শ্রীরঙ্গম মন্দির শ্রী রঙ্গনাথস্বামী মন্দির বা থিরুভারঙ্গম (তামিলঃ திருவரங்கம்) নামেও পরিচিত। এই মন্দিরের আরাধ্য পরমেশ্বরের বিশেষ চতুর্গুণের একটি শ্রীবিষ্ণুর উদ্দেশ্যে নির্মিত। রঙ্গনাথ বিষ্ণুর একটি নাম। মন্দিরটি অবস্থান শ্রীরঙ্গম, তিরুছিরাপল্লি, তামিলনাড়ু। মন্দিরটি নির্মান করা হয়েছিল দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করে। মধ্যযুগীয় তামিল সাহিত্যে মন্দিরটির অসাধারণ বর্ণনা পাওয়া যায়।
মন্দিরটি কাবেরী নদীর মধ্যস্থ একটি দ্বীপে স্থাপিত। শত শত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে হাজার বছর ধরে মন্দিরটি এখনো সমুহিমায় টিকে আছে।
মন্দিরের প্রধান ফটকের নাম রাজাগোপুরম। এটির উচ্চতা ২৩৭ ফুট। ১৫৬ একর জুড়ে বিস্তৃত এই মন্দির কমপ্লেক্সটি ভারতের সব থেকে বড় মন্দির কমপ্লেক্স। এখনো সচল মন্দির হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় (আঙ্কোরভাটের পর) মন্দির কমপ্লেক্সের তকমা অবশ্যই শ্রীরঙ্গম পাবে।
মন্দিরটি ৭টি সমকেন্দ্রিক দেয়ালে ঘেরা যা ৩২,৫৯২ ফুট বা ৬ মাইলের অধিক দীর্ঘ। এই মন্দিরে ২১ টি গোপুরম বা টাওয়ার আছে যার মধ্যে রাজাগোপুরম সব থেকে উঁচু। এছাড়া ৩৯ টি প্যাভিলিয়ন, ৫০ টি মন্দির এবং ১০০ পিলার বিশিষ্ট একটি মণ্ডপ ও কয়েকটি জলাধার আছে। ছোটখাটো এই দ্বীপটি একসময় শুধুই মন্দিরের শহর হিসেবেই বিবেচিত ছিল কিন্তু এখন এখানে জনবসতিও স্থাপিত হয়েছে।
এ মন্দিরের বর্ণনা সাঙ্গাম যুগের তামিল সাহিত্য সিলাপরিক্রম কাব্যে পাওয়া যায়। (খণ্ড ১১,৩৫-৪০ লাইন) “āyiram viritteḻu talaiyuṭai aruntiṟaṟpāyaṟ paḷḷip palartoḻu tētta viritiraik kāviri viyaṉperu turuttittiruvamar mārpaṉ kiṭanta vaṇṇamum”
ধারনা করা হয় মন্দিরটি ১০ম শতকের। বহু রাজত্বকাল, শাসনামল ও সভ্যতা অতীত হয়েছে কিন্তু শ্রীরঙ্গম তার আপন মহিমায় এখনো দাড়িয়ে আছে। শিলালিপি থেকে জানা যায়, চোল,পাণ্ডে,হয়সালা ও বিজয়নগর রাজত্বকাল অতিক্রম করেছে তিরুছিরাপল্লীর এ মন্দিরটি।
নবম শতকে গঙ্গা রাজাদের শাসনামলে এই অদ্ভুত সুন্দর মন্দিরটি প্রথম নির্মান করা হয় বলে ধারণা করা হয়।
জনবসতি না থাকায় যে স্থানে রঙ্গনাথনের মূর্তিটি ছিল সেটি ঘন বনজঙ্গলে ঢাকা পড়ে যায় অনেক দিনের জন্য। অনেক দিন পরে এক জন চোল রাজা একটি টিয়া পাখির পিছনে ধাওয়া করতে এসে এটির দেখা পান। সেখানে তিনি রঙ্গনাথস্বামীর মন্দির স্থাপন করেন যেটি বর্তমানের ভারতের বৃহৎ মন্দির কমপ্লেক্স।
জনবসতি না থাকায় যে স্থানে রঙ্গনাথনের মূর্তিটি ছিল সেটি ঘন বনজঙ্গলে ঢাকা পড়ে যায় অনেক দিনের জন্য। অনেক দিন পরে এক জন চোল রাজা একটি টিয়া পাখির পিছনে ধাওয়া করতে এসে এটির দেখা পান। সেখানে তিনি রঙ্গনাথস্বামীর মন্দির স্থাপন করেন যেটি বর্তমানের ভারতের বৃহৎ মন্দির কমপ্লেক্স।
রঙ্গনাথ স্বামীর মূর্তিটির একটি চোখ ছিল অরলভ নামে হীরার তৈরি আরেক চোখ ছিল একই রকম দেখতে জেম পাথরের । অরলভ হীরক খণ্ডটি বর্তমানে রাশিয়ার মস্কোর ক্রেমলিনের ডায়মন্ড ফান্ড কালেকশনের সংরক্ষিত। এটি ছিল ১৮৯.৬২ ক্যারেট বা ৩৭.৯২৪ গ্রাম যা প্রায় একটি মুরগীর ডিমের অর্ধেক আয়তনের। কিংবদন্তি অনুসারে শ্রীরঙ্গমের প্রথম করনাটিক যুদ্ধের (ফ্রেন্স ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির মধ্যকার যুদ্ধ) সময় একজন ফরাসী যোদ্ধা আশ্রয় নেয়। ১৭৭৪ সালে দ্বিতীয় করনাটিক যুদ্ধের সময় সে একজন হিন্দু হিসেবে ছদ্মবেশ ধারণ করে হীরক খণ্ডটি চুরি করে।
★ মন্দিরের দেয়ালে শুধু তামিল নয় আরও অসংখ্য ভাষার লিপি পাওয়া গেছে৷ সমগ্র মন্দির কমপ্লেক্সে অন্তত ৮০০ লিপি পাওয়া গেছে।
★মন্দির কমপ্লেক্সের বিশাল হলরুমটি ১০০০ মনোলিথিক গ্রানাইট নির্মিত স্তম্বের দ্বারা নির্মান করা হয়েছে যা এই বিশাল মন্দিরটিকে করেছে খুবই মজবুত।
★এই মন্দিরের প্রধান বিষ্ণু মূর্তিকে কস্তুরি, কর্পূর, মধু ও চন্দন দিয়ে সজ্জিত করা হয়।
★ এই মন্দির কমপ্লেক্সে গরুদা বাহন, সিম্বা বাহন, হনুমান বাহন, শেসা বাহন নামে অনেকগুলো অসাধারণ শিল্পশৈলীর রথ রয়েছে।
★ এই মন্দির কমপ্লেক্সে ১২ টি পুকুর আছে তবে বিশেষ দুইটি পুকুরেই "সূর্য সচ" ও "চন্দ্র পুস্কারিনি" প্রায় ২০ লক্ষ লিটার জল পাওয়া যায়।
★ এই মন্দিরে প্রতিদিন হাজার দর্শনার্থীদের জন্যই বিনামূল্যে খাবার পরিবেশন করা হয়।
★ এই রঙিন মন্দিরের অসাধারণ দেয়াল ও কারুকার্যগুলো বিভিন্ন হার্ভাল, শাকসবজি ও ফলমূলের সাহায্যে রঙ করা হয়।
★একাদশ শতকে এক খ্যাতনামাখ্যাতনামা বৈষ্ণব সন্ত ছিলেন রামানুজাচার্য। প্রায় হাজার বছর ধরে এই মন্দিরে সংরক্ষিত রয়েছে রামানুজাচার্যের নশ্বর শরীর।
★একাদশ শতকে এক খ্যাতনামাখ্যাতনামা বৈষ্ণব সন্ত ছিলেন রামানুজাচার্য। প্রায় হাজার বছর ধরে এই মন্দিরে সংরক্ষিত রয়েছে রামানুজাচার্যের নশ্বর শরীর।
শ্রী রঙ্গনাথস্বামী মন্দির কমপ্লেক্সেই রামানুজাচার্যের উদ্দেশে নিবেদিত একটি মন্দির রয়েছে আর সেখানেই ‘মমি’ করে রাখা রয়েছে এই বিখ্যাত সন্তের দেহ। রামনুজাচার্য ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে পেরুমবুদুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীরঙ্গম হয়ে ওঠে তাঁর ধর্মভাবনা প্রকাশের প্রধানতম ক্ষেত্র। তিনি শ্রী রঙ্গনাথস্বামী মন্দিরের প্রধান পুরোহিতও হন। তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় ধ্যানরত অবস্থায় ছিলেন, মৃত্যুর পরেও তাঁর দেহ অবিকৃত থেকে যায়। কোনও রাসায়নিক ছাড়াই তাঁর দেহ মমিতে পরিণত হয়। যে অবস্থায় তিনি দেহ ত্যাগ করেছিলেন, সেই অবস্থাতেই এই মূর্তি অধিষ্ঠান করছে। বছরে দু'বার তাঁর নশ্বর শরীরে কর্পূর ও কুঙ্কুম লেপন করা হয়। গত ৮৮০ বছর ধরে এই প্রথা পালিত হয়ে আসছে।
★১৩১০-১৩১১ সালে মালিক কফুর নামে এক সেনাপতি যখন এই অঞ্চলে লুটতরাজ চালায় তখন রঙ্গনাথ স্বামীর মূর্তিটি লুট করে দিল্লী নিয়ে যায়। শ্রীরঙ্গমের ভক্তরা মূর্তিটি ফেরত আনতে দিল্লী চলে যায় এবং তাদের নৃত্য ও নাটক দেখে সুলতান মোহিত হয়ে যায়। ভক্তরা সুলতানের কাছ থেকে মূর্তিটি ফেরত নিয়ে আসে। কিন্তু রাজকন্যা সুরাথানি রঙ্গনাথ স্বামীর এই মূর্তির প্রেমে পড়ে যান এবং তিনিও মূর্তির খোঁজে শ্রীরঙ্গম চলে আসেন। প্রায় হাজার মাইল পার হয়ে এসে সুরাথানি শ্রীরঙ্গমে রঙ্গনাথ স্বামীর মূর্তির সামনে প্রণিপাত করে মৃত্যু বরণ করেন। এখনও পর্যন্ত শ্রীরঙ্গমে অর্জুন মণ্ডপের কাছে সুরাথিনির চিত্র রয়েছে। তামিল ভক্তরা এঁকে থালুকা নাচিয়ার বলে সম্বোধন করেন। প্রতিদিন তাঁর উদ্দ্যেশে পূজা দেয়া হয়। প্রতিবছর সুরাথিনির কে উৎসর্গ করে কল্লানা উৎসব পালন করা হয়ে থাকে শ্রীরঙ্গমে।
১৩২৩ সালে মালিক কফুর আবারও শ্রীরঙ্গম আক্রমণ করে। এটা ছিল আরও তীব্র এবং পাশবিক। মালিক কফুরের সৈন্য বাহিনী পৌছানোর পূর্বে বৈষ্ণবতি আচার্য পিল্লাই লোকাঁচারিয়ার এবং স্বামী বেদান্ত দেশিকা স্বামী রঙ্গনাথ ও দেবী রঙ্গনায়িকার মূর্তি দুটি নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে বেরিয়ে পড়েন। যাবার আগে যেখানে মূর্তি দুটি অবস্থিত ছিল সে জায়গা ইট দিয়ে গেথে বন্ধ করে দেন। পিল্লাই লোকাঁচারিয়ার যাত্রা পথেই মারা যান। মালিক কফুর যখন শ্রীরঙ্গমে পৌছায় তখন শ্রীরঙ্গমের ১৩,০০০ বৈষ্ণব ভক্ত মন্দির রক্ষার্থে জীবন দিয়ে দেন। পরবর্তী ৬০ টি বছর স্বামী রঙ্গনাথের মূর্তিটি মাদুরাই,কেরালা,মহীশুর,ঘুরে তিরুমালা তিরুপতি পাহাড়ের নিয়ে রক্ষা করা হয়। ১৩৭১ সালে স্বামী বেদান্ত দেশিকা পুনারায় মূর্তি দুটি নিয়ে শ্রীরঙ্গমে প্রতিষ্ঠা করেন।
অসাধারণ এই মন্দিরে প্রতিবছর ২১ দিন ব্যাপী এক ধর্মীয় উৎসবের আয়োজন করা হয় যেখানে ১০ লাখেরও বেশী বক্তের সমাবেশ ঘটে।
0 মন্তব্যসমূহ