পরমেশ্বর শ্রীভগবান কি নিরাকার?





স পর্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণম,
অস্নাবিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্ ৷
কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূর্যাথাতথ্যতোহ’র্থান্, ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।
[শুক্লযজুর্বেদ ৪০/৮ (বা, ঈশোপনিষদ-৮)]
শ্রীপাদ শঙ্করাচার্য এই মন্ত্রের ভাষ্যে লিখেছেন— ব্রহ্ম ‘অকায়ম্’-শব্দে লিঙ্গশরীরবর্জিত, ‘অব্রণম্’ ও ‘অস্নাবিরম্’ শব্দদ্বয়ে স্থূল-শরীর প্রতিষেধ, ‘শুদ্ধম্’-শব্দে কারণশরীর প্রতিষেধ হইয়াছে ...৷
লিঙ্গদেহ, স্থূলদেহ ও কারণদেহ হইতেছে সংসারী জীবের দেহ, প্রাকৃত; ব্রহ্মের কোনরুপ প্রাকৃত দেহই নাই, তাহাই এ-স্থলে বলা হইল ৷ ইহাদ্বারা ব্রহ্মের অপ্রাকৃত চিন্ময় স্বরুপভূত বিগ্রহ নিষিদ্ধ হয় নাই ৷ এই মন্ত্রের ব্যাখ্যায় ত্রিদণ্ডী স্বামী শ্রীভক্তিহৃদয় বন লিখেছেন—
“তাঁহার ভোগযোগ্য কোন প্রাকৃত স্থূলসূক্ষ্ম শরীর নাই, কিন্তু ব্রহ্ম-পরমাত্মারূপ বৃহৎ ও সূক্ষ্ম অধিষ্ঠান ব্যতীত ভগবৎস্বরুপে অপ্রাকৃত-অপূর্ব্ব-রূপ-লাবণ্য-মাধুর্য্য-বিশিষ্ট নিত্য মধ্যমাকৃতিযুক্ত ৷” (বেদের পরিচয়, পৃঃ ৩৩৬)
ভগবানের দিব্য অপ্রাকৃত সাকার রূপের বর্ণনা উক্ত যজুর্বেদেই আছে ৷ যথাঃ—
নমস্তে রুদ্র মন্যব উতো ত ইষবে নমঃ৷
বাহুভ্যামুত তে নমঃ ৷৷১৬/১৷৷
— “হে দুঃখনাশক জ্ঞানপ্রদ রুদ্র, তোমার ক্রোধের উদ্দেশ্যে নমস্কার, তোমার বাণ ও বাহুযুগলকে নমস্কার করি ৷”
.
যা তে রুদ্র শিবা তনূরঘোরাহ’পাপকাশিনী ৷
তয়া নস্তনুবা শন্তময়া গিরিশন্তাভিচাকশীহি ৷৷১৬/২৷৷
— “হে রুদ্র, তোমার যে মঙ্গলময়, সৌম্য, পুণ্যপ্রদ শরীর আছে, হে গিরিশ, সে সুখতম শরীরের দ্বারা আমাদের দিকে তাকাও ৷”
.
যামিষুং গিরিশন্ত হস্তে বিভর্ষ্যস্তমে ৷
শিবাং গিরিত্র তাং কুরু মা হিংসীঃ পুরুষং জগৎ৷৷১৬/৩৷৷
— “হে গিরিশ, শত্রুর প্রতি নিক্ষেপের জন্য হস্তে যে বাণ ধারণ করেছ, হে প্রাণিগণের ত্রাতা, তা কল্যাণকর কর, পুরুষ ও জগতের হিংসা করো না ৷”
আর্যসমাজী তুলসীরাম শর্মা কৃত অনুবাদও দেখুন-ছবিতে।
[ দয়ানন্দ নিরাকরণঃ যজুর্বেদের ষোড়শ অধ্যায়ে স্পষ্টত রূদ্ররুপী ভগবানের সাকার রূপের বর্ণনা পাওয়া গেল ৷ কিন্তু নিরাকারবাদের মোহে আচ্ছন্ন দয়ানন্দ সরস্বতী তার ভ্রান্ত মতবাদ রক্ষা করতে গিয়ে উপর্যুক্ত মন্ত্রগুলোর বিকৃত অর্থ করেছে অর্থাৎ স্বেচ্ছাচারিতা করে ভগবানের সাকাররূপ অস্বীকার করেছে ৷ তিনি ওখানে ‘রুদ্র’ নামটিকে ভগবান-পক্ষে ব্যাখ্যা না করে, তাকে কোন মনুষ্য রাজা বানিয়ে দিয়েছে ৷ কিন্তু এটা ভগবানের সাকাররূপ স্বীকার না করার জন্য দয়ানন্দের ভন্ডামি মাত্র ৷ এস্থলে বর্ণিত রুদ্র যে ঈশ্বর, তা উপনিষদ দ্বারা সমর্থিত হচ্ছে, কারণ যজুর্বেদ ১৬/২-৩ মন্ত্রদুটি শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৩/৫-৬) হুবহু গৃহীত হয়েছে ৷ উপনিষদ ব্রহ্মবিদ্যা আলোচনার স্থান, বেদবর্ণিত উক্ত রুদ্র ব্রহ্ম না হলে ব্রহ্মজ্ঞ ঔপনিষদিক ঋষিগণ উপনিষদে তাঁকে ব্রহ্ম হিসেবে বর্ণনা করত না ৷ ব্রহ্মজ্ঞ ঋষিগণ বেদ বেশি বুঝতেন, নাকি কলিকালের নব্য পন্ডিত দয়ানন্দ বেশি বুঝে? দেখুন, রুদ্রের পরিচয়—
একোহি রূদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্হু-
র্য ইমাঁল্লোকান্ ঈশত ঈশনীভিঃ ৷
প্রত্যঙ্ জনাংস্তিষ্ঠতি সঞ্চুকোপান্তকালে
সংসৃজ্য বিশ্বা ভুবনানি গোপাঃ।।
—“রুদ্র অদ্বিতীয়, [ব্রহ্মবিদ্গণ] দ্বিতীয় কাহারও আকাঙ্ক্ষায় ছিলেন না। সেই রূদ্রই এই সমুদয় লোককে স্বীয় শক্তিসহায়ে নিয়মিত করেন। তিনি প্রত্যেক জীবের অন্তর্জামিরূপে অবস্থিত আছেন। তিনি নিখিল বিশ্ব সৃষ্টি করিয়া তাহার পালক হন এবং প্রলয়কালে উহার সংহার করেন।” (শ্বেতাশ্বতর ৩/২)
.
অজাত ইত্যেবং কশ্চিদ্ভীরুঃ প্রতিপদ্যতে।
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যং।
— “তোমাকে অজাত জেনে কেহ তোমার কাছে আসে আর তার চিত্ত ভয়ব্যাকুল হয় ৷ হে রুদ্র, হে ভীষণ, তোমার সেই যে অন্য হাস্যময় প্রসন্ন মুখমন্ডল, তার মধুর হাসি দিয়ে তুমি আমায় রক্ষা কর সর্বদা ৷” (শ্বেতাশ্বতর ৪/২১)]
আবার, আর্যসমাজ হতে প্রকাশিত, স্বামী সত্যপ্রকাশ সরস্বতী অনুদিত বেদভাষ্যেও ভগবানের দিব্য অঙ্গ স্বীকৃত হয়েছে ৷ উদাহরণস্বরুপ (যজুর্বেদ ৩৩/১৫)—
“O adorable God, may you with your divine ears, please listen to my prayers...”
অর্থাৎ— “হে পূজনীয় ঈশ্বর, অনুগ্রহপূর্বক তুমি তোমার দিব্য কর্ণ দ্বারা আমার প্রার্থনাসমূহ শ্রবণ করো ৷”
আমার প্রার্থনা এই যে, “অদব্ধেন ত্বা চক্ষুষাবপশ্যামি” ৷
“হে ভগবন্! আমার বিভ্রমরহিত নেত্রের দ্বারা আমি যেন আপনাকে দর্শন করিতে সমর্থ হই ৷”
(শুক্লযজুর্বেদ ১/৩০, অনুবাদক- দূর্গাদাস লাহিড়ী)
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শ্রীবিজনবিহারী গোস্বামী, দূর্গাদাস লাহিড়ী, তুলসীরাম শর্ম্মা ও সত্যপ্রকাশ সরস্বতী— প্রত্যেকের যজুর্বেদভাষ্যেই ঈশ্বরের আকারত্ব স্বীকৃত ৷
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের অমোঘ সত্যবাণী—
“ষড়ৈশ্বর্য-পূণানন্দ-বিগ্রহ যাঁহার ৷
হেন ভগবানে তুমি কহ ‘নিরাকার’ ৷৷
তাঁহার বিভূতি দেহ সব চিদাকার ৷
চিদ্বিভূতি আচ্ছাদিয়া কহে নিরাকার ৷৷”
ইহা যারা জানেন না বা মানেন না তারা নিরাকার ভেবে ভুল করেন ৷ ঈশ্বরের সত্তা, স্বরুপ ও দেহ সবই চিন্ময়, দিব্য অপ্রাকৃত ৷
অন্ধশ্চ বধিরো মূকঃ পঙ্গুঃ পণ্ডো বিনাসিকঃ ৷
ইত্যাদ্যা ব্যঙ্গতা-হেতোর্যা নিন্দা লোকসম্মতাঃ ৷
তা সর্ব্বাশ্চ নিরাকারবাদে কিং ন স্যুরীশ্বরে ৷৷
—যুক্তিমল্লিকা ১/১৪ “ইহলোকে জীবের অঙ্গবিশেষের হীনতাবশতঃ অন্ধ, বধির, মূক, পঙ্গু, নপুংসক, বিনাসিক প্রভৃতি নিন্দা হইয়া থাকে, ব্রহ্মকে নিরাকার বলিলে তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ-হীনতাবশতঃ, উক্ত নিন্দাসমষ্টি তাঁহাতেই প্রযুক্ত হইল ৷”








≈ ওম্ . ওম্ ≈
Joyanta sen

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ