‘‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর!"
-শেখ ফজলল করিম
জনৈক বাংলা কবির পঙতিগুলো রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত শাস্ত্রজ্ঞানের অভাবে স্বর্গ নরকের অস্তিত্ব অস্বীকার করে বসেন অনেকেই। কিছু পণ্ডিতাভিমানী ব্যক্তি কেবল ব্যুৎপত্তিগত অর্থ করেই সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন স্বর্গ নরক নামক কল্পিত স্থানের কোনো বৈদিক ভিত্তি নেই। অথঃ শ্রীভগবানের কৃপায় আমরা স্মৃতি ও শ্রুতি থেকে স্বর্গ-নরকের অস্তিত্ব অন্বেষণ করবো।
স্বর্গ নরকের অস্তিত্ব খোঁজার পূর্বে ব্রহ্মাণ্ডের গঠন জানা প্রয়োজন। চতুর্দশ ভুবনে বিভক্ত প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ডের ঊর্ধ্বে ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপোঃ, সত্যলোক এবং নিন্মে অতল, বিতল, সুতল, তলাতল, মহাতল, রসাতল ও পাতাল অবস্থিত।
“ভূর্লোকঃ কল্পিতঃ পদ্ভ্যাং ভূবর্লোকোঅস্য নাভিতঃ।
হৃদা স্বর্লোক উরসা মহর্লোকো মহাত্মনঃ।।”(ভাগবতম ২/৫/৩৮)
অনুবাদ: পৃথিবীর স্তর পর্যন্ত সমস্ত অধঃলোকে তার পদযুগলে অবস্থিত। তার ঊর্ধ্বে ভূবলোক তার নাভিদেশে অবস্থিত। তারও ঊর্ধে দেবতাদের বাসস্থান স্বর্গলোক তার হৃদয়ে অবস্থিত এবং মহান মুনি-ঋষিরা যেখানে বিরাজ করেন সেই মহলোক তার বক্ষে অবস্থিত বলে কথিত হয়েছে।
“গ্রীবায়াং জনলোকঅস্য তপোলোকঃ স্তনদ্বয়াৎ।
মূর্ধভিঃ সত্যলোকস্তু ব্রহ্মলোকঃ সনাতনঃ।।”(ভাঃ ২/৫/৩৯)
অনুবাদ: সেই বিরাট পুরুষের গ্রীবাদেশ জনলোকে অবস্থিত, স্তনদ্বয় তপোলোক এবং মস্তকে এই ব্রহ্মান্ডের সর্বোচ্চ লোক সত্যলোক অবস্থিত। তার ঊর্ধ্বে বৈকুণ্ঠ/ব্রহ্মলোক অবস্থিত তা নিত্য( সৃষ্ট জগতের অন্তর্ভক্ত নয়)।
“তৎকট্যাং চাতলং ক্লিপ্তমূরুভ্যাং বিতলং বিভোঃ।
জানুভ্যাং সুতলং শুদ্ধং জঙ্ঘাভ্যাস্তু তলাতলম্।।
মহাতলস্তু গুল্ফাভ্যাং প্রপদ্যাভ্যাং রসাতলম্।
পাতালং পাদতলত ইতি লোকময়ঃ পুমান্।।”(ভাঃ ২/৫/৪০-৪১)
অনুবাদ: ব্রহ্মাণ্ডের চতুর্দশ ভুবনের মধ্যে সাতটি অধঃলোক। সেই বিরাট পুরুষের কটিদেশে অতল, উরুদ্বয়ে বিতল, জানুদ্বয়ে সুতল, জঙ্ঘাদ্বয়ে তলাতল, গুলফদ্বয়ে মহাতল, পদদ্বয়ের অগ্রভাগে রসাতল এবং পদতলে পাতাল অবস্থিত। এইভাবে ভগবানের বিরাট রূপ সমস্ত লোকে পূর্ণ।
এখানে বৈদিক সহস্রশীর্ষ পুরুষ/ গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু নিজেকে হিরণ্যগর্ভরূপে বিভক্ত করে প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ডে প্রবেশ করেছেন।
ভাগবতের শ্লোকগুলির অনুরূপ মন্ত্র বেদেও পাওয়া যায়।
“ত্রিভিঃ পদ্ভির্দ্যামরোহৎ পাদস্যেহাভবৎ পুনঃ।
তথা ব্যক্রামদ্ বিষ্মঙশনানশনে অনু ।।
তাবন্তো অস্য মহিমানস্ততো জ্যায়াংশ্চ পুরুষঃ।
পাদোহস্য বিশ্ব ভূতানি ত্রিপাদস্যামৃতং দিবি।।”(অথর্ববেদ ১৯/১/৬/২-৩)
অনুবাদ: সে নারায়ণ পুরুষ তিন পাদে স্বর্গলোক অতিক্রম করেছেন, তার চতুর্থ পাদে ভূলোক প্রকাশ পাচ্ছে। সে পুরুষের চতুর্থ পাদ স্থাবর জঙ্গমাত্মক সকল ভূবনে এবং অমৃত পাদদ্বয় দ্যুলোকে অবস্থান করছে।
“নাভ্যা আসীদম্ভরিক্ষং শীর্ষ্ণো দ্যৌঃ সমবর্তত।
পদ্ভ্যাং ভূমির্দিশঃ শ্রোত্রাৎ তথা লোকা অকল্পয়ন্”(অথর্ববেদ ১৯/১/৭/৩)
অনুবাদ: এ যজ্ঞপুরুষের নাভি থেকে অন্তরীক্ষ, শীর্ষদেশ থেকে দ্যুলোক এবং চরণদ্বয় থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়া কিছু মন্ত্রে স্বর্গলোকে গমনের যজ্ঞপন্থা বর্ণিত আছে।
“তেভির্যাহি পথিভির্দেবযানৈরীজানাঃ স্বর্গং যন্তি লোকম্।।
ঋতস্য পন্থামনু পশ্য সাধ্বঙ্গিরমঃ সুকৃতো যেন যন্তি।
তেভির্যাহি পথিভিঃ স্বর্গ যত্রাদিত্যা মধু ভক্ষয়ন্তি তৃতীয়ে নাকে অধি বি শ্রয়স্ব।।
ত্রয়ঃ সুপর্ণা উপরস্য মায়ু নাকস্য পৃষ্ঠে অধি বিষ্টপি শ্রিতাঃ।
স্বর্গ লোকা অমৃতেন বিষ্ঠা ইষমূর্জং যজমানায় দুহ্রাম।।
জুহুর্দাধার দ্যামুপভৃদন্তরীক্ষং ধ্রুবা দাধার পৃথিবীং প্রতিষ্ঠাম্।
প্রতিমাং লোকা ঘৃতপৃষ্ঠাঃ স্বর্গাঃ কামংকামং যজমানায় দুহ্রাম।।”(অথর্ববেদ ১৮/৪/১/২-৫)
অনুবাদ: আয়ুধের মতো যজ্ঞের পাত্রগুলির নির্মাতা হে আহিতাগ্নি, তুমি দেবযানপথে যাও, যে পথে যজ্ঞকারী পুরুষরা সুখাত্মক স্বর্গ লোকেগিয়ে থাকে। অঙ্গিরা-বংশোৎপন্ন কর্মিগণ যে পথে স্বর্গলোকে গিয়েছেন, হে প্রেত, সে পথে স্বর্গে যাও। যে স্বর্গে আদিত্যগণ মধুর মতো প্রীতিকর অমৃত আস্বাদন করছেন। স্বকর্মের দ্বারা অর্জিত অগ্নি প্রভৃতির অধিষ্ঠিত সুখাত্মক স্বর্গলোকঅমৃতে পরিপূর্ণ। এ পৃথিবীর দীপ্তির উপরিভাগে সুখাত্মক স্বর্গলোক যজমানের সকল কামনা প্রদান করুক।
কোনো স্থানে স্বর্গলোক প্রাপ্তির জন্য ওদন(সিদ্ধ আতপ) আহুতি দেবার উল্লেখ পাওয়া যায়।
“ঘৃতেন গাত্রানু সর্বা বি মুডঢি কৃণ্বে পন্থাং পিতৃষু ষঃ স্বর্গঃ।।”(অথর্ববেদ ১১/১/৪/১)
অনুবাদ: ঘৃত-সংলগ্ন এ পক্ব ওদনের দ্বারা পিতৃ-পিতামহাদির অভিলাসিত স্বর্গলোকপ্রাপ্তির পথ করছি।
“প্রজানন্তঃ প্রতি গৃহ্নন্তু পূ্র্বে প্রাণমঙ্গেভ্যঃ পর্যাচরন্তম্।
দিবং গচ্ছ প্রতি তিষ্ঠা শরীরৈঃ স্বর্গং যাহি পথিভির্দৈবযানৈঃ।।”(অথর্ববেদ ২/৬/৩/৫)
অনুবাদ: যজ্ঞের উপযুক্ত তোমার মহিমা জেনে পূর্বে অন্তরীক্ষলোকে স্থিত দেবগণ তোমার শরীর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে আত্মাকে গ্রহণ করুক। তারপর তুমি দেবগণের দ্বারা পরিগৃহিত হয়ে অন্তরীক্ষে যাও এবং সেখানে দিব্য ভোগযোগ্য শরীরে প্রতিষ্ঠিত হও। পরে দেবযান পথে স্বর্গলোকে গমন কর।
উক্ত মন্ত্রসমূহে প্রেত, পিতৃপুরুষ এবং আত্মাকে স্বর্গলোকে যাওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। তাই নিঃসন্দেহে এই স্বর্গলোক পৃথিবীতে অবস্থিত নয়।
বেদে যমলোক/পাতাল(নরক) এরও উল্লেখ পাওয়া যায়।
“যদ্ রাজানো বিভজন্ত ইষ্টাপূর্তস্য ষোড়শং যমস্যামী সভাসদঃ।(অথর্ববেদ ৩/৬/৪/১)
অনুবাদ: ঐ দক্ষিণ দিকে দ্যুলোকে পরিদৃশ্যমান ধর্মরাজ যমের দুষ্টনিগ্রহ ও শিষ্টপালনকর্মে নিযুক্ত সভাসদগণ ইষ্টাপূর্ত কর্মের ষোড়শকলা পাপ পরিশোধন করেন।
“অসৌ যো অধরাদ্ গৃহস্তত্র সন্ত্বরায্যঃ।
তত্র সেদির্ন্যচ্যুতু সর্বাশ্চ যাতুধান্যঃ”(অথর্ববেদ ২/৩/৪/৩)
অনুবাদ: এ লোকের নিন্মে যে পাতাললোক আছে বিঘ্নকারিণী পিশাচীগণ সেখানে যাক এবং বাস করুক।
শ্রীমদ্ভাগবতমে মহর্ষী ব্যাস পাতাললোকে স্থিত ২৮টি নরকের বর্ণনা করেছেন।
“দক্ষিণ দিকে ত্রিলোকের অন্তরালে অবস্থিত নরকে পিতৃরাজ যম ভগবানের আজ্ঞানুসারে মৃত্যুর পর তাঁর দূতদের দ্বারা আনীত প্রাণীদের পাপকর্ম অনুসারে যথাযথভাবে বিচার করে দণ্ডদান করেন। ”(ভাগবত ৫/২৬/৫-৬)
“তামিস্রোঅন্ধতামিস্রো রৌরবো মহারৌরবঃ কুম্ভীপাকঃ কালসূত্রমসিপত্রবনং সূকরমুখমন্ধকূপঃ কৃমিভোজনঃ সন্দংশস্তপ্তসূর্মির্বজ্রকণ্টকশাল্মলী বৈতরণী পূয়োদঃ প্রাণরোধো বিশসনং লালাভক্ষঃ সারমেয়াদনমবীচিরয়ঃপানমিতি।
কিঞ্চ ক্ষারকর্দমো রক্ষোগণভোজনঃ শূলপ্রোতা দন্দশূকোঅবটনিরোধনঃ পর্যাবর্তনঃ সূচীমুখমিত্যষ্টাবিংশতির্নরকাঅবিবিধ যাতনাভূময়ঃ।।”(ভাগবত ৫/২৬/৭)
অনুবাদ: তামিস্র, অন্ধতামিস্র, রৌরব, মহারৌরব, কুম্ভীপাক, কালসূত্র, অসিপত্রবন, সূকরমুখ, অন্ধকূপ, কৃমিভোজন, সন্দংশ, তপ্তসূর্মি, বজ্রকণ্টক-শাল্মলী, বৈতরণী, পূয়োদ, প্রাণরোধ, বিশসন, লালাভক্ষ, সারমেয়াদন, অবীচি, অয়ঃপান, ক্ষারকর্দম, রক্ষোগণ-ভোজন, শূলপ্রোত, দন্দশূক, অবটনিরোধন পর্যাবর্তন এবং সূচীমুখ এই আটাশটি নরক জীবের দণ্ডভোগের স্থান।
কঠোপনিষদে যম-নচিকেতা সংবাদে স্বর্গলোকের উল্লেখ পাওয়া যায়।
“স ত্বমগ্নিং স্বর্গ্যমধ্যেষি মৃত্যো প্রব্রুহি ত্বং শ্রদ্দধানায় মহ্যম্।
স্বর্গলোকা অমৃতত্বং ভজন্ত এতদ্ দ্বিতীয়েন বৃণে বরেন।।”(কঠোপনিষদ ১/১/১৩)
অনুবাদ:নচিকেতা বললেন-হে মৃত্যু, যে অগ্নির চয়নদ্বারা লোক স্বর্গে গমন করে, সেই অগ্নির বিষয়ে আপনি সম্যক অবগত আছেন। শ্রদ্ধাবান, যাঁহারা মৃত্যুর পর স্বর্গলোকে গমন করেন তাঁহাদের অমৃতত্ব লাভ হয়, এইকারণে স্বর্গলাভের অভিলাষী হইয়া আমি দ্বিতীয় বরে স্বর্গলাভের সাধনভূত অগ্নিবিদ্যা প্রার্থনা করিতেছি।
এইস্থলেও মৃত্যুর পর স্বর্গলোকে গমনের কথা বলা হয়েছে।
এছাড়াও কেন উপনিষদের ৪/৯ মন্ত্রে বলা হয়েছে,
"যো বা এতমেবং বেদাপহত্য পাপ্মানমনন্তে স্বর্গে লোকে জ্যেয়ে প্রতিতিষ্ঠতি প্রতিতিষ্ঠতি।।"
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি যথোক্ত ব্রহ্মবিদ্যা এই প্রকারে অবগত হন তিনি সর্বপ্রকার পাপ হইতে মুক্ত হইয়া অনন্ত, সর্বশ্রেষ্ঠ স্বর্গলোকে প্রতিষ্ঠিত হন।
এছাড়া শ্রীমদ্ভগবদগীতায়ও স্বর্গলোকের উল্লেখ রয়েছে।
“অনার্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুন৷”(২/২)
অনুবাদ: এই ধরনের অনার্যজনিত মনোভাব তোমাকে স্বর্গলোকে উন্নীত করবেনা, পক্ষান্তরে তোমার সমস্ত যশরাশি নষ্ট করবে।
“হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্৷”(২/৩৭)
অর্থ: এই যুদ্ধে নিহত হলে তুমি স্বর্গলাভ করবে আর জয়ী হলে রাজ্যসুখ ভোগ করবে।
তে তং ভুক্ত্বা স্বর্গলোকং বিশালং ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্যলোকং বিশন্তি৷”(৯/২১)
অর্থ: তারা সেই বিপুল স্বর্গলোক উপভোগ করে পুণ্য ক্ষয় হলে আবার মর্ত্যলোকে ফিরে আসেন।
অর্জুন যুদ্ধে নিহত হলে স্বর্গলাভ করবে বলেছেন শ্রীভগবান। তাই নিঃসন্দেহে এই স্বর্গলোক পৃথিবীতে অবস্থিত নয়। তাছাড়া যেহেতু স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যলোকে(পৃথিবী) অধঃপতনের উল্লেখ পাওয়া যায় তাই মোক্ষপ্রাপ্তি এবং স্বর্গপ্রাপ্তি এক নয়।
পৃথিবীর সাময়িক সুখ-দুঃখকে স্বর্গসুখ এবং নরকযন্ত্রণার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় স্বর্গ-নরক অস্তিত্বহীন।
“মনে মনে কলা খাওয়া”- প্রবাদের অর্থ এই নয় যে বাস্তবে কলার অস্তিত্ব নেই। স্বর্গ-নরকের অস্তিত্ব শ্রুতি এবং স্মৃতিসিদ্ধঃ।
©বৃন্ত
0 মন্তব্যসমূহ