বেদ সংহিতার যম-যমী উপাখ্যানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য্য।।

 


(ঋগ্বেদ সংহিতাঃ ১০/১০/১-১৪)

ঋগ্বেদ সংহিতার দশম মণ্ডলের ১০নং সূক্তের যম-যমী উপাখ্যান নিয়ে চলছে অবান্তর অপপ্রচার। বলা হচ্ছে ভাই-বোন কামাসক্ত হয়ে মিলনের ইচ্ছে পোষণ করছে। এই অপপ্রচারকে ভাইফোঁটার সাথে জড়িয়ে হিন্দু সংস্কৃতির এই অসাধারণ সংস্কারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।

আমরা আজ জানবো এই সূক্তের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আর অপ-প্রচারকারীদের জন্য থাকবে সশব্দে চপেটাঘাত।

প্রত্যুত্তরঃ

ঋগ্বেদ সংহিতার যম-যমীর উপাখ্যান মানবের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ও এর বিপরীতে প্রকৃতির অপরিবর্তনীয় নিয়মকে তুলে ধরেছে। তাই এখানে বিচক্ষণ ব্যক্তি খুঁজে পাবে গূঢ়তম শিক্ষা আর আসুরিক প্রবৃত্তির মূ-র্খ ব্যক্তি খুঁজে পাবে কামার্ত অনুভূতি।

সূক্তের প্রথম মন্ত্রগুলোতে (ঋগ্বেদ সংহিতা ১০/১০/১-৪) স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তির কারণে সূর্যকন্যা যমী তাঁর ভাই সূর্যপুত্র যমকে মিলনে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছেন। মানবের এই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে ত অস্বীকার করা যায় না কারণ এটাও প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ারই অংশ।

★ প্রশ্ন হলো যম কি এতে কামার্ত হয়েছেন এবং বোন যমীর সাথে মিলিত হয়েছেন?

না, যম কিন্তু তার বোনকে প্রকৃতির বিধিনিষেধ বুঝিয়েছেন। বোনকে বুঝিয়েছেন এটা অসম্ভব।

যম (ঋগ্বেদ সংহিতা ১০/১০/১২) বলছেন,

"বিজ্ঞজনেরা বলেন, বোন সম্পর্কিত কারও কাছে যাওয়া ও মিলিত হওয়া পাপ। তাই আমি তোমার শরীরকে স্পর্শ করতে পারবো না। এটা প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ।"

★ বোন যমী কি যমের কথা বুঝেছেন?

হ্যাঁ, বোন যমী বুঝেছেন সবটা। ঋগ্বেদ সংহিতার ১০/১০/১৩ মন্ত্রে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে বোন যমী তাঁর ভাই যমের বক্তব্যের তাৎপর্য বুঝতে পারেন এবং ভাইয়ের জন্য অন্য সঙ্গী কামনা করেন।

★ তাহলে আপত্তি কোথায়?

এই যে মানবের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি কামাসক্ত হওয়া সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা এবং প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ না হওয়াই তো ধর্ম যা যম করে দেখিয়েছেন এবং বোনকেও বোঝাতে সমর্থ হয়েছেন।

তাহলে এই উপাখ্যান দিয়ে বৈদিক ঋষিরা আমাদের যে শিক্ষাটা দিয়েছেন সেটা হলো ভাই-বোনের পরস্পর কামাসক্ত হওয়া ও একত্রে মিলিত হওয়া সম্পূর্ণ প্রকৃতি বিরুদ্ধ ও সনাতন শাস্ত্রে পাপ হিসেবে বিবেচ্য।

বিকল্প ব্যাখ্যাঃ

এবার তাহলে এই উপাখ্যানকে অন্য আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করা যাক। এখানেও থাকবে প্রকৃতির অপরিবর্তনীয় নিয়ম সম্পর্কে গূঢ়তত্ত্ব।

আমরা জানি সূর্যের আলোয় পৃথিবী আলোকিত হয়। সূর্যের যে প্রকাশ তার উপস্থিতিতে দিন ও অনুপস্থিতিতে রাত্রী অর্থাৎ দিবা-রাত্রীর জন্ম সূর্য হতে। ঋগ্বেদ সংহিতার ১০/১০/৫ মন্ত্রে দেখা যাচ্ছে সূর্য কর্তৃক প্রকৃতির গহ্বর হতে দিবা-রাত্রীর প্রতিনিধি (নিরুক্ত ১০/২০, ১২/১০-১১ দ্রষ্টব্য) হিসেবে যম (দিবা) ও যমীর (রাত্রী) জন্ম৷ তাই যম-যমীর পিতা সূর্য তথা বিবস্বান্।

রাত্রীর লক্ষ্যই থাকে দিনকে প্রাপ্ত করা। তাই রাত্রী সর্বদাই দিনের দিকে ধাবিত হয়।

★ যম-যমীকে কেন যমজ বলা হয়?

কারন ঋগ্বেদ সংহিতার ১০/১০/৫ মন্ত্রেই বলা হচ্ছে সূর্য হতে যম ও যমীর যুগলরূপে জন্ম। আমরা যদি খেয়াল করি পৃথিবীর যখন উৎপত্তি ঠিক সেই মূহুর্ত থেকেই দিবারাত্রির উৎপত্তি। অর্থাৎ পৃথিবীর এক প্রান্তে দিন ও অন্য প্রান্তে রাত। তাই একই উৎস হতে একই মুহুর্তে দিন ও রাতের সৃষ্টি বলে যম ও যমী যমজ ভাইবোন।

★ যম ও যমীর মিলন কেন প্রকৃতি বিরুদ্ধ?

দিন ও রাতের মিলন সম্ভব নয়। যখনই রাতের শেষ ঠিক সেই মূহুর্তেই দিনের শুরু আর দিনের অন্তেই রাত। পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে আবার নিজ অক্ষেও ঘুরছে। পৃথিবীর নিজ অক্ষের ঘুর্ণনের ফলেই একই সময়ে পৃথিবীর উভয় পৃষ্ঠে দিবারাত্রির পালাবদল হচ্ছে। তাই যম বলছেন (ঋগ্বেদ সংহিতা ১০/১০/২), দিবারাত্রির মিলনকে সূর্যই নাকচ করে দিচ্ছেন। পৃথিবীর ঘুর্ণন যদি প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ হয় অর্থাৎ ঘুর্ণন যদি থেমে যায় বা হঠাৎ করে বিপরীতমুখী হয় (ঋগ্বেদ সংহিতা ১০/১০/৯-১১) তবেই দিবারাত্রি তথা যম-যমীর মিলন হতে পারে। কিন্তু এতে পৃথিবী কক্ষচ্যুত হয়ে এই জগৎ সংসারের বিনাশ নিশ্চিত। ঋগ্বেদ সংহিতার ১০/১০/১২নং মন্ত্রে তাই যম সরাসরি যমীর সাথে মিলবকে নাকচ করে দেয়।

এই সুক্তে যম-যমীর উপাখ্যান বিশ্লেষণে আমরা সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর ঘুর্ণন ও দিবারাত্রির পালাবদল সম্পর্কেও ধারণা পাই যা বিজ্ঞানের নব্য আবিস্কার।

মন্তব্যঃ এই সুক্তের আলোচিত উপাখ্যানকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন সেখানে নেগেটিভ কিছুই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথম ব্যাখ্যায় আমরা এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে ভাই-বোনের একত্রে কামবশত মিলন সনাতন শাস্ত্রে সম্পূর্ণ নিষেধ এবং প্রাকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ। দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে দিবারাত্রির কেবল পালাবদল হয় কিন্তু মিলন সম্ভব নয়।

এবার উপরোক্ত উপাখ্যানকে যদি আমরা আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ করি তবে বিষয়টা হয় যে, যম হচ্ছে জ্ঞানের প্রতীক এবং যমী হল অজ্ঞানতার অন্ধকার। এই অজ্ঞানতা কামরূপে জ্ঞানকে কলুষিত করতে উদ্যত হলেও জ্ঞান কলুষিত হয়না। জ্ঞান সর্বদাই নির্মল ও পবিত্র তাই অজ্ঞানতাকে দূরে সরিয়ে জ্ঞান সূর্যের প্রকাশের ন্যায় উজ্জ্বল।
যেমন ঋগবেদ সংহিতার ৫/৪০/৫ মন্ত্রে আমরা দেখি,
"অহংকার বা কাম হলো জ্ঞানের পথে প্রতিবন্ধক। চন্দ্র যেমন সূর্যের আলো ঢেকে পৃথিবীকে বিকট অন্ধকার করে দেয় অহংকারও তেমনি বিদ্যানের বুদ্ধিনাশ করে দেয়।"
এখানে বিবেচ্য যে চন্দ্র আপাতদৃষ্টিতে সূর্যকে ঢেকে দিয়ে পৃথিবীকে অন্ধকার করে দিলেও সূর্যের প্রকাশকে কিন্তু মুছে দিতে পারে না। গ্রহণ কাটিয়ে সূর্য আবার উদিত হয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করে।

অর্থাৎ আমরা এই উপাখ্যানকে আদিভৌতিক, আদিদৈবিক বা আধ্যাত্মিক যেভাবেই ব্যাখ্যা করি না করে মূল তাৎপর্য্য এই যে ধর্মের জয়, সত্যের জয়।

দ্বিতীয় আপত্তিঃ এই উপখ্যান থেকেই ভাইফোঁটার উৎপত্তি।

প্রত্যুত্তরঃ এই উপাখ্যানের ভাইফোঁটার সাথে সম্পর্কিত কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় নি৷ এই সুক্তে মন্ত্র আছে ১৪ টি তার মধ্যে ভাইফোঁটার কোন উল্লেখ নেই।

বিঃদ্রঃ মোটামুটি সকল ভাষ্য ও অনুবাদেই একই রকম তাৎপর্য্য পাওয়া যায় তাই এই সুক্ত নিয়ে খুব বেশি অপপ্রচারের সুযোগ নেই অহিন্দুদের।

©SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
শ্রী অনিক কুমার সাহা 

Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ