সনাতন ধর্ম কি? সনাতন শাস্ত্রে 'সনাতন' শব্দটি কোথায়?

 

                       


সেই সনাতন পুরুষ হতে উৎপন্ন ধর্মই অনাদিকাল হতে সনাতন ধর্ম নামে পরিচিত। আগে একটু জেনে নেই ধর্ম কাকে বলে। ধর্ম, রিলিজিয়ন ও ইজমের মধ্যে পার্থক্য জেনে নেওয়াও আবশ্যক। প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে ধর্ম, ইজম/মতবাদ ও রিলিজিয়ন/বিশ্বাস কিন্তু এক নয়।

🔸ধর্মঃ ধর্ম সেটা যেটা আমরা ধারণ করি অর্থাৎ আমার মধ্যেকার বৈশিষ্ট্যসমূহই প্রকাশ করবে আমার ধর্ম কি!

ধর্ম /
ধৃ + মন্ /
ধর + মন্ /
ধরন্ + মনন্ ।
আমার মনের ধরন/ধারণা।


আমার মনে তথা নিজের মধ্যে যা ধারণ করি, সেটাই আমার ধর্ম। ধর্ম আমার নাম কিংবা উপাধিতে নয় বরং আমার আচরণ, সংস্কৃতি ও সংস্কারে প্রকাশ পাবে৷ তাই ধর্ম কোন গ্রহণের বিষয় নয় বরং ধারণের বিষয়।

🔸ইজমঃ ইজম তথা মতবাদ হচ্ছে একটা স্পেসিফিক আদর্শগত দলবদ্ধ সংগঠন৷ এখানে একজন স্পেসিফিক ব্যাক্তির আদর্শকে বা তার প্রচারিত ধ্যানধারণাকে উপজীব্য করে এগিয়ে যাওয়া হয় এবং সেই প্রচারক ও প্রচারকের প্রচারকে সবকিছুর উর্ধে ভাবা হয়।

🔸রিলিজিয়নঃ এরপর আসে রিলিজিয়ন তথা বিশ্বাস৷ মতবাদের চুড়ান্ত স্তর হচ্ছে রিলিজিয়ন তথা বিশ্বাস। কখনো কখনো উত্তরাধিকারসূত্রে সরাসরিই বিশ্বাস জন্ম নেয়৷ রিলিজিয়নে কোন যুক্তি খাটে না বিশ্বাসই মুখ্য। ঈশ্বর একজন আছেন তিনি সবকিছুর মালিক আমার পূর্বপুরুষ সঠিক ছিল তাই আমিও সেই বিশ্বাসে আছি এটাই হচ্ছে রিলিজিয়ন।

শাব্দিক বলেন কিংবা বিশ্লেষণগত মাপকাঠিতেও ধর্ম এবং রিলিজিয়ন সম্পূর্ণ আলাদা।

ধর্ম কিভাবে এলো?

প্রাচীন মানুষরা জীবনের প্রথম দিন থেকেই ধর্মে আবদ্ধ৷ সংঘবদ্ধ বসবাস, পশুশিকার থেকে পশুপালন সবই তারা ধারাবাহিকভাবে ধারণ করে করে বিবর্তনের শিকার হয়েছে। যারা গুহামানব ছিল তারা প্রকৃতিকে রক্ষাকর্তা মানত এবং প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল তারা কোন মতবাদে না গিয়ে সরাসরি রিলিজিয়ন তথা বিশ্বাসে চলে গিয়েছিল।

এখন যদি ধর্মকে সার্বজনীন হিসেবে চিন্তা করি অর্থাৎ প্রত্যেকের জন্য একটা পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা তবে পরমেশ্বর সমগ্র মানবজাতির জন্য একদম কল্পের শুরুতে একটা স্পেসিফিক নির্দেশনা তথা জ্ঞানের প্রকাশ পাঠিয়েছেন বেদ আকারে৷ অতঃপর সেই সনাতন জ্ঞানকে সকলের নিকট সহজবোধ্য করতে বিভিন্ন বৈদিক শাস্ত্র৷ বেদ পেয়ে সমাজ ও সংসার জ্ঞানের আলোয় সমৃদ্ধ হলো। তখন থেকে মানুষে মানুষে ভেদ একটাই তা হলো ধর্ম ও অধর্ম। যেহেতু বেদ ছিল সরাসরি পরমেশ্বর কর্তৃক নির্ধারিত মানবিক ধর্ম তাই এটার নাম হলো সনাতন ধর্ম। সনাতন বলতে বুঝানো হয়েছে চিরন্তন। অর্থাৎ যেটা ছিল, আছে ও থাকবে।

🔸 সনাতন ধর্মঃ
মুস্তাফা পান্না সঙ্কলিত ও ড. হায়াৎ মামুদ কর্তৃক সংশোধিত "কিশোর বাংলা অভিধান" -এ সনাতন শব্দের অর্থ হিসেবে বলা হয়েছে শাশ্বত, বহুকাল প্রচলিত। অমরার্থ-চন্দ্রিকার ৪০তম শ্লোকে নিত্যের প্রতিশব্দ হিসেবে বলা হয়েছে,

"শ্বাশ্বতস্তু ধ্রুবো নিত্য সদাতন সনাতনাঃ।"
অর্থ: নিত্যের নাম— শ্বাশ্বত, ধ্রুব, নিত্য, সদাতন, সনাতন

আমরা হিন্দুরা আমাদের ধর্মকে অনাদিকাল হতেই 'সনাতন ধর্ম' হিসেবে মনে করি যা পরম্পরাগতভাবে চলমান।

এক্ষেত্রে 'ধর্ম' শব্দের আবার প্রচলিত বাংলা অর্থ নেওয়া যায় না। সংস্কৃতে 'ধর্ম' শব্দ এক বিশেষ অর্থ গ্রহন করে।

মহাভারতে বলা আছে,
"ধারণাদ্ধর্মমিত্যাহু ধর্মো ধারয়তে প্রজাঃ।
যৎস্যাদ্ধার সংযুক্তং স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ।।"
                                     মহাভারত [কর্ণপর্ব ৬৯ /৫৮]

সরলার্থঃ সমাজকে, প্রজা সাধারণকে যা ধারণ করে রাখে, তাই ধর্ম । কিসে প্রজা ও সমাজের সমৃদ্ধি, কল্যাণ হয়, তা বিচার করে সেটিই ধর্ম, তাই স্থির করতে হবে ।

বৈশেষিক সূত্রে মহর্ষি কনাদ বলেন,

'য়তো অভ্যুদয় নিঃশ্রেয়সসিদ্ধিঃ স ধর্ম
বৈশেষিক দর্শন [১/১/২]

অর্থাৎ অভ্যুদয় ও নিঃশ্রেয়স যাহা দ্বারা পাওয়া যায় তাহারই নাম ধর্ম।

এতেই বোঝা যাচ্ছে ধর্ম শব্দের অর্থ কোন ঈশ্বর বা ব্যক্তি কেন্দ্রিক মতবাদ নয়। সোজা ভাষায় হিন্দু শাস্ত্র আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মই ধর্ম বলে অভিহিত করে।

এবার আশা যাক সনাতন ধর্ম প্রসঙ্গে। শাস্ত্রে ঈশ্বরকে সনাতন বলেই অভিহিত করা হয়েছে।
অথর্ববেদ সংহিতার ১০ম কান্ডের ৮ম সুক্তে ২৩দশ মন্ত্রে আমরা পাই,

"সনাতনমেনমানরুতাদ্য স্যাতপুর্ণবঃ।
অহোরাত্রো প্রজায়েতে অন্যো অন্যস্য রূপয়ো।"
                                                       অথর্ববেদ সংহিতা [১০/৮/২৩]

অনুবাদঃ তাঁকে সনাতন(পুরুষ) বলা হয় কারন তিনি সদা নতুন; যেমন দিন ও রাত্রি একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে নিত্য নতুন রূপে জন্মগ্রহণ করেও সনাতন।

ঈশ্বর যেহেতু নিত্য, শাশ্বত তথা সনাতন সেই কারনে তাঁর থেকে উৎপন্ন জ্ঞানও সনাতন। এই কারনে মনুস্মৃতির ১/২৩ এ আমরা দেখতে পাই 'ত্রয়ং ব্রহ্ম সনাতন', অর্থাৎ সনাতন ত্রয়ী(বেদ)।

মনুসংহিতার ৪/১৩৮ এ আরো বলা হয়েছে,

"সত্যং ব্রৃয়াৎ প্রিয়ং ব্রৃয়ান্ন ব্রৃয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্।
প্রিয়ঞ্চ নানৃতং ব্রৃয়াদেষ ধর্মঃ সনাতনঃ।।"
                                                      মনুসংহিতা [৪/১৩৮]

অনুবাদঃ সব সময় সত্য কথা বলবেন এবং সেই সত্যবচন অবশ্যই প্রিয় হতে হবে । লোকের মর্মভেদী , অপ্রিয় সত্য কখনোই বলা উচিত নয় কিংবা লোকের তোষামদের জন্য মিথ্যা প্রিয় বাক্য বলা উচিত নয় — ইহাই বেদোক্ত সনাতন ধর্ম।

আবার উক্ত স্মৃতির ১২/৯৯ এ পাই,

"বিভর্তি সর্বভূতানি বেদশাস্ত্রং সনাতনম্।
তস্মাদেতৎ পরং মন্যে যজ্জন্তোরস্য সাধনম্।।"

অনুবাদঃ এই চরাচর সমুদয় প্রাণীজগৎকে সনাতন বেদ শাস্ত্রই ধারণ করছেন । তাই জ্ঞানীরা বেদকে মানুষের পুরুষার্থ সাধনের পরম উপায় বলে মনে করেন ।

শ্রীমদ্ভগবতগীতার ১/৪০ এ অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে আক্ষেপ করে বলেন,

"কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্মাঃ সনাতনাঃ।
ধর্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধর্মোহভিভব ত্যুত।।"

অনুবাদ: নিজেদের কুলকে বিনাশ করলে আমাদের কুলধর্ম সনাতন নষ্ট হয়ে যাবে। তখন আমাদের সম্পূর্ণ কুলে বহুপ্রকারে পাপ প্রবেশ করবে।
এখানে স্পষ্টত সনাতন শব্দে উল্লেখ দেখতে পাই আমরা।

সর্বপরি, গীতার ১১/১৮তে অর্জুন কর্তৃক ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সনাতন ও সনাতন ধর্মের রক্ষা ঘোষনা করার দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।

ত্বমক্ষরং পরমং বেদিতব্যং ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্। 
ত্বমব্যয় শাশ্বতধর্মগোপ্তা সনাতনস্ত্বং পুরুষো মতো মে।।
                                                                      ~ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা [১১/১৮]

অর্থ: আপনি অক্ষর পরম জ্ঞাতব্য, আপনি বিশ্বের পরম আশ্রয়, ও সনাতন ধর্মের রক্ষক, আপনিই সনাতন পুরুষ। এই আমার অভিমত ।

হিন্দু শাস্ত্রের বহু স্থানেই ঈশ্বর, বেদ, বেদোক্ত ধর্মকে সনাতন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমরা যেহেতু বেদ ও বেদোক্ত ধর্মের অনুসারী তাই আমরা হিন্দুরা আমাদের ধর্মকে 'সনাতন ধর্ম' বলেই আখ্যায়িত করি।

©️  শ্রী অনিক কুমার সাহা, গৌরব চৌধুরী

প্রচারেঃ
SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি 
(বেদ ও বেদাঙ্গ বিভাগ)
সনাতনী দর্শন ও শাস্ত্র প্রচারে বদ্ধপরিকর 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ