা মাত্র জিনিস কেটে অতিরক্তি কোন উপকরণ ছাড়াই একটা স্ট্রাকচার দাড় করানো হয়।
#কৈলাশ মন্দির ভারতের মহারাষ্ট্র (মুম্বাই) থেকে ৩৬০ কিঃমিঃ দূরে ইলোরায় অবস্থিত।
মহারাষ্ট্রের ইলোরাতে রয়েছে প্রায় ৩৪ টি গুহা মন্দির। এর মধ্যে প্রথম ১২ টা হচ্ছে বৌদ্ধ মন্দির, তারপর ১৭ টা হিন্দু মন্দির এবং সর্বশেষ ৫ টা হচ্ছে জৈন মন্দির। আশ্চর্যের ব্যাপার সবগুলো মন্দিরই বিশাল পাহাড় কেটে গুহা ভেতর তৈরী করা হয়েছে। এই ৩৪ টা গুহার মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হচ্ছে ১৬ নং গুহা।
ইলোরার ১৬ নং গুহায়ই রয়েছে সেই আশ্চর্যজনক "কৈলাশ মন্দির"।
কোণার্কের সূর্য মন্দির কিংবা মিশরের পিরামিড এগুলো তৈরী করা হয়েছে বড় বড় পাথরখন্ড একটার উপর আরেকটা রেখে কিন্তু ইলোরার গুহা মন্দিরগুলো করা হয়েছে পাথরের বিশাল পাহাড় কেটে। ইলোরার ১০ নাম্বার গুহা কিংবা বাকী মন্দিরগুলো কাটা হয়েছে গুহামুখ থেকে ভেতরের দিকে কিন্তু ১৬ তম গুহার কৈলাশ মন্দির সবথেকে আশ্চর্য এবং বিশ্বে বিরল কারন এই মন্দিরটি কাটা হয়েছে পাহাড়ের উপর থেকে নিচের দিকে। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় উপর থেকে কেটে প্রায় ১১০ ফুট নিচ অব্দি নিখুঁত আয়তাকার স্থাপত্যশৈলী ও সুনিপুণ কারুকার্য শোভিত এমন একটা মন্দির তৈরী করা অসম্ভব প্রায়। কারন আজ থেকে ১২০০ বছর আগে কোন আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না এবং বিশাল একটি পাথরের পাহাড়কে উপড় থেকে কাটা প্রায় অসম্ভব কারন পাথর একবার ভুল কেটে ফেললে সেটা আর সংশোধনের সুযোগ নেই। এই মন্দির কাটার আগেই নকশা করে নেওয়া হয়েছিল এবং সেই নকশা অনুযায়ীই এই মন্দির কাটা হয়েছিল সেটাও পাহাড়ের উপর থেকে একদম নির্ভুলভাবে। এই মন্দির যে নকশা মেনে করা হয়েছে তার প্রমান পাওয়া যায় কর্ণাটকের ভিরুপাকশা মন্দিরের নকশা দেখলে (দুইটা নকশাই কমেন্ট বক্সে দেওয়া হলো)
কৈলাশা মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী আশ্চর্যজনকভবে কর্ণাটকের ভিরুপাকশা মন্দিরের অনুরূপ। দুইটা মন্দিরে কাছাকাছি সময়ে তৈরী করা হয়েছিল। ১২০০ বছর আগে কোন আধুনিক ডিজাইন ইনস্ট্রুমেন্ট ছাড়া এই ধরণের নিখুঁত ডিজাইন করে পাহাড়ের উপর থেকে পাথর কেটে একটা মন্দির তৈরী করা প্রায় অসম্ভব।
আধুনিক স্থাপত্যবিদদের মতে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়েও এই ধরণের মনোথিলিক স্ট্রাকচার মাত্র ১৮ বছরে দাড়া করানো প্রায় অসম্ভব যেখানে এত সুনিপুণ কারুকার্যও বিদ্যমান।
জেনে অবাক হবেন এই আয়তাকার পাথর কেটে মন্দির বানাতে প্রায় ৩০ লক্ষ কিউবিট ফিট পাথর অপসারণ করা হয়েছে।


#এবার একটু হিসেব নিকেশ করি।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের দেওয়া তথ্যমতে এই মন্দিরের বেশিরভাগ অংশ তৈরি হয়েছিল রাষ্ট্রকূট রাজা প্রথম কৃষ্ণের শাসনামলে (৭৫৬-৭৭৩ খ্রীস্টাব্দ)। এই মন্দির নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল ১৮ বছর আর পাহাড় কেটে মন্দির বানাতে পাথর অপসারণ করা হয়েছে প্রায় ৩ লাখ টন পাথর অপসারণ করা হয়েছিল। প্রতিদিনের হিসেবে প্রায় ৪৪ টন।
প্রতিদিন যদি ১১ ঘন্টা টানা কাজ করে তবেও ঘন্টায় প্রায় ৪ টন পাথর কাটা হয়েছে।
উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিক যযন্ত্রপাতি ছাড়া এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে?
আশ্চর্যের বিষয় পাথর কিন্তু এলোপাতাড়ি কাটা হয় নি। একদম নিখুঁতভাবে, সুনিপুণ নকশায় এক অসাধারণ মন্দির ফুটিয়ে তুলা হয়েছে।
আরেকটা বিষয় খুব আশ্চর্যের যে এই অপসারিত ৩ লাখ টন পাথর আশেপাশে কোথাও পাওয়া যায় নি।
এই মন্দিরটি এতটাই মজবুত করে বানানো হয়েছে যে সপ্তদশ শতকে কয়েকবার এই মন্দির আক্রান্ত হয়েও মাত্র ৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ১২০০ বছর পর এখনও দাড়িয়ে আছে।


#প্রত্নতাত্ত্ববিদ এম. কে. দেবালিকারের মতে এই মহান ও আশ্চর্য স্থাপনার প্রধান আর্কিটেক্ট ছিলেন কোকাসা। তিনি ছিলেন চালুক্য সাম্রাজ্যের প্রধান স্থপতি কিন্তু পরবর্তীতে হয়ত তাদেরকে ইলোরায় নিয়ে আসেন রাষ্ট্রকূট সম্রাট প্রথম কৃষ্ণ।
এখন প্রশ্ন হলো এই মন্দির কেন উপর থেকে নিচের দিকে কাটা হলো?
সেটা জানতে হলে আগে জানতে হবে কেন এই মন্দির নির্মান করা হয়েছিল।


#একবার রাজা প্রথম কৃষ্ণ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন রানী এই মহেশ্বর শিবের কাছে প্রার্থণা করেন যদি তার স্বামী সুস্থ হন তবে এই ইলোরা পাহাড়ে তিনি একটা শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন। কিছুদিনের মধ্যেই তার স্বামী সুস্থ হয়ে যায় এবং রানী আরেকটা প্রতিজ্ঞা করেন যে এই মন্দিরের চূড়া না দেখা অব্দি তিনি উপবাস রাখবেন।


#রাজ্যের সব বড় বড় স্থপতি ও ভাস্করদের ডাকা হলো। সবাই বলল সাধারণ কোন মন্দির বানালেও মন্দিরের চূড়া বানাতে হবে সবার শেষে সেক্ষেত্রে চূড়া সম্পন্ন করতে কয়েক মাস লেগে যাবে এবং রানী এতদিন উপবাস করতে পারবেন না।


#এই সমস্যার সমাধান নিয়ে আসেন মহান স্থপতি কোকাসা।
তিনি বললেন যদি মন্দিরের শুরুই করা হয় চূড়া থেকে তবে হয়ত এক সপ্তাহের কম সময়েই চূরা সম্পন্ন করা যাবে। তখন সকলের কাছেই এই যুক্তি খুব হাস্যকর লেগেছিল। কিন্তু প্রথম কৃষ্ণ কোকাসাকেই নিয়োগ দিলেন এবং কোকাসা আজ থেকে ১২০০ বছর আগে নির্মাণ করে ফেললেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মনোলিথিক স্থাপত্য একদম নিখুঁত ও অসাধারণ কারুকার্যসহ।
ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে বহিরাগত অনেক শাসক বছরের পর বছর চেষ্টা করেন এই মন্দির ভেঙে ফেলার কিন্তু এই মন্দিরের মাত্র ৫ শতাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয় গত ১২০০ বছরে।।


#এই মন্দিরের ভেতর দিকে অনেকগুলো সুড়ঙ্গ পথ আছে যেগুলো ব্রিটিশ আমলে বিশাল পাথর দিয়ে বন্ধ করে ফেলা হয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে এই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে ভুগর্ভস্থ বিশাল নগরী আছে। যদিও এই বক্তব্যের কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। তবে সুড়ঙ্গ পথ গুলোর নিশ্চয়ই কোন ইতিহাস কিংবা রহস্য ত আছেই।

🅒স্টিমন অনিক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ