রামজন্মভূমির মামলায় রামজন্মভূমির স্বপক্ষে বাল্মীকী রামায়ণ, রামচরিতমানস সহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু আমরা হয়ত অনেকেই জানি, আবার অনেকেই হয়ত জানিনা যে, সবচেয়ে বেশি যেই গ্রন্থের রেফারেন্স ব্যবহার করা হয়েছে, এবং মামলায় জয়লাভ করতে যেই গ্রন্থের অবদান সবচেয়ে বেশি, তা হল স্কন্ধপুরাণ। এই স্কন্ধপুরাণ ও রামজন্মভূমি নিয়েই আজকের আলোচনা। প্রথমে আমরা দেখবো স্কন্ধপুরাণে অযোধ্যা সম্পর্কে কি কি উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর আমরা রামজন্মভূমি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের ভারডিক্ট থেকে দেখবো স্কন্ধ পুরাণের রেফারেন্স কিভাবে মামলায় জয়লাভে সহায়তা করেছে।
প্রথমে আসা যাক স্কন্ধ পুরাণের বৈষ্ণব খন্ডের অযোধ্যা
মাহাত্ম্যে। বিরাট
এই অধ্যায়ের পুরোটা জুড়ে অযোধ্যা সম্পর্কেই বর্ণিত হয়েছে, তবে আমরা কয়েকটি মাত্র প্রাসঙ্গিক
শ্লোক দেখবো এখানে।
অযোধ্যা নামের অর্থঃ
অ কারো ব্রহ্ম চ প্রোক্তং য কারো বিষ্ণুরুচ্যতে।
ধ কারো রুদ্ররূপশ্চ অযোধ্যানাম রাজতে ।। ১-৬০
অ-কার ব্রহ্ম, য-কার বিষ্ণু এবং ধ-কার রুদ্রের রূপ; অযোধ্যা-এই বর্ণত্রয়ে সম্পন্ন হয়ে বিরাজ করে; অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব এখানে সতত বাস করেন, এজন্য এই ক্ষেত্রের নাম অযোধ্যা হয়েছে।
শ্রীহরির (শ্রীরামের) গর্ভগৃহের অবস্থানঃ
সহস্রধারামারভ্য যোজনং পূর্ব্বতো দিশি।
প্রতীচি দিশি তথৈব যোজনং সমতোহবধিঃ।। ১-৬৪
পূর্বদিকে সহস্র ধারা হতে একযোজন, পশ্চিম দিকে সম হতে একযোজন, দক্ষিণে সরযু হতে একযোজন এবং উত্তরে তমসা হতে একযোজন, এটাই অযোধ্যাক্ষেত্রের সংস্থান ও এই স্থান মধ্যে হরির অন্তর্গৃহ অবস্থিত।
অযোধ্যায় নবরাত্রি উদযাপনঃ
তস্য যাত্রা বিধাতব্যা
সপুষ্যা নবরাত্রিষু।
তৎপশ্চিমদিশাভাগে বিঘ্নেশং
কিল পূজয়েৎ ॥ ১০-১৬
যস্য দর্শনতো নৃণাং বিঘ্নলেশো ন বিদ্যতে।
তস্মাদ্বিগ্নেশ্বরঃ পূজ্যঃ সর্ব্বকামফলপ্রদঃ।।১০-১৭
নবরাত্রির
মধ্যে পুষ্যাধক্ত দিবসে পিণ্ডারকের যাত্রা বিধেয়। পিণ্ডারকের পশ্চিমে বিঘ্নেশের পূজা
করবে; বিঘ্নেশের দর্শনে মানবের বিঘ্নলেশ থাকে না;
অতএব সর্ব্বকামফলপ্রদ বিঘ্নেশের পূজা কর্তব্য।
শ্রীরামজন্মভূমির
অবস্থানঃ
তস্মাৎ স্থানত ঐশানে রামজন্ম প্রবর্ততে।
জন্মস্থানমিদং প্রোক্তং মোক্ষাদিফলসাধনম্।। ১০-১৮
বিঘ্নেশ্বরাৎ পূর্বভাগে বাসিষ্ঠাদুত্তরে তথা।
লৌমশাৎ পশ্চিমে ভাগে জন্মস্থানং ততঃ স্মৃতম্।। ১০-১৯
বিঘ্নেশের ঈশানকোণে মোক্ষাদিফলসাধন রামজন্মনামক স্থান বিদ্যমান। বিঘ্নেশের পূর্ব্বে,
বশিষ্ঠের উত্তরে ও লৌমশের পশ্চিমে রামজন্মস্থান কথিত হয়।
Part-N. Suit 5: The deities
N.10 Nature and use of the disputed structure: oral evidence
স্কন্ধ পুরাণের উল্লেখ প্রথম যেই সাক্ষীর নিকট থেকে পাওয়া যায়, তিনি হলেন Mahant Paramhans Ram Chandra Das (OPW-1)
সাক্ষী Shri Ram Nath Mishra Alias Banarsi Panda (OPW-5) নিজের বক্তব্যে স্কন্ধ পুরাণ ও তার সাথে সাথে ব্রহ্ম পুরাণ এবং বরাহ পুরাণের কথা উল্লেখ করেন।
N.13 The polestar of faith and belief
এই সেকশনে রামজন্মভূমির অবস্থান সম্পর্কে হিন্দুদের বিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে বাল্মীকী রামায়ণ ও রামচরিতমানসের সাথে উল্লিখিত হয় স্কন্ধপুরাণের নাম।
শুধু নামই না, ভারডিক্টের উক্ত সেকশনে স্কন্ধ পুরাণের শ্লোকের উল্লেখও পাওয়া যায়।
ADDENDA
Whether disputed structure is the
holy birth place of Lord Ram as per the faith, belief and trust of the Hindus?
এই সেকশনে দেখা যাক, ওরাল এভিডেন্সের পাশাপাশি কিভাবে এবং কতবার স্কন্ধ পুরাণের রেফারেন্স ব্যবহৃত হয়েছে রামজন্মভূমির কেসে। সকল স্ক্রিনশট নিচে সিরিয়ালি দেওয়া হলো।
তবে স্কন্ধ পুরাণে স্পষ্ট প্রমান থাকলেও এর বিরুদ্ধে বাধাও কম ছিলো না। চারজন বামপন্থী ইতিহাসবিদ - আর এস শর্মা, ডি এন ঝা, সুরাজ ভান ও এম আতহার আলি কোর্টে একটি রিপোর্ট পেশ করে “The Historian’s Report to Nation” নামে। এবং সেখানে তারা সেটাই দাবী করে, যেটা তর্ক যুক্তিতে না পারা মূর্খ ও প্রক্ষিপ্তবাদীরা সর্বদা নিজেদের ভুয়া মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এবং যেটা বর্তমানে হিন্দুদের মাঝেই ভেকধারী কিছু অজ্ঞানী সমাজ প্রচার করছে – স্কন্ধপুরাণ প্রক্ষিপ্ত এবং অযোধ্যা মাহাত্ম্য পরবর্তী সংযোজন!!
কিন্তু কোর্ট তাদের এই অনর্থক দাবী গ্রহন করে না। কোর্ট জানায় কেস চলাকালীন স্কন্ধ পুরাণের অযোধ্যা মাহাত্ম্যের অনেক শ্লোক বিভিন্ন সময় ক্রস এক্সামিন করা হয়েছে, কিন্তু কোথাও থেকে একবারও এমন কোনো clue পাওয়া যায়নি যাতে একে পরবর্তী সংযোজন বলা যেতে পারে।
যাই হোক, যুগে যুগে আগাছার মত গজিয়ে উঠা এসকল রামবিদ্বেষী, কলির অসুরদের সকল চেষ্টা বিফল করে, তাদের মনে ঈর্ষা জাগিয়ে এবং সকল প্রমান, বাল্মীকী রামায়ণ ও বিশেষ করে স্কন্ধ পুরাণের অবিস্মরণীয় অবদানে শেষ পর্যন্ত কোর্টের রায় এটাই আসে যে, বিতর্কিত স্থানটিই প্রভু শ্রীরামের জন্মভূমি।
এই ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষনীয় এটাই যে, সকল সমস্যার সমাধান বা সমাধান পর্যন্ত পৌঁছানোর উপায় আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রেই বর্ণিত আছে। সনাতন সংস্কৃতি "এক গ্রন্থ, এক উপাস্য"-র ভিত্তিতে গঠিত নয়। বেদ, তন্ত্র, স্মৃতি, পুরাণ, ইতিহাস প্রভৃতি শাস্ত্রের অভাব নেই আমাদের। দরকার শুধু শ্রদ্ধাভরে নিজেদের শাস্ত্রের অধ্যায়ন ও উপলব্ধি করা এবং সকলকিছুর মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখা। তবেই ব্যক্তিগত ও জাতিগত পর্যায়ে সকলের জাগতিক ও পারমার্থিক কল্যান সাধিত হবে। এবং একই সাথে সেসব অধোগামী, ধর্মব্যবসায়ী, নব্য গড়ে ওঠা স্বার্থান্বেষী মহলের প্রতি ধিক্কার, যারা নিজেদের স্বার্থ ও ব্যবসার লোভে প্রভু শ্রীরাম ও রামমন্দিরকে অপমান করে এবং সমগ্র পুরাণশাস্ত্রকে প্রক্ষিপ্ত ও বিকৃত বলে প্রচার করে।
সম্পূর্ণ ভারডিক্টঃ
https://www.sci.gov.in/pdf/JUD_2.pdf
শেষ করছি প্রভু শ্রীরামের স্তুতি দিয়ে
সনাতন শাস্ত্র ও দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর।।
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)
0 মন্তব্যসমূহ