শ্রীরাধাকে নিয়ে বিতর্ক অনেক কালের। কারো জন্য তিনি প্রধান উপাস্য, আবার কারো কাছে তিনি শুধুই একজন কাল্পনিক চরিত্র!! অনেকে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের সাথে সাথে শ্রীরাধাকেও সরাসরি অস্বীকার করে বলে যে, রাধা চরিত্রের নির্মাণ নাকি শুধুমাত্র কৃষ্ণচরিত্রকে অপমান করার জন্য হয়েছে! এও শোনা যায়, একমাত্র ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ বাদে অন্য কোনো পুরাণে নাকি শ্রীরাধার উল্লেখ নেই!
শুরুতেই এই পুরাণ নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রসঙ্গতঃ এটিই সেই গ্রন্থ, রামায়ণের পাশাপাশি
যার বিশাল অবদান আছে রামমন্দিরের মামলায় জয়লাভ করার পিছে। স্কন্ধ পুরাণের অনেক রেফারেন্স
ব্যবহৃত হয় রামজন্মভূমি নিয়ে বিতর্কের মীমাংসায়।
স্কন্ধ পুরাণের বৈষ্ণব খণ্ড-ভাগবত মাহাত্ম্য, অধ্যায় ২, শ্লোক ১১-১৭
এখানে শ্রীরাধার উল্লেখ পাওয়া যায়। বলা
হয় রাধা হলেন আত্মা এবং শ্রীকৃষ্ণ হলেন আত্মারাম।
স্কন্ধ পুরাণের বৈষ্ণব খণ্ড -বাসুদেব মাহাত্ম্য, অধ্যায় ২৬, শ্লোক ২৭-৩০
এখানে শ্রীরাধা কৃষ্ণের বিগ্রহের বর্ণনা পাওয়া যায়।
স্কন্ধ পুরাণের বৈষ্ণব খণ্ড -বাসুদেব মাহাত্ম্য, অধ্যায় ২৬, শ্লোক ২৭-৩০
এখানে পুরো অধ্যায়েই রাধা কৃষ্ণের স্বরূপের ধ্যান নিয়ে বলা হয়েছে।
স্কন্ধ পুরাণের বৈষ্ণব খণ্ড -বাসুদেব মাহাত্ম্য, অধ্যায় ২৯, শ্লোক ১৫
বাসুদেবের পূজা
পদ্ধতির অধ্যায়ের এই শ্লোকে শ্রীরাধার বিগ্রহকে সজ্জিত করার কথা পাওয়া যায়।
স্কন্ধ পুরাণের প্রভাস খণ্ড -দ্বারকা মাহাত্ম্য, অধ্যায় ১২, শ্লোক ৩০
মায়া সরোবোর
সম্পর্কিত অধ্যায়ের এই শ্লোকে শ্রীরাধার উল্লেখ পাওয়া যায়।
পদ্ম পুরানঃ
পদ্ম পুরাণের ব্রহ্ম খণ্ড, অধ্যায় ৭
এই অধ্যায়ে পাওয়া যায় রাধাষ্টমীর মাহাত্ম্য।
পদ্ম পুরাণের ব্রহ্ম খণ্ড, অধ্যায় ২০
এই অধ্যায়ে রাধা দামোদর উপাসনার মাহাত্ম্য সম্পর্কে জানা যায়।
পদ্ম পুরাণের পাতাল খণ্ড, অধ্যায় ৭১
এই অধ্যায়ে
রাধা কৃষ্ণের মাহাত্ম্য নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
পদ্ম পুরাণের পাতাল খণ্ড, অধ্যায় ৮২, শ্লোক ৪৪-৪৬
বৃন্দাবনের
মাহাত্ম্য সম্পর্কিত এই অধ্যায়ের উক্ত শ্লোকে শ্রীরাধার উল্লেখ পাওয়া যায়।
বরাহ পুরানঃ
বরাহ পুরাণের অধ্যায় ১৬৪, শ্লোক ৩৫-৩৬
অন্নকূটের মাহাত্ম্য
সম্পর্কিত এই অধ্যায়ের উক্ত শ্লোকে শ্রীরাধা-কৃষ্ণ ও রাধাকুন্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়।
নারদ পুরানঃ
নারদ পুরাণের অধ্যায় ৮২
এই অধ্যায়ে
রাধা কৃষ্ণের সহস্রনাম উল্লিখিত হয়েছে।
মৎস্য পুরাণের অধ্যায় ১৩,
শ্লোক ৩৮
এতে বৃন্দাবনের রাধা ও দ্বারাবতীর রুক্মিনী নামের উল্লেখ রয়েছে।
শিব পুরানঃ
শিব পুরাণের রুদ্র সংহিতা, পার্বতী খন্ড, অধ্যায় ২, শ্লোক ৩০
এতে বৃষভানু
কন্যা রাধার কথা বলা হয়েছে।
শিব পুরাণের রুদ্র সংহিতা,যুদ্ধ খন্ড, অধ্যায় ১৬, শ্লোক ১০
এতে কৃষ্ণ প্রসঙ্গে
রাধার উল্লেখ পাওয়া যায়।
শিব পুরাণের রুদ্র সংহিতা,যুদ্ধ খন্ড, অধ্যায় ২৮, শ্লোক ২৩-২৪
এতে সুদামা, কৃষ্ণ ও রাধার প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে।
শিব পুরাণের রুদ্র সংহিতা,যুদ্ধ খন্ড, অধ্যায় ২৯, শ্লোক ৫৩-৫৫
এখানে শ্রীরাধার উল্লেখের পাশাপাশি তাঁকে সমস্ত জগতের মাতৃস্বরূপা বলা হয়েছে।
শিব পুরাণের রুদ্র সংহিতা,যুদ্ধ খন্ড, অধ্যায় ৩১, শ্লোক ১২-৪৩
এখানে শঙ্খচূড়
প্রসঙ্গে সুদামা, কৃষ্ণ ও রাধার কথা বর্ণিত হয়েছে। কয়েকটি
শ্লোকের ছবি দেওয়া হলো।
বায়ু পুরানঃ
বায়ু পুরাণের অধ্যায় ১০৪, শ্লোক ৫২; অথবা, ভলিউম ২, অধ্যায় ৪২, শ্লোক
৫২
এখানে রাধা কৃষ্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ব্রহ্মান্ড পুরানঃ
ব্রহ্মান্ড পুরাণের ভলিউম ২, সেকশন ৩, অধ্যায় ৪২, শ্লোক ২১-৫৫
এখানে শ্রীরাধা-কৃষ্ণ,পরশুরাম,শিব-পার্বতী
ও গনেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। কয়েকটি শ্লোকের ছবি দেওয়া হলো।
ব্রহ্মান্ড পুরাণের ভলিউম ২, সেকশন ৩, অধ্যায় ৪৩, শ্লোক ৭-২৯
এখানেও একসাথে শ্রীরাধা-কৃষ্ণ,পরশুরাম,শিব-পার্বতী ও গনেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। কয়েকটি শ্লোকের ছবি দেওয়া হলো।
লিঙ্গ পুরানঃ
লিঙ্গ পুরাণের অধ্যায় ১২৩, শ্লোক ১০
এখানে রাধা গায়ত্রী মন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানঃ
এই পুরানের
বেশ কিছু আপত্তিকর ও অসংলগ্ন কাহিনীর কারণে এবং বিভিন্ন গবেষকের গবেষণা অনুসারে এই
পুরাণের কিছু অংশকে অথেনটিক মানা হয়না। তবে লক্ষনীয় বিষয় হলো ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকাশিত বেঙ্গল
স্ক্রিপ্ট ছাড়াও আরো দুটি স্ক্রিপ্ট রয়েছে; সাউথ স্ক্রিপ্ট ও কাশ্মীর স্ক্রিপ্ট। এই
দুটি স্ক্রিপ্টেও রাধাকৃষ্ণের বিশেষ বর্ণনা রয়েছে, কিন্তু বেঙ্গল ভার্সনে বর্ণিত রাধাকৃষ্ণের
বিভিন্ন অসংলগ্ন ঘটনাগুলোর তেমন কোনো উল্লেখ এগুলোতে পাওয়া যায়না!
দেবীভাগবত পুরানঃ
দেবীভাগবত পুরাণের স্কন্ধ ৭, অধ্যায় ৩০, শ্লোক ৬৯
এখানে বর্ণিত হয়েছে রুক্মিণী আছেন দ্বারাবতীতে এবং রাধা রয়েছেন বৃন্দাবনে।
দেবীভাগবত পুরাণের স্কন্ধ ৯, অধ্যায় ৩৯, শ্লোক ৯-১০,১৩
এখানে বলা হয়েছে শ্রীরাধা ডানপার্শ্ব থেকে সম্ভূতা হয়ে শ্রীকৃষ্ণের সাথে একাত্ম হলেন।
দেবীভাগবত পুরাণের স্কন্ধ ৯, অধ্যায় ৫০, শ্লোক ১-৫১
মহাভাগবত পুরানঃ
মহাভাগবত পুরাণের অধ্যায় ৪৯, শ্লোক ২২
এখানে বলা হয়েছে যখন কালী কৃষ্ণরূপে আসবেন, তখন মহাদেব রাধা হয়ে আবির্ভূত হবেন।
মহাভাগবত পুরাণের অধ্যায় ৫৩
এখানে পুরো অধ্যায়ে রাধাকৃষ্ণের রাস বর্ণিত হয়েছে। কিছু শ্লোকের ছবি দেওয়া হলো।
আদি পুরানঃ
শ্রীরূপগোস্বামীপাদ রচিত “শ্রীলঘুভাগবতামৃতম” গ্রন্থের উত্তরখন্ডের ৪৬ তম শ্লোকের বিবরন মতে, আদিপুরানে শ্রীরাধার উল্লেখ পাওয়া যায়।
সুতরাং,
দেখা যাচ্ছে শুধু একটা দুটো নয়, বরং অনেক পুরাণেই শ্রীরাধার প্রত্যক্ষ উল্লেখ রয়েছে।
তাছাড়া
এগুলোই সব প্রমাণ নয়। এর বাইরেও অনেক পুরাণ আছে, যা পাঠ করা সম্ভব হয়নি। বা, এগুলোর
মধ্যেও হয়ত কিছু অংশ বাদ পড়ে গিয়েছে।
তাছাড়া
এখানে তন্ত্রশাস্ত্র নিয়েও কোনো আলোচনা হয়নি,
যেখানে শ্রীরাধার বিস্তৃতি ব্যাপক এবং গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আশা করি সামনে এই বিষয়ে আলাদা আলোচনা হবে।
তবে
আজকের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য হলো, যদি আমরা ভাগবত পুরাণ-১০ম স্কন্ধ, ৩০ তম অধ্যায়, ২৬-২৮ তম শ্লোকে এবং
বিষ্ণু পুরাণ-৫ম অংশ,
১৩ তম অধ্যায়, ৩৩-৩৫তম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণের
সাথে অন্তর্হিত হওয়া "এক বিশেষ গোপী"র মাঝে শ্রীরাধার পরোক্ষ উপস্থিতি বিবেচনা
নাও করি, তারপরও তিনি কাল্পনিক চরিত্র হয়ে যাননা। কারণ, সমগ্র পুরাণ শাস্ত্র জুড়েই
বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে শ্রীরাধার উল্লেখ রয়েছে।
সুতরাং, সমস্ত প্রমাণ সাপেক্ষে এটাই স্বীকার্য যে, শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণের মতোই একজন ঐতিহাসিক এবং আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব।
© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
সনাতন শাস্ত্র ও দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর।।
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)
0 মন্তব্যসমূহ