বৈদিক রুদ্র/শিব নিয়ে শঠতার জবাব।।


 🔱 শিবের কথাঃ 

রুদ্র বীণায় কোন তাণ বাজে?

(অষ্টাধ্যায়ী নিয়ে শঠতা করা যবনবীরের জন্য শক্ত প্রত্যুত্তর রয়েছে।) 

শিব নিয়ে আলোচনার না আছে কোন শুরু, না আছে কোন অন্ত ।  বর্তমান এই মুঠোফোনের যুগে তথ্যের বন্যায় আমরা ভেসে যাচ্ছি । কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল তা বিচার করার চেয়ে ফেইসবুক আর ইউটিউবে উঠে আসা তথ্য আমাদের কাছে বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হয় । ফলশ্রুতিতে মহাদেব শিব নিয়েও নানা তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা- সমালোচনা আমরা দেখি। এগুলোর সত্যতা যাচাই করার মত কোন রিউমার স্ক্যানারও নেই আমাদের । মহাদেব শিব নিয়ে প্রচলিত সংশয়গুলো দূর করতেই আমাদের আজকের এই বিশেষ আয়োজন ।

⭕ বেদ সংহিতায় রুদ্রঃ 

মহর্ষি যাস্ক দ্বারা রচিত একটি বৈদিক শব্দকোষ রয়েছে , যাকে বলে নিঘন্টু। নিঘন্টুতে বরুণের পর রুদ্রের উল্লেখ আছে। 

যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতার (২০/৭১) বর্ণনা প্রসঙ্গে শ্রী অনির্বাণ বলেন, 

"গ্রীষ্মের শেষে তপ্ত অন্তরিক্ষে প্রথমে এলোমেলো হাওয়া বইছিল । তারপর মেঘে-মেঘে আকাশ ঢেকে গেল। বর্ষার বরুণকে দেখেছি, আসন্ন বর্ষণের মেঘ হয়ে চিত্তের (মনের) আকাশে থমথম করছেন। এই মেঘ যখন জল হয়ে ঝরে না, তখন সে 'বৃত্র’ (সে ঢেকে থাকে), অথবা 'নমুচি’ (মেঘে অবরুদ্ধ জলকে যে মুক্তি দেয় না); যখন ঝরে, তখন সে 'বরুণ’—যিনি নমুচির সঞ্চিত বিত্তকে ছিনিয়ে নেন ।” 

"বর্ষণের আগে মেঘ গুরুগুরু গর্জনে ডেকে ওঠে—যেন জানিয়ে দেয় । এর পর অন্তরীক্ষে শুরু হবে ঝড় বৃষ্টি আর বিদ্যুতের মাতন। এই গর্জনই রুদ্রের ‘রোদন’।" 

(বেদমীমাংসা, শ্রীঅনির্বাণ, ৩য় খণ্ড)

'রুদ্র' শব্দের অর্থ সম্পর্কে নানা ব্যাখ্যা প্রচলিত।

বাজসনেয়িসংহিতায় রুদ্রকে বলা হয়েছে— "উচ্চৈঃ ঘোষঃ" অর্থাৎ মহাশব্দরূপী (বাজসনেয়ি সংহিতা, ১৬/১৯)। এছাড়াও বলা হয়েছে ‘শ্রব’ এবং ‘প্রতিশ্রব’ অর্থাৎ শব্দ এবং প্রতিশব্দ। 

শ্রদ্ধেয় উপেন্দ্রকুমার দাস এর মতে,  ঝড়ের প্রচণ্ড গর্জন শুনে লোকে তার দেবতাকে রুদ্র নাম দিয়েছিল।  

মহর্ষি যাস্ক রুদ্র শব্দের যে-ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতেও এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, যিনি গর্জন করেন তিনি রুদ্র ('রুদ্রো রৌতীতি সতঃ' –নিরুক্ত, ১০/৫) ।  

আচার্য সায়ণ রুদ্র শব্দের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যথা—

১। যিনি অন্তকালে সবাইকে কাঁদান, তিনি রুদ্র ( ”রোদয়তি সর্বন্তকালে ইতি রুদ্রঃ” - ঋগ্বেদ সংহিতা, ১/৪৩/১, সায়ণ ভাষ্য)। 

২। যিনি শত্রুদের কাঁদান, তিনি রুদ্র (”রোদয়তি শত্রুন্‌ ইতি রুদ্রঃ” - অথর্ববেদ  সংহিতা ৭/৯২/১, সায়ণ ভাষ্য)।

৩। যিনি সংসার নামক দুঃখ গলিয়ে দেন, দূর করেন বা বিনাশ করেন তিনি রুদ্র ( ”রুৎ সাংসারাখ্যং দুঃখং তৎ দ্রাবয়তি অপগময়তি বিনাশয়তি ইতি রুদ্রঃ” — ঋগ্বেদ  সংহিতা, ১/১১৪/১, সায়ণ ভাষ্য)। 

৪। রুৎ অর্থাৎ শব্দরূপ উপনিষৎ, তার দ্বারা যিনি প্রতিপাদ্য তিনি রুদ্র (”রুতঃ শব্দরূপাঃ উপনিষদ। তার্ভিদ্রয়তে গম্যতে প্রতিপাদ্যতে ইতি রুদ্রঃ।” - ঋগ্বেদ  সংহিতা, ১/১১৪/১, সায়ণ ভাষ্য)। 

৫। রুৎ অর্থ শব্দাত্মিকা বাণী অথবা তার দ্বারা প্রতিপাদ্য আত্মবিদ্যা। যিনি উপাসকদের এই আত্মবিদ্যা দান করেন তিনি রুদ্র  “রুৎ শব্দাত্মিকা বাণী তৎপ্রতিপাদ্যা আত্মবিদ্যা বা। তামুপাসকেভ্যো রাতি দদাতি ইতি রুদ্রঃ”- ঋগ্বেদ  সংহিতা, ১/১১৪/১, সায়ণ ভাষ্য) 

৬। যা আবৃত করে তাই রুৎ। রুৎ অন্ধকারাদি, তা যিনি বিদারণ করেন তিনি রুদ্র (”রণদ্ধি আবৃণােতি ইতি রুৎ অন্ধকারাদি। তৎ দৃণাতি বিদারয়তি ইতি রুদ্রঃ।” — ঋগ্বেদ  সংহিতা, ১/১১৪ ১, সায়ণ ভাষ্য)।

৭। যজুর্বেদের ভাষ্যে মহীধর বলেন, রুৎ অর্থ জ্ঞান , তা যিনি দেন তিনি রুদ্র। যিনি পাপীদের দুঃখ ভোগের দ্বারা কাঁদান তিনি রুদ্র ( ”রবণং রুৎ জ্ঞানং রাতি দদাতি রুদ্রঃ। অথবা পাপিনাে নরান দুঃখভােগেন রােদয়তি রুদ্রঃ” — বাজসনেয়ি সংহিতা, ১৬/১, মহীধরভাষ্য)

বেদের ব্রাহ্মণ ভাগে "রুদ্র" শব্দটির ব্যুৎপত্তি ‘রুদ’ ধাতু হতে, যার মৌলিক অর্থ ‘গর্জন করা’। 

কারও কারও মতে, বিকল্প ব্যুৎপত্তি ‘রু’ হতে, যার অর্থ রক্তবর্ণ। 

নিঘন্টুতে রুদ্র ছাড়া মধ্যস্থান দেবগণের মধ্যে রুদ্রগণের উল্লেখ আছে (নিঘন্টু, ৫/৫)। সংহিতায় বহুস্থানে উল্লিখিত তিনটি দেবগণের মধ্যে রুদ্রগণ অন্যতম। 

রুদ্রের প্রসঙ্গ আসলে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই মরুৎগণের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। দেবতাগণের মধ্যে রুদ্র ও রুদ্রগণ একটা মুখ্যস্থান অধিকার করে আছেন, সুতরাং ঋগ্বেদ  সংহিতায় রুদ্রের উদ্দেশ্যে সূক্তসংখ্যা কম বলে তিনি একজন অপ্রধান দেবতা— এ-যুক্তি মানা যায় না।  

ঋগ্বেদে দেখা যায়, ঝড়বৃষ্টির দেবতা মরুৎ (ঋগ্বেদ সংহিতা , ১/৬৪/১২; ২/৩৪/১,২)। মরুতের সংখ্যা ঊনপঞ্চাশ (৪৯) । মরুগণকে রুদ্রগণ (রুদ্রিয়াঃ, রুদ্রিয়াসঃ, রূদ্রাঃ) বলা হয়েছে। রুদ্র মরুৎদের পিতা (ঋকবেদ  সংহিতা, ১/৩৮/৭; ১/৬৪/২,১২; ১/১১৪/৬; ২/৩৪/১০)।

রুদ্র ধ্বংসের দেবতা। প্রকৃতির আর একটি ভয়ঙ্কর রূপের প্রকাশ মহামারীর আকারে। মহামারীর প্রবল আক্রমণে কত মানুষ মরে যেত। এখন যেমন মানুষ ঝড়, তুফান, মহামারী দেখে আতঙ্কিত হয়, বৈদিক ঋষিরা এর মধ্যেও রুদ্রের প্রকাশ দেখতে পেতেন। ঝড়ঝঞা, বজ্রপাত, মহামারী, সর্পাঘাত, সাধারণ রোগ, বিষ প্রভৃতি যা-কিছু মানুষের অনিষ্টকর ও প্রাণনাশক তা-ই তারা রুদ্রের সঙ্গে যুক্ত মনে করতেন। 

অনির্বাণের মতে, “রুদ্রগণ ও মরুৎগণ - এই দুটি গণের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। রুদ্রগণের অধিকার মরুৎগণের চাইতে ব্যাপক। মরুদগণ অন্তরিক্ষস্থান হলেও দ্যুলোক-ঘেঁষা, আর রুদ্রগণ এই পৃথিবীতেও  হাজারে হাজারে বিচরণ করেন (বাজসনেয়ি সংহিতা ১৬/৫৪) । একদিকে তারাই যেমন মরুৎগণ ইন্দ্রসহচর, হিরণ্যরথচারী, কল্যাণপথের দিশারী, তৃষার্ত হয়ে যে জল চায় তার কাছে যেন আলোর নিঝর (ঋগ্বেদ  সংহিতা, ৫/৫৭/১); আরেকদিকে তারাই আমাদের পরিচিত শিবের প্রমথগণ। অর্থাৎ, মরুৎগণ শুধু আলো, ঘোর  এবং উগ্র হলেও  রুদ্রগণ আলো আর কালো দুইই। 

আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে, মরুৎ  হল প্রাণের ঊর্ধস্রোত—যা প্রবাহিত হয়ে  চলেছে শ্রী ও শুভের দিকে; আর রুদ্রগণ প্রাণের ওভারঅল স্বাস্থ্য আর বিকার দুইই। এই  দুটি গণেরই গণপতি হলেন রুদ্র। কিন্তু একটি গণ তাঁর পুত্র বা আত্মজ- ‘সাকংজাত’ রূপে তার শক্তির সুষম প্রকাশ, আরেকটি গণ তাঁর বিভূতির বিচিত্র ও বিষম বিচ্ছুরণ (যেমন পুরাণের শিব এবং তাঁর পুত্র দেবসেনাপতি কুমার  ও তাঁর অনুচরগণ)।“

আবার বায়ুকে এঁদের সঙ্গে জড়িয়ে প্রাণের দিক থেকে বিচার করে দেখলে বলা যায়, বায়ু হল বিশ্বমূল - প্রাণের একটি সামান্য সংজ্ঞা (সাধারণ প্রতিশব্দ)। বায়ু বিরাট পুরুষের প্রাণ, তিনি অদিতিতে উচ্ছ্বসিত মাতরিশ্বা—তার সাধনায় রূপকল্পনার স্থান নাই। এই প্রাণই যখন ভূবনে-ভূবনে সঞ্চরমান ঊর্ধ্বস্রোতা একটি চিৎশক্তি, তখন তা মরুৎ। 

রুদ্রকে ঋকসংহিতাতেই পাই বিরাটপুরুষরূপে, যজুঃসংহিতায় তিনি একরুদ্র। 

অথর্ববেদে যাঁকে ব্রাত্য একঋষি ও বিশ্বের সৎপতি বলে বর্ণনা করা হয়েছে (প্রশ্নোপনিষদঃ ২/১১)। তিনি তত্ত্বরূপে প্রাণ আর দেবতারূপে রুদ্র। সংহিতায় তারই একাদশ বিভূতি রুদ্রগণ (ঋগ্বেদ  সংহিতাঃ ১/১৩৯/১১), ব্রাহ্মণে অধ্যাত্মদৃষ্টিতে যাদের বলা হয়েছে, দশটি প্রাণ আর তাদের অধিপতি আত্মা (শতপথ ব্রাহ্মণঃ ১১/৬/৩/৭) । 

ঋকসংহিতায় ইন্দ্রের মত রুদ্রও ‘মরুত্বান্,’ এটি লক্ষণীয় (ঋগ্বেদ  সংহিতাঃ ১/১১৮/১১; ২/৩৩/৬) । ইন্দ্র সেখানে পরমপুরুষ (ঋকবেদ  সংহিতাঃ ৬/৪৭/১৮), রুদ্রও তা-ই—বিশেষত তিনি যখন সপ্তভুবনসঞ্চাির মরুৎগণের পিতা। তিনি  চিন্ময় প্রাণ, এ কারণে একজায়গায় তাকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘দ্যুলোকের বরাহ’ বলে  (“দিবো বরাহম্‌” , ঋগ্বেদ  সংহিতা ১/১১৪/৫)। 

⭕শিবোপাসনা ও বিষ্ণু আরাধনাঃ 

রুদ্রের উপাসনা উপনিষদের ভাষায় "মুখ্যপ্রাণের উপাসনা"। বৈদিক সাধনার এটি একটি প্রধান ধারা। আরেকটি ধারা, প্রজ্ঞার উপাসনা। এই উপাসনার প্রধান আরাধ্য দেবতা বিষ্ণু। যজুর্বেদে এবং অথর্ববেদে রুদ্রকে আমরা পাই পৌরাণিক শিবের রূপে—যদিও এই ভাবনার সুস্পষ্ট নির্দেশ ঋকবেদেই  আছে (ঋগ্বেদ  সংহিতাঃ ১০/৯২/৯) । তেমনি ব্রাহ্মণে বিষ্ণুকে পাই নারায়ণরূপে (শতপথ ব্রাহ্মণঃ ১৩/৬/১/১)। শিব আর নারায়ণের উপাসনা ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। শৈব আর ভাগবত ধর্ম এদেশের দুটি মুখ্য গণধর্ম। এখন ইতিহাস-পুরাণ তাদের বেদ; কিন্তু সুদূর অতীতে ত্রয়ীতেও ( বেদেও) তাদের সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়।

শৈবধর্মের  যজ্ঞ ভিত্তিক রূপ আমরা পাই যজুর্বেদের শতরুদ্ৰীয়হোমে, আর ভাগবতধর্মের যজ্ঞভিত্তিক রূপ পাই পুরুষমেধযজ্ঞে। বৈদিক যজ্ঞ সাধারণত যজমানের একার ব্যাপার, অন্তরের গভীরে দেবতার সঙ্গে তার সাযুজ্যের সাধনা। কিন্তু এই দুটি অনুষ্ঠানে দেবতা যেন চোখের সামনে দেখা দিয়েছেন বিশ্বরূপ হয়ে, বিরাট হয়ে। পুরুষমেধযজ্ঞ স্পষ্টতই ঋকসংহিতার পুরুষসূক্তের ছাঁচে ঢালা—দেবতা নিজেই সেখানে যজ্ঞের পশু; আর সে-পশু বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ হতে অন্ত্যজ পর্যন্ত সবাই (বাজসনেয়ি সংহিতাঃ ১৬/১-৬৬) । শতরুদ্ৰীয়-হোমেমন্ত্রেও দেখি, রুদ্রই সব হয়েছেন— “দেবতির্য-নরাদি’, নরের বা মানুষর মধ্যে সবই তিনি, চেতন-অচেতন সবই। উভয় দিক থেকেই দেখতে পাচ্ছি, দেবতা বিশ্বরূপ, তিনিই সব হয়েছেন, তিনি ছাড়া আর কিছুই নাই। এই সুপ্রাচীন আর্যভাবনার মূল মহাবাক্য হল ঋকসংহিতার ‘পুরুষ এবেদং সর্বং’ (ঋকবেদ  সংহিতা  ১০/৯০/২)।

তারই প্রতিধ্বনি যজুঃসংহিতায় শৈবধর্মের মহাবাক্য ‘এক এব রুদ্ৰো ন দ্বিতীয়ায় তস্থে’ (তৈত্তিরীয় সংহিতাঃ ১/৮/৬/১)। 

আর ইতিহাস-পুরাণে ভাগবতধর্মের মহাবাক্য “বাসুদেবঃ সর্বং”। 

এসবেরই উপনিষদ প্রতিরূপ হল, ”সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম ” (ছান্দ্যোগ্য উপনিষদঃ ৩/১৪/১)।

আর একে ভিত্তি করেই বেদান্তের ন্যায়প্রস্থানে শাঙ্কর বৈষ্ণব ও শৈব মতের ঐক্য। এই হল বৈদিক ভাবনার মূলগত ঐক্যের দিক যার সুষ্পস্ট ছবি আমরা ঋকবেদ  সংহিতার মধ্যে পাই।

⭕ রূপ ও অরূপের কন্সেপ্টঃ

ভাবনা আর উপাসনার বৈচিত্র্য থেকেই আবার অনৈক্যেরও সূত্রপাত হয়। 

১। বিষ্ণুর উপাসনা আদিত্যের উপাসনা, তাকে চোখে দেখা যায়—তিনি আদিত্যমণ্ডল-মধ্যবর্তী হিরন্ময় পুরুষ, কল্যাণতম রূপের আধার (ছান্দ্যোগ্য উপনিষদঃ ১/৬/৬-৭, ঈশোপনিষদঃ ১৬)।

২। কিন্তু রুদ্রের উপাসনা মূলত বায়ুর উপাসনা। আমরা বায়ুকে দেখতে পারি না, কিন্তু তাঁর বেগ বা গতি অনুভব করতে পারি (ঋগ্বেদ সংহিতা, ১/ ১৬৪/৪৪; ১০/১৬৮/৪)। তাই তিনি যখন পরম আরাধ্য, তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে,

"ন সংদৃশে তিষ্ঠতি রূপমস্য" (কঠোপনিষদঃ ২/৩/৯, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদঃ ৪/২০)।

রূপ ধারণ করে দেবতা যখন চোখের সামনে থাকে তখন থাকে দ্বৈতবাদ। কিন্তু দেবতা যখন বায়ুর মত অরূপ, প্রতি নিঃশ্বাসে যেন তিনি আমাদের মধ্যে প্রবাহিত হন, তখন অদ্বৈত ভাব আসে। এজন্য বিষ্ণুসম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বৈতবাদের এত প্রাধান্য আর শৈব সম্প্রদায়ের মধ্যে অদ্বৈতবাদের। রামানুজ থেকে শুরু করে শ্রীচৈতন্য - সকলেই যেন দ্বৈতবাদী আর আচার্য শঙ্কর হলেন অদ্বৈতবাদী।

★ উপাস্যের ভেদে কি লক্ষ্য আলাদা হয়?

যদিও বিষ্ণু সম্প্রদায় আর শৈব সম্প্রদায়ের মধ্যে এই যে ভাবনার পার্থক্য আমরা দেখলাম, তাতে কি লক্ষ্য বা পরম প্রাপ্তি আলাদা হয়? আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হতে পারে। কিন্তু বৈদিক মত অনুসারে আপনি যে পথই অবলম্বন করুন না কেন, মূল উদ্দেশ্য মোক্ষলাভ। 

রুদ্ররূপে যার মধ্যে শক্তির উন্মেষ সাধক দেখন [ঋগ্বেদে রুদ্রের বিশেষণ (ঋগ্বেদ সংহিতাঃ ১/১৪১/১, ২,৩,১০) রূপে পাই "ক্ষয়দ্বীর" যার অর্থ শক্তি বা বীর্যের ঈশ্বর] , শক্তির শান্তভাবে তিনিই শিব। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, রুদ্র "মরুত্বান্"। 

এই মরুৎগণের সম্পর্কে আবার বলা হয়েছে "এবয়াবা" (ঋগ্বেদ সংহিতাঃ ২/৩৪/১১, ৫/৪১/১৬)। এখন এই "এবয়াবা" বিশেষণটি প্রযুক্ত হয়েছে তখনই, যখন তাঁরা বিষ্ণুসহচর (ঋগ্বেদ সংহিতাঃ ৫/৮৭/১-৮)। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে বলা যায়, দীপ্ত প্রাণের ঝড় যখন শান্ত হয়ে আসে, তখনই তা পরমপদ বা মোক্ষলাভ করে,  সে রুদ্র বা বিষ্ণু যারই উপাসক হোক না কেন। 

★ শিব কি শুধুই অবৈদিক?  নাকি বৈদিকও? শিব নিয়ে এত ভ্রান্তি কেন?

প্রায়শই শোনা যায় শিবকে নাকি আমরা হিন্দুরা অনার্যদের কাছ থেকে ধার করেছি। কারণ হল, মহাভারতে উল্লেখিত  দক্ষযজ্ঞে প্রসঙ্গে দেখা যায় রুদ্রকে যজ্ঞের ভাগ দিতে যক্ষ নারাজ ছিলেন। 

দক্ষ বলেছিলেন, 

"সন্তি নো বহবো রূদ্রা শূলহস্তাঃ কপর্দ্দিনঃ।
একাদশস্থানগতা নাহং বেদ্মি মহেশ্বরম্।।"

অর্থাৎ, শূলহস্ত জটাধারী বহু রুদ্রই তো আমাদের আছেন, তাঁরা একাদশ স্থানে থাকেন তা জানি। কিন্তু কই মহেশ্বরকে তো চিনিনে?"

(মহাভারতম্ঃ ১২/২৮৩/২০)

এই উক্তি দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে, শিব তাহলে বেদবাহ্যই ছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হল, দক্ষের এই অনাচার সম্পর্কে মহামুনি দধীচি তাঁকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ শিবের পরিচয় বৈদিক সমাজে জ্ঞাতই ছিল। 

অথচ যারা এই মহাভারতের প্রসঙ্গ টানেন, তারা হয়ত জানেনই না যে, মহাভারতের নানা স্থানে শিবের তথা রূদ্রের মহিমাকীর্তন রয়েছে। বেদসংহিতাদিতে রুদ্রের যেসব বিশেষণ পাওয়া যায়, তার প্রায় সবই মহাভারতে উল্লেখিত হয়েছে। দ্রোণপর্বের ২০০ এবং ২০১ নং অধ্যায়ে শিবের মহিমাকীর্তন করা হয়েছে। পড়লে যেন মনে হবে যজুর্বেদের শতরূদ্রীয় পাঠ চলছে। 

আবার দক্ষের শিব সম্পর্কে করা উক্তির অন্য ব্যাখ্যাও আছে বলে মনে করেন শ্রদ্ধেয় উপেন্দ্রকুমার দাস। তাঁর মতে, উক্ত প্রকরণ শিবমাহাত্ম্য সূচক। দক্ষ শিব তথা রুদ্র সম্পর্কে যে মোহগ্রস্থ ছিলেন, তারই প্রকাশ ঘটেছে উক্ত ঘটনায়। 

এখন প্রজাপতি দক্ষের শিব সম্পর্কে এরকম কনফিউসড হওয়ার কি কারণ থাকতে পারে? এ সম্পর্কে খুব সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন স্বামী নির্ম্মলানন্দ। তিনি বলেন,

"শিবচরিত্র অতি দুর্জ্ঞেয়। তাঁর প্রকৃতি এবং আচরণও বিচিত্র এবং পরস্পরবিরুদ্ধ। ইনি কি তপস্বী? যদি তাই হন, তবে কেন অস্ত্র ধারণ করেন? ইনি কি গৃহী? তা হলে কেন হবেন শ্মশানবিহারী? বিবাহ করেছেন, সুতরাং, ব্রহ্মচারীও বলা চলে না। বাণপ্রস্থীও নন, কেন না, ইনি কৈলাসেশ্বর। তবে কি ইনি ব্রাহ্মণ? না, তা-ই বা কেমনে সম্ভব? ইনি তত বেদজ্ঞ নহেন! তবে কি ক্ষত্রিয়? না, ক্ষত্রিয়ের প্রজারা ব্রতততা এঁতে নেই, বরং ইনি তাে প্রলয়ে করেন প্রজাধ্বংস। ধনােপার্জন করেন না, সুতরাং, বৈশ্যও নহেন। কণ্ঠে নাগযজ্ঞােপবীতধারী, সুতরাং, শূদ্র বলাও অকর্তব্য। ইনি কি পুরুষ? না, তার অর্ধনারীশ্বরমূর্তি দেখে এঁকে তাে সৰ্বাংশে পুরুষ বলেও ধারণা হয় না। তবে নারী হােন? না, তাও অসম্ভব, কেন না, ইনি যে শ্মশ্রুধারী। ইনি ক্লীবও নহেন, বালক বা যুবাও নহেন, বৃদ্ধ বলাও দুষ্কর-কেন না, একক ভাবে এ সবের কোন লক্ষণই তঁার শ্রীঅঙ্গে নেই। ইনি কি পুণ্যবান্? তাও নয়, কেন না, ইনি যে ক্রোধে ব্রহ্মার মস্তক ছেদন করেছিলেন। তবে কি ঘাের পাপী? না, প্রলয়কালে দেবগণকে সংহার করেও তাে ইনি পাপভাগী হন না। এঁর সর্বাঙ্গে অস্থির ভূষণ এবং ইনি দিগম্বর ; সুতরাং, এঁর তত শুচিতা বা শালিনতাবােধও নেই। তবে ইনি কে?

দক্ষ প্রজাপতি একদিন শিবচরিত্র সম্বন্ধে এ গােলেই পড়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারেন নি যে, কূৰ্ম্মের অঙ্গে রােম, শশের মস্তকে শৃঙ্গ এবং শূন্যাকাশে কুসুমােদ্যানের কল্পনা যেমন অসম্ভব, তেমনি শূলপাণি শিবতত্ত্ব অপেক্ষা অন্য কোনও শ্রেষ্ঠ তত্ত্ব বা অন্য কোনও শ্রেষ্ঠ দেবতার অস্তিত্ব সম্ভব নয়।" 

তাই শিব নিয়ে এত কনফিউশন। মহাকালের কুল কিনারা কি কেউ ধারণা করতে পারে?

★ পুরাণের শিব কি বৈদিক রূদ্র থেকে আলাদা?

প্রায়শই নব্য "বৈদিক" খ্যাত সম্প্রদায়সহ আর অনেকেই দাবী করেন যে পুরাণে যে শিবের উল্লেখ রয়েছে তা নাকি বেদের বর্ণনা হতে ভিন্ন।

আমরা এখানে পুরাণে বর্ণিত শিবের বিশেষণ ও তার প্রতিটি শব্দের বৈদিক উল্লেখ দেখব। 

১। পুরাণে শিবকে বলা হয়েছে ঈশান, কারণ তিনি সকল জীবের প্রভু। অথর্ববেদের ১১/২/১৪,১৬ তেও এই ঈশান নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। 

২। শিবপুরাণে শিবকে বলা হয়েছে পশুপতি। যজুর্বেদ ও অথর্ববেদের একাধিক মন্ত্রে রূদ্রকে বলা হয়েছে পশুপতি। এই পশুগুলো কি কি, অথর্ববেদের ১১/২/৯ এ এ সম্পর্কে বলা হয়েছে,

"তবেমে পঞ্চ পশবো বিভক্তা গাবো অশ্বাঃ পুরুষা অজাবয়ঃ।" (অথর্ববেদ সংহিতাঃ ১১/২/৯)

অনুবাদঃ হে রুদ্র, তোমার পশুগুলো পাঁচ ভাগে বিভক্ত। যথা- গো, অশ্ব, মানুষ, মেষ ও ছাগ। 

৩। শিব পুরাণে রূদ্রকে বলা হয়েছে ভগবান। যজুর্বেদের বাজসনেয়ি সংহিতায়ও ( ১৬/৫২,৫৩) একই কথা বলা হয়েছে।

৪। শিবপুরাণে শিব কপর্দী । যজুর্বেদের বাজসনেয়ি সংহিতায়র ১৬/২৯ নং মন্ত্রে তাঁকে কপর্দী বলা হয়েছে। 

৫। পুরাণের শিবের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল তিনি নীলকণ্ঠ। সমুদ্রমন্থনের সময় উদ্ভূত অনল বা বিষ পান করে তিনি নীলকণ্ঠ হন। যজুর্বেদের বাজসনেয়ি সংহিতায় ১৬ অধ্যায়ের ৭ ও ৮ নং মন্ত্রে "ৎ "নীলগ্রীব" অর্থাৎ নীলকণ্ঠ শব্দটি পাওয়া যায়।

৬। পুরাণের শিবের তৃতীয় একটি নয়ন বা চোখ রয়েছে। ঋগ্বেদ সংহিতায় ৭/৫৯/১২ তে বলা হয়েছে রুদ্র "ত্র্যাম্বক"।

৭।পুরাণে শিব অম্বিকাপতি, উমাপতি। বেদে এই সকল বিষয়ের ভুরি ভুরি উল্লেখ রয়েছে। 

৮। শিবের বাহন নন্দী হল বৃষভ বা ষাঁড়। একাধিক ঋকমন্ত্রে রুদ্রকে শিবকে বলা হয়েছে বৃষভ (ঋগ্বেদ সংহিতাঃ ২/৩৩/৪,৬,৭,৮১৫)

তাই উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়, বেদের রূদ্রই পুরাণের শিব। 

⭕ শিবের পূজাঃ অর্চা ও লিঙ্গ 

মহাভারতে শিবের মূর্তি পূজার কথা রয়েছে। অশ্বথামাকে ব্যাসদেব বলেছেন, 

”তাভ্যাং লিঙ্গোহর্চিতো দেবসস্ত্বয়ার্চায়াং যুগে যুগে।”

অনুবাদঃ নরনারায়ণ যুগে যুগে শিবের অর্চনা করেছেন লিঙ্গে আর তুমি অর্চায় অর্থাৎ প্রতিমাতে।

(মহাভারতম্ঃ ৭/২০০/৯২)

এই অর্চা বা প্রতিমা পূজা নিয়ে বর্তমানে তথাকতিত কিছু আর্য নামধারীরা কুৎসা রটাচ্ছে। তাদের দাবী বৈদিক সংস্কৃতিতে নাকি অর্চা অর্থাৎ প্রতিমা বা বিগ্রহ পূজার কোন স্থান নেই। 

এ মত যে সর্বৈব মিথ্যা তা আমারা বৈদিক শাস্ত্র ও ভাষ্য পড়লেই বুঝতে পারি। 

বৈদিক সাহিত্যে কল্পসূত্রগুলোর মধ্যে শ্রৌতসূত্র ও গৃহ্যসূত্রের স্থান উল্লেখযোগ্য। শ্রৌতসূত্রে মূলত যজ্ঞভিত্তিক উপাসনা ও ধ্যান ধারণা রয়েছে আর গৃহ্যসূত্রসমূহে গার্হস্থ্য আশ্রমের নানবিধ বিষয় আলোচিত হয়েছে। 

যাজ্ঞিকদের মধ্যে দেবতার পুরুষবিধ অর্থাৎ সাকার রূপে দেবতাদের আরাধনার যে রীতি ছিল, তৎকালীন জনসাধারণের মধ্যে তার যে ব্যাপক রূপ পাওয়া যাবে তা সহজেই বোঝা যায়। 

ষড়বিংশ ব্রাহ্মণে আমরা প্রথম বিগ্রহ বা অর্চা অর্থে "দেবায়তন" বা মন্দির এবং " দৈবপ্রতিমা" বা দেবতার বিগ্রহের উল্লেখ পাই (ষড়বিংশ ব্রাহ্মণঃ ৫/১০)।

গৃহ্যসূত্রে প্রতিমা বা অর্চার প্রচুর উল্লেখ পাই। যথাঃ

১। যদ্য অর্চা দহ্যেদ্ বা নশ্যেদ বা প্রপতেদ্ বা প্রভজেদ বা প্রহসেদ্ বা প্রচলেদ্ বা... এতাভির জুহুয়াৎ.... ইতি দশাহুতয়ঃ (মানবগৃহ্যসূত্রঃ ২/১৫/৬)

এখানে "অর্চা" শব্দে প্রতিমার উল্লেখ

২। অথো পনিষ্ক্রম্য বাহ্যানি 'চিত্রিয়ানি' অর্চাভ্য.... স্বান্ গৃহান্ আয়াতি [দেবতাকুল বা দেউল বা মন্দির ঘরের বাইরে অর্থাৎ সার্বজনীন  (বৌধায়ন গৃহ্যসূত্রঃ ২/২/১৩)

এখানেও অর্চার উল্লেখ পাই। 

দেবায়তন বা মন্দিরের উল্লেখ রয়েছে নিম্নলিখিত গৃহ্যসূত্রগুলিতেঃ

১. লৌগাক্ষি গৃহ্যসূত্রঃ ১৮/৩
২. গৌতম গৃহ্যসূত্রঃ ৯/৬৬
৩. কৌষীতকি গৃহ্যসূত্রঃ ১/১৮/৪
৪. কাঠক গৃহ্যসূত্রঃ ১৮/৩
৫. বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রঃ ১১/৩১
৬. বিষ্ণুধর্মসূত্রঃ ৯১/১৯
৭. শাঙ্খ্যায়ন গৃহ্যসূত্রঃ ৪/১২/১৫
৮. বৈখানস গৃহ্যসূত্রঃ ৪/ ১১ঃ১১, ১২ঃ১৩....

দেবকুল বা দেউলের উল্লেখ রয়েছেঃ

১. কৌষীতকি গৃহ্যসূত্রঃ ২/৭/২১
২. শাঙ্খ্যায়ন গৃহ্যসূত্রঃ ২/১২/৬
৩. কাঠক গৃহ্যসূত্রঃ ১৯/৩

দেবকুলায়তনের উল্লেখ রয়েছেঃ

১. কৌষীতকি গৃহ্যসূত্রঃ ৩/১১/১৫

দেবতার অর্চা বা প্রতিমার উল্লেখ রয়েছেঃ

১. বিষ্ণু ধর্মসূত্র ২৩/৩৪, ৬৩/২৭ ( বাসুদেবের), ৬৫/১

দেবালয়ের বা মন্দিরের উল্লেখ রয়েছেঃ

১. আগ্নিবেশ্য গৃহ্যসূত্রঃ ২/৫/৪ঃ২ঃ
২. বৈখানস ধর্মসূত্রঃ ৩/২/৮, ৬/৬

৩. বিষ্ণুধর্মসূত্রঃ ৯১/১০

এছাড়াও পাণিনীর অষ্টাধ্যায়ীর ৫/২/১০১ সূত্রে অর্চা বা দেবতার প্রতিকৃতির উল্লেখ লক্ষ্যনীয়। মূর্তিপূজককে তখন বলা হত "আর্চ"।এখানে আরও উল্লেখ্য যে, উক্ত সূত্রে প্রজ্ঞা, শ্রদ্ধা, অর্চা ও বৃত্তি শব্দ পরপর ব্যবহৃত হয়েছে। 

সূত্রটি নিম্নরূপঃ

"প্রজ্ঞাশ্রদ্ধার্চাবৃত্তিভ্যো ণঃ"

অনুবাদঃ প্রজ্ঞা, শ্রদ্ধা, অর্চা এবং বৃত্তি শব্দের পরে 'ণ' প্রত্যয় হয় "মত্বর্থে" বা অভিজ্ঞ অর্থে। 

যেমন- প্রাজ্ঞো ব্যাকরণে অর্থাৎ ব্যাকরণে অভিজ্ঞ যিনি। এরকমভাবে মূর্তি পূজায় যিনি অভিজ্ঞ তাকে বলা হয়েছে "আর্চ"। 

এমনকি প্রতিকৃতির বা মূর্তির  অর্থেও পাণিনীর অষ্টাধ্যায়ীতে প্রতিমার উল্লেখ রয়েছে।

যেমন অষ্টাধ্যায়ীর ৫/৩/৯৬ নং সূত্রে বলা হয়েছে, ”ইবে প্রতিকৃতৌ”

অনুবাদঃ " ইব" এর অর্থে বিদ্যমান প্রাতিপাদিকের পর "কন্" প্রত্যয় হয়। 

যেমনঃ অশ্ব ইব প্রতিকৃতিঃ= অশ্বকঃ ( অর্থাৎ অশ্বের প্রতিকৃতি বা মূর্তি। 

এই মূর্তিগুলো কেউ কেউ বিক্রয় করতেন বলেও পাণিনী উল্লেখ করেছেন, “জীবিকার্থে চাপণ্যে” (অষ্টাধ্যায়ীঃ ৫/৩/৯৯)

অর্থাৎঃ জীবিকার জন্য কিন্তু বিক্রীর অযোগ্য অর্থ বুঝালে "কন্" প্রত্যয়ের লুক্ হয়। 

সিদ্ধান্তকৌমুদীতে এ ধরণের মূর্তির উদাহরণ হিসেবে বাসুদেব বা কৃষ্ণ, শিবঃ বা শিব ও স্কন্দঃ বা কার্তিকেয়র মূর্তির উল্লেখ আছে। 

পতঞ্জলি এই সূত্রের মহাভাষ্যে বলেছেন,

"অপণ্য ইতি উচ্যতে। তত্রে দং ন সিধ্যতি শিবঃ স্কন্দঃ বিশাখ ইতি। কিং কারণম্? মৌর্যৈর্ হিরণ্যার্থিভির্ অর্চাঃ প্রকল্পিতাঃ।  ভবেৎ তাসু ন স্যাৎ।  যাস্ ত্বেতা সম্প্রতি পূজার্থাস্ তাসু ভবিষ্যতি। "

অর্থাৎ, এই সকল মূর্তি বিক্রয় হত না, এগুলো অর্চনায় ব্যবহৃত হত। 

গবেষক বা. শ. আগারওয়াল এথেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেচেন যে, ৫ রকমের মূর্তি তখন প্রচলিত ছিল। 

১. সার্বজনিক দেবায়তনের যার উল্লেখ আমারা গৃহ্যসূত্রে ভুরি ভুরি পেয়েছি 

২. দেবলক ব্রাহ্মণদের

৩. বিক্রির জন্য

৪. মৌর্যদের

৫. পতঞ্জলির সময়ে প্রচলিত 

পাণিনীসূত্রও মহাদেব শিব থেকেই প্রাপ্ত

পিঙ্গলাচার্য রচিত পাণিনী শিক্ষায় উল্লেখ রয়েছে,

”শঙ্করঃ শাঙ্করীং প্রাদাদ্দাক্ষীপুত্রায় ধীমতে।
বাঙ্ময়েভ্যঃ সমাহৃগ্য দেবীং বাচমিতি স্থিতিঃ।।” 

অনুবাদঃ মহেশ্বর বাঙ্ময় জগৎ থেকে বাক্ রূপা দেবীকে আহরণ করে কল্যাণকর বুদ্ধিমান দাক্ষীপুত্র পাণিনীকে প্রদান করেছিলেন। 

(পাণিনীয় শিক্ষাঃ ৫৬)

মহেশ্বর শিব কর্তৃক পাণিনীকে প্রদত্ত ১৪ টি সূত্রই অষ্টাধ্যায়ীর ভিত্তি। 

তারপর আলোচনা করা যাক শিবলিঙ্গ নিয়ে। শিবলিঙ্গ নিয়ে বিভ্রান্তির অন্ত নেই। 

শিবলিঙ্গের উৎপত্তি  নিয়ে মূলত তিনটি মত প্রচলিত আছে। 

১। শিব লিঙ্গ জননেন্দ্রিয়ের প্রতীক (phallus symbol)
২। স্তম্ভ থেকে লিঙ্গের উৎপত্তি
৩। বৈদিক যুপ ও স্তুপ পূজন থেকে লিঙ্গের উৎপত্তি

প্রথমে লিঙ্গ শব্দটির কনসেপচুয়াল আলোচনা না করে, আমাদের উচিত আগে মত তিনটি বিস্তারিত ভাবে জেনে নেওয়া। 

১ম মতঃ শিবলিঙ্গ জননেন্দ্রিয়ের প্রতীক

পাশ্চাত্য স্কলারদের অনেকের মত শিবলিঙ্গ পুং জননাঙ্গকে নির্দেশ করে। তারা এটিকে লিঙ্গ যোনী পূজা হিসেবেই উল্লেখ করেন।  তারা বলেন, শিবলিঙ্গ মূলত জননেন্দ্রিয়। প্রাচীন কালে পৃথিবীর সকল শ্রেণীর মানুষর মধ্যে স্ত্রীজননেন্দ্রিয় ও পুংজননেন্দ্রিয়ের পূজার প্রচলন ছিল এমনটি তাদের মত। সভ্য সমাজের মধ্যে ফিনিসীয়, মিশরীয়, রোমকরা এই পূজা করত। রোমান মহিলারা ও কন্যারা জননেন্দ্রিয় সদৃশ পদক ও অলঙ্কার পড়তেন। তাদের নাকি বিশ্বাস ছিল এতে সন্তানসম্ভবা হওয়া যায়। তাই এই মতের সাথে রিলেট করার জন্য এসকল পাশ্চাত্য স্কলাররা ঋগ্বেদে উল্লেখিত "শিশ্নদেবাঃ" শব্দটিকে তাদের মতের সমর্থন রূপে পেশ করেন(ঋগ্বেদ সংহিতা ৭/২১/৫ ও ১০/৯৯/৩)। 

কালে কালে মতের রূপ বদলায়। এসকল স্কলারদের মধ্যেই আবার আরও এক দল আছেন যারা বলেন, জননেন্দ্রিয়ের পূজা আর্যেতর লোকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। তাদের কাছ থেকেই আর্যরা এই পূজা গ্রগণ করে। ঋগ্বেদে শিশ্নদেবদের নগরবাসী বলা হয়েছে।  এ থেকেউ কেউ কেউ মনে করেন,  এরা মহেন্জোদারো সভ্যতার নির্মাতা ছিলেন। 

স্যার জন মার্শাল মহেন্জোদারো ও হরপ্পায় যেসকল স্তম্ভ সদৃশ ও আংটির মত অবশেষ পাওয়া গিয়েছে সেগুলোকে যথাক্রমে পুংজননেন্দ্রিয় ও স্ত্রীজননেন্দ্রিয় এবং পূজার আধার হিসেবে বর্ণনা করেছেন। উত্তরবেলুচিস্তানের মুঘল ঘুন্ডৈ নামক স্থানে বাস্তব লিঙ্গের আকারের পাথরের লিঙ্গ ও পেরিয়ানো ঘুন্ডৈ নামক স্থানে একটি বাস্তব যোনির আকারের পাথরের স্ত্রী যোনী স্যার ওরেল স্টাইল নামক এক গবেষক আবিষ্কার করেন। এগুলোকে তাঁরা মহেঞ্জোদারোও পূর্ববর্তী মনে করেন। 

এখন এই মত আবার সকলে স্বীকারও করেন না। মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করে দেখিয়েছেন, শিশ্নদেবা শব্দের মূল অর্থ কামুক (lustful)। মজার ব্যাপার হল এই মতের সমর্থন যাস্কাচার্য রচিত নিরুক্তেই পাওয়া যায়।  যাস্ক "শিশ্নদেবাঃ" শব্দের অর্থ করেছেন "অব্রহ্মচর্যাঃ" অর্থাৎ যে ব্রহ্মচারী নয় যা lustful অর্থের কাছাকাছি (নিরুক্ত ৪/১৯)। যে সায়ণাচার্যকে নিয়ে সারাদিন সমালোচনা করা হয় তিনিও একই অর্থ সমর্থন করেছেন (ঋগ্বেদ ৭/২১/৫, সায়ণভাষ্য)। 

সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপার হল, যিনি মহেন্জোদারোতে প্রাপ্ত বস্তুকে লিঙ্গ ও যোনী বলে মনে করেছেন, সেই স্যার জন মার্শাল নিজেও বলেছেন, এগুলো প্রথাগতভাবে বানানো (conventionalized)। অর্থাৎ এগুলো বাস্তব শিশ্নের আকৃতি নয়। এমনকি যে বস্তু দুটিকে তিনি নিঃসন্দেহের সাথে শিশ্ন মনে করেছেন সে দুটি সম্পর্কেও তিনি বলেছেন, "more or lesslikely modelled". আপনারা শব্দচয়ন লক্ষ করলে দেখবেন " likely" অর্থাৎ তিনিও এগুলোকে বাস্তব শিশ্ন বলেননি। 

ভারতের গুডিমল্লমের যে শিবলিঙ্গের মাথায় ভাগ দেখে এই মতের লোকজন একে জননেন্দ্রিয় বলেন, সেখানেও ভিন্নমত আছে। ভিন্নমতাবলম্বীরা বলেন যে, এখানে লিঙ্গের মাথা কেটে মন্দিরের আকৃতি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। 

যারা মনে করেন, আর্যেরা লিঙ্গ শব্দটি প্রোটো-অস্ট্রলয়েডদের কাছ থেকে ধার করেছে, সেই প্রোটো-অস্ট্রোলয়েডদের মধ্যেও প্রাচীনকালে কোন শিশ্নপূজার নিদর্শন পাওয়া যায় না। 

তাই, লিঙ্গ প্রতীক যে জননেন্দ্রিয় নয়- এটি এখনও পর্যন্ত প্রমাণিত সত্য। 

২য় মতঃ স্তম্ভ থেকে লিঙ্গের উৎপত্তি 

স্তম্ভ বা পিলার যে শিবলিঙ্গের আকার নির্ণয়ের অন্যতম কারণ তার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে কুশানযুগের শেষদিকের একটি শিবমূর্তিতে।  এ প্রমাণ পেশ করেন গবেষক কুমারস্বামী।  এই শিব মূর্তিটি চতুর্ভুজও দণ্ডায়মান এবং এটি স্তম্ভের মত পিলারের গায়ে বানানো।  এই স্তম্ভকেই শিবলিঙ্গের আদিরূপ বলা যায়। 

এটির পুরাণসম্মত প্রমাণও রয়েছে। শিবপুরাণে বর্ণিত শিবলিঙ্গের আবির্ভাব কাহিনীতে বলা হয়েছে শিবের স্তম্ভমূর্তিই শিব লিঙ্গের আদিরূপ ( শিবপুরাণ, বিদ্যেশ্বরসংহিতা ৩/২৭-৩১, ৫/১১)।

অথর্ববেদের স্কম্ভসুক্ত থেকে 'স্কম্ভ' বা মহাজাগতিক স্তম্ভকেও কেউ কেউ শিবলিঙ্গের আদিরূপ মনে করেন। 

৩য় মতঃ বৈদিক যুপ ও স্তুপ পূজন থেকে শিবলিঙ্গের উদ্ভব 

কিছু কিছু  গবেষকের মতে বৈদিক যুপ ও স্তুপ থেকেি শিব লিঙ্গ পূজার উদ্ভব। স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ ও স্বামী শঙ্করানন্দও এই মতের সমর্থক। 

যুপ হল বৈদিক যজ্ঞে ব্যবহৃত স্তম্ভ। মহাভারতেও বৈদিক যুপ স্তম্ভের উল্লেখ পাওয়া যায়
(মহাভারতম্ঃ ১/৯৪/২৯, ৩/১৯৮/১০)।

প্রথম কয়েক খ্রিষ্টীয় শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত যুপ স্তম্ভও আবিস্কৃত হয়েছে। আনুমানিক ২য় খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রাপ্ত আর্জুনায়নদের এবং যৌধেয়দের মুদ্রায় যুপের পাশে বৃষভ বা ষাঁড়ের দণ্ডায়মান মূর্তি রয়েছে। বেদে শিবকে বৃষভ বলা হয়েছে যা আমরা পূর্বেই দেখেছি। 

তাহলে, আজকের এই আলোচনায় আমরা তিনটি জিনিস খুব পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারলাম। 

১. শিব হল বৈদিক দেবতা 

২. শিবের অর্চা ও লিঙ্গ দুই ধরণের পূজাই প্রচলিত 

৩. শিবলিঙ্গ কোন phallus symbol বা যৌন প্রতীক নয়। 

লিঙ্গ শব্দের ব্যাখ্যাঃ শাস্ত্রে লিঙ্গ শব্দের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে,

"লিঙ্গ সর্ব দেবতার বা বিষয়ের আলয় স্থল অর্থাৎ লয় স্থল। সমস্ত যেখানে লয় প্রাপ্ত হয় তাকে লিঙ্গ বলে।"(স্কন্দপুরাণম্) 

অমরকোষে লিঙ্গ শব্দের অর্থ করা হয়েছে,

"লিঙ্গং চিহ্ন" অর্থাৎ লিঙ্গ হল চিহ্ন বা প্রতীক। (অমরকোষ, ৩য় কাণ্ড, গান্তবর্গঃ,৭৬)

তাই শিবলিঙ্গ হল শিবের প্রতীক। অব্যক্তের প্রতীক। 

📖 সহায়ক গ্রন্থাবলীঃ

১. ঋগ্বেদ সংহিতা
২. যজুর্বেদ সংহিতা
৩. অথর্বেদ সংহিতা
৪. বেদ মীমাংসা - শ্রীঅনির্বাণ
৫. শাস্ত্রমূলক শক্তিসাধনা - উপেন্দ্রকুমার দাস
৬. অমরকোষ
৭. অষ্টাধ্যায়ী - অধ্যাপক ড. তপনশঙ্কর ভট্টাচার্য
৮. মহাভাষ্য
৯. সিদ্ধান্তকৌমুদী
১০. মহাভারতম্
১১. শিবপুরাণ
১২. স্কন্দপুরাণ

হর হর মহাদেব 🙏

প্রচারেঃ
এসপিএস শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
সনাতন শাস্ত্র ও দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ