সরস্বতী পূজার আগে কুল বা বরই খাওয়া বারণ?

 


এটাকে প্রথা বলুন বা সংস্কার আমরা ছোটবেলা থেকেই এই বিষয়টার সাথে পরিচিত। বিশেষত শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রবণতাটি বেশি যে সরস্বতী পূজার আগে কুল খেলে মা সরস্বতী রুষ্ট হবেন। তাই সরস্বতী পূজার দিন মায়ের চরণে অঞ্জলি নিবেদন করেই কুল খেতে হবে৷ ছোটবেলা থেকে শিশুমনে পরিবারের গুরুজনেরাও এই শিক্ষাই দিয়ে দিতেন এবং এখনও দেন।

কিন্তু কেন খাওয়া যাবে না! আসলেই কি মা সরস্বতী রুষ্ট হন! এই বিষয়টিই পরিস্কার করার চেষ্টা করা হবে এই লেখায়। অতঃপর আমাদের ব্যাখ্যা গ্রহণ বর্জন একান্তই পাঠকদের উপর।

এই বিষয়ে একটা জনশ্রুতি রয়েছে যা প্রাচীন পরম্পরা থেকেই প্রচলিত তাই জনশ্রুতিটি একেবারে ফেলনা নয়। ঘটনাটি হলো; সরস্বতী দেবী তথা মা সারদাকে তুষ্ট করার জন্য মহামুনি ব্যাসদেব বদরিকাশ্রমে তপস্য করেছিলেন। তপস্যা শুরুর পূর্বে তাঁর তপস্যা স্থলের পাশে একটি কুল বীজ রেখে শর্ত দেয়া হলো যে এই কুলবীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা, চারা থেকে বড় গাছ, বড় গাছে ফুল এবং সেখান থেকে নতুন কুল হবে। যেদিন সেই কুল পরিপক্ব হয়ে ব্যাসদেবের মাথায় পতিত হবে, সেই দিন তাঁর তপস্যা পূর্ণ হবে। ব্যাসদেবও সেই শর্ত মেনে নিয়ে তপস্যা শুরু করলেন।

বেশ কয়েক বছর পর ধীরে ধীরে এই কুলবীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা, চারা থেকে বড় গাছ, বড় গাছে ফুল এবং ফুল থেকে নতুন কুল হলো এবং তা পরিপক্ব হয়ে ব্যাসদেবের মাথায় পতিত হলো। ব্যাসদেব তখন বুঝতে পারলেন যে সরস্বতী দেবী তাঁর প্রতি তুষ্ট হয়েছেন। দিনটি ছিল শ্রীপঞ্চমীর দিন। সেদিন বেদমাতা সরস্বতীকে গাছ থেকে পতিত পরিপক্ব বদ্রী/কুল ফল নিবেদন করে অর্চণা অন্তে মহামুনি ব্যাসদেব ব্রহ্মসূত্র রচনা আরম্ভ করলেন। কুল বা বরইয়ের আর এক নাম বদ্রী, তপস্যার সাথে বদ্রী-এর সম্পর্ক থাকায় জায়গার নাম হয় বদরিকাশ্রম। আজও পাকিস্তানে রয়েছে বদরিকাশ্রম সারদাপীঠ। এই স্থানে বসেই আদিগুরু শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচনা করেছিলেন।

আমরা জানি তপস্যার সাথে জড়িয়ে থাকে ত্যাগ, সংযম ধৈর্য্য। এই ত্যাগ, সংযম ধৈর্য্যের প্রতীকরূপেই বিবেচিত হয় কুল ফল। এর সাথেই জড়িয়ে রয়েছে সরস্বতী পূজার আগে কুল ফল না খাওয়ার কারণ। কুল অত্যন্ত লোভনীয় একটি ফল। গাছে যখন কুল হয় তখন অপরিপক্ক অবস্থাতেই সেটা খাওয়ার বাসনা সৃষ্টি হয় শিশুমনে। আর রসে টসটসে পাকা কুল যখন মাটিতে পরে থাকে তখন সেগুলো না খেয়ে লোভ সংবরণ করা যেকোনো বয়সের মানুষের জন্যই প্রায় অসম্ভব। কিন্তু একটা শিশুকে যখন ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয় যে সরস্বতী পূজার আগে কুল খাওয়া বারণ এবং এতে মা সরস্বতী রুষ্ট হন তখন শিশুরা তাদের কুল খাওয়ার লোভ সংবরণ করে ধৈর্য্য সহকারে সংযমের সাথে সরস্বতী পূজা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকে। আমরা জানি লোভ হচ্ছে নরকের দ্বার এবং ধৈর্য্য, সংযম ত্যাগ হচ্ছে স্বর্গের সোপান। এই যে কুল খাওয়ার জন্য শিশুদেরকে বারণ করা হয় এতে কিন্তু শিশুরা ছোটবেলা থেকেই লোভনীয় ফল কুল খাওয়ার তীব্র ইচ্ছেকে প্রশমিত করে লোভকে জয় করতে শিখে যায়। পাশাপাশি সরস্বতী পূজা পর্যন্ত কুল খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে ধৈর্য্য, সংযম ত্যাগের শিক্ষাটুকুও মনের মধ্যে গেঁথে যায়। এই যে সামান্য কুল না খেয়েই সনাতন শাস্ত্রের চিরন্তন সারবস্তুর শিক্ষাটুকু শিশুরা পেয়ে যাচ্ছে সে অন্তর্নিহীত তাৎপর্য্যটি অনুধাবন করে তা পালন করতে হবে এবং এর গূঢ়তত্ত্ব জনমনে ঢুকিয়েও দিতে হবে।

আমাদের সনাতন সংস্কৃতিতে সংযম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো পূজায় অঞ্জলি দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা আগের দিনও খাদ্য সংযম পালন করি এবং অঞ্জলির পূর্ব পর্যন্ত উপবাস থেকে দেব চরণে অঞ্জলি নিবেদন করি। এক্ষেত্রেও সরস্বতী পূজার আগে কুল না খাওয়ার সংস্কার পালন করে শিশুদের শিক্ষার্থীদের মনে ধৈর্য্য, সংযম ত্যাগের শিক্ষা প্রদান করা হয়। অতঃপর তাদের লোভহীন মন যখন স্থির হয়, তখন শুদ্ধ চিত্তে মা সরস্বতীর চরণে অঞ্জলি নিবেদনে মা সরস্বতীও তুষ্ট হোন।

মা সরস্বতী কি রুষ্ট হন সরস্বতী পূজার আগে কুল খেলে?!

বিষয়টা এমন নয়, মা সরস্বতী এই সামান্য ব্যাপারে রুষ্ট হতে যাবেন কেন! আসলে আমরা যদি কাউকে বলি প্রতিদিন ফল খেলে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো তবে এটা খুব কম সংখ্যক মানুষ মেনে চলবে কিন্তু যদি কোন একটি ফল দেখিয়ে বলা হয় যে এই ফল খেলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে তখন সে ফলটি কেউ ভুলেও স্পর্শ করবে না। আসলে পূণ্যের আশা দেখানোর চেয়ে পাপের ভয় দেখানোটা বেশি কার্যকর। সেক্ষেত্রে আমাদের শাস্ত্রে যেকোনো নৈতিক শিক্ষা বা কল্যাণকর কিছু সমাজে প্রতিষ্ঠা কর‍তে পুণ্যের প্রতিশ্রুতি পাপের ভয় যুগৎপৎ রূপক অর্থে প্রয়োগ করেছেন আমাদের মুনি-ঋষি আচার্য্যরা। এতে করে শুভ সংস্কারগুলোকে একটি শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে বছরের পর বছর সমাজে প্রচলন করা সহজ হয়।

এই সংস্কারগুলো টিকে থাকুক, প্রচলিত থাকুক। কুসংস্কারের নামে শুভ সংস্কারগুলো হারিয়ে গিয়ে সমাজ স্বেচ্ছাচারিতায় বাড়বাড়ন্ত না হোক।


© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।

সনাতন শাস্ত্র দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর।।

Sanatan Philosophy and scripture (SPS)


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ