আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি অপপ্রচার খুব দেখা যাচ্ছে যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও মাতা রুক্মিনীর বিবাহকালীন বয়স নিয়ে। আমরা আজ সনাতন শাস্ত্রাঘাতে সে অপপ্রচারই খণ্ডন করবো। এক্ষেত্রে আমরা অন্যের ব্লগ টুকে না লিখে নিজেরা যাচাই-বাছাই করে অথেনটিক শাস্ত্র হতে তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করবো।
প্রথম অপপ্রচারঃ
প্রথমে দেখে নেওয়া যাক, এদের আপত্তিগুলো কি কি?
আপত্তিঃ
শ্রীকৃষ্ণ যখন রুক্মিণীকে বিয়ে করেন তখন তাঁর বয়স ছিল ৮ বছর। (রেফারেন্স: স্কন্দ পুরাণ: ৫.৩.১৪২.৮-৭৯)।
শ্রীকৃষ্ণ যখন রুক্মিণীর সাথে যৌনক্রিয়া শুরু করে তখন তিনি পরিপূর্ণ ভাবে বেড়ে উঠেনি এবং যৌনতা সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না, ফলে শ্রীকৃষ্ণ যৌনক্রিয়া করায় রুক্মিণী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। (রেফারেন্স: ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, শ্রীকৃষ্ণ জন্ম খন্ডঃ ১১২/১-১০)
খণ্ডনঃ
এবার তবে আপত্তির খণ্ডন করা যাক। খণ্ডন শেষে সুধী পাঠকমাত্রই বুঝবেন যে কি পরিমান মানসিক দৈন্যতা ও অন্তঃসারশূন্য ভাবনার জগতে বিচরণ করলে মানুষ এহেন অপপ্রচার করে।
পুরাণোক্ত বিবাহকালীন মাতা রুক্মিণীর বয়স প্রসঙ্গেঃ
দেখা যাক, প্রদত্ত রেফারেন্সে স্কন্দ পুরাণে (৫/৩/১৪২/১৩-১৪) ঠিক কি লেখা হয়েছে!
"ততঃ সা কালপর্ষায়াদষ্টবর্ষা ব্যজায়ত পূর্ব্বোক্তং চৈব তদ্ধাক্যমশরীরিণ্যুদীয়িতম্।
স্মৃত্বা স্মৃত্বাথ নৃপতিশ্চিন্তয়ামাস ভূপতিঃ। কস্মৈ ময়া বালা ভবিতাক শ্চতুর্ভূজঃ।"
অনুবাদঃ অনন্তর রুক্মিণী কালক্রমে অষ্টবর্ষে পদার্পণ করলে অশরীরি বাণীর (দৈববানী) স্মরণ করিয়া চিন্তিত হইলেন। ভূপতি ভাবিলেন, বালকন্যা রুক্মিণীকে কাহার করে (হস্তে) অর্পণ করিব? আকাশবাণী যে চতুর্ভূজের কথা কহিয়াছেন, সেই চতুর্ভূজই বা কে?
পরবর্তী শ্লোকগুলো অনুবাদ করলে অর্থ এইরূপ হয় যে,
রাজা ভীষ্মক যখন এইরূপ চিন্তা করিতেছেন তখন সভাস্থলে গিরিবর রেবত হইতে নৃপশ্রেষ্ঠ চেদিপতি দমঘোষ তথায় উপস্থিত হইয়া যে স্থানে ভীষ্মক উপবিষ্ট ছিলেন, সেই সভামণ্ডপে গমন করিলেন। ভূপতি ভীষ্মক চেধিপতিকে গৃহাগত দেখিয়া তাহাকে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক সভা মণ্ডপে উপবেশন করাইলেন। রাজা শ্রীমান চেদিপতিকে কুশল জিজ্ঞেস করিলেন। চেদিপতি বলিলেন 'আজ পুন্যহা তাই আমি আপনার দর্শনে উপস্থিত হইয়াছি।' হে রাজেন্দ্র! আমার কন্না অষ্টমবর্ষে পদার্পণ করিয়াছে। আকাশবাণী কহিয়াছিলেন এই কন্যা চতুর্ভুজকে প্রদান করিতে হইবে।
ভীষ্মকের বাক্যে দমঘোষ বললেন,
"চতুভূর্জো মম সুতস্ত্রিষু লোকেষু বিশ্রুতঃ তস্যেয়ঃ দীয়তাং কন্যা শিশুপালস্য ভীষ্মক।
তস্য তদ্বচনং শ্রুত্বা দমঘোষস্য ভূমিপ ভীষ্মকেন ততো দত্তা শিশুপালায় রুক্মিণী।"
স্কন্দ পুরাণঃ (৫/৩/১৪২/২০-২১)
অনুবাদঃ হে ভীষ্মক আপনার এই কন্যাকে আমার পুত্র শিশুপালের করে অর্পণ করুন। হে ভূমিপ! ভীষ্মক তখন দমঘোষ বাক্য শ্রবণ করিয়া কন্যা রুক্মিণীকে শিশুপালের করে অর্পণ করিতে মনস্থ করিলেন।
বিচার-বিশ্লেষণঃ
পাঠক একটু লক্ষ্য করুন মাতা রুক্মিণীর যখন আট বছর বয়স, তখন কেবল তাঁর পিতা পূর্ব ঘোষিত দৈব বানী স্মরণ করে চিন্তিত হন যে চতুর্ভুজ কে যার হাতে নিজ কন্যাকে অর্পন করতে বলা হয়েছে। চিন্তিত পিতা এই বিষয়টি যখন চেদিপতিকে জানালেন তখন তিনি নিজ পুত্রের নাম (শিশুপাল) উত্থাপন করলেন। এতে করে ভীষ্মক আশ্বস্ত হলেন এবং শিশুপালের সাথে মাতা রুক্মিনীর বিয়ের ব্যাপারে মনস্থির করলেন। এখানে স্পষ্টত কেবল বিয়ের ব্যাপার মনস্থির করলেন কিন্তু বিয়ে দেন নি। এখনও অনেকেই পারিবারিকভাবে ছোটবেলায় বিয়ের কথাবার্তা নিশ্চিত করে রাখেন এর অর্থ বিয়ে দেওয়া নয়। উল্লেখ্য যে এই ক্ষেত্রে উভয়েরই বয়সে পার্থক্য খুব একটা বেশি হয় না।
অবশ্য এরপরের শ্লোক দেখিয়ে সমালোচকগণ তর্ক করতে পারেন। যথাঃ
"প্রারদ্ধং মঙ্গলং তত্র ভীষ্মকেন যুধিষ্ঠির।
দিক্ষু দেশান্তরেষ্বেব যে বসন্তি স্বগোত্রজাঃ।।"
স্কন্দ পুরাণঃ (৫/৩/১৪২/২২)
অনুবাদঃ ভীষ্মকের আদেশে বৈবাহিক মঙ্গলক্রিয়া আয়োজিত হইল। দেশে বিদেশে যেখানে তাঁহার যে জাতিগোত্র বাস করিতেন, এ বিবাহে সকলেই নিবন্ধিত হইলেন; সকলেই ভীষ্মপুরে আগমন করিলেন।
বিচার-বিশ্লেষণঃ
পাঠক এখানে পুনরায় মনোযোগ দিন। এই জায়গাটা না বোঝার কারনেই যত গোলযোগের সৃষ্টি হয়েছে। ভীষ্মক আট বছর বয়সেই রুক্মিণীর বিবাহের বিষয়ে মনস্থির করেন ঠিক কিন্তু তিনি বৈবাহিক মঙ্গলক্রিয়া শুরু করেছিলেন আরও নয়/দশ বছর পর। এই মাঝখানের নয় দশ বছরের ঘটনা পুরাণকার উল্লেখ করেননি। তাই স্কন্দ পুরাণের বাকি অংশ এবং শ্রীকৃষ্ণ ও রুক্মিণীর বিবাহকেন্দ্রিক ঘটনাবলী অন্যান্য পুরাণের ঘটনা না পড়ে কেবল মাঝখান হতে রেফারেন্স টুকে এই শ্লোককটার বিশ্লেষণ করলে এই ভাবনা আসা স্বাভাবিক যে রুক্মিণীর আট বছর বয়সেই বিয়ে হয়েছিলো৷ শাস্ত্রধ্যয়নের কিছু ধারা আছে৷ শর্টকাটে শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে শাস্ত্রের অর্থ উদ্ধার সম্ভব নয় বরং বিভ্রান্তির সুযোগ বেশি।
এবার দেখুন, এই স্কন্দ পুরাণেই (৫/৩/১৪২/২৬) বিবাহ অনুষ্ঠান চলাকালীন মাতা রুক্মিণীর বিষয়ে কি বলা হয়েছে!
"সাপশ্যতত্র দেবেশং গোপবেষধরং হরিম।
তং দৃষ্ট্বা মোহমাপন্না কামেন কলুষাকৃতা।"
অনুবাদঃ রুক্মিণী তখন গোপ বেশধারী দেবেশ হরিকে (শ্রীকৃষ্ণ) দর্শন করিলেন। কামে তাঁহার চিত্ত কলুসিত হইল। তিনি মোহপ্রাপ্ত হই লেন।
প্রশ্ন হলো, রুক্মিণী যদি বিবাহকালীন সময়ে আট বছরের বালিকাই হতেন, তবে এক সুদর্শন পুরুষকে দেখে তাঁর মনে কামোদ্রেক হতো কি? একজন সুবিবেচক হিসেবে চিন্তা করুন।
এটুকু তথ্য পর্যাপ্ত নয় তাই আমরা এবার বেশ কিছু পুরাণ হতে উদ্ধৃতি দিবো।
"ক ত্বা মুকুন্দি মহতী কুলশীলরূপ- বিদ্যাবয়োদ্রবিণধামভিরত্নতুল্যম্
ধীরা পতিং কুলবর্তী ন বৃণীত কন্যা।
কালে নৃসিংহ নরলোকমনোহভিরামম্।"
শ্রীমদ্ভাগবত (১০/১৫২/৩৮)
অনুবাদঃ (রুক্মীণি বলছেন) হে প্রেমস্বরূপ শ্যামসুন্দর! যে দৃষ্টিতেই দেখি কুল, শীল, স্বভাব, সৌন্দর্য, বিদ্যা, অবস্থা, ধন-ধাম সব দিক দিয়েই আপনি যেন অদ্বিতীয়। আপনার তুলনা স্বয়ং আপনি। মানবলোকের সকল প্রাণীর মন আপনাকে দেখে শান্তি অনুভব করে ও আনন্দ লাভ করে। অতএব হে পরমপুরুষ! আপনিই বলুন এমন কোনো কুলবর্তী, মহাগুণবতী ও ধৈর্যবতী কন্যা আছে যে বিবাহযোগ্যা হয়েও আপনাকেই স্বামীরূপে বরণ করে নেবে না?
দেখা যাচ্ছে, মাতা রুক্মিণী এখানে নিজেকে বিবাহযোগ্যা বলছেন। আর শ্রীকৃষ্ণ এই কথার কোনো প্রতিবাদ না করে রুক্মিণীকে বিবাহ করায় প্রমাণিত হয় শ্রীকৃষ্ণও সমর্থন করেছেন যে রুক্মিণীর বিবাহের বয়স হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, শ্রীকৃষ্ণ যে আত্মস্বরূপ শিবভক্ত ছিলেন তা সর্বজনবিদিত, তাও দুটো উদ্ধৃতি দেখাই,
"অহমাত্মা।হ লোকনাংবিশ্বেষাং পান্ডুনন্দনা তস্মাদাত্মান মেবাগ্রে রুদ্রং সংপূজয়াম্যহম।।"
মহা.শান্তিপর্ব (৩২৭/২২)
অনুবাদঃ শ্রীকৃষ্ণ বললেন, পান্ডুনন্দন আমি সমস্ত লোকের জীবাত্মা, অতত্রব আমি প্রথমে আমার আত্মস্বরূপ রুদ্রের পূজা করিয়া থাকি।
"যদ্যহং নাৰ্চিয়েয়ং বৈ ঈশানং বরদং শিবম।
আত্মনং নাৰ্চয়েৎ কশ্চিদিতি মে ভাবিতাত্মম।।"
মহা.শান্তিপর্ব (৩২৭/২৩)
অনুবাদঃ পান্ডুনন্দন! আমি যদি বরদাতা ও ঈশ্বর শিবের পূজা না করি, তাহা হইলে কেহই আমার পূজা করিবে না ইহাই আমার ধারণা।
অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ আত্মস্বরূপ শিবের উপাসক ছিলেন। তাই শিবের বানীই শ্রীকৃষ্ণের বানী।
এইসব বলার উদ্দেশ্য একটাই যে মহাদেব কন্যার বিবাহের বয়স নিয়ে বলেছেন,
"অজ্ঞাতপতিমর্য্যাদাম অজ্ঞাতপতিসেবনাম্
নোদ্বাহয়েৎ পিতা বালাম্ অজ্ঞাতধর্মশাসনাম্।"
মহানির্বানতন্ত্র (৮/১০৭)
অনুবাদঃ যে নারী পতি মর্যাদা জানতে পারেনি, যে নারী পতিসেবার উপযুক্ত নয়, যে নারী ধর্মের শাসন অবগত নয়, পিতা তাদৃশ বালিকা কন্যার বিবাহ দিবেন না।।
অর্থাৎ মহাদেব এখানে স্পষ্টভাবেই বালিকা কন্যাকে বিবাহের অনুপযোগী বলেছেন। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ শিবের উপাসক ছিলেন তাই তিনি যখন রুক্মিণীকে বিবাহের উপযোগী বলেই মেনেছেন, তখন আর সন্দেহ থাকেনা যে বিয়ের সময় মাতা রুক্মিণী বালিকা ছিলেন না।
এবার আসি রুক্মিণী দেবী যে বিবাহকালীন যুবতী ছিলেন, তার প্রমানে।
"তাং দেবমায়ামিব বীরমোহিনীং সুমধ্যমাং কুণ্ডলমণ্ডিতাননাম্।
শ্যামাং ব্যঞ্জস্তনীং নিতম্বার্পিতরত্নমেখলাং কুহুলশঙ্কিতেক্ষণাম্।।
শ্রীমদ্ভাগবত (১০/৫৩/৫১)
অনুবাদঃ হে পরীক্ষিৎ ! শ্রীরুক্মিণী শ্রীভগবানের মায়ার মতন বড় বড় ধীর-বীরদেরও মোহিত করতে সক্ষম ছিলেন। তাঁর সুন্দর ও ক্ষীণ কটিদেশের সৌন্দর্য ছিল অনুপম। তাঁর বদনমণ্ডলে কর্ণকুণ্ডল যুগলের শোভা ছিল নয়নাভিরাম। কৈশোর-যৌবনের বয়ঃসন্ধি সুনিতম্বিনীর দেহে রত্ন খচিত চন্দ্রহারের সৌন্দর্য ছিল অপরূপ। বক্ষঃস্থলে ছিল যৌবনের অঙ্কুরোদগম। দোদুল্যমান অলকদাম হেতু তাঁর দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠছিল।
শ্রীকৃষ্ণের প্রামাণ্য এবং প্রাথমিক উৎসের জীবনী ভাগবতে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে মাতা রুক্মিণী যৌবনপ্রাপ্তা ছিলেন তা আমরা দেখলাম। তবে উক্ত শ্লোকের কোন শব্দে যদি কেহ অশ্লীলতা খুঁজে পান তবে তার মানসিক স্থিতি নিয়ে আমাদের সন্দেহ রয়েছে।
এবার আসি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরেকটি জীবনী ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে। মাতা রুক্মিণী সম্পর্কে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে,
"নবযৌবনসম্পন্না রত্না ভরণভূষিতা।
তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভা তেজস জ্বলিতা সতী।। "
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ (শ্রীকৃষ্ণজন্মখন্ড/১৫০/৪)
অনুবাদঃ তিনি নবযৌবনসম্পন্না, রত্ন দ্বারা শোভিতা। তিনি একজন সতী নারী যার উজ্জ্বলতা তপ্ত স্বর্ণের মতো।
"শরৎ ভূর্ণেন্দুশোভাঢ্যাং শরৎকমললোচনাম্।
দ্বারকানগরে বিবাহযোগ্যাং যুবতীৎ লজ্জানম্রাননাং শুভম্"
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ (শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড/১০৫/৯)
অনুবাদঃ তিনি শরতের চাঁদের মতো সুন্দরী এবং শরতের পদ্মের মতো নয়ন তাঁর। তিনি সলজ্জা, বিবাহের যোগ্যা ও উত্তম যুবতী।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের এই দুই শ্লোকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে বিবাহকালীন মাতা রুক্মিণী যুবতী ছিলেন।
এবার আমরা হরিবংশ পুরাণ হতে আরও কিছু উদ্ধৃতি দেখাই,
"विवाहयोग्या कन्या मे वर्धमाना मनोहरा ।
शीघ्रं पश्य वरं योग्यं नवयौवनसंस्थितम् ||
হরিবংশ পুরাণ (২/৫৯/১২)
My growing daughter has achieved the age of puberty, therefore a groom for her should be searched immediately.
অতএব এখানেও দেখা যাচ্ছে, বিবাহের আগেই রুক্মিণী Puberty বা বয়ঃসন্ধিকালের শেষভাগ অর্থাৎ সময়টাকে যৌবনারম্ভ ধরা হয়।
অতএব, বিচক্ষণ পাঠক মাত্রই বুঝবেন যে মাতা রুক্মিণীর বাল্যবিবাহ হয়নি, তিনি যৌবনপ্রাপ্ত হয়েই বিবাহ করেছিলেন।
দ্বিতীয় অপপ্রচারঃ
আপত্তিঃ
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে নাকি বলা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণ যখন রুক্মিণীর সাথে যৌনক্রিয়া শুরু করে তখন তিনি পরিপূর্ণ ভাবে বেড়ে উঠেনি এবং যৌনতা সম্পর্কে তাঁর কোনো জ্ঞান ছিল না, ফলে শ্রীকৃষ্ণ যৌনক্রিয়া করায় রুক্মিণী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রেফারেন্স হিসেবে দিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড - ১১২/১-১০।
খণ্ডনঃ
আমরা আগেই প্রমান করেছি যে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মাতা রুক্মিণীকে যৌবনপ্রাপ্তা বলা হয়েছে। অতএব, তাদের এই দাবি যে ভিত্তিহীন তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এবার চলুন দেখি এই শ্লোকে আসলে কি বলা হয়েছে!
"বাসুদেবো দ্বারকায়াং বহুদেবীজ্ঞয়া মুনে।
প্রষযৌ রত্নরচিত রুক্মিণীমন্দিরং বরম্ ॥ শুদ্ধস্ফটিকসঙ্কাশমমূল্যরত্বনির্ম্মিতম্।
পুরতঃ পারতো রম্যং নানাচিত্ৰেণ চিত্রিতম্ ॥
অমূল্যরত্নকলসং শ্বেতচামরদপণৈঃ।
বহ্নিশুদ্ধাংশুকৈঃ শুন্ধৈঃ পরিতঃ পরিশোভিতম্ ॥
দদর্শ রুক্মিণীং দেবীগতীব নবযৌবনাম্ ।
রত্নপর্যাঙ্ক মারুহ শয়ানাং সম্মিতাং মুদ৷ ॥
ও অপ্রৌঢ়াঞ্চ নবোঢ়াং তাং নবসঙ্গমলজ্জিতাম্ । অমূলরত্ননির্ব্বাণ-ভূষণেন বিভূষিতাম্ ॥
রত্নদর্পণহতঞ্চ সিন্দূরবিন্দুশোভিতাম্ ।
লুচারুকবরীভারাং মালতীমাল্যভূষিতাম্ ॥
দৃষ্ট্ব৷ কান্তং ভীকেঙ্গা! সহসা এণনাম সা শুভক্ষণে চ শুভয়াস রেমে রাময়। সহ ॥
সুখসম্ভোগমাত্রেণ মুর্ছামাপ মুদ| সতী।
তস্মিন্ জজ্ঞে কামদেবে৷ ভস্মীভূতশ্চ শম্ভূনা ॥ "
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ (শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড/১১২/১-৮)
অনুবাদঃ নারায়ণ কহিলেন, মুনে! বাসুদেব তাঁর পিতা বসুদেবের আজ্ঞাক্রমে দ্বারকাতে উপস্থিত হইয়া রত্নবিনির্ম্মিত উৎকৃষ্ট রুক্মিণীমন্দিরে গমন করিলেন। অমুল্য রত্ন- নির্ম্মিত সেই গৃহের আভা যেন বিশুদ্ধ স্ফটিক মণির ন্যায় দীপ্যমান। অগ্রভাগে অতি রমণীয় ও চতুর্দিক নানান চিত্রে বিচিত্রিত। উহার স্থানে স্থানে অমূল্য রত্নকলস। চারিদিকে শ্বেত-চামর, দর্পণ এবং বহ্নি- বিশুদ্ধ অংশুকদ্বারা সেই গৃহ পরিশোভিত। ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ, নবযৌবন-সম্পন্না পরমানন্দে রত্নমগ্ন পালঙ্কের উপর শয়ানা এবং সম্মিতা রুক্মিণীদেবীকে দর্শন করিলেন। তিনি প্রৌঢ়া নয়; কিন্তু নবোঢ়ার শেষভাগে অবস্থিতা; সুতরাং নবসঙ্গমে লজ্জিতা। তাঁহার শরীর অমূল্য রত্ননির্ম্মিত ভূষণে বিভূষিত হস্তে রত্নময় দর্পণ, কপাল সিন্দূরবিন্দুদ্বারা শোভিত, মস্তকের সুচারু কবরীভার মালতীলো অলঙ্কৃত। ভীষ্মক কন্যা রুক্মিণী, দর্শন করিবামাত্র কে প্রণাম করি- অনন্তর শ্রীকৃষ্ণ, শুভক্ষণে তাঁহার সহিত রমণ করিলেন। রুক্মিণীদেবী সুখসম্ভোগমাত্রে হর্ষিতা হইয়া মূর্ছিতা হইলেন।
বিচার-বিশ্লেষণঃ বোঝাই যাচ্ছে যে যারা অপপ্রচার করছে তারা স্বচ্ছ মনে সম্পূর্ণ বিবরণটা পড়েও দেখে নি। যেখানে বলা আছে যে সহবাসকালে রুক্মিণী নবযৌবনসম্পন্না ছিলেন এবং লাজুক হয়েছিলেন (সহবাস সম্পর্কে জ্ঞাত বলেই লাজুক হয়েছিলেন), সেখানে তারা বলে দিলো যে মাতা রুক্মিণী তখন শিশু ছিলেন এবং এই কারনে নাকি তিনি ধকল সইতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যান!
কি ভয়ংকর ভাবনাচিন্তা!
অজ্ঞানের প্রসঙ্গে বলে রাখি, এই পুরাণে কিন্তু বলা হয়নি যে রুক্মিণী শিশু ছিলেন বলে ধকল সইতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যান, বরং বলা হয়েছে, সহবাসকালে অতি সুখ অনুভব করায় তিনি সুখে মূর্ছা গেছেন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকের নিকট নিশ্চয়ই সুখে মূর্ছা যাওয়া ব্যাপারটা ব্যাখা করার দরকার নেই।
এবার অনেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন যে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে ঐরকম অশ্লীলভাবে কেন সঙ্গমের প্রসঙ্গ এলো? তাদের উদ্দেশ্যে বলি, স্বামী স্ত্রীর রমণ কবে থেকে অশ্লীল হয়ে গেলো! যখন এই পুরাণসমূহ রচিত হয়েছিলো তখন অশ্লীলতার সংজ্ঞা ভিন্ন ছিলো তখন মানবের মন সদা কামার্ত ছিলো না বরং উন্নত মানসিকতার সুশিক্ষিত মানুষ ছিল সেসময়। আজকাল যেভাবে মানুষের মনে অশ্লীলতার দোলাচল তাতে করে আগামীতে বায়োলজি ক্লাসে সেক্স-ক্রোমোজম, পরাগায়ণ, নিষেকের মতো টপিকগুলো তুলে দিতে হবে৷ জেনে রাখা ভালো পৃথিবীর প্রাচীনতম সঙ্গম সাহিত্য 'তামিল-সঙ্গম' ভারত ভূমিতেই রচিত।
মূল লেখাঃ শ্রী নিলয় চৌধুরী
সহযোগিতায়ঃ শ্রী গৌরব চৌধুরী, শ্রী অনিক কুমার সাহা।
SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)
0 মন্তব্যসমূহ