স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে অপপ্রচারের জবাব- ১

 

স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে অপপ্রচারের জবাব

স্বামী বিবেকানন্দ একজন যুগপুরুষ ও সনাতন সমাজের একজন ক্রান্তিকালীন কান্ডারী। শিকাগোর সেই ধর্মীয় মহাসম্মেলনে সনাতন ধর্মকে বিশ্বসভায় তুলে ধরেন গৌরবের সাথে। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন সংসারের কল্যাণে।
সম্প্রতি কিছু স্বার্থান্বেষী মহল স্বামীজিকে ব্যবহার করে তাঁদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য প্রচার করে চলেছে স্বামীজি নাকি তাঁর শেষ জীবনে প্রচন্ড সাকারবাদ বিরোধী হয়ে উঠেন এবং তিনি মূর্তি পূজার বিরোধ্যে গিয়ে মূর্তি ভেঙে ফেলতে বলেছেন। প্রমাণ হিসেবে ভগিনী মেরিকে লিখা একটা চিঠির খন্ডিত স্ক্রিনশট প্রচার করতেছেন।
প্রথমে সে চিঠির বক্তব্য খন্ডন করে স্বামীজি বানী ও রচনাসমগ্র বই থেকেই সাকারবাদের পেছনে স্বামীজির দেওয়া অকাট্য যুক্তিগুলোও দেওয়া হবে।।
স্বামী বিবেকানন্দকে লিখা ভগিনী মেরির চিঠির প্রতিত্তোরে স্বামীজিও একটা চিঠি লিখেন যেটা স্বামী বিবেকানন্দের বানী ও রচনাবলি বইয়ে ৩৪১ নাম্বার চিঠিতে দেওয়া আছে।।
৩৬৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন "আর নিখিল আত্মার সমষ্টিরূপে যে ভগবান বিদ্যমান এবং একমাত্র যে ভগবানে আমি বিশ্বাসী, সেই ভগবানের পূজার (পূজা!) জন্য যেন আমি বার বার জন্মগ্রহণ করি এবং সহস্র যন্ত্রণা ভোগ করি (এই যন্ত্রণা যারা তাকে জাতিচ্যুত করতে চেয়েছিল)।"
তিনি এই চিঠিতে আরও লিখেছে, "প্রিয় মেরি আমার মুখ থেকে যাই বের হোক না কেন, কিছুতেই ভয় পেও না। কারণ যে শক্তি আমার পশ্চাতে কাজ করছে তা বিবেকানন্দ নয়, স্বয়ং প্রভু (বেদান্তের আত্মদর্শন)।
তাঁকে জাতিচ্যুত করতে চাওয়া সেই সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে তিনি সেই চিঠিতে লিখেছেন "আমাকে যদি জাতিচ্যুত করতে হয় তাহলে ভারতের অর্ধেক রাজন্যবর্গ ও সমুদোয় শিক্ষিত লোকের সঙ্গে আমাকে জাতিচ্যুত করতে হবে। তা তো হয়ই নি বরং আমি সন্ন্যাস নেবার পূর্বে আমার যে জাতি (যারা তাকে এখন জাতিচ্যুত করতে চায়) ছিল, সেই জাতিভুক্ত এক প্রধান রাজা আমাকে সম্মানপ্রদর্শনের জন্য একটি সামাজিক ভোজের আয়োজন করেছিলেন, তাতে ঐ জাতির বড় বড় ব্যক্তি যোগ দেন। প্রিয় মেরী, শত শত রাজার বংশধরেরা এই পা ধুইয়ে মুছিয়া পূজো করেছে ভারতে এরকমটি আরও কারও হয়নি"
চিঠিটা আসলে মেরীকে আশ্বস্ত করে স্বামীজি জাতিচ্যুত করা সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে লিখা।
আরেকটু গভীরে গিয়ে চিঠিটা বিশ্লেষণ করি।
মূল অপপ্রচারটা হচ্ছে যে স্বামীজি নাকি সব মূর্তি ভেংগে ফেলতে বলেছেন এবং তিনি সাকারবাদের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন সেই চিঠিতে।
স্বামীজি যখন আমেরিকার শিকাগোর বিশ্বধর্ম সম্মেলনে হিন্দু ধর্মকে বিশ্বব্যাপী প্রচারের জন্য যায়,তখন এই ভারত অঞ্চলে ছিল ধর্মের নামে ব্যাপক গোড়ামি আর কুসংস্কার। স্বামীজিকে ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে অনেক অহিন্দুদের সাথে উঠা বসা করতে হয়েছিল, আর সেটাই নাকি ছিল স্বামীজির মহা অপরাধ, এটা ছিল তৎকালীন হিন্দু ধর্মের নামে কুৎসা রটনা কারী সমাজপতি দের দাবী। তারা স্বামীজিকে সমাজচ্যুত করতে চেয়েছিলেন,স্বামীজিকে স্লেছ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন৷ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে স্বামীজিকে যারা সমাজচ্যুত করতে চেয়েছিলেন তারা মুখে ধর্মের কথা বললেও আদতে ছিল ধর্মব্যবসায়ী তারা জাতিভেদ ও বর্ণভেদ নিয়েই সর্বদা সরব থাকতেন। তারা কোন দরিদ্র মানুষের পাশে দাড়াতেন না, কারও বিপদে এগিয়ে আসতেন না, বিপরীতে তাদেরকে পীড়ন করত তাই এসব বিষয়ে স্বামীজি জানতে পেরে মনের কষ্টে আর ক্ষোভে এসব কথা গুলো বলেছেন। তিনি ধর্মের নামে ভন্ডামি সহ্য করতেন না তাই তিনি বলেছিলেন দরিদ্র মানুষের জন্য যার মন কাঁদে না, সে কীসের মানুষ? দরিদ্র জনসাধারণই স্বামীজির কাছে সাক্ষাৎ নারায়ণ ছিল। জীবন্ত নারায়ণ এর সেবা না করে কেবল ব্যাক্তিস্বার্থে ধর্মীয় আচার পালন মিথ্যাচার, যেখানে মানুষ বঞ্চিত, অবহেলিত, নির্যাতিত, খেতে পায় না, সেখানে ঈশ্বরের পূজার নামে ভন্ডামি তিনি সহ্য করতে পারে নি৷ তাই তিনি আগে মানুষ রূপী নারায়ণের পূজা করতে বলতেন,
নরের মধ্যেই নারায়ণ কল্পনা করে তাঁর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছিল সেই অমর বানী,
"জীবে প্রেম করে যেইজন,সেইজন সেবিছে ঈশ্বর"
স্বামীজি ধর্মের নামে ভন্ডামি দেখে রাগে,ক্ষোভে,আর কষ্টে বলেছিলেন,,,,ভেংগে ফেল সব মূর্তি,,যেখানে দরিদ্র নারায়ণই সেবা পায় না,,তার মানে এটা নয় যে স্বামীজি আধ্যাত্মিক ভাবেই মূর্তি ভাংতে বলেছেন,,,
রেফারেন্স: (বাণী ও রচনা সমগ্র;খন্ড ৭,পেজ ৩৬১;চিঠি নং ৩৪১)

★ স্বামীজি সাকারবাদ বিরোধী ছিলেন?

"যে - কোন বস্তুর ভিতর ঈশ্বর দর্শন করিয়া তাঁহাকে উপাসনা করিতে পারেন। মূর্তি ভুলিয়া সেখানে ঈশ্বরকে দেখুন। ঈশ্বরে অন্য কিছু আরোপ করিবেন না, কিন্তু যে - কোন বস্তুতে ইচ্ছা ঈশ্বরভাব প্রবেশ করান।
যে সাকার মূর্তিটি উপাসনা করেন, তাহার মধ্যে ঈশ্বরকে সীমাবদ্ধ করিবেন না।বরং যাহা কিছু উপাসনা করেন, সেই সবকিছু ঈশ্বরভাবে পূর্ণ করিয়া দিন।"
"প্রতিমা প্রভৃতি একান্ত আবশ্যক। মনকে স্থির করিবার সময় বা কোনরুপ চিন্তা করিবার সময় দেখিবেন, আপনার স্বভাবতই মনে মনে মূর্তি গড়িবার প্রয়ােজন অনুভব করেন,
এইরপ কল্পনা না করিয়া থাকিতে পারেন না।
দুই প্রকার মানুষের রুপ-কল্পনার বা মূর্তির প্রয়ােজন হয় না -যে ধর্মের কোন ধার ধারে না; আর সিদ্ধপুরুষের, যিনি এই-সকল অবস্থার মধ্য দিয়া গিয়াছেন। আমরা এই দুই অবস্থার মধ্যে রহিয়াছি। ভিতরে ও বাহিরে আমাদের কোন-না-কোনরুপে আদর্শ বা মূর্তির প্রয়ােজন—উহা কোন পরলােকগত মানুষের হইতে পারে, অথবা কোন জীবিত নর বা নারীর হইতে পারে। ইহা ব্যক্তিত্বের উপাসনা—শরীর-কেন্দ্রিক, তবে ইহা খুব স্বাভাবিক। সূক্ষ্মকে স্থূলে পরিণত করার দিকে আমাদের ঝোঁক।
সূক্ষ্ম হইতে যদি আমরা স্থূল না হইয়া থাকি, তবে কিভাবে এখানে আসিলাম ? আমরা স্থূল ভাবপ্রাপ্ত আত্মা, এইভাবেই আমরা এই পৃথিবীতে আসিয়াছি।
সুতরাং মূর্তি ভাব যেমন আমাদিগকে এখানে আনিয়াছে, তেমনি মূর্তির সাহায্যেই আমরা ইহার বাহিরে যাইব। ইহা হােমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সদৃশবিধানের মতো—
“বিষস্য বিষমৌষধম'।"
স্বামীজির বানী ও রচনাবলি গ্রন্থের প্রশ্নোত্তর পর্বে।

★ মূর্তি পূজার দ্বারা কি মুক্তিলাভ হতে পারে?

উত্তরঃ মূর্তিপুজার দ্বারা সাক্ষাৎভাবে মুক্তি হতে পারে না তবে মূর্তি মুক্তিলাভের গৌণ কারণস্বরূপ, ঐ পথের সহায়ক। মূর্তি পূজার নিন্দা করা উচিত নয় কারণ অনেকের পক্ষে মূর্তি অদ্বৈতজ্ঞান লাভের জন্য মনকে প্রস্তুত করে দেয়, ঐ অদ্বৈতজ্ঞান লাভেই মানব মুক্ত হতে পারে।

★ ঈশ্বর অনন্ত; তিনি মানুষরূপ ধরে এতটুকু হন কি করে?

উত্তরঃ সত্য বটে ঈশ্বর অনন্ত, কিন্তু তোমরা যেভাবে অনন্ত বলতে একটা খুব প্রকান্ড জড়সত্তা মনে করে গুলিয়ে ফেলছ। ভগবান মানুষরূপ ধারণ করতে পারে না বলে তোমরা বুঝছ একটা প্রকান্ড সাকার পদার্থকে এতটুকু করতে পারা যায় না৷ কিন্তু ঈশ্বর ও-হিসাবে অনন্ত নন- তাঁর অনন্তত্ব চৈতন্যের অনন্তত্ব। সুতরাং তিনি মানবকারে আপনাকে অভিব্যক্ত করলেও তাঁর স্বরূপের কোন হানি হয় না।
যারা নির্দিষ্ট ব্যাক্তিকেন্দ্রিক মতবাদের চর্চা করেও নিরাকারবাদের জন্য গলা ফাটান তাদের উদ্দেশ্যেও স্বামীজি বলেছেন,
"ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়সমূহের পিছনে ছুটিয়াই আমরা মানুষভাবাপন্ন হইয়া পড়িয়াছি, আমরা সাকার ব্যক্তিভাবের উপাসনা করিতে বাধ্য ; ইহার বিরুদ্ধে যাহাই বলি না কেন, ব্যক্তিরূপের বা সাকারের উপর আসক্ত হইও না ---- ইহা বলা খুব সহজ বটে,
কিন্তু যে উহা বলে, সে-ই ব্যক্তিভাবের উপর অতিশয় আসক্ত, বিশেষ বিশেষ নরনারীর উপর তাহার তীব্র আসক্তি --- মরিয়া গেলেও তাহাদের প্রতি তাহার আসক্তি যায় না, সুতরাং মৃত্যুর পরেও সে তাহাদের অনুসরণ করিতে চায়। ইহাই পুতুলপূজা।"
মন্তব্যঃ সনাতন দর্শন বিশাল থেকে বিশালতর। যুগে যুগে বহু যুগপুরুষের আবির্ভাব হয়েছে যারা সংসারের কল্যাণের জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। আমরা যেন কেবল নিজেদের মতবাদকে শ্রেষ্ঠ প্রমান করার জন্য এইসকল যুগপুরুষদের নিয়ে বিভ্রান্তি না ছড়াই। আমরা যেন মতবাদের পথে না হেটে ধর্মের পথে হাটি এবং জ্ঞানীদের দেখানো পথ অনুসরণ করি।
মনে রাখতে হবে বেদের সেই অসাধারণ নির্দেশনা।
"তন্তুর বুননে যেমন বুনটের বিস্তার হয় ঠিক তেমনি আলোর পথে চলে কর্মের বিস্তার কর,হৃদয় অন্তরীক্ষে জ্যোতির প্রকাশক পরমাত্মার পথ অনুসরন কর, বিবেক দিয়ে কাজ কর, জ্ঞানীদের প্রদর্শিত চেতনাকে রক্ষা কর, মানুষ হও এবং অন্যকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোল।"
- ঋগবেদ (১০/৫৩/৬)

©স্টিমন অনিক।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ