"সোমরস" -এর বৈদিক মীমাংসা।।


সোম কি?

বৈদিক যুগে 'সোম' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চর্চার বিষয় ছিলো। ঋগ্বেদ ও সামবেদ সংহিতায় অসংখ্য মন্ত্র রয়েছে সোমকে নিয়ে। বেদের 'সোম' নিয়ে লিখতে গেলে মোটামুটি একটি গবেষণা গ্রন্থ দাঁড় করানো যাবে। চারবেদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার এবং বৈদিক শাস্ত্রের উপর অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করে ভারত সরকার কর্তৃক "পদ্মশ্রী" পুরস্কারে ভূষিত RL Kashyap মহাশয় সোম-এর উপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন "Soma, The delight of existence" নামে।

ঋগ্বেদে 'সোম' একদিকে একজন দেবতা এবং অন্যদিকে দেবহব্য যা দেবতাদের জন্য প্রদেয় শ্রেষ্ঠ হব্য। সুতরাং সংহিতায় সোমের রূপ দুইটি। একটি পার্থিব এবং অন্যটি দিব্য। পার্থিব 'সোমলতা' ছেঁচে যে রস বের করা হত, সেটা বৈদিক ঋষিরা বিবিধ অনুষ্ঠান শেষে সোমরস হিসেবে পান করতেন, দেবতারাও আনন্দ লাভ করার জন্যই 'সোম' পান করতেন। তাই ঋগ্বেদের ৯ম মণ্ডলের পবমান সুক্তের একটি মন্ত্রে (৯/১০৬/৮) বলা হচ্ছে "ত্বাং দেবাসো অমৃতায় কং পপুঃ.."। এই সুক্তের দেবতা পবমান (দিব্য সোম) এবং হব্য হলো পার্থিব সোম। সামবেদের (কৌথুম শাখা) একটি মন্ত্রেও (১/১/৭) অগ্নির উদ্দেশ্যে একটি স্তুতিতে সোমরস দিয়ে সমৃদ্ধ করতে বলা হয়। 

সোমরস কি?

সোমরস মূলত একটি ওষধি। ঋগ্বেদ সংহিতার ৯/৮৩ সুক্তে সোমরসের উল্লেখ পাওয়া যায়। যজ্ঞে (সোমযাগ) সোমরসের বিনিয়োগ পাওয়া যায় আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্রে। আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্রের ৫ম অধ্যায়ের দ্বাদশ কাণ্ডিকায় সোমরসের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়। ঋগ্বেদের ৯/৮৩ সুক্তের দেবতা হলেন পবমান সোম। এই সুক্তের দ্বিতীয় ও তৃতীয় মন্ত্রে সোমের (চন্দ্র) স্তুতি করে চতুর্থ মন্ত্রে সৎকর্মকারীকে সোমরস পান করতে বলা হয়। সোমরস এখানে ওষধি, মদ নয়। স্কন্ধ পুরাণেও আমরা পাই ব্রহ্মা সোমকে (চন্দ্র) ওষধির অধিপতি হিসেবে নিযুক্ত করেন। সোমের (চাঁদ) সাথে ওষধির কি সংযোগ তা আমরা শেষের দিকে দেখাচ্ছি। 

আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্রের ৫/১২/৩নং সূত্রে দেখা যায় গ্রাবস্তুত্কে হবির্ধানমণ্ডপে প্রবেশ করে সোমের (চন্দ্র) দিকে মুখ করে তাকাতে বলা হয়েছে। তারপর ৫/১২/৬নং সূত্রে বলা হয়, যে কাপড় দিয়ে সোমলতা বেঁধে রাখা হয় সে কাপড়টিই যজমান গ্রাবস্তুত্কে উষ্ণীব (পাগড়ি) হিসেবে দেন। ঋগ্বেদ সংহিতার একটি প্রসিদ্ধ সুক্ত (১০/৯৪) আছে যা 'গ্রাবস্তোত্র' নামে পরিচিত। সোমযাগে যিনি গ্রাবস্তোত্র পাঠ করবেন তাঁকেই গ্রাবস্তুত্ বলে। গ্রাবা বা নুড়ি (পাথর) থেকেই গ্রাবস্তোত্র। সোমযাগের সময় যে পাথর দিয়ে সোমলতা ছেঁচা হয় সেই পাথরকেই 'গ্রাবা' বলা হয়। আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্রের ৫/১২/৭ সূত্রে এর বিস্তারিত উল্লেখ পাওয়া যায়। চন্দ্রের উদ্দেশ্যে সোমরস নিষ্কাশন পর্যন্ত ঋগ্বেদ সংহিতার ১০/৭৬ ও ১০/১৭৫ দুই সুক্তের মাঝামাঝি বা আগে ও পরের মন্ত্রগুলো এবং অবশ্যই পবমানগুলো (ঋগ্বেদ সংহিতার ৯ম মণ্ডল) অন্তর্ভুক্ত করে শেষ মন্ত্র (গ্রাবস্তোত্র) পাঠ করে পাগড়িটি আবার যজমানকে ফেরত দিবে গ্রাবস্তুত্। এরপর যজ্ঞাবিশিষ্ট সোমরস পান করা হয়৷ শ্রীমদভগবদগীতার ৯/২০নং শ্লোকেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, 

"ত্রৈবিদ্যা মাং সোমপাঃ পূতপাপা
যজ্ঞৈরিষ্ট্বা স্বর্গতিং পার্থয়ন্তে।"

অনুবাদঃ ত্রিবেদজ্ঞগণ যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা আমাকে আরাধনা করে যজ্ঞাবশিষ্ট সোমরস পান করে পাপমুক্ত হন এবং স্বর্গে গমন প্রার্থনা করেন।

এই হলো বেদ- বেদাঙ্গে ও গীতায় সোমযাগ, সোমরস ও সোম (চন্দ্র) এর সংযোগ।

সোমলতা কি?

সোমলতা নামক এক ওষধি উদ্ভিদের রস থেকে তৈরি হয় সোমরস। ঋগ্বেদ সংহিতার ১০/৮৫/৩ মন্ত্রে ওষধি হিসেবে সোমের উল্লেখ রয়েছে যথা "পাপিবান ইয়াৎ সংপিংষন্ত্য ওষধিম্..." 

According to Ayurveda, Somlata has Astringent taste and reduces vitiated Kapha and Vata doshas. The main chemical compounds present in Somlata are ephedrine, nor-ephedrine, flavonoids, catechols, and polysaccharides. It has antimicrobial, anti-asthmatic, diuretic, anti-inflammatory, and anti-aging properties.

এখানে স্পষ্ট বলা হচ্ছে যে সোমলতার রসের ওষধি গুণাবলি অনেক এবং এর এন্টি-এজিং (বার্ধক্য নিরোধক) গুণাবলির জন্য ইহা দেহকে পুষ্ট করে। সোমলতার এই এন্টি-এজিং বা আয়ু বর্ধক গুণের উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদ সংহিতায়। ঋগ্বের সংহিতার ৩/৬২/১৫ মন্ত্রে সোমকে "আয়ুর বর্ধায়ণ.." বলা হয়েছে।

সোমলতার বৈজ্ঞাণিক নাম হলো Ephedra Gerardiana. এটি আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, উত্তর ভারত, সিকিম ও তিব্বতের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলে পাওয়া যায়; যদিও এখন প্রকৃত সোমলতা পাওয়া যায় না। 

সোমের (চন্দ্র) সাথে ঔষধির সংযোগ কি?

ব্রহ্মপুরাণের নবম অধ্যায় ও স্কন্ধ পুরাণে (কাশীখণ্ড, চতুর্দশ অধ্যায়, শ্লোকঃ ২৪-২৬) চাঁদের ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কে আলোচনা পাওয়া যায়। সেখানে বলা হচ্ছে প্রজাপতি ব্রহ্মা সোমকে (চাঁদ) ওষধি, বীজ, জলরাশীর অধিপতি নিযুক্ত করেন। অর্থাৎ ওষধি (ভেষজ উদ্ভিদ), বীজের অঙ্কুরোদগম থেকে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও জলরাশীর হ্রাসবৃদ্ধির (জোয়ারভাটা)  উপর সরাসরি চাঁদের প্রভাব রয়েছে। এটাই পুরাণের সিদ্ধান্ত এবং চাঁদের এই প্রভাব সম্পর্কে সম্ভবত সবচেয়ে প্রাচীন সিদ্ধান্তও বটে। 

সাধারণত আমরা জানি উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে সূর্যের প্রভাব রয়েছে কিন্তু চাঁদের প্রভাব! তবে জেনে নেওয়া যাক আধুনিক গবেষণায় কি পাওয়া যাচ্ছে!

জোয়ার ভাটার পাশাপাশি উদ্ভিদ বা ওষধির ওপরেও রয়েছে চন্দ্রের প্রভাব। চাঁদের আলো সূর্যের আলোর তুলনায় অত্যন্ত কম (মাত্র ১৫%) শক্তিশালী হলেও উদ্ভিদের ওপর এর প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেশিরভাগ উদ্ভিদেরই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লাভ, বৃদ্ধি ও বিস্তারের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চাঁদের আলো অপরিহার্য হয়ে থাকে। চন্দ্র প্রতিটি জীবিত কোষস্থিত জলের ওপর প্রভাব ফেলে।  

Isabella Guerrini (University of Perugia, ইতালি) ২০১২ সালে "Mysteries and symbols in plants and gardens" নামক একটি স্টাডিতে দেখান চন্দ্রের বৃদ্ধির সাথে সাথে উদ্ভিদের অভ্যন্তরে রস সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় এবং চন্দ্রের হ্রাসের সাথে সাথে রস সঞ্চালনও হ্রাস পায়। তিনি এটাও দেখান পূর্ণ চন্দ্রের সময় রসালো উদ্ভিদের অঙ্গছেদ করলে তারা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং “লুনার বার্ন” নামক ঘটনার শিকার হয়, অপরদিকে শুষ্ক উদ্ভিদকে এই সময় কাটলে তারা পার্শ্ব অংকুর ও প্রশাখা বৃদ্ধি সহ নানা সুবিধা লাভ করে থাকে। 

Ernst Zürcher এর ২০১১ সালের পাব্লিকেশন "Plants and the Moon-Traditions and Phenomena" এর মতে, বিভিন্ন উদ্ভিদের আদ্রতা এবং বীজের অঙ্কুরোদগম, বৃদ্ধি ও বিকাশ চন্দ্রের হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত। 

বেশিরভাগ ভেষজ গুনসম্পন্ন উদ্ভিদের ওপর চাঁদের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মূলত এরা রাতে বৃদ্ধি পায় এবং চাঁদের আলো বা হ্রাস-বৃদ্ধি এদের জীবদ্দশায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের বলা হয় “Herbs of the Moon". এসব উদ্ভিদ ঔষধি বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং আমাদের শারীরিক, মানসিক এমনকি আধ্যাত্মিক স্তরেও উন্নতি সাধনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এমন কিছু উদ্ভিদ হলোঃ মৌরি, পদ্ম, গোলাপ, কাঁটাগাছ, আদা, জবা, পপি, বাঁশ, নারকেল, তেঁতুল, বাদাম, ঘৃতকুমারী, ট্যাপিওকা, শালগম, কলমি, বিচুটি, রাস্পবেরি, রেড ক্লোভার, ডামিয়ানা ইত্যাদি।

সোমরস ও সুরার মধ্যে তফাৎ কি? 

অনেকে বলার চেষ্টা করে যে সোমরস ও সুরা একই এবং সুরা হলো মাদক জাতীয় পানীয়। আসলেই কি তাই? চলুন দেখে নেওয়া যাক শুক্ল যজুর্বেদীয় শতপথ ব্রাহ্মণে (মাধ্যন্দিন শাখা) কি বলা হয়েছে!! শতপথ ব্রাহ্মণের ৫/১/২/১০ মন্ত্রে বলা হয়, "সত্যংশ্রীর্জ্যোতিঃ সোমহনৃতং পাপ্মা তমঃ সুরৈ......" অর্থাৎ সোমরস সত্য, শ্রী ও জ্যোতির প্রকাশ এবং সুরা হলো অনৃত ও পাপস্বরূপ। শতপথ ব্রাহ্মণের ৫/১/২/১৫ মন্ত্রে দেখা যায় যজ্ঞে সোমরস ও সুরার পাত্র আলাদা স্থানে রাখা হয় যাতে উভয়ই একত্রে মিলে না যায়৷ কারণ শতপথ ব্রাহ্মণ ৫/১/২/১৭ মন্ত্রে বলা হচ্ছে যে এতে করে জ্যোতি ও অন্ধকার পরস্পর মিশে যাবে। শতপথ ব্রাহ্মণের ৫/১/২/১৮ মন্ত্রে দেখা যায় যে দুই পাত্র আলাদাভাবে স্থাপন করে বলা হয়, "সুখ ও কল্যাণের সাথে আমাকে যুক্ত করো, পাপ থেকে আমাকে বিমুক্ত করো।" এখানেও স্পষ্টত প্রতীয়মান হচ্ছে যে সোমরস কোন মাদক পানীয় নয় এবং সোমরস ও সুরা একই দ্রব্যও নয়।

★ সোমরসে কি মাদকতা রয়েছে?
ঋগ্বেদ সংহিতার একটি মন্ত্রে (৯/৯/৯) রয়েছে "স্বাদিষ্ঠয়া মদিষ্ঠয়া পবস্ব সোম ধারয়া" অর্থাৎ সোম যেন স্বাদুতম (মুখরোচক) মাদকতম ধারায় মধুর ধারায় ক্ষরিত হয়। এই মাদকতা সুখের ও আনন্দের। "মদিষ্ঠয়া" শব্দের প্রয়োগে সোমের আহ্লাদ জনকতাকেই প্রকাশ করে। ঋষিরা তাই বলেছেন, সোম "সুমৃড়ীক" অর্থাৎ সুখদান কারী হিসেবে তৃপ্তি প্রদান করে। এজন্যই ঋগ্বেদ সংহিতার ৮/৪৮/১ মন্ত্রে বলা হয়েছে, "গাভীর যেমন শস্যে তৃপ্তি, পুরুষের যেমন গৃহে তৃপ্তি সেইরকম ভাবে সোম ঋষির হৃদয়ে তৃপ্ত হোক"। তাই স্পষ্টই বলা যায় যে বেদমন্ত্রে মাদকতা শব্দের অর্থ সুখকর বা তৃপ্তিদায়ক অর্থে, নেশাজাতীয় অর্থে নয়। তাছাড়া শতপথ ব্রাহ্মণেও (৫/১/২) দেখা যায় বিভিন্ন উপাদান সমন্বয়ে সোমরসকে নিষ্কাশন করা হয় যা সোমরসকে অমৃতের গুণ প্রদান করে। এজন্য ঋগ্বেদ সংহিতার ১/৮৪/৪ মন্ত্রে বলা হয়েছে "জ্যৈষ্ঠমমৃতং মদম্"

© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
সনাতন শাস্ত্র ও দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর।।
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ