★ মূর্তিতে ঈশ্বর থাকে নাকি মূর্তিই ঈশ্বর?
কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে সনাতন সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব শ্রী শ্রী দূর্গা পূজা। ইতোমধ্যে লোকজন আদ্যাশক্তি মহামায়া মা দূর্গা ও মূর্তি নিয়ে অশালীন, কুৎসিত ও বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা প্রচার করছে। তাই মূর্তি ও মূর্তি পূজা বিষয়ে বিভিন্ন দার্শনিক, মহাপুরুষ ও ব্রহ্মজ্ঞানীদের বক্তব্যের আলোকে কিছু লিখার প্রয়াস করলাম।
১৯১২ সালের ১৮ মার্চ আরেকটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ কাদম্বিনী দেবীকে লেখেন,
"প্রতিমা সম্বন্ধে আমার মনে কোনো বিরুদ্ধতা নেই, অর্থাৎ যদি কোনো বিশেষ মূর্তির মধ্যেই ঈশ্বরের আবির্ভাবকে বিশেষ সত্য বলে না মনে করা যায় তাহলেই কোনো মুস্কিল থাকে না । তাকে বিশেষ কোনো একটি চিহ্নদ্ধারা নিজের মনে স্থির করে নিয়ে রাখলে কোনো দোষ আছে একথা আমি মনে করিনে, কিন্তু এ সমন্ধে কোনো মূঢ়তাকে পোষণ করলেই তার বিপদ আছে।"
অর্থাৎ কেবলমাত্র একটি বিশেষ বস্তুর মধ্যেই ঈশ্বর আছে এমন ধারণা থেকে বের হয়ে সকল বস্তুতেই (সকল মূর্তিতে এবং মূর্তির বাইরেও) ঈশ্বরজ্ঞান করলে মূর্তিতে ঈশ্বর তথা মনের মধ্যে ঈশ্বরের কোন স্বরূপকে স্থির করার মধ্যে কোন সংঘর্ষ নেই।
আরেকটু পরিস্কারভাবে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন,
"যে - কোন বস্তুর ভিতর ঈশ্বর দর্শন করিয়া তাঁহাকে উপাসনা করিতে পারেন। মূর্তি ভুলিয়া সেখানে ঈশ্বরকে দেখুন। ঈশ্বরে অন্য কিছু আরোপ করিবেন না, কিন্তু যে - কোন বস্তুতে ইচ্ছা ঈশ্বরভাব প্রবেশ করান।
যে সাকার মূর্তিটি উপাসনা করেন, তাহার মধ্যে ঈশ্বরকে সীমাবদ্ধ করিবেন না।বরং যাহা কিছু উপাসনা করেন, সেই সবকিছু ঈশ্বরভাবে পূর্ণ করিয়া দিন।"
অর্থাৎ সর্বব্যাপক ঈশ্বর মূর্তিতেও আছেন তবে কেবল মূর্তিটিই ঈশ্বর এমন ভাবলেই বরং মহাভুল।
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে একবার তাঁর এক শিষ্য প্রশ্ন করেছিলেন ঈশ্বরের স্বরূপ নিয়ে এত নানা মত কেন? কেউ বলে সাকার কেউ বলে নিরাকার আবার সাকারবাদীদের নিকট নানা রূপের কথা শুনতে পাই। এত গন্ডগোল কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেন,
"যে ভক্ত যে রূপ দেখে, সে সেই রূপ মনে করে। বাস্তবিক কোন গন্ডগোল নাই। তাঁকে কোনও রকমে যদি একবার লাভ করতে পারা যায়, তা হলে তিনি সব বুঝিয়ে দেন। সে পাড়াতেই গেলে না সব খবর পাবে কেমন করে?
যে ব্যক্তি সদা - সর্বদা ঈশ্বর চিন্তা করে সেই জানতে পারে তাঁর স্বরূপ কী? সে ব্যক্তিই জানে যে তিনি নানারূপে দেখা দেন, নানাভাবে দেখা দেন। তিনি সগুন, আবার তিনি নির্গুণ। যে গাছতলায় থাকে, সেই জানে বহুরূপীর নানা রঙ। আবার কখনও কখনও কোনও রঙই থাকে না। অন্য লোকে কেবল তর্ক ঝগড়া করে কষ্ট পায়।"
সাধন যাত্রার শুরুতে শ্রীমূর্তি আপনার আমার অবলম্বন হতে পারে কিন্তু সাধনার পরিনতিতে উহাই চিন্ময় সত্তা। প্রতীক রুপটি চিন্ময় রুপে পরিনতি হলেই পূজা সার্থক হয়। বন্ধুর সাথে প্রথম পরিচয়ে মনের মিল কিন্তু হয় না অথচ দিনেদিনে সেই বন্ধুই হয়ে উঠে পরম বন্ধু আত্মার আত্মা, তখন নিজের চেয়েও বেশী আস্থা জন্ম নেয় বন্ধুর প্রতি। প্রতীক রূপে যে মূর্তির প্রতিষ্ঠা হয়, ভক্তের অর্চনার ফলে তিনিই হয়ে উঠেন আস্থার প্রতিধ্বনি ভগবান। আচার্য রামানুজের কথায় যা হল “অরচ্চাবতার” এবং এই ভাবে সেই ভক্ত শ্রীমূর্তি থেকে পরম চিন্ময় সত্তা কে বোঝে এবং একসময় “সর্বভূতে ঈশ্বরের অনুভুতি লাভ করে” অর্থাৎ “পরম ঈশ্বর কে লাভ করে” অর্থাৎ “স্ব-আত্মা সাথে পরমআত্মার সংযোগ"। শূধুমাত্র এই অংশটুকু সংঘটিত হতে সময় লাগতে পারে কয়েক দিন বা কয়েক মাস বা কয়েক বছর আবার এই জন্মেও না হতে পারে। এটা নির্ভর করে সম্পূর্ণ নিজের উপর। এই প্রসঙ্গে আচার্য রামানুজের একটি ঘটনার কথা বললে আপনারা বুঝতে পারবেন।
আচার্য রামানুজের কাছে একদিন এক মূর্তি পুজায় আস্থাহীন ব্যক্তি এসে উপস্থিত হন।তিনি আচার্যকে জিজ্ঞেস করেন, ব্রহ্ম বিশ্ব ব্যাপী, তাকে পূজা করার জন্য আপনি ছোট ছোট কতগুলি পিতলের মূর্তি রেখেছেন কেন? আচার্য বললেন, "আমার ধুনি জ্বালাবার জন্য আগুনের দরকার, আপনি গ্রাম হতে আমাকে আগুন এনে দিন , তারপর আপনার প্রশ্নের জবাব দিব।"
ঐ লোকটি একখানা কাঠে আগুণ নিয়ে উপস্থিত হলেন। আচার্য তাকে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনি এক খণ্ড দগ্ধ কাঠ এনেছেন কেন? যা বলেছি তাই আনুন। আগুন বলেছি আগুন আনুন। আগুন সকল বস্তুর মধ্যেই আছে। আপনার হাত ঘষে দেখুন, হাতের মধ্যেও আগুন আছে। আপনি আমার জন্য একটু খাটি আগুন আনুন। পোড়া কাষ্ঠ চাই না।"
আচার্যের কথা শুনে লোকটি বললেন, অগ্নি সব বস্তুর মধ্যেই আছে কিন্তু আপনার নিকট আনতে হলে কাষ্ঠ ছাড়া উপায় দেখি না।
তখন আচার্য বললেন,
"সকল বস্তুর মধ্যে নিহিত অগ্নিকে আমার নিকট আনতে হলে কাষ্ঠ ছাড়া উপায় দেখেন না- আমিও সেই রূপ সর্বভুতস্থ সর্বব্যাপী পরম ব্রহ্মকে আমার নিকটতম আনতে চাইলে, মূর্তিকে আরোপ ছাড়া উপায় দেখি না। আপনার হাতের কাষ্ঠ খানা আগে ছিল কাষ্ঠ কিন্তু তাতে অগ্নি ধরাবার পর তা হয়ে উঠেছে অগ্নি, তেমনি আমার নিকটস্থ এই ঠাকুরটি এক সময় ছিলেন পিতল নির্মিত মূর্তি এখন সেটি চিন্ময় ব্রহ্ম। ইহা সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ। নারায়ণ যেমন অযোধ্যায় এসেছিলেন রাম রূপে, তিনি আজ আমার দুয়ারে এসেছেন ‘অরচ্চাবতার’ রূপে।"
আচার্যের উক্তিটি জিজ্ঞাসু ব্যক্তিটির সকল সংশয় দূর করে দিল।
শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ দ্বিতীয় অধ্যায় প্রথম মন্ত্রে,
"যুজ্ঞানঃ প্রথমং মনস্তত্ত্বায় সবিতা ধিয়ঃ।
অগ্নে্র্জ্যোতির্নিচায়্য পৃথিব্যা অধ্যাভরৎ।।"
উপরোক্ত এই মন্ত্রের ভাষ্যে ভগবৎপাদ আদি শঙ্করাচার্য্য বলছেন―
"যখন তুমি আত্মস্বরূপ সত্যে পৌঁছাতে চাইছো তখন তোমার প্রাথমিক ভূমিকাই হবে প্রার্থনা করা, সেই হিরণ্যকান্তিস্বরূপ জ্যোতির্ময় ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করা। তাঁর কাছে প্রার্থনা করো, তিনি যেন তোমায় সেই প্রজ্ঞাশক্তি প্রদান করেন তথা তোমার জ্ঞানেন্দ্রিয়াদিকে সেই ত্যেজ প্রদান করেন, যার দ্বারা সে সকল অন্তর মুখী হয়ে তীব্র বল-বেগে আত্মোনুধাবন পূর্বক তোমায় আত্মস্বরূপে উপনীত করে।"
স্বামী লোকেস্বরানন্দ পুরীজী আদি-শঙ্করের এই উক্তিকে আরো বোধগম্য করতে এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন
"উপনিষদ বলছেন প্রার্থনা করতে। কিন্তু কেন প্রার্থনা করবো?- আমি যে অদ্বৈতবাদী, আমি যে মনে করিনা ঈশ্বর আমার থেকে ভিন্ন, তো কার কাছে প্রার্থনা করবো?- যদি আমি ঈশ্বরের থেকে ভিন্ন হই তবেই তো প্রার্থনার প্রশ্ন আসে।"
কিন্তু এখানে উপনিষদ ও তার অদ্বৈত ভাষ্যকার জগদগুরু শঙ্করাচার্য স্পষ্ট নির্দেশন করছেন-
"যতক্ষন তোমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তুমি নিজেকে এই জগতের থেকে ভিন্ন ভাবছো, যতক্ষন তোমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তুমি তোমার অস্তিত্বকে সকলের থেকে পৃথক ভাবছো, অর্থাৎ যতক্ষন পর্যন্ত তোমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় কিঞ্চিৎ পরিমাণও দ্বৈততার আভাস আছে;- ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি সেই জ্যোতির্ময় সর্বেশ্বরের নিকট প্রার্থনা করো যাতে, তুমি যেন এই ভেদভূমির সকল দ্বৈততার উর্ধে উঠে নির্ভেদ অদ্বৈতাবস্থা প্রাপ্ত করতে পারো।"
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন,
“পুতুল পূজা করে না হিন্দু, কাঠ মাটি দিয়ে গড়া;
মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে, হয়ে যাই আত্মহারা।"
1 মন্তব্যসমূহ
খুব ভালো লাগলো,, এবং অনেক কিছু জানতে পেরেছি।
উত্তরমুছুন