শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ১০ম অধ্যায়ের ২১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে,
আদিত্যানামহং বিষ্ণুর্জ্যোতিষাং রবিরংশুমান্৷
মরীচির্মরুতামস্মি নক্ষত্রাণামহং শশী৷৷২১/১০।।
অর্থ: আমি আদিত্যদের মধ্যে বিষ্ণু, জ্যোতিস্কদের মধ্যে কিরণশালী সূর্য, মরুতদের মধ্যে মরীচি এবং নক্ষত্রদের মধ্যে চন্দ্র।
এখানে অনেকের কাছেই খটকা লাগে "নক্ষত্রাণামহং শশী" অর্থাৎ নক্ষত্রদের মধ্যে আমি চন্দ্র এই অংশ টুকু নিয়ে। অনেকে আবার মনে হতে পারে এখানে ভুল লেখা আছে। মূলত এখানে ভুল লেখা নাই, আপাতদৃষ্টিতে ভুল মনে হয় কারণ আমরা নক্ষত্র বলতে একটি তারা বুঝি। জ্যোতিষশাস্ত্রে নক্ষত্র বলতে একটি তারা বোঝায় না। নক্ষত্র শব্দটা যদিও তারার প্রতিশব্দ বলেই চলে আসছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। নক্ষত্র বলতে একটি মাত্র তারা বোাঝায় না, বরং আকাশের বিশেষ কিছুটা অংশের তারাসমষ্টিকে বুঝায়। ভারতবর্ষ, আরব, মিশর ও চীনে এই নক্ষত্র বিভিন্ন নামে পরিচিত। পৃথিবীর চারিদিকে যে কক্ষপথে চন্দ্র পৃথিবীকে আবর্তন করে সেই কক্ষপথকে ২৮ ভাগে (কোথাওআবার ২৭ বলা হয়। সেক্ষেত্রে অভিজিৎ বা অভিজয়িনী নক্ষত্র বাদ দিয়ে ২৭ ধরা হয়) করে প্রত্যেক ভাগের নাম দেওয়া হয়েছে চন্দ্রের আবাস বা নক্ষত্র। ভারতবর্ষে এদের বলা হতো নক্ষত্র, আরবে এদের নাম ছিলো মানাজেলোল-কামার এবং চীনে এরা সিউ নামে প্ররিচিত। এদের প্রত্যেকটি আকাশে ৩৬০÷২৮ ডিগ্রী জুড়ে আছে।
নক্ষত্র ও রাশি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন থেকে প্রকাশিত মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারের তারা পরিচিতি বইটা পড়তে পারেন।
আর নক্ষত্র সম্পর্কে হালকা ধারণা পেতে উকিপিডিয়ার এই আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
সুতরাং নক্ষত্র মানে হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট জায়গার তারাসমষ্টি, একক তারা নয়। আর এই জায়গাগুলো নির্ণয় করা হয় চন্দ্রের কক্ষপথকে সমান ২৮ ভাগে ভাগ করে অর্থাৎ (৩৬০÷২৮)° , যেহেতু পুরো চন্দ্র কক্ষপথ ৩৬০°। আরো ভালো করে বুঝতে নিচের চিত্রে দেখুন।
দেখুন চিত্রে চন্দ্রের কক্ষপথকে সমান ২৮ টি ভাগে করে প্রতিটি ভাগের তারা সমষ্টিকে একেকটা নক্ষত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। চিত্রে ২৮ টি নক্ষত্রের নামও দেওয়া আছে।
এখন লক্ষ্য করুন এখানে নক্ষত্র বিচারের মূল ভিত্তি কি? উত্তর টা হবে চন্দ্র। কেননা চন্দ্রের আবর্তন পথের সাপেক্ষেই এই নক্ষত্র বিচার। মূলত নক্ষত্র নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে চন্দ্র ।
তাই এখানে ভগবানের "নক্ষত্রগণের মধ্যে আমি চন্দ্র" কথাটি দ্বারা ভগবান বোঝাতে চাচ্ছেন যে, "নক্ষত্র নির্ণয় করা হয় যার ভিত্তিতে, সেই নক্ষত্র নির্ণয়ের ভিত্তিও আমিই অর্থাৎ চন্দ্র"। এই ছোট কথার মাঝে লুকিয়ে আছে বিশাল তত্ত্ব। চন্দ্র ব্যাতীত যেমন নক্ষত্রের কোনো অস্তিত্ব নাই, তেমন ভগবান ব্যাতীত জগতের কোনো অস্তিত্বই নাই। তিনি সকল কিছুর ভিত্তি। তিনি পরমেশ্বর পরমব্রহ্ম পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ। এজন্য তিনি গীতার ৭/৭ এ বলেছেন,
মত্তঃ পরতরং নান্যত্কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয়৷
ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব৷৷৭/৭
অর্থ: হে অর্জুন, আমার থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই। সূত্রে যেমন মণিসমূহ গাথা থাকে তেমনিই সমস্ত বিশ্ব আমাতে ওতপ্রোতভাবে অবস্থান করে।
অর্থাৎ মণিহারের মূল ভিত্তি যেমন সূত্র, সেরূপ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূল ভিত্তি পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ।
তাঁর অনন্ত বিভুতি অনন্ত। তাই শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন।
অথবা বহুনৈতেন কিং জ্ঞাতেন তবার্জুন৷
বিষ্টভ্যাহমিদং কৃত্স্নমেকাংশেন স্থিতো জগত্৷৷৪২/১০
অর্থ: হে অর্জুন, অধিক কি আর বলব এইটুকু মাত্র জেনে রাখ আমি আমার এক অংশের দ্বারা সমস্ত জগত ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছি।
------------- শ্রী প্রান্ত সাহা
0 মন্তব্যসমূহ