দিল্লীর লালকেল্লা কে নির্মাণ করান? সম্রাট শাহজাহান লালকেল্লার নির্মাণ করান নি!

 


দিল্লির বহু পরিচিত একটি স্থাপত্য "লালকেল্লা" যা এখন ভারতীয়দের গর্বের প্রতীক হিসেবেও পরিচিত। তবে ইতিহাসের সত্য লুকিয়ে লালকেল্লার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এক মোগল সম্রাটের নাম।

লালকেল্লার ভেতরে রাখা ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের একটি পাথরের ফলকে স্পষ্ট করে লিখা রাখা হয়েছে শাহজাহান (১৬২৮-১৬৪৮ খ্রি: ) ১৬৩৯ থেকে ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লালকেল্লা নির্মাণ করান। বলা হয়ে থাকে এর মূল স্থপতি ছিলেন ওস্তাদ আহমেদ লাহোরী।

আদৌ কি লালকেল্লা সম্রাট শাহজাহান নির্মাণ করান নাকি অন্যের স্থাপত্যের আস্তরণ বদলে দিয়ে নিজের নামে চালিয়ে দেন

ইতিহাসের লুকিয়ে রাখা সত্যঃ

ভারতের ইতিহাস পরিবর্তিত হয়েছে নানা সময়ে, নানাভাবে নানা চক্রান্তের দ্বারা। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর সে ধারা আরও বেগবান হয়৷ 

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ স্যার হ্যানরী মাইয়ারস ইলিয়টের একটি বক্তব্য আছে স্যার এইচ.এম. ইলিয়ট ভারতে মধ্য যুগের মুসলমান ইতিবৃত্ত নিয়ে আট খণ্ডের একটি বই লিখেন যা পরবর্তীতে জন ডাউসন সংস্কার প্রকাশ করেন। বইটির নাম ছিলো "The History of India, as Told by Its Own Historians." 

শেষ খণ্ডে  স্যার এইম. এম. ইলিয়টের পর্যবেক্ষণ ছিলো, ভারতে মুসলিম শাসনকালের ইতিহাস হলো এক উদ্দেশ্যমূলক জালিয়াতি।

🚩 লালকেল্লার নামকরণঃ 

লালকেল্লা তৈরির সময় এর বিভিন্ন অংশে ব্যাবহৃত হয়েছে চূনাপাথর তাই এর প্রকৃত রঙ ছিলো সাদা। পরবর্তীকালে এর ঔজ্জ্বল্য হারাতে থাকলে ব্রিটিশরা এই দুর্গটির দেওয়ালে লাল রং করে দেয়। ব্রিটিশরা তখন এটাকে বলতো, "রেড ফোর্ট" যা পরবর্তীতে হয়ে যায় "লালকেল্লা" মোগল আমলে এর নাম ছিল "কিলা--মুবারক" তবে এর আগেও ইতিহাস আছে যা ইচ্ছেকৃতভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। 

লালকেল্লার পর্যবেক্ষণঃ

🔸পয়েন্ট-

লালকেল্লার নির্মাণ নিয়ে সন্দেহের ভিত্তি শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ "Weekly of India" মেগাজিনের ১৩২তম পাতায় প্রকাশিত একটি ছবি। ছবিটি মূলত অক্সফোর্ডের বোডলিয়ান গ্রন্থাগারে রাখা আছে। ওই ছবিতে দেখা যাচ্ছে সম্রাট শাহজাহান এক পার্শিয়ান দূতকে "দেওয়ান--আম" এর মধ্যে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। ছবির নিচে তারিখ দেওয়া আছে ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দ এবং মোগল ইতিহাসে ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহানের রাজ্যাভিষেক হয়েছে। কিন্তু প্রাপ্ত ছবিতে দেখা যাচ্ছে রাজ্যাভিষেকের আগেই লালকেল্লার অস্তিত্ব ছিলো। যেহেতু শাহজাহান ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় লালকেল্লা শাহজাহান নির্মাণ করান নি।

🔸পয়েন্ট-

লালকেল্লার ভেতরের একটি খিলানে রয়েছে জ্বলন্ত সূর্য” যা সূর্য বংশীয় রাজাদের প্রতীক এবং তার ঠিক পাশেই রয়েছে প্রণব চিহ্ন "ওঁ" এর ঠিক নিচেই রয়েছে কিছু সনাতন রাজকীয় প্রতীক। এইসব প্রতীকগুলির মাঝেমাঝে কিছু উর্দু অক্ষর রয়েছে যেগুলো স্পষ্টতই বোঝা যায় যে পরবর্তীতে সংযুক্ত।


🔸পয়েন্ট-

লালকেল্লার প্রধান দরবার কক্ষ বলে পরিচিত খাসমহলে রয়েছে একটি বিশেষ রাজকীয় প্রতীক। প্রতীকটিতে দেখা যাচ্ছে দু'টি তরবারির হাতল একসাথে যুক্ত এবং তরবারি দুটির বাঁকানো ফলা ডানে বাঁয়ে উপরের দিকে উঠে গিয়েছে। বাঁকানো ফলার দুই মাথা গিয়ে স্পর্শ করেছে দুইটি শঙ্খকে। তরবারি দুটির সংযুক্ত হাতলের ওপর রয়েছে একটি কলস, কলসে উপর একটি পদ্মফুলের কুঁড়ি এবং তার ওপরে ঝুলছে ন্যায় বিচারের প্রতীক তুলাদণ্ড সম্পূর্ণ প্রতীকে অনেকগুলো খোদাই করা জলন্ত সূর্য যা প্রাচীন সূর্য বংশীয় রাজাদের প্রতীক। এই প্রতীকের সবগুলো নিদর্শন স্পষ্ট হিন্দু সংস্কৃতিকে নির্দেশ করে। অথচ সেখানকার গাইড আঞ্চলিক ইতিহাসবিদরা হঠকারিতার সাথে এই প্রতীককে অর্ধচন্দ্র হিসেবে ব্যাখ্যা করে। 



🔸পয়েন্ট-

লালকেল্লার খাসমহলের প্রতিটি দরজায় রয়েছে হাতির পিঠে বসা হিন্দু মাহুতের প্রতিকৃতি। 


🔸পয়েন্ট-

লালকেল্লার দিল্লি গেইট/ফটকের দু'পাশে রয়েছে দুটি বড় হাতির মূর্তি। প্রাসাদ, মন্দির বা কেল্লার ফটকে হাতির প্রতিকৃতি নির্মাণ হিন্দু সংস্কৃতির অংশ। এছাড়াও গোয়ালিয়র, উদয়পুর বা কোটার প্রাসাদ বা কেল্লাগুলোর প্রধান ফটকেও হাতির মূর্তি পাওয়া যায়। কারণ হিন্দু সংস্কৃতিতে হাতি হলো বিশালতা, শক্তি, গৌরব সমৃদ্ধির প্রতীক। 

(লালকেল্লার ফটক)

(সাধারণ হিন্দু মন্দিরের ফটক)

🔸পয়েন্ট- 

লালকেল্লার ভেতরে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৈরি বলে প্রচলিত মোতি মসজিদ রয়েছে যার দুটি গম্বুজের মাঝখানের খিলানে রয়েছে কলার ছড়া। আর খিলানের ওপরে রয়েছে দুই ধারে পাঁচটি করে ফল সাজানো যা সনাতন সংস্কৃতিতে পুজোর থালায় ব্যবহৃত পঞ্চফলকে নির্দেশ করে। অন্যথায় মসজিদে পঞ্চফলের থালা বা কলার ছড়ার প্রয়োজন নেই। 

 


তাহলে লালকেল্লা কে নির্মাণ করেন?

পৃথ্বীরাজ চৌহানের সভাকবি চাঁদ বরদৈ-এর লেখা "পৃথ্বীরাজ রাসো"-তে রয়েছে এই প্রশ্নের উত্তর। সেখানে উল্লেখ আছে রাজপুত তোমর বংশের রাজা অনঙ্গপাল ৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে একটি দুর্গ তৈরি করেন যার নাম ছিল "লালকোট" তথা লালকেল্লা। 


পরবতর্তীতে ১০৫২ সালে অনঙ্গপাল- বর্তমান কুতুব মিনারের (মূলত একটি হিন্দু মন্দির) পাশে একটি আইরন পিলার (বিষ্ণু দণ্ড) স্থাপন করেন যা তিনি মথুরা থেকে এনেছিলেন। পৃথ্বীরাজ রাসোতে লিখা আছে, 

हुं गड्डि गयौ किल्ली सज्जीव हल्लाय करी ढिल्ली सईव

- फिरि व्यास कहै सुनि अनंगराइ भवितव्य बात मेटी जाइ

অর্থাৎ অনঙ্গপাল দিল্লীতে একটি কিল্লি স্থাপন করেন যা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না৷ 

সত্যিই কুতুবউদ্দিন আইবেক বহু চেষ্টা করেও এই আইরন পিলারটি (বিষ্ণু দণ্ড) ধ্বংস করতে পারে নি। কুতুবউদ্দিন আইবেক মা চণ্ডীর সুউচ্চ মন্দিরও ধ্বংস করতে পারেনি যা পরবর্তীতে কুতুব মিনার (এই বিষয়ে পরবর্তীতে লিখা হবে প্রমাণসহ) বলে চালিয়ে দেয়। আইরন পিলারের চারপাশে অনঙ্গপাল প্রায় মাইল দীর্ঘ দুর্গের দেয়াল (৩০ ফুট পুরু) নির্মাণ করেন যা পরবর্তীতে লালকোট নামে পরিচিত হয় এবং এটাই দিল্লীর মূল লালকেল্লা। বর্তমান লালকেল্লার নিকাশি ব্যবস্থাও রাজপুত স্থাপত্য শৈলীর পরিচয় বহন করছে। লালকেল্লার সামনে দু'টি প্রাচীন মন্দিরের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে এই এলাকা আগে হিন্দু অধ্যুষিত ছিল এবং হিন্দু স্থাপত্য লালকেল্লা ছিল বলেই কাছাকাছি এই মন্দির দুটি তৈরি হয়েছিল। মন্দির দুটির একটি হলো লাল জৈন মন্দির এবং অপরটি গৌরীশঙ্কর মন্দির এছাড়া পুরোনো দিল্লির অধিকাংশ মানুষ হিন্দু এবং এই এলাকার বেশির ভাগ বাড়িই হিন্দু রীতিতে তৈরি। তাই ধারণা করা যেতেই পারে বর্তমান লালকেল্লাও তমার সাম্রাজ্যের সময়কালেই অনঙ্গপাল দ্বারা নির্মিত কারণ দিল্লীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁর নামই ঐতিহাসিকভাবে চর্চিত। 

দিল্লী জাদুঘরে সংরক্ষিত একটি শিলালিপিতে লিখা আছে,

देशोऽस्ति हरियानाख्यो पॄथिव्यां स्वर्गसन्निभः

ढिल्लिकाख्या पुरी तत्र तोमरैरस्ति निर्मिता

Translation: In a country called Haryana, which is equivalent to heaven on earth, Tomars built a city called Dhillika.

আইরন পিলারের শিলালিপিতে যা লিখা আছে সেটাকে আলেকজান্ডার কানিংহাম অনুবাদ করেন,

"Samvat Dihali 1109 Ang Pāl bahi"

 Translation: In Samvat 1109 [1052 CE], [Anang] Pāl peopled Dilli.

অর্থাৎ লালকোট লালকেল্লা তমার সাম্রাজ্যের সময়কালে  অনঙ্গপাল তমার কর্তৃক নির্মিত এটাই সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য। 

©স্টিমন অনিক

প্রচারেঃ
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)
সনাতনী ঐক্য, প্রচার কল্যাণে অবিচল।।

তথ্যসূত্র:
উইকিপিডিয়া, সাংবাধিক উত্তম মণ্ডল, ইন্টারনেট

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ