প্রশ্নঃ ঔষধ কি? ঔষধ কিভাবে কাজ করে? জলের ঔষধি গুণ কি?
উত্তরঃ রোগ নিরাময়ের উপাদানকে এক কথায় ঔষধ বলা যায়। প্রচলিত বিজ্ঞানের ধারণা হতে পাওয়া যায় যে ঔষধ মানুষের শরীরে নানাভাবে প্রবেশ করতে পারে। ইনহেলারের মাধ্যমে, ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে কিংবা গলধঃকরণের মাধ্যমে। শরীরে প্রবেশের পর ঔষধগুলোকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়। যখন আমরা মুখ দিয়ে ঔষধ গ্রহণ করি তখন সেটা আমাদের পরিপাকতন্ত্র দিয়ে চলাচল করে এবং আভ্যন্তরীণ অঙ্গ যেমন পাকস্থলী আর ক্ষুদ্রান্ত্র দ্বারা শোষিত হয়। তারপর সেটাকে লিভারে পাঠিয়ে দেয়া হয় আর তখন সেটার রাসায়নিক ধর্ম পরিবর্তন হয়। পরিশেষে সেটা রক্তে মুক্ত হয়ে যায়। যেহেতু রক্ত সমস্ত শরীরে পরিবাহিত হয় সুতরাং ঔষধও রক্তের মাধ্যমে শরীরের সবরকম অঙ্গ আর টিস্যুর সংস্পর্শে এসে তার কার্যকারিতা দেখায়।
এই বিষয়ে সনাতন জ্ঞানশাস্ত্রে বলা হয়েছে,
"যস্যৌষধীঃ প্রসর্পথাঙ্গমঙ্গং পরুস্পরু।
ততো যক্ষ্মং বি বাধধ্ব উগ্রো মধ্যমশীরিব।।"
- ঋগবেদ ১০/৯৭/১২
অনুবাদঃ হে ওষধি! যে ব্যক্তির অঙ্গ প্রত্যঙ্গে, গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে তুমি প্রবেশ করো, যুদ্ধক্ষেত্রে বীর সৈন্য শত্রুকে যেমন বিনাশ করে, তুমি তেমনই তাহার শরীরের মধ্যে ক্ষয় রোগকে বিনাশ কর।
অর্থাৎ, ঔষধকে ক্রিয়াশীল হওয়ার জন্য সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে পড়া আবশ্যক আর মাধ্যম হিসেবে কাজ করে রক্ত। ঔষধের ফলাফল নির্ভর করে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গে, গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে ছড়িয়ে পড়ার উপর। প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ধারণার অনেক আগেই সনাতন শাস্ত্রে এই বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছিল।
প্রশ্ন হতে পারে তাহলে মানবদেহে রক্ত কিভাবে পরিচালিত হয়?
এই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পেতে হলে আমাদের রক্তসংবাহনতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।
★ রক্তসংবহনতন্ত্র কি?
উত্তরঃ রক্তসংবাহনতন্ত্র/Blood Circulation একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া।
রক্ত হল আমাদের দেহের জ্বালানি স্বরূপ। মানবদেহে শতকরা ৭ ভাগ রক্ত থাকে (গড়ে মানবদেহে ৫-৬ লিটার রক্ত থাকে)।
আমাদের দেহে দুই ধরনের রক্ত প্রবাহিত হয় একটি হল অক্সিজেনযুক্ত বিশুদ্ধ রক্ত যা গাঢ় লাল আর অপরটি হল কার্বন-ডাই-অক্সাইড যুক্ত অবিশুদ্ধ রক্ত যা মূলত রক্তে বাই কার্বনেট হিসেবে প্রবাহিত হয় এবং এই ধরণের রক্তের রঙ হয় কালচে লাল৷ আমাদের দেহে এই রক্ত এত দ্রুত বেগে প্রবাহিত হয় যে সমস্ত দেহে রক্তের প্রবাহিত হতে মাত্র এক মিনিট বা তার চেয়েও কম সময় লাগে৷
এই বিষয়ে সনাতন জ্ঞানশাস্ত্রে কি বলা আছে?
"কো অস্মিন্নাপো ব্যঃ দদাদ্বিষূবৃতঃ পুরুবৃতঃ সিন্ধুস্রত্যায জাতাঃ।
তীব্রা অরুণা লোহিনিস্তম্রধুম্রা উর্ধ্বা অবাচীঃ পুরুষে তিরশ্চীঃ।। "
-অথর্ববেদ (১০/২/১১)
অনুবাদঃ কে মানবদেহে এই তরলের সৃষ্টি করেছেন যা নদীর মত প্রবাহিত হচ্ছে? ইহা লৌহযুক্ত, গাঢ় লাল ও কালচে লাল এবং ইহা তীব্রবেগে, উপর-নীচে, শরীরের সর্বত্র প্রবাহিত হচ্ছে।
আর আমরা সবাই জানি যে, রক্তের রঙ লাল হয় এতে উপস্থিত লৌহ জাতীয় প্রোটিনের কারনে যাকে হিমোগ্লোবিন বলা হয়।
জলের কি ধরনের ঔষধি গুণ বিদ্যমান?
উত্তরঃ এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় Water therapy/Hydro Therapy/জল চিকিৎসা।
★জল () দিয়ে কিভাবে চিকিৎসা সম্ভব? জল কিভাবে ঔষধের কাজ করে? জল চিকিৎসা কি?
উত্তরঃ ঔষধের ক্রিয়া সম্পর্কে উপরেই লিখেছি। জলও আমাদের শরীরে সেভাবেই ক্রিয়া করে।
প্রাকৃতিক (Natural) জল ব্যবহারের মাধ্যমে চিকিৎসার একটা পদ্ধতি হল জল চিকিৎসা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় Watertherapy বা Hydro therapy.
জল রক্তের বিষাক্ত উপাদান অপসারণ করতে কিডনিকে সাহায্য করে।
জলের স্পর্শে স্নায়ু একটা উদ্দীপনা শরীরের গভীরে নিয়ে যায় যার অনুভূতি ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে এবং স্ট্রেস হরমোনকে (Stress Hormone) নিউট্রাল করে। স্ট্রেস হরমোন শরীরে ক্লান্তির অনুভূতি জাগায়। জল রক্ত সঞ্চালনকে সজীব করে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়, হজম ক্রিয়া সুসংহত করে ও শরীরে ব্যথার অনুভূতি কমায়।
সঠিক নিয়মে জল পান করাটাও ওয়াটার থেরাপির আওতায় পড়ে। যেমন সকালে ঘুম থেকে উঠে দুই গ্লাস পরিমাণ, খাওয়ার এক ঘন্টা আগে ১ গ্লাস, স্নানের আধাঘন্টা আগে ১ গ্লাস, ঘুমাতে যাওয়ার একঘন্টা আগে ১ গ্লাস পরিমাণ জল পান করতে হবে।
সনাতন জ্ঞান শাস্ত্রে এই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণাই ছিল।
"অপ্সস্বহন্তরমৃতমপ্সু ভেষজমপামুত প্রশস্তয়ে। দেবা ভবত বাজিনঃ।।"
- ঋগবেদ (১/২৩/১৯)
অনুবাদঃ জলের মধ্যে অমৃত ও রোগ নিবারক শক্তি আছে। হে বিদ্বানগন! জলের সদ্ব্যবহার করিয়ে তোমরা শক্তিমান হও।
"অপ্সু মে সোমো অব্রবীদন্ত বির্শ্বানি ভেষজ।
অগ্নিং চ বিশ্বশম্ভুবমাপশ্চ বিশ্বভেষজ।।"
- ঋগবেদ (১/২৩/২০)
অনুবাদঃ অমৃতময় পরমাত্মা আমাকে উপদেশ দিয়াছেন যে জলের মধ্যে সমস্ত ওষধি বিদ্যমান, অগ্নি সর্ব্বত্র কল্যাণকারী এবং জল সব রোগের চিকিৎসক।
অর্থাৎ, জলের ঔষধীগুণ অনুধাবন করুন এবং প্রতিদিন অন্তত ৯-১০ গ্লাস পরিমাণ জল পান করুন৷
©স্টিমন অনিক
0 মন্তব্যসমূহ