শাঁখা-সিঁদুরের মাহাত্ম্য!

 

শাঁখা-সিঁদুর নারীর জন্য শৃঙ্খল নাকি অলংকার!

শুরু করছি অথর্ববেদের একটা মন্ত্রের অংশ দিয়ে,
"সুমঙ্গলী প্রতরনী গৃহাণাং সুশেবাপত্যে"
অর্থাৎ, নারী হলো মঙ্গলময়ী ও শোভাবর্ধণকারী অলংকার।
এই মন্ত্রকে ধারণ করে নারী তাঁর সদাপবিত্র দুই হাতে ধারণ করে শাঁখা এবং সিঁথি ও কপালে ধারণ করে সিঁদুর/কুমকুম। অঞ্চলভেদে কেউ উভয়ই ধারণ করে আবার কেউ যেকোনো একটি ধারণ করে আবার কিছু অঞ্চলের নারীরা গলায় "মঙ্গলসূত্র" ধারণ করে৷
এখন কেউ কেউ দাবী করছে ধর্মীয় মূলশাস্ত্রে এগুলো ধারণ করতে বলা হয় নি তাই এগুলো ধারণ করা অবান্তর, কেউ কেউ বলছে এগুলো কুসংস্কার, কেউ কেউ বলছে এগুলো নারীর জন্য অপমানজনক।
আমি ধর্মের নামে যেকোনো কুসংস্কার চাপিয়ে দেওয়ার বিপক্ষে আবার ধর্মীয় শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে যেকোনো সংস্কার, সংস্কৃতি ও দর্শনকে অবান্তর বলারও বিপক্ষে৷ সনাতন ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতি কোনভাবেই কঠোর হতে শেখায় না বরং কিছু স্বার্থন্বেষী গোষ্ঠী শাস্ত্রকে নিজেদের মত বিশ্লেষণ করে কঠোরতা ছড়ায় এবং সতীদাহের মত প্রথার জন্ম দেয় কিংবা তাৎপর্যপূর্ণ সনাতন দর্শন ও সংস্কৃতিকে ধ্বংসের পায়তারা করে।
আমরা ধর্ম ধর্ম করে গলা ফাটালেই ধর্ম প্রতিষ্ঠা হবে না কিংবা ধর্ম ধ্বংসও হয়ে যাবে না কারণ ধর্ম চিরন্তন বরং আমি নিজের মধ্যে শাস্ত্রকে কতটুকু ধারণ করতে পারলাম সেটাই আমার ধর্ম। তাই স্বঘোষিত ধার্মিক মাত্রই সুযোগসন্ধানী।
একটা সমাজ কেবল ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠা হলেও সেই সমাজের ভারসাম্য বজার থাকে তার দর্শন, সংস্কৃতি ও সংস্কারের উপর। তাই দর্শন, সংস্কৃতি ও সংস্কারকে অবমূল্যায়ন করার সুযোগ নেই।
★ সংস্কৃতি কি?
সংস্কৃতি বা কৃষ্টি হলো সেই জটিল সামগ্রিকতা যাতে অন্তর্গত আছে জ্ঞান, বিশ্বাস, নৈতিকতা, শিল্প, আইন, আচার এবং সমাজের একজন সদস্য হিসেবে মানুষের দ্বারা অর্জিত অন্য যেকোনো সম্ভাব্য সামর্থ্য বা অভ্যাস।
সংস্কৃতি অনেকাংশে নির্ভর করে ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠা কোন সমাজের দর্শনের উপর। সেই সমাজের সংস্কৃতিই নির্দেশ করবে সেই ধর্মীয় দর্শনের উদারতা। আবার সমাজের প্রয়োজনীয়েই জ্ঞানীদের দেখানো পথে সংস্কৃতির সংস্কারও প্রয়োজন হয়।
কোন সংস্কার তখনই কুসংস্কার হয় যখন সেটা সমাজ ও সংসারের জন্য অকল্যাণকর হয়। এখন নারী যদি তাঁর স্বামী-সংসারের মঙ্গল কামনায় এবং অলংকাররূপে শাঁখা সিঁদুর ধারণ করে তবে সেটা কিভাবে কুসংস্কার হয়ে যায়!!
মূল শ্রুতি শাস্ত্র উল্লেখ নেই এমন অনেক কাজই আমরা করছি। গেরুয়া কাপড় পড়ার বিধান আছে ধর্মীয় মূলশস্ত্রে? মূলশাতস্ত্রে সবকিছু থাকতে হবে? আমাদের সনাতন দর্শন কি এতটাই রিজিড?
"এর বাইরে কিচ্ছু করা যাবে না" এমন উগ্রবাদী চিন্তাভাবনা সনাতন দর্শনে কবে জায়গা করে নিল, কারা জায়গা করে দিল?
সমাজ সংসারের কল্যাণেও আমরা নতুন নতুন অনেক পরম্পরা সৃষ্টি করি। সেখান থেকেই জন্ম নেয় একটা সমাজের সংস্কৃতি, দর্শন।।
শাঁখা-সিঁদুর মাহাত্ম্যঃ
আমরা যখন কোন আচারের বিষয়ে আলোচনা কিংবা সমালোচনা করব তখন সেটার গভীর তাৎপর্য অনুভব করতে হবে।
ঋগবেদের ১০ মন্ডলের ৮৫ নং সুক্তে সূর্যদেব রীতিমতো দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করে তাঁর কন্যা সূর্যার বিয়ের আয়োজন করেছিলেন। সূর্যা রথে চরে পতিগৃহে যায় সেখানে গিয়ে সে কিভাবে সম্রাজ্ঞী হয়ে থাকে সেই বিষয়ে বলা আছে। এই সম্পূর্ণ সুক্তটাই ত রূপক অথচ ইহার গভীর তাৎপর্য নারীসমাজে অনুসরণীয়।
ঋগবেদের ১০ম মন্ডলের ৮৫ সুক্তের ৬ থেকে ১৬ নং মন্ত্রগুলোতে রূপক অর্থে সূর্য কন্যা সূর্যার (ভোর/কুমারী) বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার বিষয়ে বলা হয়েছে।
'Raibhi verses of the Veda are the bride’s wedding gifts, Narashansi verses, the bride’s ornaments, grace and good fortune, her bridal robes sanctified by exemplary verses relating to the good life."
- RIGVEDA(10/85/6)
এই রূপক মন্ত্রগুলোর ভেতর লুকিয়ে আছে গভীর মাহাত্ম্য। একইভাবে নারীর শাঁখা সিঁদুরের গভীর দর্শনও মুগ্ধ করার মত।
কেন শাঁখা সিঁদুর আমাদের হিন্দু বিবাহিত নারীরা পরে আসছে??
শাঁখা, সিঁদুর ও লোহা ব্যবহারের আপাতদৃষ্টিতে চারটি কারণ আধ্যাত্মিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ও বৈজ্ঞানিক।
১/ আধ্যাত্মিক কারণ :  শাঁখার সাদা রং- সত্ত্ব, সিঁদুরের লাল রং – রজঃ এবং লোহার কাল রং- তম গুণের প্রতীক। সংসারী লোকেরা তিনটি গুণের অধীন হয়ে সংসারধর্ম পালন করে। আবার ভ্রূযুগলের মধ্যস্থলে সিঁদুর নারীকে ধ্যানের সময় তার মনকে সেস্থলে স্থির রাখতে সাহায্যও করে। নারী যখন সিঁথিতে উর্ধদিকে সিঁদুরের রেখা টানেন তখন সেটা স্বামীর দীর্ঘায়ুই কামনা করা হয়।
নারীর সাথে স্বামীর দীর্ঘায়ুর বিষয়টা বেদের একাধিক মন্ত্রে উল্লেখ আছে।
"তেজস্বী পরমাত্মা পত্নীকে দীর্ঘ আয়ু ও তেজ দান করিয়াছেন৷ ইহার পতি শতবর্ষ জীবিত থাকুক।"
- অথর্ববেদ (১৪/২/২)
২/ সামাজিক কারণ : তিনটি জিনিস পরিধান করলে প্রথম দৃষ্টিতেই জানিয়ে দেয় ঐ রমণীর একজন পুরুষের অভিভাবক আছেন। স্বামীর মঙ্গল চিহ্ন তো অবশ্যই এবং অন্যান্য ধর্মের নারীদের চেয়ে একটা আলাদা স্বাতন্ত্র্যতা প্রধান করে।
৩/ মনস্তাত্ত্বিক কারণঃ এগুলো পরিধানে স্বামী সংসারের বিশেষ কোন কল্যাণ যদি নাও হয় এতে করে কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন অনেকটাই দৃঢ় হয়৷ এগুলো ধারণ করার সময়ও যদি স্ত্রী তার স্বামীর মঙ্গল কামনা করে তবেও ত স্বামীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা সুদৃঢ় হয়।
৪/ বৈজ্ঞানিক কারণ : রক্তের ৩টি উপাদান শাঁখায় ক্যালসিয়াম, সিঁদুরে মার্কারি বা পারদ এবং লোহায় আয়রণ আছে। রক্তের ৩টি উপাদান মায়েদের মাসিক রজঃস্রাবের সাথে বের হয়ে যায়। তিনটি জিনিস নিয়মিত পরিধানে রক্তের সে ঘাটতি পূরণে সহায়তা করে বলে ধারণা করা হয়। বিজ্ঞানের বাস্তবিক বিশ্লেষণে অসঙ্গতি থাকলেও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে গূঢ়তত্বটা পরিস্কার হয়। 
Sindoor is prepared using mercury, turmeric and lime. Mercury acts as a catalyst that helps to ease stress and strain. It also helps in keeping the brain active and alert. Other than this, mercury also helps in controlling blood pressure, activating sexual drive and libidinal energy. This is why, a widow or an unmarried woman is forbidden from applying sindoor.
এবং সর্বোপরী অলংকার হিসেবেও শাঁখা-সিঁদুরের তাৎপর্য ব্যাপক। একটা সনাতন বিয়ের সবচেয়ে সুন্দরতম ও আকর্ষনীয় অংশ হচ্ছে "সিঁদুরদান"। এমন অনেক কুমারী মেয়েকে বলতে শোনা যায় যে এই সিঁদুর পড়ার জন্য হলেও একবার বিয়ে করতে চাই। সনাতন সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ দূর্গা পূজায় দশমীতে সকল সনাতনী নারীরা সিঁদুর খেলায় মেতে উঠে এটাও ত মূলশাস্ত্রে নেই তবে কি এটাও অপসংস্কৃতি মনে হয় তথাকথিত প্রগতিশীল ধর্মবোদ্ধাদের?
জগৎগুরু আদি শঙ্করাচার্য তাঁর "সৌন্দর্যলহরী" গ্রন্থে সিঁদুর কে মা শক্তির স্বরূপ অর্থ্যাৎ মা দূর্গার প্রতীক অর্থ্যাৎ যিনি দূর্গতিহারিণী তার প্রতীক ও মঙ্গলরুপী সূর্য হিসাবে ব্যাখা দিয়েছেন। সিঁথিতে সিঁদুর ও কপালের সিঁন্দুরের টিপ শ্রী চক্রের স্বরূপ।
নারীদেরও শাঁখা সিদুঁরের প্রতি আলাদা স্পৃহা থাকে, কেন না এটি তার জীবনের মিলবন্ধনের প্রতিটা মূহুর্তকে মনে করিয়ে দেয়। স্বামী হিন্দু মেয়েদের কাছে তাদের দেবতাস্বরূপ । তাই স্বামীর দেওয়া এ শাখাঁ সিঁদুরই তার অহংকার এবং একজন পতিব্রতা নারী তা আমৃত্যু ধারণ করতে চায়।
না, এতেও অনেকের সন্তোষ্টি হবে না৷ তাদের কথা হলো নারী এগুলো ধারণ করলে পুরুষ কেন করবে না?
পুরুষ কি অলংকার পড়ে? একজন পুরুষের কাছে তার স্ত্রীই ত সবচেয়ে বড় অলংকার। বিয়ের মন্ডপে মন্ত্র উচ্চারণ করে একজন পুরুষ যখন তার স্ত্রীর সকল দায়িত্ব গ্রহণ করে এটা কি মূল্যহীন? তাহলে হে পুরুষ, তুমি পত্নীগৃহে যাও, শ্বশুর-শ্বাশুরীর সেবা করে পত্নীগৃহে সম্রাট হয়ে থাকো যদিও ধর্মীয় মূলশাস্ত্র তোমাকে এই নির্দেশ দেয় নি।
"হে বধু! কল্যাণময়ী, গৃহের শোভাবর্ধনকারিনী, পতিসেবাপরায়ণা, শ্বশুরের শান্তিদায়িনী, শ্বাশুড়িরর আনন্দদায়িনী! গৃহকার্যে নিপূণা হও।
- অথর্ববেদ (১৪/২/২৬)
আপনি নারী, আপনি দেবী, আপনি মঙ্গলময়ী লক্ষ্মী আপনার মনে কষ্ট দিলে সংসার শ্রীহীন হবে। আপনি যদি শাঁখা-সিঁদুর ধারণ না করেন তবে আপনার উপর এটা চাপিয়ে দেওয়া অবশ্যই অন্যায়৷ কিন্তু আপনি যখন এগুলোকে কুসংস্কার, অপ্রয়োজনীয় ও অবান্তর বলে কটাক্ষ করবেন তবে এটাও অবশ্যই অন্যায়৷ আপনি বরং নিজের শালীনতার দিকে যত্নশীল হোন। আপনার আচার-আচরণে ও মন্তব্যে শালীনতা বজায় রাখুন।
"অধঃ পশ্যস্ব মোপরি সন্তরাং পাদকৌ হর।
মা তে কশপ্লকৌ দৃশন্ স্ত্রী হি ব্রহ্মা বভূবিথ।।"
- ঋগ্বেদ (৮/৩৩/১৯)
অর্থাৎ, হে পুরুষ ও নারী তোমাদের দৃষ্টি সবসময় হোক ভদ্র ও অবনত। তোমাদের চলন হোক সংযত,দেহ হোক পোশাকে আবৃত, নগ্নতা হোক পরিত্যজ্য।।
শাঁখা-সিঁদুর নারীর জন্য শৃঙ্খলের প্রতীক নয়, ইহা স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনের প্রতীক, ইহা নারীর অলংকার।।
©স্টিমন অনিক৷


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ