সূক্ষ্ম বিজ্ঞানের স্থুল দর্শন হয় অপবিজ্ঞান।।

 


প্রথমেই জানিয়ে রাখি নিচের বিশ্লেষণটি একটি ডকুমেন্টারি ভিডিও-এর উপর ভিত্তি করে ‍সম্পূর্ণ আমার করা এবং লিখাটা নামে বেনামে অনেকেই শেয়ার করেছে। লিখার সত্যটা যাচাই হেতু দেশের দুইটা বড় মুক্তমনা ও বিজ্ঞান মঞ্চের গ্রুপে আমার পোস্টের লিংক দেওয়া হলো।
বিজ্ঞানের যেকোনো সিদ্ধান্তঃ প্রমাণিত তত্ত্বের উপর দাড়িয়ে থাকে। আমি হুট করে কোনকিছুকে অলৌকিক বলে দিলে কিংবা বৈজ্ঞানিক বলে দিলে মানুষ সেটা বিজ্ঞান হিসেবে মানবে না যদি না আমি সাম্প্রতিক কালের বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে সেটা প্রমাণ করতে পারি, নাহলে রব উঠবে অপবিজ্ঞানের। আমি যেটা বিশ্বাস করি যে জড়বিজ্ঞান হলো অধ্যত্মবিজ্ঞানের কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশু এবং আমি সেটা পরবর্তী লিখায় যুক্তিসহ তুলে ধরব।
এই লিখায় আমি যেটা প্রমাণ করব সেটা হলো বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণকে দুইভাবে করা যায়।
১/ আপাত বিশ্লেষণ তথা স্থুল বিশ্লেষণ
২/ সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ
প্রশ্নঃ জলের নিচে একজন মানুষ কোন অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়া সর্বোচ্চ কতক্ষণ বেঁচে থাকবে?
বিজ্ঞানের প্রামানিক উত্তর হবে সর্বোচ্চ দুই মিনিট কিংবা কিছু বেশী। তবে আমি যদি উত্তর দেই যে একজন মানুষ সর্বোচ্চ ৬০ ঘন্টা বেঁচে থাকার রেকর্ড আছে তখন কি সেটা বেইজলেস উত্তর হবে না?
গতবছর বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবির প্রায় ১৩ ঘন্টা পর জলের নিচ থেকে বেঁচে ফিরে এসেছিল একজন। ঘটনা কতটুকু সত্য সেটা জানি না তবে এটা সম্ভব এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তিতেই সম্ভব।
এখন অনেকগুলো প্রশ্ন আসতে পারে মানুষের মাথায় এই বেঁচে ফেরার সম্ভাব্যতা নিয়ে।
★ জলের নিচে ১৩ ঘন্টা কিভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব?
★ লোকটা এতক্ষণ জলের নিচে থেকেও মুখ শরীর সাদা হয়ে কুচকে যায় নি কেন?
★এই লঞ্চে এয়ার টাইট কোন প্রকোষ্ঠ বা অক্সিজেন সিলিন্ডার না থাকলে লোকটা প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কোথায় পেলো?
৮-৯ বছর আগের আরেকটা ঘটনা বলি। হ্যারিসন ওকেনে নামে একজন প্রায় ৬০ ঘন্টা পর একটা ডুবন্ত জাহাজ থেকে বেঁচে ফিরেছিল। হ্যারিসন সেই টাগবুটের একজন বাবুর্চি ছিল। ১২ জন ক্রিউ নিয়ে নাইজেরিয়ার বন্দর থেকে জাহাজটি যাত্রা শুরু করেছিল। রাত ৪ টার দিকে সাগরের মাঝে এক প্রচন্ড ঢেউয়ে টাগবুটটি উল্টে যায়, উল্টে যাওয়ার সময় হ্যারিসন ছিল টয়লেটে। সবগুলো ক্যাবিন অটোমেটিক লকড হয়ে যায়। হ্যারিসন আটকা পড়ে যায় টয়লেটে। সে ভাগ্যবান ছিল তাই সে টয়লেটে একটা এয়ার পকেট/এয়ার বাবল তৈরী হয় কিন্তু সেখানে বাতাসের পরিমাণ খুব সামান্যই ছিল। তারপর হ্যারিসন ইঞ্জিন রুমে যাওয়ার একটা পথ খুজে পায় এবং সেখানে গিয়ে ভাগ্যক্রমে আরেকটা এয়ার পকেট পেয়ে যায় এবং এটা মোটামুটি ৪-৫ ফিটের মত যেখানে হ্যারিসন নিজেকে ভালোভাবেই আটিয়ে নিতে পেরেছিল। ভাগ্যক্রমে সেখানে সে একটা ম্যাট্রেক্স পেয়ে যায় যেটার উপর বসে সে নিজেকে প্রায় ৬০ ঘন্টা জলের উপর ভাসিয়ে রাখতে পেরেছিল। প্রায় ৬০ ঘন্টা পর একদল ডুবুরি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০ মিটার (১০০ ফিট) নিচে গিয়ে ভাগ্যবান হ্যারিসনকে জীবিত উদ্ধার করে।
এই ঘটনা থেকে ত স্পষ্ট যে জলের নিচেও এয়ার পকেটের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় মানুষ বেঁচে থাকতে পারে।
এবার আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর খুজি।
★ এয়ার পকেট কি?
এয়ার পকেটের বাংলা হলো বায়ুগহ্বর। আমরা যদি একটা খালি গ্লাসকে উপুড় করে জলে ডুবাই তাহলে খেয়াল করব গ্লাসের ভেতরের অংশে জল প্রবেশ করবে না। এর কারন আমরা যখন কোন কিছু জলে ডুবাই তাহলে সেই বস্তুর যে পরিমাণ আয়তন জল অপসারিত করে সেই পরিমাণ অংশই ডুবে যায়। এখন গ্লাসের ভেতর ফাকা জায়গাটা কিন্তু আসলে ফাকা নয়, সেটা বায়ু দ্বারা পূর্ণ। এই নির্দিষ্ট পরিমাণ বায়ুও সম আয়তনের জলকে আপসারিত করে এতে করে জল গ্লাসের ভেতর প্রবেশ করে না। যেহেতু নৌযানগুলো এমনভাবে তৈরী করা হয় যাতে এর বিভিন্ন অংশ এয়ার টাইট থাকে তাই এগুলো উল্টে গেলে খুব সহজেই এর ভেতর এয়ার পকেট তৈরি হতে পারে। এটা পরীক্ষা করার জন্য একটা খালি বালতিতে মাথা ঢুকিয়ে ডুব দিয়ে দেখতে পারেন, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী সময় ডুবে থাকতে পারবেন।
★ এয়ার পকেটে ঠিক কি পরিমাণ অক্সিজেন থাকতে পারে কিংবা একজন মানুষ সেখানে কত সময় বাঁচতে পারে?
আমরা জানি বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় ২১% এবং একজন মানুষ প্রতিদিন মিনিমাম ১০ কিউবিক মিটার বাতাস গ্রহণ করে। তবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ মিটার নিচে গেলেই প্রয়োজনীয় বাতাসের চাহিদা কমতে থাকে। হ্যারিসনের ক্ষেত্রে পদার্থবিদরা হিসেব করে দেখছিল ১০০ ফিট নিচে হ্যারিসনের জন্য প্রয়োজনীয় বাতসের চাহিদা ছিল মাত্র ২ কিউবিট মিটার পার ডে। অর্থাৎ এয়ার পকেটের আয়তন ৬ কিউবিট মিটার হলেও তার জন্য জলের ৬০ ঘন্টা বেঁচে থাকা অসম্ভব ছিল না।
★ কিন্তু এয়ার পকেটে CO2 লেভেল বেড়ে যায় নি?
বাতাসে CO2 এর স্বাভাবিক পরিমাণ ০.১%। এই পরিমাণ যখন ৫% ক্রস করে তখন সেটা জীবননাশের কারণ হয়ে যায়। হ্যারিসনের এয়ার পকেটের সারফেসে জল ছিল আর আমরা জানি জল কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। যেহেতু হ্যারিসন অন্ধকার এয়ার পকেটে আটকে ছিল সে হয়ত অসাবধানতাবশতও বারবার জলে হাত পা ছুড়েছে এতে করে সারফেস ওয়াটারের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে CO2 এর শোষণও বেড়ে গেছে। বিজ্ঞানীদের হিসেবে এয়ার পকেটের আয়তন যদি একটা U-haul Van এর সমান হয় তবে একজন মানুষের জন্য CO2 লেভেল ৫% এ যেতে প্রায় ৮০ ঘন্টা লেগে যাবে। সেই হিসেবে হ্যারিসনের জন্য ৬০ ঘন্টা বেঁচে থাকা অসম্ভব ছিল না।
★ হাইপোথারমিয়া হতে পারত না?
হ্যা, হ্যারিসনের জন্য হাইপোথারমিয়া হওয়ার চান্সও ছিল। সাধারণত শরীরের তাপমাত্রা ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটে নামলেই হাইপোথারমিয়া শুরু হয়ে যায়। জলের তাপমাত্রা যদি ৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে থাকে এবং মানুষের শরীর যদি জলে ডুবন্ত থাকে তবে মানুষটা মারা যাওয়ার জন্য দুই ঘন্টা সময় লাগবে৷ এক্ষেত্রেও হ্যারিসন ভাগ্যবান ছিল কারন সে নিজেকে একটা ম্যাট্রেক্সে ভাসিয়ে রেখেছিল।
এসব বিষয় বিশ্লেষণ করলে এটা ত স্পষ্ট যে ডুবে যাওয়া টাগবুটে সৃষ্ট এয়ারপকেটে হ্যারিসনের জন্য ৬০ ঘন্টা বেঁচে থাকা অসম্ভব ছিল না।
এখন আসি বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ ডুবিতে ১৩ ঘন্টা পর বেঁচে ফিরে আসা ব্যাক্তির বিষয়ে।
টিভি ভিডিওতে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে ছোট লঞ্চটি বড় লঞ্চটির ধাক্কায় সরাসরি উল্টে ডুবে গেছে। এই লঞ্চে একটা এয়ার পকেটের তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং সেখানে আটকা পড়লে ১৩ ঘন্টা বেঁচে থাকাও সম্ভব। এটা সাজানো নাটক কি না সেই বিতর্কে আমি যাচ্ছি না তবে আমার বক্তব্য স্পষ্ট যে জলের নিচে দীর্ঘসময় বেঁচে থাকা অসম্ভব কিংবা অলৌকিক কিছু না। লঞ্চ থেকে বেঁচে ফেরা ব্যক্তিটি হ্যারিসনের মত ইঞ্জিনরূম থেকেই ফিরেছে।।
ও হ্যা, হাইপোথারমিয়া না হলে মানুষটার মুখমন্ডল কিংবা শরীর সাদা ফ্যাকাসে হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।
চিত্রঃ হ্যারিসনের এয়ার পকেটের ধরন।
সম্পূরক ঘটনাঃ ২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জে বালুবোঝাই ট্রলার ডুবির ৩০ ঘন্টা পর সেই ট্রলার থেকেই উদ্ধার করা হয় সোহাগের জীবিত দেহ।
বিঃদ্রঃ আমি কোনকিছু জাস্টিফাই করছি না। এটা কেবল একটা ঘটনার উল্লেখ করলাম যে স্থুল বিশ্লেষণে যেখানে একটা মানুষের ২ মিনিট বেঁচে থাকার কথা সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে সেটা-ই বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ ঘন্টায়!
©স্টিমন অনিক।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ