আমি কে তা জানার উপায় কি?
প্রায়ই দেখা যায়, আত্ম দর্শন এই কথাটি উঠে আসে, নিজেকে জানতে হবে। তখনই প্রশ্ন আসে কিভাবে?
আত্মাকে অবলম্বন করেই আনন্দ রাজ্যের সৃষ্টি হয়। আত্মার সাক্ষাৎকার আনন্দের-প্রেম ময় হয়ে থাকে। অতএব আত্মদর্শনই দর্শন জিজ্ঞাসার মূল লক্ষ্য। কিন্তু কিভাবে হবে সেই আত্মদর্শন? আত্ম তো স্থুল বস্তু নয়, এর কোনো রুপ নাই। তাহলে বস্তুত চর্মচক্ষুতে তার দর্শন সম্ভব নয়৷ বাস্তবে আত্মদর্শন শব্দটিতে দর্শন
শব্দের অর্থ দেখা নয় বরং জানা অর্থে ব্যাবহৃত হয়েছে৷
বৃহদারণ্যক উপনিষদে রাজা জনকের বিচার সভায় উষস্ত
ও কহোল ঋষির প্রশ্নের উত্তরে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য আত্ম-দর্শনের যে বিস্তৃত উপদেশ প্রধান
করেছিলেন তাতে আত্মাকে সাক্ষাৎসম্বন্ধে জানার কথাই বলা হয়েছিল। ঋষি উষস্ত প্রশ্ন করিলেন - " হে যাজ্ঞবল্ক্য, যে আত্মা সমস্তের অভ্যন্তরে
অবস্থিত থেকেও কোন আবরণ দ্বারা আবৃত নয়, সেই পরম ও চরম আত্মতত্ত্ব আপনি জানেন কি? যদি
জানেন তবে শৃংগ ধরে যেভাবে গরু দেখানো যায়, সেইরুপ সেই আত্মাকে ধরিয়া দেখাইতে
পারেন কি? "
উষস্ত ঋষির প্রশ্নের উত্তরে ব্রক্ষ্মর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য
বলেন, অরুপ নিরবয়ব আত্মাকে শৃঙ্গ ধরে গরু দেখানোর মতো দেখানো তো সম্ভবপর নয়। তবে মানুষ যে জড় বস্তুকে প্রত্যক্ষ করে থাকে সেই প্রত্যক্ষের অন্তরালে স্ব প্রকাশে
আত্মা অবস্থিত থাকেন৷ঐ জড় বস্তুর প্রত্যক্ষ দ্বারাই জড়ের অন্তরালে অবস্থিত জ্যোতির্শ্ময়
আত্মার সাথে আমাদের পরিচয় হচ্ছে। চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণ জড়, বিষয়ও জড়। জড় তো জড়কে প্রকাশ করতে পারে না। সুতরাং জড় বস্তুতে
যে প্রকাশিত হচ্ছে তা দ্বারাও স্বপ্রকাশ চৈতন্যময় আত্মাই প্রকাশ পাচ্ছে।
আত্মাই এই
বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ডের একমাত্র স্বাক্ষী। অন্তঃকরণ আত্মার
আলোতেই আলোকিত হয়৷ সুতরাং অন্তকরণ নিজের আত্মাকে প্রকাশ করতে পারে না। তাই শ্রতি শাস্ত্রে এই আত্মাকে চক্ষু, মন বা বুদ্ধি দ্বারা প্রকাশ করতে নিষেধ
করা হয়।
ন
দৃষ্টের্দ্রষ্টারং পশ্যের্ন শ্রতে
শ্রোতারং শৃণুয়া ন
মতের্মস্তারং মন্বীথা ন
বিজ্ঞাতের্বিজ্ঞাতারং
বিজানীয়া ঃ। (- বৃহদাঃ ৩/৪/২)
বৃহদারণ্যক উপনিষদের মতে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে
আত্মাকে জানা যায় না। আত্মা জড় দেহের ভিতর অবস্থান করলেও সে ভোগের
দ্বারা জর্জরিতহয় না, জরামৃতুরহিত, শুদ্ধ এবং অবিনশ্বর। বিবেক চক্ষু উন্মুচিত হলে মানুষ আত্মার সাক্ষাৎ সম্পর্কে জানতে পারে৷ কিন্তু আত্মজ্ঞান যে সাক্ষাৎ ও
অপরোক্ষ যা কেবল যোগ চক্ষু এবং জ্ঞান চক্ষুতেই প্রকাশিত হয়। শ্রীমদভগবদগীতার বিশ্বরুপ দর্শনেও ভগবান অর্জুনকে দিব্যচক্ষু দিয়েছিলেন এবং
এর সাহায্যে বিশ্বের অন্তরাত্মারুপী পরমেশ্বর ভগবানকে কারণাত্মা রুপে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সেটি ভ্রান্তি নয় বরং প্রকৃত আত্মদর্শন। আমাদের চর্মচক্ষুতে প্রত্যক্ষ দর্শনে ভুলের অবকাশ থাকলেও ভগবানের দেয়া দিব্যচক্ষুতে
যে বিশ্বরুপদর্শন করেছিলেন তাতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না৷ এটিই দর্শনের পরম স্তর,
প্রকৃত আনন্দের অনুভূতি, আত্মদর্শনের উপলব্ধিই হল দর্শন শাস্ত্র।
শ্রীমদভগবদগীতার ভগবান, নিজেকে জানার কথা বিভিন্ন
স্থানে উল্লেখ করেছেন সেখান থেকে মূলভাব তুলার চেষ্টা করছি।
.....আত্মনোবাত্ননা
তুষ্টঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে (গীতা ২/৫৫)
অর্থাৎ যিনি মনোগত কামনা বর্জন করে আপনাতে তুষ্ট থাকেন
তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ বলে পরিচিত হন।
যে সমস্ত কামনা বাসনা ত্যাগ করেছে, তার জাগতিক কোন বস্তুতে সন্তোষ আসে না। এই অবস্থায় ব্যাক্তি কেবল নিজের মধ্যেই সন্তোষ খুজে পান। সন্তোষ দুইধরনের একটি অভ্যাসগত আর
অন্যটিতে স্বাভাবিক ভাবেই থাকে। অন্তরে কোন প্রকার ইচ্ছা না থাকা হলো অভ্যাসগত
কারণ ইচ্ছা দমনের জন্য সাধক প্রতিনিয়ত অভ্যাস করে যান। আর অন্যটি হল স্বয়ং এ অসন্তোষের অভাব অনুভব না হওয়া৷ জড় কামনা
কখনো সাধকের নিজের সাথে সম্পর্কিত ছিল না কিন্তু সেই বোধ উদয় না হওয়া পর্যন্ত তিনি
বশীভূত থাকেন কামনা দ্বারা। ঠিক যেমনটি ধুলোপড়া আয়নায় নিজের চেহারা দেখা যায়
না তদরুপ৷ যখন সেই বোধ উদয় হয় এবং কামনা
বাসনা থেকে নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেন তখনই তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ ভাব অনুভব করেন। স্বয়ং এ সন্তোষ্ট ব্যাক্তি বাস্তবে পরমাত্মায় স্থিত হন। কামনার লেশ বিন্দু থাকা অবস্থায় তাকে সাধকই বলা হয়, যখন তিনি এর উর্ধ্বে চলে
যান তখনই সিদ্ধ হন। এই কামনাই হলো পরমাত্মা প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধক৷
.....আত্মন্যেব চ সন্তুষ্ট কার্যং ন বিদ্যতে।। (গীতা ৩/১৭)
অর্থাৎ যে ব্যাক্তি নিজেতেই সন্তোষ্ট তার নিজের
জন্য কোন কর্তব্য থাকে না৷ প্রকৃত পক্ষে ভোগে কখনো সুখ আসে না। মিষ্ঠান্ন যতই সুস্বাদু হউক তা গ্রহনের সাথে সাথে তার প্রতি তিক্ততা সৃষ্টি
হয়, কিন্তু সাধারণ মানুষ তাকে তৃপ্তি বলে ভুল করেন। বাস্তবে তা ভোগের প্রতি
আমাদের অনিহারই প্রকাশ। সংসারে অভাব সর্বদাই বিদ্যমান থাকে তাই প্রেম-প্রীতি, সুখ এইগুলা কখনো চিরস্থায়ী হতে পারে না। কামনা উৎপন্ন হলে নিজের মধ্যে অভাব আর পরাধীন ভাব অনুভূত হয়৷ আকাঙ্খাকারী
ব্যাক্তি সর্বদা দুঃখিত থাকে। কামনা পূরণ হলে লোভ আর না হলে ক্ষোভ তৈরি হয়। তাই যে কোনো সাধন (কর্মযোগ,জ্ঞানযোগ বা
ভক্তিযোগ) দ্বারা উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলে মানুষের পক্ষে আর কিছু করা, জানা বা পাওয়ার বাকী থাকে
না, এটিই মানব জীবনের চরম উদ্দেশ্য।
যত্রোপরমতে চিত্তং
নিরুদ্ধং যোগসেবয়া
যত্র
চৈবাত্মনত্মানং পশ্যন্নত্মনি তুষ্যতি।। (গীতা ৬/২০)
অর্থাৎ যোগ্যাভ্যাস করলে যে অবস্থায় চিত্ত নিরুদ্ধ, সর্ব্ববৃত্তিশূন্য হয় এবং নিজের স্বরুপ "আমিকে" দেখে নিজেই নিজেতে পরিতুষ্ঠি লাভ করে। ধ্যানে মনকে সেই স্বরুপে স্থিত করতে হয়। ধ্যানে সংসারের সম্পর্ক থেকে বিমুখ হওয়ায় অপার সুখ ও শান্তি অনুভূত হয়, যা সাংসারিক সম্বন্ধ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। নিজের মধ্যে নিজেকে দেখার তাৎপর্য এই যে আত্মতত্ত্ব পরসংবেদ্য নয় এটি স্বসংবেদ্য। মন বা বুদ্ধি দ্বারা যা
চিন্তা করা হয় তা প্রকৃতির চিন্তা হয়ে থাকে, পরমাত্মার নয়৷ কিন্তু
পরমাত্মাকে প্রাপ্ত করতে হলে মন-বুদ্ধি-বাক্যের চিন্তা থেকে বিমুখ হতে হবে। জাগতিক বিষয় থেকে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হলেই তবে তাকে অনুভব করা যায়।
যতন্তো
যোগিনশ্চৈচিনং পশ্যন্ত্যাত্মন্যবস্থিতম
যতন্ত্যহপ্যকৃতাত্নানো
নৈনং পশ্যন্ত্যচেতস (গীতা ১৫/১১)
অর্থাৎ যত্নশীল
যোগীগণ আপনাতে অবস্থিত পরমাত্মতত্ত্বকে অনুভব করতে পারেন৷ তবে যারা অবিবেকী, চিত্ত অশুদ্ধ তারা যত্নকরলেও তা অনুভব করতে পারেন না। যাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য
পরমাত্মাকে লাভ করা তাদের মধ্যে আপনা-আপনি ভাবেই আসক্তিশূন্যতা
বা নিষ্কাম ভাব আসে৷ তাই যেসকল যোগী গন যত্নশীল ভাবে নিজের কামনা বাসনা, ভোগবৃত্তি নির্মূল করেছেন, তিনি আপনি সেই
পরমাত্মতত্ত্বকে অনুভব করেন। যতক্ষণ সাধকের মধ্যে
আমি বোধ(অহংকার) থাকে, আমি বেদ-বিদ্যান , আমি ইঞ্জিনিয়ার, আমি ডাক্তার, অমুক
তমুক ভাব থাকে, তার কখনোই জ্ঞানযোগ(বোধ), কর্মযোগের(ত্যাগ), ভক্তিযোগের ( প্রেম) কোনটাই প্রকাশ হয় না। ফলে সে পরমাত্মাতত্ত্ব সম্পর্কে বাস্তবে অজ্ঞ থাকে।
নায়মাত্মা প্রবচনেন
লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শ্রতেন।। ( কঠোপনিষদ ১/২/২৩)
এই পরমাত্মাকে প্রবচনের দ্বারা বা বুদ্ধি দ্বারা
বা অনেক শুনলেও প্রাপ্ত হওয়া যায় না।
নৈব বাচা ন মনসা প্রাপ্তুং
শক্যো ন চক্ষুষা (কঠোপনিষদ ২/৩/১২)
এই পরমতত্ত্বকে বাক্য বা মন বা চোখ
দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায় না।
সাধক সবচেয়ে বড় ভুল করেন এই জায়গায় তিনি যে রীতিতে
জগৎকে চিনেন সেই ভাবে পরমাত্মাকে জানতে চান। বাস্তবে জগৎ এবং পরমাত্মা ভিন্ন। জগৎকে ইন্দ্রিয়াদি, মন, বুদ্ধি ইত্যাদিএ সাহায্যে জানা যায় কারণ তা করণ-সাপেক্ষ। কিন্তু পরমাত্মা করণ-নিরেপেক্ষ। তাই তাকে জানার জন্য জগৎ সংসারের সাথে
সম্বন্ধ ছিন্ন করতে হয়। এই অবস্থাকে
নির্বিজ সমাধিও বলা হয়।
তমাৎমস্থং যেহনুপশ্যান্তি
ধীরান্তেষাং সুখং শ্বাশতং নেত্ররেষাম্।। (কঠোপনিষদ২/৩/১৩)
আপনাতে আত্মস্থ পরমাত্মাকে যে ব্যাক্তি নিত্যদর্শন
করেন, তিনি সদাবিরাজমান সুখ অনুভব করেন, অন্যেরা নয়৷
আত্মজ্ঞান পূর্ণতা পেলে পরমাত্মার বিভাব এই জীব ও
জড় প্রকৃতি সচিতানন্দ বিগ্রহ পরমাত্মাতে বিলীন হয়ে যায়। তাই বেদান্ত বলে,
ব্রক্ষ্মৈবেদং
সর্ববং নেহ নানাস্তি কিঞ্চন, সর্বং খলিদং ব্রক্ষ্ম।।
অর্থাৎ ব্রক্ষ্ম মূর্ত- অমূর্ত রুপে , ব্যাক্ত-অব্যাক্ত রুপে, বিজ্ঞান-অবিজ্ঞান রুপে সত - তত রুপে প্রকাশিত হন।
কৃতজ্ঞতা ও উৎসর্গ - স্বামী রামসুখদাসজী 🙏
---- রবিন দে
0 মন্তব্যসমূহ